ফ্রিটাউনে এয়ারপোর্টের পথে জেটিতে
ওয়াটার ট্যাক্সির জেটিতে অন্যমনস্ক হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ওখান থেকে সৈকতের পরিষ্কার ভিউ পাওয়া যায়। দেখি, কয়েকজন জেলে দারুণ মেহনতে ঠেলছেন একটি দেশি নৌকা। আমি জেটির ব্রিজ ধরে চলে আসি নোঙর করা ওয়াটার ট্যাক্সির কাছে। ঝকঝকে মোটরবোটটি তরঙ্গের ঘাত-প্রতিঘাতে নার্ভাস হওয়া হৃৎপিণ্ডের মতো ধড়াস ধড়াস করে দোলে। কিছু দূরে দূরে নোঙর ফেলে ঢেউয়ে দোল খাচ্ছে ফ্রিটাউনের বিত্তবান নাগরিকদের শৌখিন বোটগুলো।
সিয়েরা লিওনর রাজধানী ফ্রিটাউন থেকে এয়ারপোর্টে যেতে হলে এ জেটি থেকেই বোট পাকড়ে উপসাগরের মতো সুপ্রশস্ত জলধি অতিক্রম করে পৌঁছাতে হয় বিমানবন্দরে। এ নগরীতে আজকে আমার শেষ দিন। বছর তিনেক আমি ফ্রিটাউনে বসবাস করেছি, কাজ করেছি মূলত ইবোলা রিকভারি প্রগামে। ইবোলা সংক্রমণের দুর্যোগপূর্ণ দিনগুলোতে আন্তর্জানিক রুটে বিমান চলাচল সাসপেন্ডের কারণে মাসের পর মাস দেশটি ছিল বিচ্ছিন্ন। আমরা গুটিকয়েক বিদেশ থেকে আগত এইড ওয়ার্কাররা ইবোলা-সংকটে যারা এ দেশ ছেড়ে চলে যাইনি, বোধ করি বিচ্ছিন্নতার কারণে আমাদের মধ্যে গড়ে উঠেছিল সামাজিক অন্তরঙ্গতা। আজ আমি চলে যাচ্ছি যুক্তরাষ্ট্রের দিকে। ফ্রিটাউনের বিমানবন্দরটি লুঙ্গি এয়ারপোর্ট নামে পরিচিত। এর অবস্থান উপসাগরের অন্য পাড়ে একটি পেনিনসুলায়। বিমানবন্দরে পৌঁছার সহজ উপায় হচ্ছে, এ জেটিতে এসে ওয়াটার-ট্যাক্সি নামক বোটে সওয়ার হয়ে দরিয়া পাড়ি দেয়া।
ভাসমান প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে লাউঞ্জের দিকে ফেরার পথে জেটির রেলিংয়ে এসে দাঁড়াই। ওখান থেকে পার্ক করা মোটরকারগুলোকে পরিষ্কার দেখা যায়। আমি হরেক রকমের পণ্য নিয়ে ঘোরাফেরা করা ফেরিওয়ালাদের দিকে তাকাই। বৃদ্ধ জোসেফ বার্জকে দেখি, একজন ফেরিওয়ালার সাথে কথা বলতে বলতে তার ডালায় পণ্য খুঁটিয়ে দেখছেন। মি. বার্জের বয়স পঁচাত্তর থেকে উনআশির মধ্যে। একসময় বিলাতের বাকিংহামশায়ার শহরে টাউন ক্লার্ক হিসেবে কাজ করতেন। তিনি হরহামেশা স্যুট-টাই পরে ঘোরাফেরা করতে ভালোবাসেন। আজকেও তিনি পুরোনো ঝ্যালঝ্যালে একটি পিন-স্ট্রইপ স্যুট পরে এসেছেন। হাত নাড়িয়ে ফেরিওয়ালার সাথে কথা বলছেন, তাই রোদে পুড়ে তাঁর কবজিতে ঝলমলাচ্ছে কাফলিংকসের পাথর। তিনি মারাত্মক রকমের কোনো রোগে ভুগছেন বিধায় তাঁর চলৎশক্তি সীমিত। কোমরে সার্জারি হয়েছে দুবার। বিলাতে ডাক্তাররা তাঁর হাঁটু রিপ্লেস করে দিয়েছেন। ঠিরঠিরিয়ে এক-পা, দু-পা করে হাঁটেন। আর থেকে থেকে বাঁধানো দাঁতে ঝিকমিকিয়ে হাসেন। এ ইংরেজ বৃদ্ধের সাথে আমার ঘনিষ্ঠ পরিচয় আছে। তাঁর স্ত্রী নিকোল বার্জও আমার প্রিয় মানুষদের একজন। নিকোল ফ্রিটাউনের একটি আন্তর্জাতিক এনজিওতে কান্ট্রি ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করছেন। তাঁর সংস্থা গরিবগোর্বাদের জন্য সস্তায় ঘর বানানোর ফান্ডস সরবরাহ করে থাকে। অবসর সময়ে নিকোল সেইন্ট জর্জ এতিমখানায় সেবা প্রদান করে থাকেন। স্বামী জোসেফের সঙ্গে তাঁর বয়সের ব্যবধান বিশ থেকে পঁচিশ বছরের মতো। তবে তাঁদের সম্পর্কের তীব্রতা দেখে আমি বিস্মিত হই!
ফ্রিটাউনের হিল স্টেশনে আছে ঔপনিবেশিক আমলে নির্মিত কতগুলো কাঠের ভিলা। আমি উইকএন্ডে ওগুলোর ছবি তুলতে যেতাম। আমার এ হবির কথা জানতে পেরে নিকোল তার বৃদ্ধ স্বামী জোসেফকে নিয়ে আমার সাথে ছবি ওঠানোর আয়োজনে শরিক হতেন। আমি বাড়ির বাসিন্দাদের সাথে কথাবার্তা বলে সব বন্দোবস্ত করে রাখাতাম। নিকোল জোসেফকে নিয়ে নির্দিষ্ট বাড়িটির সামনে সময়মতো হাজির হতেন। এ ডিজিটালের যুগেও জোসেফ আদ্যিকালের অলিম্পিয়া ক্যামেরায় ফিল্ম পুরে ছবি তোলা পছন্দ করেন। নিকোল বৃদ্ধের হাত ধরে, ভারসাম্য রক্ষা করে তাঁকে পুরোনো বাড়িগুলোর উঁচু সিঁড়ি দিয়ে, নানা কসরতে ঘরে ঢুকতে সাহায্য করতেন। তারপর জোসেফ ঠিরঠিরিয়ে হেঁটে গিয়ে তুলতেন কেবল দোতালায় ওঠার সিঁড়ির ফটোগ্রাফস। তিনি হালফিল নানা অ্যাঙ্গেল থেকে তোলা, হরেক রকমের কাঠের সিঁড়িতে স্কাইলাইট দিয়ে আসা আলোর প্রতিসরণকে থিম করে ফটোগ্রাফসের একটি বই কম্পোজ করছেন। গ্রন্থটি প্রকাশের জন্য তিনি পাবলিশারও খুঁজে পেয়েছেন।
আমি ওয়েটিং-লাউঞ্জে ফেরার পথে দেখতে পাই, সরু করিডোরের জানালার সামনে দাঁড়িয়ে জোসেফের স্ত্রী নিকোল। তিনি উদ্বিগ্ন চোখে আইফোনে নিউজ পড়তে পড়তে তাঁর ঠ্যারঠেরানো স্বামীর দিকে নজর রাখছেন। দাঁড়িয়ে পড়ে তাঁর সাথে একটু-আধটু কথাবার্তা বলি। আজকেই ফ্রিটাউন ছেড়ে চলে যাচ্ছি শুনে তিনি চিন্তিত হয়ে বলেন, 'জোসেফ যে তোমাকে তার অনেক বছর আগে প্রকাশিত ফটোগ্রাফসের বইটি উপহার দিতে চেয়েছিল?' নিকোলের সাথে বিয়ে হওয়ার অনেক আগে জোসেফ সাহেবের প্রথমা স্ত্রীর আমলিও একবার নাকি তিনি ছবি তোলায় মেতেছিলেন। তখন তরুণ জোসেফ ফ্রান্সের নানা পোতাশ্রয়ে তুলেছিলেন শৌখিন ইয়টগুলোর হাওয়ায় ফুলে ওঠা পালের ছবি। হরেক রকমের আকৃতি ও বর্ণের সাথে সাথে তিনি নাকি সমুদ্রজলে পালের বিচিত্র সব প্রতিবিম্বের অনেক তসবির তুলেছিলেন। এসব ফটোগ্রাফস কম্পাইল করে প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর একটি মনোজ্ঞ ছবিওয়ালা বই। জোসেফ এত দিন বইখানি খুঁজে পাচ্ছিলেন না, তাই আমাকে তা উপহার দেয়া হয়নি। সম্পত্তির উইল-বিষয়ক দলিল খুঁজতে গিয়ে গতকাল তিনি তাঁর পুরোনো ট্রাংকের তলায় পালের ছবিওয়ালা কেতাবটি খুঁজে পেয়েছেন। নিকোল সিনসিয়ারলি জানতে চান, পুস্তকখানি আমাকে পাঠানোর উপায় কী? আমি তাঁর নোটবুকে আমার ফরোয়ার্ডিং অ্যাড্রেস লিখে দিয়ে লাউঞ্জের দিকে অগ্রসর হই।
ওখানে চাকাওয়ালা সব স্যুটকেস নিয়ে প্যাসেঞ্জাররা জড়ো হচ্ছেন। টিকিট কাউন্টারের সামনে ছোটখাটো জটলা, কী যেন একটা কোন্দল বেধেছে, জনা তিনেক স্থানীয় কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ হাত ছুড়ে তর্কাতর্কি করছেন। একজন পোর্টার আমার স্যুটকেস পাহারা দিচ্ছেন, আমি তাকে হ্যালো বলে বসে পড়ি একটি চেয়ারে। তখনই জোসেফের উইলের প্রসঙ্গটি ফিরে আসে মনে। আমার সাথে ঔপনিবেশিক আমলের কোনো ভিলাতে সিঁড়ির ছবি তোলার সময় বার কয়েক তিনি উইলের কথা উল্লেখ করেছিলেন। তাঁর জীবনের মেয়াদ যে বেশি দিন নেই, এ ব্যাপারে জোসেফ সচেতন। তিনি উকিল খুঁজছিলেন, উইলটি বদলানোর জন্য। কারণ, অনেক দিন আগে করা উইলে উত্তরাধিকারী হচ্ছেন তাঁর প্রথম স্ত্রী, যিনি বহু বছর হলো বিগত হয়েছেন। সুতরাং নাম পরিবর্তন করে উইলে বর্তমান পত্নী নিকোলের নাম ঢোকানো প্রয়োজন। আন্দাজ করি, মি. যখন উইলটি খুঁজে পেয়েছেন, আশা করি ব্রিটিশ হাইকমিশনের হিল্লা ধরে ল-ইয়ার জোগাড় করা তাঁর জন্য কঠিন কিছু হবে না।
একটি অশুভ ভাবনাও আমার মনে উঁকি দেয়। আগামী দু-এক বছরের মধ্যে তাঁর মৃত্যু হওয়া অস্বাভাবিক কিছু না। জোসেফ তাঁর অন্তিম সময়ের কথা ভেবে মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন। ছবি ওঠাতে গিয়ে নিকোলের অবর্তমানে আমার সাথে এ বিষয়টি তিনি আলাপও করেছেন। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার খরচাদি নির্বাহের জন্য তাঁর যে ইনস্যুরেন্স আছে, তা মরদেহ বিলাতে পাঠানোর ব্যয় বহন করবে না। তিনি 'রিহেবিলিটেশন অব রিমেইনস' নামে ভিন্ন ধরনের আরেকটি ইনস্যুরেন্স, যা বিমানযোগে তাঁর স্বদেশে লাশ পাঠানোর ব্যয় বহন করে থাকে, তার পদ্ধতি ও প্রিমিয়াম নিয়ে আমার সাথে পরামর্শ করেছিলেন। তূলনামূলকভাবে কম বয়স্ক নিকোল কেন তাঁকে স্বামী হিসেবে নির্বাচিত করেছে, বিষয়টা আমার কাছে রহস্যময়। তবে যতটা জানি, নিকোল তার ওপর ইমোশনালি দারুণভাবে নির্ভরশীল। তিনিও ওপেনলি তাঁর ভালোবাসার প্রকাশ করেন কায়মনোবাক্যে। তাদের দাম্পত্য নিয়ে একটি ভাবনা আমাকে কৌতূহলী করে তোলে, নিকোল কি জোসেফের মৃত্যুর পরপরই ভিন্ন কোনো অল্প বয়সী পুরুষকে বিবাহের উদ্যোগ নেবে?
হইচই করে ওয়েটিং-লাউঞ্জে এসে ঢুকে নানা রকমের ড্রাম, মারিমবা ও গিটার প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্র হাতে রংচঙে জামাকাপড় পরা, পিঠে মুখোশ ঝোলানো তরুণদের কালচারাল ডেলিগেশন। তাদের সাথে আছেন মিসেস কিটি ওয়াং। এই চৈনিক নারী ফ্রিটাউনের বালানটা মিউজিক একাডেমির ডিরেক্টর। পিয়ানো বাজিয়ে এই প্রৌঢ়া ব্রিটিশ এক অ্যাকাউটেন্ট মি. ক্লাইভকে বিয়ে করে নব্বই দশকের শেষ দিকে ফ্রিটাউনে এসে সেটেল্ড হন। তারপর আর ফিরে যাননি তাঁর স্বদেশে। আমার সাথে চোখাচোখি হতেই কিটি ওয়াং কাউন্টার থেকে পুরো কালচারাল ডেলিগেশনের জন্য ওয়াটার-ট্যাক্সির টিকিট কিনতে কিনতে হাত নেড়ে যেন বলতে চান, একটু অপেক্ষা করো সুলতান, ঝামেলাটা মিটুক, তারপর এসে তোমার সাথে বাতচিত করব।
আমি আগ্রহ নিয়ে ডেলিগেশনের তরুণ-তরুণীদের দেখি। এদের মধ্যমণি হয়ে দাঁড়িয়ে সকলকে নানা রকমের নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছেন মি. মাসাক্যুই। বছর আষ্টেক আগে ইনি ছিলেন সিয়েরা লিওনের তথ্যমন্ত্রী। বর্তমানে একটি মিডিয়া হাউসের মালিক, রেডিও ও টেলিভিশন নেটওয়ার্ক পরিচালনা করেন। আক্রা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সত্তর দশকে নাটকে ডক্টরেট করা ম্যাসাক্যুইকে ফ্রিটাউনের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের প্রধান চাঁই হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। আকার-আকৃতিতে দশাসই এ পুরুষ দৈহিক উচ্চাতায় অন্য কলাকারদের চেয়ে কমসে-কম ফুটখানেক লম্বা। লাউঞ্জে জড়ো হওয়া কালচারাল ডেলিগেশনের ধুন্ধুমারের ভেতর ছড়ি হাতে ম্যাসক্যুইকে দেখায় যানবাহনের ভিড়ে ট্র্যাফিক-আইল্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশের মতো। তিনি এক হাত তুলে আমাকে ফৌজি কায়দায় স্যালুটের ভঙ্গিতে যেন বোঝাতে চান, যাক, অবশেষে তোমাকে ধরা গেল সুলতান। আমি মাথা ঝুঁকিয়ে তাঁর সম্ভাষণের জবাব দিই।
তখনই হুড়মুড় করে এসে ঢুকে কালচারাল ডেলিগেশনের আরেক অংশ, সালোন ড্যান্স ট্রুপ। এ গ্রুপের মেয়েগুলোর মুখে ফোটা ফোটা রং দিয়ে আল্পনা আঁকা। ম্যাসাক্যুই হাঁকডাক করে সকলকে একপাশে সরিয়ে দিয়ে, পুরো ড্যান্স-ট্রুপকে দেয়ালের সামনে দাঁড় করিয়ে আইপ্যাডে ফটো তোলেন।
ডেলিগেশনের কলাকারদের কার হাতে কী ধরনের বাদ্যযন্ত্র, এসব খুঁটিয়ে দেখার সময় সালোন জ্যাজের জবরদস্ত গায়িকা লায়লাতু তুরেকে শনাক্ত করি। চেহারা-সুরতে চনমনে সেক্স অ্যাপিলওয়ালি মেয়েটি হালফিল তরুণদের হৃদয়ে হার্টথ্রবের মর্যাদা পাচ্ছে। নাইট ক্লাব মাতানো পারফরমেন্সের জন্য ট্যাবলয়েডে লায়লাতু তুরেকে সন্ধ্যারাতের ললিপপও বলা হচ্ছে। সপ্তদশী এ গায়িকাকে আমি পয়লা চাক্ষুষ করি বালানটা মিউজিক একাডেমির বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানে। সে নিজের লেখা লিরিক 'রিয়েল ম্যান ডোন্ট স্লিপ উইথ আ স্কুলগার্ল' ব্লুজের কায়দায় গেয়েছিল।
অনুষ্ঠানের মাস দেড়েক আগে সিয়েরা লিওন কেবল ইবোলামুক্ত হয়েছে। মারাত্মক এ রোগের দুর্বিষহ দিনে সংক্রমণের ভয়ে দেশের স্কুল-কলেজ বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। এতে বালকদের মধ্যে ছড়ায় ড্রাগসে আসক্তি এবং প্রচুর স্কুলছাত্রী হয়ে পড়ে অনভিপ্রেতভাবে অন্তঃসত্ত্বা। পরবর্তীতে ইবোলাহীন নরমাল পরিবেশে স্কুল খুললে, কর্তৃপক্ষ প্রেগনেন্ট মেয়েদের বিদ্যালয়ে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। সালোন স্যোসাইটি বলে পরিচিত সিয়েরা লিওনের রক্ষণশীল সমাজ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এ নিষেধাজ্ঞাকে সমর্থন দেয়। সারা দেশে কোথাও এ নিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ওঠে না বটে, তবে লায়লাতু তার অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়া বান্ধবীদের সহানুভূতিতে রচনা করে বিতর্কিত এ লিরিক এবং তা বিশাল একটি অনুষ্ঠানে সাহসীভাবে গেয়ে তোড়জোড় তোলে। প্রতিবাদী এ কণ্ঠস্বরকে অ্যাপ্রিশিয়েট করে অনুষ্ঠানের গোটাকয়েক শ্রোতা, মঞ্চে গাইতে গাইতে ড্যান্সার লায়লাতুর দিকে লকেল কারেন্সি লিয়োন্স ছুড়ে দিলে আমিও জোশাক্রান্ত হয়ে ছুড়েছিলাম টাকার ছোটখাটো একটি তোড়া।
ওই অনুষ্ঠানে বাদ্যবাজনার তামাকি হলে পর বালানটা মিউজিক একাডেমির ডিরেক্টর মিসেস কিটি ওয়াংয়ের সঙ্গে সহবতের উদ্দেশ্যে গ্রিনরুমের চৌকাঠে উঠলে স্ক্রিন ঠেলে বেরিয়ে এসেছিল লায়লাতু। আমাকে ধন্যবাদ দিয়ে একটি ছোট্ট কার্ডে লিরিকটির পয়লা চরণ 'রিয়েল ম্যান ডোন্ট স্লিপ উইথ আ স্কুল গার্ল' লিখে অটোগ্রাফও দিয়েছিল। গানটিতে প্রচারিত হচ্ছে সময়ানুগ বার্তা। তাই তা সিডি আকারে প্রকাশ করার সম্ভাবনা যাচাই করেছিলাম। সদালাপী লায়লাতুর সাথে কথাবার্তা বলতে বলতে আগ্রহের সাথে নজর করেছিলাম, তার ব্যতিক্রমী ফ্যাশন সেন্স। সুতির শার্টটপের সাথে সে পরে ছিল লাল-সবুজের মিশেলে ঝলমলে একটি পুরুষালি টাই। তার দুটি পায়েও ছিল এক পাটি লাল ও এক পাটি সবুজ রঙের স্পোর্টস শু।
আজ লায়লাতুকে লাউঞ্জে প্রভোকেটিভ আউটফিটে দেখতে পেয়ে কৌতূকবোধ করি। সাদায় সোনালি গ্লেইস দেয়া হাইহিল পরে, কোমরের দোদুল্যমানতায় পুরুষদের হৃদয়ে সেনসেশন ছড়িয়ে সে হাঁটে। তার বিড বসানো টপটি নিম্ননাভির ওপরে জরির আভায় ঝলমলে হয়ে দুলছে। তার এক হাতের বাস্কেটে বেনি-কেক নামে পরিচিত মধুমাখানো সেসমি সিডের বরফি। অন্য হাতে সে এক পুরুষ প্যাসেঞ্জারের কাঁধ মৃদুভাবে সংবাহন করে দিতে দিতে অনুযোগ করে বলে, কালচারাল ডেলিগেশন আক্রাতে যাচ্ছে সালোন সংস্কৃতির ডিসপ্লে করতে। সরকার তাদের টিকিটের বন্দোবস্ত করে দিলিও কলাকার ছেলেমেয়েদের হাতে কোনো পকেটমানি ধরিয়ে দেয়নি। তো, তারা আক্রাতে দিনযাপন করবে কীভাবে?
প্যাসেঞ্জার ভদ্র সন্তানের মুখে সে একটি সুপার সুইট বানি-কেক গুঁজে দিতে চাইলে, তিনি লায়লাতুর কোমরে কড়ির বেল্টে বাঁধা পার্সে ঢুকিয়ে দেন লিয়োন্সের বান্ডিল বাঁধা কিছু নোট। ব্যাপারটি নিরিখ করে দেখতে গিয়ে লায়লাতুর সাথে আমার আই কন্টাক্ট হয়। সে তৎক্ষণাৎ লোহিত ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে প্যাসিঞ্জার ভিকটিমটিকে ত্যাগ করে আমার দিকে পুরোপুরি নজর দেয়। বলে,' অহ ম্যান, হিয়ার ইউ আর, হাইডিং বিহাইন্ড অ্যাভরি বডি, নট গেটিং দ্য অ্যাটেনশন ইউ ডিজারভর্ড।' আমি রিঅ্যাক্ট করার আগেই সে চলে আসে আমার সামনে। ন্যাপকিনে প্যাঁচিয়ে সেসমি সিডের দুখানা বরফি তুলে দিয়ে জানতে চায়, 'হ্যান্ডসাম গাই, তুমি কি ইউরোতে কনট্রিবিউট করতে চাও? নাকি তোমার পছন্দ ডলারে পেমেন্ট করা।' আমি মুখে কিছু না বলে বাতাসে তর্জনি দিয়ে ডলারের চিহ্ন আঁকি।
উৎসাহিত হয়ে কাঁধে হাত রেখে সে বলে, 'হাউ অ্যাবাউট আ টোয়েনটি ডলার বিল।' আমি তার চোখে চোখ রাখি। তো সে বাঁ চোখ কুঁচকে খুব ফেমিনিনভাবে উইনক করে বলে, 'ম্যান, ওহ ম্যান, পকেট থেকে ওয়ালেট বের করতে এত দেরি হচ্ছে কেন তোমার? ইজ টেন ডলার আ বেটার কনট্রিবিউশন ফর ইউ?' আমার মেজাজ ফ্লার্টি হয়ে ওঠে, তাই চটুলভাব এনে বলি, 'আজকে আমি ফ্রিটাউন ছেড়ে যাচ্ছি, তাই একটু জেনারাস হতে চাচ্ছি।' লায়লাতু চোখমুখে বিভ্রান্তি ফুটিয়ে জানতে চায়, 'হোয়াট ডু ইউ মিন বাই দিস?' আমি ওয়ালেট বের করতে করতে প্রস্তাব করি, 'হাউ অ্যাবাউট থার্টি ডলার? এর সাথে এয়ারপোর্টে তুমি চিলড দুটি বিয়ার কিনে খাবে, এ জন্য আমি যদি আরও পাঁচ ডলার যোগ করি, তুমি খুশি হবে না লায়লাতু?' কিছু না বলে পঁয়ত্রিশ ডলার পার্সে ঢুকিয়ে ফিক করে হেসে, মুখ বাড়িয়ে দিয়ে সে বলে, 'হাউ অ্যাবাউট আ সফট সুইট কিস?' আমি আঁতকে উঠে 'ওহ হেল নো,' বলে ঘাড় বাঁকিয়ে সরে যাই। সাদা ধুপদুরস্ত ম্যানিলা শার্ট পরে আছি। এতে লিপস্টিকের দগদগে লোহিত বর্ণের ছোঁয়া নিয়ে পরপর একাধিক বিমানবন্দর অতিক্রম করতে চাই না।
কিটি ওয়াং ও মাসাক্যুই এসে আমার কাছাকাছি বসেন। বসেই ম্যাসাক্যুই আইপ্যাডে ই-মেইলের জবাব দিতে শুরু করেন। তাঁর পকেট থেকে উঁকি দিচ্ছে সেলোফোনে মোড়া সিগার। কিটি আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসেন। তিনি কালারফুল ড্রেস পরে আছেন। পোশাকটির নেকলাইন সম্পূর্ণ স্লিভলেস হওয়ার ফলে তাঁর গ্রীবার কাছে তৈরি হয়েছে ক্রিসেন্ট মুনের সিগ্ধ আকৃতি। তিনি চায়নিজ ইংকে ক্যালিওগ্রাফ করে হাতে লেখা একটি দাওয়াতি চিঠি আমার হাতে ধরিয়ে দেন। এতে সপ্তাহ দেড়েক আগে আক্রা শহরে কালচারাল ডেলিগেশনের যাত্রা উপলক্ষে ফান্ড রাইজিং অনুষ্ঠানে যাওয়ার তারিখ ও ভোজ বাবদ পঞ্চাশ ডলারের তথ্য আছে। আমি দুঃখ প্রকাশ করে বলি, 'স্যরি, সিয়েরা লিওন ছেড়ে যাওয়ার আগে আমি যে ইবোলা রিকভারি প্রোগ্রামে কাজ করতাম, তার গোটা বিশেক প্রজেক্ট ক্লোজ আউট করতে হলো। এ নিয়ে বড্ড ব্যস্ত ছিলাম কিটি।' অজুহাতকে আমলে না এনে কিটি বলেন, 'নো প্রবলেম সুলতান,' তিনি এবার একটি বই বের করে বলেন, 'তোমাকে কিন্তু স্যুভিনির হিসেবে এটা ক্যারি করতে হবে।' কিটি সিয়েরা লিওনের জ্যাজ সংগীত নিয়ে তাঁর লেখা বইটিতে চায়নিজ ইনকওয়ালা একটি কলম দিয়ে ক্যালিওগ্রাফ করে আমার নাম লেখেন।
লিখে চলা হাতের দিকে তাকিয়ে আমি জানতে চাই, তাঁর স্বামীর খবরাদি। কী রকম আছেন ক্লাইভ? কিটি লেখা থেকে চোখ না তুলেই বলেন, 'হয়তো শুনেছ, তার চিকিৎসার জন্য আমরা বিলাতে মাস দুয়েক কাটিয়ে এসেছি, ক্লাইভ ইজ ডুয়িং অলরাইট, জানোই তো এসব সমস্যার কোনো নিরাময় নেই।' কিটি নিচু মাথায় বইয়ের পৃষ্ঠায় চায়নিজ ইনক দিয়ে সিয়েরা লিওনের একটি জ্যাজ লিরিকের কয়েকটি চরণ লিখছেন। এ সংগীতের কথা ও সুরের রচয়িতা কিটি সয়ং। এর প্রথম দুটি লাইন 'স্পেনডিং টু মাচ টাইম এলোনহর্সেস গ্যালাপ টু হার থ্রোন,' আমি এ দেশের অনেক তরুণ-তরুণীকে এ গানটি গুনগুন করে গাইতে শুনেছি। কিটির অঙ্কনরত সুগোল বাহুর দিকে তাকিয়ে এ লিরিকটির রেশ আমার করোটিতে বেজে ওঠে।
তার আবেশে আমি উদ্দীপ্ত হতে হতে ক্লাইভকে নিয়েও একটু ভাবি। তাঁর জন্ম ফ্রিটাউনে। তাঁর বাবা ঔপনিবেশিক প্রশাসনে কাজ করতেন। বালক বয়সে ক্লাইভ ক্রিকেট ক্লাব গড়ে তুলেছিলেন। সিয়েরা লিওন স্বাধীন হলে পর ক্লাইভ মা-বাবার সাথে ফিরে যান বিলাতে। বেড়ে ওঠেন ব্রিস্টলে। তারপর সওদাগরি কোম্পানিতে চাকুরি পেয়ে চলে যান হংকংয়ে। ওখানে পরিচয় থেকে প্রণয় অবধি গড়ায় কিটি ওয়াংয়ের সঙ্গে। তাঁকে বিয়ে করে ক্লাইভ কিছুদিন হংকংয়ে কাটিয়ে চীনা কনেকে নিয়ে অতঃপর ফিরে আসেন ফ্রিটাউনে। দেশটি তাঁদের এতই ভালো লাগে যে তাঁরা এ দেশে হালফিল সম্পূর্ণ সেটেল্ড, বিলাতে ফিরে যাওয়ার কোনো পরিকল্পনা নেই।
কিটি এখন লিরিকের চরণগুলোর চারপাশে পাখির মোটিফ এঁকে যাচ্ছেন। ক্লাইভের ভাবনা আমি মাথা থেকে সরাতে পারি না। বছর দেড়েক আগে তিনি অ্যাকাউটেন্টের চাকুরি থেকে আর্লি রিটায়ারমেন্ট নিয়েছেন। ফ্রিটাউনের বাইরে দরিয়ার তীরে তাঁদের কটেজ, যার আঙিনা থেকে হেঁটে চলে যাওয়া যায় সমুদ্রসৈকতে। মাঝে মাঝে কিটি ও ক্লাইভ বিচ-পার্টির আয়োজন করে থাকেন। তাতে বালানটা মিউজিক একাডেমির ছাত্রছাত্রীরা এসে পরিবেশন করে লাইভ মিউজিক। এ ধরনের একটি বিচ-পার্টিতে ক্লাইভের আউলাঝাউলা আচরণ আমার নজরে আসে। পানীয়ের পাত্র হাতে গল্পগুজব করতে করতে বলেন, ঠিক মনে করতে পারছেন না, কোন স্ট্রিটে ছোটবেলা তিনি তাঁর মা-বাবার সাথে বসবাস করতেন। এ তথ্য আমার তো জানা থাকার কথা নয়। ওই পার্টিতে তিনি স্যুট-টাই পরা জোসেফ বার্জকে ব্রিটিশ হাইকমিশনার ভেবে 'ইয়োর এক্সলেন্সি' সম্বোধন করলে ঠোঁটটেপা হাসাহাসির খোরাক হন।
মাসখানেক পর ব্রিটিশ হাইকমিশনারের বাসভবনে নিউ ইয়ার্স ডের পার্টিতে আবার কিটি ও ক্লাইভের সাথে দেখা হয়। ক্লাইভ এক বাটি আইসক্রিম হাতে নিয়ে আমাকে বলেন, 'গতকাল সূর্যগ্রহণের সময় তুমি কোথায় ছিলে? আমরা সৈকতে পার্টি করলাম। ইট ওয়াজ ট্রুলি অ্যান অ্যামেজিং সাইট।' গতকাল সূর্যগ্রহণের তো কোনো প্রশ্নই ওঠে না, আমি এ দেশে আসা অবধি কখনো চন্দ্র কিংবা সূর্যগ্রহণ কিছুই হয়নি। কী আজগুবি আবজাব বলছেন ক্লাইভ, বিরক্ত হয়ে প্রশ্ন করি, 'হোয়াট দ্য হেল আর ইউ টকিং অ্যাবাউট?' তিনি জবাব দেন,' ইট ওয়াজ অ্যান আনপ্যারালাল সাইট। আমরা সবাই দাঁড়িয়ে ছিলাম সৈকতে, আর তাবৎ কিছু ঠিক দুপুরবেলা অন্ধকার হয়ে আসল। মুদে গেল বনগোলাপের পাপড়ি, কাঁটাঝোপে ঝিঁঝিপোকারা তারস্বরে ডাকছে, আর জলতলে বিভ্রান্ত হয়ে সমুদ্রের সারফেসে লাফিয়ে ওঠছে ডলফিন।'
সূর্যগ্রহণের বর্ণনা শুনে আমি নির্বাক হয়ে যাই! ক্লাইভ পাইপ ধরিয়ে, পাশে বসা ফ্রিটাউন ইন্টান্যাশনেল স্কুলের শিক্ষয়ত্রী আইরিনকে পুতুলনাচের দারুণ পারফরম্যান্সের গল্প বলতে শুরু করেন। ইন্দোনেশিয়া থেকে আসা পাপেটিয়ারদের ট্রুপ নাকি ব্রিটিশ গভর্নর জেনারেলের ম্যানসনে গেল উইকঅ্যান্ডে পুতুলনাচের প্রদর্শনী করেছে।
শুনতে শুনতে মহাবিভ্রান্তির মাঝে পড়ি। সিয়েরা লিওন তো স্বাধীন হয়েছে অনেক বছর। এখানে ব্রিটিশ গভর্নরের সাবেক ম্যানশনটি নাম বদলে হয়েছে প্রেসিডেন্টসিয়াল লজ। বর্তমানে তাতে বহাল তবিয়তে বসবাস করছেন দেশের রাষ্ট্রপতি ড. বাই করোমা। ফ্রিটাউন তেমন একটা বড় মেট্রোপলিটন শহর নয়। ইন্দোনেশিয়া থেকে পুতুলনাচের ট্রুপ আসলে তা পত্রিকায় নিউজ হতো। আমরাও জানতে পারতাম। দূতাবাসগুলোর চ্যানেলে ইনভাইটেশনের কার্ড পেতাম। মি. ক্লাইভ পুতুলনাচের নানা রকমের ডিটেলস উৎসাহের সাথে বর্ণনা দিয়ে চলছেন। আশপাশে চেয়ারে বসা জানাশোনা অভ্যাগতরা পরস্পরের দিকে চোখ ঠারছেন। আমি কী করব বুঝতে না পেরে উঠে পড়লে কিটি আমাকে বাগানের এক কোনায় ডেকে নিয়ে বলেন, 'স্যরি, ক্লাইভ ইজ ক্রিয়েটিং কনফিউশন। সে গত কয়েক দিন ধরে ফ্রিটাউনে পিতা-মাতার সাথে তার বালক বয়সে বসবাসের সময় লেখা একটি ডায়েরি বারবার পড়ছে। ডায়েরিতে বছর তিরিশেক আগে ফ্রিটাউনে ঘটা সূর্যগ্রহণ ও পুতুলনাচের বিস্তারিত বিবরণ আছে।' আমি তাকে বলি, ' ইটস অলরাইট কিটি, আমি বুঝতে পারছি, ডোন্ট ওয়ারি।'
আইপ্যাডের স্ক্রিন থেকে চোখ তুলে মাসাক্যুই বলেন, 'আই অ্যাম স্যরি দ্যাট ইয়োর টাইম হ্যাজ কাম টু এন য়েন্ড ইন ফ্রিটাউন। আমরা তোমার কটেজে ককটেলে যাওয়ার সুযোগ হারাব। টু ব্যাড, তোমার দেয়া সিডিগুলোও আর পাব না। দ্যাট ইজ গোয়িং টু বি আ লস ফর মি।' আমি হাত বাড়িয়ে, 'আই উইল ট্রুলি মিস ইউ মি. মাসক্যুই,' বলে করমর্দন করে তাঁর কাছ থেকে বিদায় নেই।
ওয়াটার ট্যাক্সিতে উঠে পড়ার আনাউন্স হতেই স্যুটকেস, বাক্স-পেটরা টেনেটুনে সি-অফ করতে আসা আত্মীয়স্বজনের শেষবার আলিঙ্গন করে প্যাসেঞ্জাররা জেটির দিকে হুড়মুড় করে রওনা হয়।
বোটখানি মিহি বালুকায় বাদামি হয়ে থাকা সৈকতের পাড় ঘেঁষে লুঙ্গি এয়ারপোর্টের দিকে এগোয়। বেলাভূমিতে অকেজো হয়ে পড়ে থাকা হলুদ রঙের বিচিত্র একটি বিশাল মোটরবোটের দিকে নির্দেশ করে একজন চেনা প্যাসেঞ্জার বলে ওঠেন, 'দিস ইজ আওয়ার ব্রোকেন ডাউন হোভারক্রাফট।' একসময় ফ্রিটাউন থেকে এয়ারপোর্টে যাওয়ার জন্য কোনো ওয়াটার-ট্যাক্সির ব্যবস্থা ছিল না। এ হোভারক্রাফেট জলের সামান্য ওপর দিয়ে উড়ে প্যাসেঞ্জারদের যেতে হতো এয়ারপোর্টে।
ওয়াটার ট্যাক্সির বোটখানি চলে আসে লুঙ্গি পেনিনসুলার বালুচরের কাছাকাছি। গতি কমে আসলে কাছ থেকে দেখি, সুদীর্ঘ কাঠের একটি নৌকা চলছে একই গন্তব্যে প্রায় সমান্তরালভাবে। নাওখানির নীল-হলুদে ডোরাকাটা বড়িতে ইংরেজিতে লেখাতে, 'আল্লাহ ইজ ওয়ান'। তাতে ভিড় করে আছে বসে আছেন অজস্র স্থানীয় মানুষজন। লুঙ্গি বিমানবন্দরে পৌঁছার জন্য একসময় এদিকে চালু ছিল হেলিকপ্টার ও হোভারক্রাফট। এ মুহূর্তে আমি যে মোটরবোটে চড়ছি, তা তুলনামূলকভাবে বিলাসবহুল, দামের দিক থেকেও খুবই এক্সপেনসিভ। ফ্রিটাউনের বিত্তবানরা এবং বিদেশের নাগরিকেরা মূলত ব্যবহার করে থাকেন ওয়াটার-ট্যাক্সির সার্ভিস। স্থানীয়রা এখানো তাদের দেশি নৌকায় পাড়ি দেন দরিয়া। সম্পদের তারতম্য এভাবে প্রতিভাত হয় যানবাহনে ও সমাজের সর্বত্র। এ ব্যবধান আমার জীবদ্দশায় ঘুচবে বলে মনে হয় না।
মোটরবোটটি লুঙ্গি পেনিনসুলার জেটিতে এসে ঠেকে। ঢেউয়ে হিলহিলানো বোট থেকে সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে আমি ক্যারি-অন ব্যাগটি সামলানোর চেষ্টা করি। একজন পোর্টার এসে তা তুলে নেন তার হাতে। আমি জেটির রেলিংয়ের পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে সমুদ্রের দিকে তাকাই। দরিয়ার ওপর দিয়ে উড়ছে মেঘছোঁয়া কুয়াশার মতো ঘন মিস্ট। দূরে ফ্রিটাউনের নগররেখাকে আবছা দেখায়। মনে হয়, এভাবে প্যাসেঞ্জাররা হয় ওয়াটার-ট্যাক্সি বা দেশি নৌকা পাকড়ে খেয়া পারাপার করবে অনাগত দিনে। সমুদ্রের সবুজাভ তরঙ্গরাজিতে তৈরি শুভ্র ফেনায় হাওয়ার তোড় লেগে তছনছ হবে হামেশা। কিন্তু এসব দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে থাকার ফুরসত নিয়ে আমিই শুধু এ দেশে থাকব না।