কেউ কেউ গোস্টরাইটার, কেউ কেউ সহলেখক
২০২০ সালের জুন মাস। ভার্জিনিয়া অ্যান্ড্রুজের বিখ্যাত গথিক ডোলাঙ্গ্যাঙ্গার সিরিজের দশম বই 'শ্যাডোজ অব ফক্সওর্থ' প্রকাশ হওয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে রয়েছে লেখিকা আর এই সিরিজের ভক্তরা। ১৯৭৯ সালে সিরিজের প্রথম বই 'ফ্লাওয়ার্স ইন দ্য অ্যাটিক' লিখে গথিক উপন্যাস দুনিয়ায় রীতিমতো সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন ৫৬ বছর বয়সী ভার্জিনিয়া, ৪০ বছর পর তার নামের পাশে উপন্যাসের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮০টি, বিক্রি হয়েছে ১০০ মিলিয়নেরও বেশি কপি। ৩৪ বছর আগে মারা যাওয়া একজন লেখিকার জন্য এই সংখ্যা খারাপ কিছু নয়!
যদি ভার্জিনিয়া অ্যান্ড্রুজের ওয়েবসাইটে ঢোকা হয়, তবে প্রথমেই পাঠকদের সামনে যে বার্তাটি ভেসে আসে তা হচ্ছে, 'সর্বকালের অন্যতম জনপ্রিয় লেখিকা ভার্জিনিয়া অ্যান্ড্রুজ তার ফ্লাওয়ার্স ইন দ্য অ্যাটিক বই প্রকাশিত হওয়ার পরেই বেস্টসেলিং লেখিকার খাতায় নাম লিখিয়েছেন...।' কিন্তু ওয়েবসাইটের কোনো জায়গাতেই উল্লেখ করা নেই, তিনি ১৯৮৬ সালেই মারা গিয়েছেন, কফিনে ঢোকার আগে শেষ করে গিয়েছেন মাত্র ৭টি উপন্যাস। তাহলে?
এরপরের ঘটনা হচ্ছে ভার্জিনিয়ার পরিবার তার নাম বিক্রি করে ব্যবসা করার সুযোগ হাতছাড়া করতে চায়নি। ফলে অ্যান্ড্রু নিডারম্যান নামের এক লেখককে ভাড়া করা হয় এবং ভার্জিনিয়ার অসম্পূর্ণ লেখাসহ পরবর্তী ৪ দশকের যত উপন্যাস আছে সবগুলোই ভার্জিনিয়ার নামের আড়ালে লিখতে থাকেন তিনি। বিনিময়ে পেতে থাকেন বেশ মোটা অঙ্কের টাকা। তিনি নিজে উপন্যাস লিখে ততটা সাফল্য হয়তো পেতেন না, যতটা পেয়েছেন আগেই বিখ্যাত হয়ে যাওয়া লেখিকার নামের আড়ালে থেকে।
নিডারম্যানের পরিচয় অবশ্য কয়েক বছর পরেই প্রকাশ হয়ে যায় এবং প্রকাশকেরাও তার নাম প্রকাশ করতে সময় নেয় প্রায় ২৫ বছর, তারপরেও বইয়ের কোথাও নিডারম্যানের নাম এখনো দেখা যায় না। তবে কি ডোলাঙ্গ্যাঙ্গার সিরিজের ভক্তরা প্রতারিত হয়েছেন? ভার্জিনিয়া অ্যান্ড্রুজের মৃত্যুসংবাদ প্রায় প্রতিটি সংবাদপত্রেই প্রকাশিত হয়েছিল, কিন্তু ইন্টারনেট যুগের আগে হওয়ায় পাঠকেরাও ততটা খেয়াল রাখেনি এবং এখনো অনেকেই অ্যান্ড্রুজকে জীবিত বলেই মনে করে।
এর আরও একটি কারণ হলো, পাঠকেরা কে লিখছে, তা সম্পর্কে ততটা মাথা ঘামায় না। তাদের কাছে ভার্জিনিয়া অ্যান্ড্রুজ নামটি প্রায় ব্র্যান্ডের সমকক্ষ হয়ে উঠেছে। কে লিখেছে, তা বিষয় নয়, কার নামের আড়ালে ছাপা হয়েছে, তা-ই মুখ্য হয়ে দাঁড়ায় ভক্তদের কাছে। প্রকাশকেরাও এই ধোঁয়াশা ভাঙেননি তাদের ব্যবসা টিকিয়ে রাখার স্বার্থেই।
গোস্ট রাইটিং অবশ্য সাহিত্যের ইতিহাসে একেবারে নতুন কিছু নয়। দীর্ঘদিন ধরেই এই ধারা চলে আসছে, বিশেষ করে বর্তমান যুগে গোস্ট রাইটিংয়ের চাহিদা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। অভিনয়শিল্পী থেকে শুরু করে তারকা খেলোয়াড় কিংবা রাজনীতিবিদ পর্যন্ত সকলেই নিজেদের নাম ভাঙিয়ে গোস্টরাইটারদের সাহায্য নিয়ে বই প্রকাশ করেন, বিনিময়ে গোস্টরাইটাররা পান মোটা অঙ্কের টাকা। কেউ কেউ গোস্টরাইটারের নাম প্রকাশ করেন সহকারী লেখক হিসেবে, তবে বেশির ভাগের ক্ষেত্রেই দেখা যায়, তারকারা নিজেদের নামেই চালিয়ে দেন। লেখকদের পুরোদস্তুর গোস্টরাইটার হিসেবেই এককালীন মোটা অর্থ পেয়ে সন্তুষ্ট হয়ে থাকতে হয়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজের নামে প্রকাশিত হওয়া বই 'আর্ট অব দ্য ডিল' নিজে কখনো পড়ে শেষ করেছেন কি না, তা নিয়ে অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করেন, লেখা তো দূরের কথা।
এগুলোর বাইরেও গত শতাব্দীতে জনপ্রিয় হওয়া শিশু-কিশোরদের জন্য বিশেষভাবে লেখা প্রচুর সিরিজও চালু ছিল কেবল গোস্টরাইটারদের কারণেই। রমরমিয়ে ব্যবসা করা এসব সিরিজের পেছনে ছিল প্রকাশকের তুখোড় ব্যবসায়ী মনোভাব। বাংলাদেশে রাজত্ব করা তিন গোয়েন্দা সিরিজ যেসব সিরিজ থেকে রূপান্তরিত হয়েছে, যেমন: ক্যারোলিন কিনের লেখা ন্যান্সি ড্রু কিংবা ফ্রাঙ্কলিন ডব্লিউ ডিক্সনের লেখা হার্ডি বয়েজ, এসব সিরিজ প্রকাশ করতেন এডওয়ার্ড স্ট্রেটমায়ার। যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার বিভিন্ন গোস্টরাইটারদের ভাড়া করতেন তিনি এবং এসব গোস্টরাইটাররা মাত্র ১২৫ ডলারের বিনিময়ে নিজেদের সকল স্বত্ব বিক্রি করে দিত স্ট্রেটমায়ারের কাছে, সাথে নিজেদের পরিচয়ও গোপন রাখতে হতো।
গোস্টরাইটারদের আরও এক ধরন দেখা যায়, তবে একে গোস্ট রাইটিং না বলে প্যাস্টিশ লেখকই বলা শ্রেয়। এসব বইয়ে মূলত সাহিত্যের বিভিন্ন বিখ্যাত চরিত্রকে ধার নেওয়া হয়। আগাথা ক্রিস্টির এরকুল পোয়ারোঁ, কোনান ডয়েলের শার্লক হোমস কিংবা ইয়ান ফ্লেমিংয়ের জেমস বন্ডকে মূল লেখকের মৃত্যুর পরও কয়েক দশক ধরে জীবিত রেখেছেন এই প্যাস্টিশ লেখকরাই। ইয়ান ফ্লেমিংয়ের পর কিংস্লে অ্যামিন, উইলিয়াম বয়েড কিংবা অ্যান্থনি হরোউইটজের মতো লেখকেরা জেমস বন্ড লিখেছেন। হরোউইটজ অবশ্য নিজেই বর্তমান সময়ের অন্যতম জনপ্রিয় থ্রিলার লেখক, শার্লক আর ড. ওয়াটসনকেও জীবিত করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল তার কাঁধে। অন্যদিকে ক্রিস্টির বংশধররা পোয়ারোঁর গল্প চালিয়ে যাওয়ার জন্য সোফি হ্যানা নামক এক লেখিকাকে নিয়োগ দিয়েছে। থ্রিলার ও ডিটেকটিভ সিরিজের ক্ষেত্রে তাই গোস্ট রাইটিং খুবই সাধারণ ব্যাপার।
তবে গোস্ট রাইটিং নিয়ে ধাপ্পাবাজিও কম নয়। ব্রিটেনের একসময়কার চ্যাম্পিয়ন ঘোড়ার জকি ডিক ফ্রান্সিস রেসিং দুনিয়ার অপরাধ নিয়ে একের পর এক ক্রাইম থ্রিলার লিখে যেতে থাকলেন, এমনকি সমালোচকেরাও তার লেখনীর প্রশংসা করতে থাকলেন। একসময় তার উপাধিই হয়ে গেল যুক্তরাষ্ট্রের রহস্য লেখকদের গ্র্যান্ডমাস্টার হিসেবে। কিন্তু তার স্ত্রীর মৃত্যুর পর তিনি ধরা পড়ে গেলেন, নিজে রেসিং দুনিয়ার লোক হয়ে এত দিন যে রহস্য লুকিয়ে রেখেছিলেন, জানা গেল এই ক্রাইম থ্রিলারগুলোর মূল লেখক তার স্ত্রী!
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্টের ছেলে এলিয়ট রুজভেল্টও রহস্যগল্পের লেখক হিসেবে নাম কামিয়েছিলেন, যেখানে তার গল্পের প্রধান চরিত্র হিসেবে ছিলেন তার মা এলিয়ানর রুজভেল্ট স্বয়ং। তবে এলিয়টের মৃত্যুর পর অবশেষে জানা যায়, তার গল্পগুলোর মূল লেখক ছিলেন উইলিয়াম হ্যারিংটন নামক এক গোস্টরাইটার!
বিখ্যাত দুই থ্রিলার লেখক টম ক্ল্যান্সি এবং রবার্ট লুডলামও গোস্টরাইটারদের ব্যবহার করতেন। থ্রিলার-জগতের এই অন্যতম দুই সফল লেখক তাদের দুই চরিত্র জ্যাক রায়ান এবং জেসন বোর্নকে ব্যবহার করে ব্যাপক টাকা কামিয়েছেন জীবিত অবস্থাতেই, আর তাদের মৃত্যুর পরও গোস্টরাইটাররা এই দুই চরিত্রকে পরিণত করেছেন টাকা কামানোর মেশিন হিসেবে, যার প্রমাণ চলচ্চিত্রের পর্দাতেও এই দুই চরিত্রের সরব উপস্থিতি।
তবে এই গোস্টরাইটারদের ব্যবহার কতটা নৈতিক, প্রশ্ন করেন অনেকেই। অনেকের কাছে এটি পাঠকদের ঠকানো বৈ কিছু নয়। আবার অনেকে এর সাথে তুলনা দিতে গিয়ে ডেকে এনেছেন ভোগবাদিতাকে। তাদের মতে, ভোগবাদী দুনিয়ায় ভোক্তারা যেমন ব্র্যান্ড দেখেই কোনো কিছু কিনবে কি না, তা বিচার করে সাহিত্যের ক্ষেত্রেও তারা চালিত হয় এই মনোভাব দ্বারা। তাদের কাছে বইয়ের ওপরে লেখা লেখকের নামটুকুই ধ্রুব সত্য, অন্য কিছু নিয়ে তারা তাদের মাথাকে কাজে লাগাতে চায় না।