আমি যখন ‘ভূত-লেখক’
ভূতের গল্পের লেখক-অনুবাদক হিসেবে অনেকেই আমাকে চেনেন, জানেন। কিন্তু 'ভূত-লেখক' হিসেবে আমার পরিচয় সিংহভাগের অজানা। 'ভূত-লেখক' মানে 'গোস্টরাইটার', যে শব্দটি নিয়ে গত ২-৩ বছর ধরে আমাদের দেশে মহা শোরগোল চলছে।
গোস্ট রাইটার কনসেপ্টটির জন্ম পশ্চিমা দেশে, যার বাংলা ছায়া লেখক বললেও মানায়। অর্থাৎ যিনি কিনা খ্যাতনামা কিংবা অখ্যাত কোনো লেখকের হয়ে গল্প-উপন্যাস-প্রবন্ধ -নাটক কিংবা লেখালেখি-সংক্রান্ত অন্য কিছু পয়সার বিনিময়ে রচনা করে দেন এবং রচনাকারী হিসেবে অর্থদানকারীর নামটিই প্রকাশিত হয়; যিনি পয়সার বিনিময়ে লিখছেন, তিনি স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় পাদপ্রদীপের আড়ালে তথা অন্ধকারেই থেকে যান।
পশ্চিমা বিশ্বে গোস্টরাইটারদের দারুণ কদর। তাঁরা বিখ্যাত লেখকদের নামে বই লিখে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার কামাই করেন। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্টদের অনেকের আত্মজীবনীমূলক লেখার নেপথ্য নায়কই নাকি এই ভূত-লেখকগণ! আমাদের দেশের ভূত-লেখকদের কেউ কেউ নিজের নামটি বিক্রি করে দিয়ে লাখ লাখ টাকা কামাই করেছেন বটে, তবে পরবর্তীতে তাঁদের মধ্যে অনুশোচনাও হয়েছে কেন অত ভালো ভালো লেখা অমুকের নামে লিখতে গেলেন! অমুকে শুধু পয়সা দিয়েই খালাস। এখন ওপরেরটা খাচ্ছে, তলারটাও কুড়োচ্ছে!
এ রকম আফসোস যাদের জাগে কিংবা অনুশোচনায় ভোগেন, তাঁদের আসলে গোস্ট রাইটিংয়ের দিকে যাওয়াই উচিত নয়। কারণ, আমার জানামতে গোস্ট রাইটিংয়ে রয়্যালটির ব্যাপারটি থাকে না, এটি এককালীন পেমেন্টের বিষয় (তবে যুক্তরাজ্য এবং ভারতে নাকি গোস্টরাইটাররা রয়ালটি পেয়ে থাকেন, সেটা মৌখিক চুক্তি হলেও)। অন্যদের কথা জানি না, তবে একজন গোস্টরাইটার হিসেবে আমি কখনো রয়্যালটি দাবি করতে যাইনি। আমার লেখা বেশ কিছু বই অন্য লেখকের নামে ছাপা হয়েছে, বইগুলো চলেছেও দারুণ। কিন্তু রয়্যালটি নিয়ে কখনো মাথা ঘামাইনি। তাঁদের সঙ্গে আমার মৌখিক চুক্তি ছিল এককালীন একটা টাকা তাঁরা আমাকে দেবেন। ব্যস, মামলা ডিসমিস।
ভূত-লেখক হিসেবে আমার যাত্রা সম্ভবত ১৯৯২-৯৩ সালের দিকে। সেবা প্রকাশনীর একজন লেখককে রহস্য পত্রিকার সহকারী সম্পাদক, প্রয়াত লেখক শেখ আবদুল হাকিম 'রিডার্স ডাইজেস্ট' থেকে স্বাস্থ্যবিষয়ক একটি ফিচার অনুবাদ করতে দিয়েছিলেন। তেমন কঠিন বিষয় নয়। কিন্তু ওই লেখক বোধ করি কোনো ঝুঁকি নিতে চাননি। তাই লেখাটি আমাকে দিয়ে অনুবাদ করিয়ে নিজের নামে রহস্য পত্রিকায় ছেপে দিয়েছিলেন। এ জন্য তিনি আমাকে যৎসামান্য সম্মানীও দিয়েছিলেন। না, টাকার জন্য অবশ্যই আমি সেদিন ওই কাজটি করিনি, করেছিলাম ওই লেখকের সঙ্গে আমার সুসম্পর্কের কারণে। পরবর্তীতে আমি তাঁর দুটি হরর বইও লিখে দিয়েছিলাম ২০০১ বা ২০০২-এর দিকে।
গোস্টরাইটার হিসেবে আমি প্রথম বইটি লিখেছিলাম সেবা প্রকাশনীর তুমুল জনপ্রিয় এক লেখকের জন্য। এ লেখকটির বই পড়ে আমি বড় হয়েছি। ওই সময় তিনি দুই হাতে প্রচুর লিখেও কুলিয়ে উঠতে পারছিলেন না। তাই একদিন তাঁর বাসায় আমাকে আমন্ত্রণ করে, আপ্যায়ন শেষে আমার হাতে দুটি ইংরেজি বই গুঁজে দিয়ে, আমাকে ভীষণ চমকিত করে বলেছিলেন, 'অনীশ, আপনি এই বই দুটি বাসায় নিয়ে যান। আমি চাই, বই দুটি আপনি আমাকে অনুবাদ করে দেবেন। তারপর আমি আমার মতো করে অ্যাডাপ্ট করব।'
যে মানুষটির লেখায় আমি কৈশোরকাল থেকে মন্ত্রমুগ্ধ, সেই লেখক যখন আমাকে তাঁর ভূত-লেখক হওয়ার অনুরোধ করেন, সেটি কি প্রত্যাখান করা যায়?
বইগুলো তেমন বৃহদায়তন ছিল না। একেকটি ১৩-১৪ ফর্মা হবে। আমি বেশ দ্রুতই তাঁকে বই দুটি লিখে জমা দিয়েছিলাম। তিনি আমাকে অ্যাডভান্স হিসেবে হাফ পেমেন্ট করেছিলেন, বাকিটা পাণ্ডুলিপি পাবার পরে দিয়েছিলেন। সেই বইয়ের একটি সেবা থেকে বেরিয়েছে, আরেকটি প্রকাশিত হয়েছিল বাংলাবাজার থেকে। দুটোই সুপারহিট। তবে বিখ্যাত এ লেখকটির সঙ্গে পরবর্তীতে ভূত-লেখক হিসেবে আমার কাজ করা হয়নি নানান কারণে।
গোস্টরাইটার হিসেবে এ পর্যন্ত আমি গোটা ১৫টি বই লিখেছি। প্রতিটি বই-ই পেয়েছে প্রত্যাশিত জনপ্রিয়তা। আমি যেমন দেশের খুব বিখ্যাত লেখকদের নামে বই লিখে দিয়েছি, পাঠকদের কাছে অচেনা-অজানা-নবীন লেখকদের নামেও লিখেছি বই। গোস্টরাইটার হিসেবে আমার ভালো লেগেছে, যখন দেখেছি আমার লেখা বই পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে, একজন নবীন লেখক পরিচিতি পাচ্ছেন লেখালেখির জগতে। তবে ঈর্ষাপরায়ণ কেউ কেউ আবার আমার এ প্রচেষ্টা বাঁকা চোখে দেখে ফেসবুকে এ নিয়ে কটাক্ষ করতেও ছাড়েনি। তাতে আমার বয়েই গেছে। (একবার আমি গোস্টরাইটার হিসেবে ছোট্ট একটি স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম ফেসবুকে। সেই লেখা পড়ে কারও কারও গাত্রদাহ হয়েছিল কি না!)
তবে একজন ভূত-লেখকের প্যারাও কিন্তু কম নয়। ভূত-লেখক হিসেবে কাজ করতে গিয়ে এ ঝামেলার ভেতর দিয়ে একাধিকবার যেতে হয়েছে আমাকে। একবার আমেরিকাপ্রবাসী এক ভদ্রমহিলা ইংরেজিতে লেখা তাঁর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ আমাকে দিয়ে অনুবাদ করাবেন ঠিক করলেন। তিনি এ জন্য আমাকে ছয় অঙ্কের পারিশ্রমিক দিতেও রাজি হলেন। মৌখিক চুক্তি মোতাবেক অর্ধেক পারিশ্রমিক আমাকে আগেই পাঠিয়ে দিলেন ঢাকার কলাবাগানে তাঁর এক আত্মীয়ের মারফত। আমি তাঁর বায়োগ্রাফির প্রথম তিনটে অধ্যায় অনুবাদ করে মেইলে পাঠালাম। তিনি আমার অনুবাদ পড়ে মহাখুশি। 'অসাধারণ হয়েছে!' ফিরতি মেইলে জানালেন লেখিকা। 'প্লিজ, ক্যারি অন!'
ভদ্রমহিলার সঙ্গে আগেই কথা হয়েছিল স্ক্রিপ্ট যেদিন কমপ্লিট করে দেব, সেদিনই তিনি বাকি টাকা পরিশোধ করবেন। অত্যন্ত সজ্জন তিনি। লেখা শেষ করার আগেই পুরোটা দিয়ে দিলেন। কিন্তু যন্ত্রণা শুরু হলো লেখা শেষ করার পরে। তিনি তাঁর ইংরেজি বইটির প্রায় প্রতিটি অধ্যায়ে নতুন নতুন প্যারাগ্রাফ যুক্ত করে পাঠাতে লাগলেন এবং সেগুলো আমাকে আবার অনুবাদ করে দিতে বললেন।
আমি তাঁর নিত্য নতুন প্যারাগ্রাফের প্যারায় নাজেহাল হয়ে যাচ্ছিলাম। ভদ্রমহিলা আমাকে তাঁর ছোট ভাইয়ের মতো দেখেন দাবি করায় চক্ষুলজ্জায় কিছু বলতেও পারছিলাম না। যে বইয়ের কাজ শেষ হওয়ার কথা দেড় মাসে, তার সমাপ্তি ঘটল সাড়ে তিন মাসে। শেষের দিকে আমি এতটাই বিধ্বস্ত বোধ করি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আর কোনো দিন কারও জীবদ্দশায় আত্মজীবনী অনুবাদে যাব না।
আরেকবার কাতারপ্রবাসী একজন বাঙালী, তিনি মার্কিন সেনাবাহিনীর কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করতেন, আমাকে দিয়ে তাঁর একটি বই সম্পাদনা করানোর পরে সিদ্ধান্ত নিলেন নিজের খুব পছন্দের একটি থ্রিলার অনুবাদ বের করবেন। তবে কাজটি আমাকে করে দিতে হবে। অর্থাৎ ভূত-লেখকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে আমাকে। আমি বাংলাবাজারে থ্রিলার অনুবাদে যে রকম পারিশ্রমিক নিয়ে থাকি, তার তিন গুণেরও বেশি আমাকে দিতে রাজি হলেন। তবে শর্ত বেঁধে দিলেন, নির্দিষ্ট তারিখের মধ্যে অবশ্যই পাণ্ডুুলিপি তাঁকে পাঠিয়ে দিতে হবে, নইলে তাঁর নাকি বইটি প্রকাশনায় অনেক দেরি হয়ে যাবে। আমি রাজি হয়ে গেলাম। কারণ, নিজের দ্রুতগতির ওপর বিশ্বাস ছিল নির্ধারিত তারিখের আগেই শেষ করে দিতে পারব কাজ। তা ছাড়া দু-এক দিন দেরি হলে এমন কিইবা মহাভারত অশুদ্ধ হবে? আমি বিম্মৃত হয়েছিলাম ইনি আর্মি ম্যান, যিনি প্রতিটি কাজ সময় ধরে এবং রুটিন মেপে করেন!
কে জানত কমান্ডার সাহেবের কাজটি করতে গিয়ে আমি অসুস্থ হয়ে পড়ব! আমার ফ্লু হয়েছিল ফলে থ্রিলার অনুবাদের কাজটি কয়েক দিন পিছিয়ে যায়। বলাই বাহুল্য নির্দিষ্ট তারিখে আমার পক্ষে পাণ্ডুলিপি জমা দেওয়া সম্ভব হয়নি। এ দেরিটা তিনি মেনে নিতে পারেননি। আমার ওপর বেশ ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। আমি অসুস্থতার কথা বলে আত্মপক্ষ সমর্থন করতে গেলে তিনি বলেছিলেন, 'তোমাকে বারবার বলেছিলাম এক মাসের জায়গায় দরকার হলে দেড় মাস সময় নাও। কিন্তু যখন লেখা দেবে বলবে, কমিটমেন্ট রক্ষা করতেই হবে, কোনো অজুহাত আমি শুনব না।'
যা হোক, এ ঘটনায় আমার একটা শিক্ষা হয়েছে, তারপর থেকে আমি হাতে পর্যাপ্ত সময় রেখে কাজে হাত দিয়েছি। আর হ্যাঁ, আমার অনুবাদ করা ওই বইটি বের হয়েছিল এবং সুস্বাদু অনুবাদের জন্য কমান্ডার সাহেব অনেক প্রশংসিত হয়েছিলেন।
গোস্টরাইটার হিসেবে দেশের এবং দেশের বাইরের লেখকদের যেসব বই আমি অর্থের বিনিময়ে লিখে দিয়েছি, সেগুলো করেছিলাম দুটি কারণে। প্রথম কারণটি অবশ্যই অর্থনৈতিক। দ্বিতীয়টি হলো, পরখ করতে চেয়েছিলাম গোস্ট রাইটার হিসেবে আমার সাফল্য। গোস্টরাইটার হিসেবে আমি যখন যা লিখেছি, অত্যন্ত যত্ন নিয়েই কাজগুলো করেছি। আমি সব সময় চেয়েছি যাঁরা আমার নামটির ওপর নির্ভর করছেন, তাঁদের যেন হতাশ হতে না হয়। না, তেমনটি আজতক ঘটেনি। গোস্টরাইটার হিসেবে লেখা আমার বইগুলো প্রত্যাশিত সাফল্য অর্জন করেছে।
গোস্ট রাইটিং আমার পেশা কিংবা নেশা কোনোটিই নয়। কাজটি আমি উপভোগ করি বলেই লিখি। আমি জানি আমার বই জনপ্রিয়তা পেলে পুরো শাঁসটাই খেয়ে নেবেন সেই লেখক, যাঁর নামে প্রকাশিত হয়েছে আমার লেখা। জানা আছে, ওই বই থেকে ভবিষ্যতে কোনো রয়্যালটিও পাব না। যেমন জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আমি একটি বই একজন প্রকাশকের নামে অনুবাদ করে দিয়েছি। বইটির তৃতীয় মুদ্রণ ছাপাখানায় চলে গেছে প্রকাশের দেড়-দুই বছরের মাথায়। যাঁর নামে বইটি বেরিয়েছে, তিনি অনুবাদক হিসেবে বেশ বাহবা কুড়োচ্ছেন। আমার কিন্তু তাতে একটুও ঈর্ষা হয়নি। বরং গর্ব বোধই করেছি আমার লেখা বই একজন প্রকাশককে সফল অনুবাদক হিসেবে পাঠকসমাজে পরিচিত করে তুলেছে ভেবে।
মোটিভেশনাল কিছু বইয়েরও গোস্ট রাইটিং করেছি আমি। বেশ পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে সেসব বই। নবীন অনুবাদকদের নামে উপযুক্ত অর্থের বিনিময়ে অনুবাদ করে দিয়েছি বিশ্বখ্যাত লেখকদের নানান ধরনের বই। যখন শুনেছি আমার লেখা ওই সব অনুবাদের সুবাদে নবীন অনুবাদকটি প্রকাশকদের কাছ থেকে আরও বই অনুবাদের প্রস্তাব পেয়েছেন, আমার কিন্তু বেশ মজাই লেগেছে। তিনি আবারও আমার দ্বারস্থ হলে বলেছি, 'এবারের বইটাও না হয় আমি অনুবাদ করে দিলাম। কিন্তু পরেরবার থেকে নিজেই চেষ্টা করুন। আমি না হয় সম্পাদনা করে দেব।'
হ্যাঁ, যাদের জন্য গোস্ট রাইটিং করেছি, তাঁরা কিন্তু পরবর্তীতে নিজেরাই আমার উৎসাহে নিজে নিজে অনুবাদ শুরু করেছেন। আমি শুধু সম্পাদনার দায়িত্বটি পালন করেছি নিষ্ঠার সঙ্গে। আশা করছি, একসময় তাঁরা নিজেরাই দক্ষ লেখক-অনুবাদক হয়ে উঠবেন, ভূত-লেখকদের আর দ্বারস্থ হতে হবে না!