উন্নত ছিপ আর রিলের খোঁজ করতে করতে যে অ্যাংলার শপের জন্ম!
মধ্যযুগের এক জনপ্রিয় শ্লোক 'লিখিব পড়িব মরিব দুঃখে, মৎস্য মারিব খাইব সুখে'। মাছে-ভাতে বাঙালিমাত্রই মনের মধ্যে 'মৎস্য মারিব, খাইব সুখে'র একটি সুপ্ত বাসনা থাকে। সবার হয়তো দুঃখের ভয়ে লেখাপড়া বাদ দিয়ে মাছ মেরে জীবিকা নির্বাহের সুযোগ হয় না। কেউ কেউ ব্যস্ত জীবনে নানা কাজের ফাঁকে শুধু শখ হিসেবেই মাছ ধরে মনের সুখ মিটিয়ে থাকেন। দেশের শৌখিন অ্যাংলারদের (ছিপ-বড়শি দিয়ে মাছ ধরেন যারা) ফেসবুক গ্রুপগুলোর আড্ডায় দেখা যায় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এই মাছ ধরার শখ মেটাতে শামিল হচ্ছেন নানা আয়োজনে। দেশে এই শখের কাজের সরঞ্জামের বাজারও বিশাল।
শৌখিন মৎস্য শিকারিদের হাতিয়ারের প্রিয় চাইনিজ ব্র্যান্ড টিকা ফিশিং ট্যাকেল। যেখানে পাওয়া যায় মাছ শিকারের যাবতীয় সরঞ্জাম। দেশে টিকার পণ্যের অফিশিয়াল সাপ্লায়ার রাজধানীর মহাখালী টিবি গেইটে অবস্থিত টিকা বাংলাদেশ। ২০১৪ সালে নিজেদের মাছ ধরার শখকে ছড়িয়ে দিতেই দুই ভাইকে সঙ্গে নিয়ে দোকানটি শুরু করেছিলেন অ্যাংলার মাহবুবুর রহমান।
বিক্রমপুরের গ্রামে কাটানো শৈশবে বাবার সাথে বড়শি দিয়ে খালে মাছ ধরতে যাওয়া ছিল মাহবুব আর তার ভাইদের প্রিয় নেশা। বেড়ে ওঠার পরও পিছু ছাড়েনি সেই নেশা। দেশে-বিদেশে সব জায়গাতেই খুঁজে বেড়াতেন মাছ ধরার সুযোগ আর সংগ্রহ করতেন মাছ ধরার নানা আধুনিক সরঞ্জাম। মাহবুবুর রহমান বলেন, 'ভালো মানের ছিপ আর রিলের খোঁজ করতে করতেই টিকা ব্র্যান্ডের সন্ধান পেয়েছিলাম। দেশের অন্যান্য মাছ শিকারিদের মধ্যেও টিকার পণ্যের প্রতি আগ্রহ দেখতে পাই সেসময়। ভাইয়ের পরামর্শে তাই চীন থেকে টিকা ব্র্যান্ডের আধুনিক সব মাছ ধরার সরঞ্জাম আমদানি করা শুরু করি আমরা।'
বর্তমানে শোরুমের যাবতীয় কার্যক্রম দেখাশোনা করেন সেখানকার ম্যানেজার নূর আলম। ২১ বছর যাবত তিনি এই ব্যবসায় জড়িত। টিকা বাংলাদেশ শুরু করার আগে মাহবুব আর তার ভাইয়েরা মাছ ধরার সরঞ্জাম সংগ্রহ করতেন তার কাছ থেকেই। নূর আলমের অভিজ্ঞতার সাহায্য নিয়েই এরপর শুরু করেন নিজেদের শোরুম।
প্রথমে শুধু মাছ ধরার রড (ধাতব ছিপ) আর রিল (হুইল) নিয়েই শুরু করেছিলেন ব্যবসা। বর্তমানে রড, রিলের বাইরেও আছে মাছ শিকারের যাবতীয় সব সরঞ্জাম। ফিশিং লাইন বা সুতা, ফাৎনা, সুইভেল, ভার, ফোল্ডিং চেয়ার, ট্যাকল বক্স, তাঁবু, ছাতা, মাছ তোলার আর রাখার জাল, রড রাখার ব্যাগ, লাইফ জ্যাকেট, নানা ধরনের ফিশিং বোটসহ অ্যাংলারদের প্রয়োজনীয় সবকিছুই পাওয়া যায় টিকা বাংলাদেশে। মহাখালী ছাড়াও বর্তমানে ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডে আরেকটি শোরুম রয়েছে তাদের।
জলাশয়ের মাছকে আকৃষ্ট করতে সুগন্ধি খাবার চার আর ছাতুও পাওয়া যায় এখানে। মাছের চার বানানো হয় মিষ্টির গাদ, খৈল, মেথি, পচা লতাপাতা আর নানা জাতের সুগন্ধি মশলা দিয়ে। যে জায়গায় বড়শি ফেলা হবে, সেখানে আধঘণ্টা আগেই চার ফেলে মাছকে আকৃষ্ট করা হয় বলে জানান নূর আলম। এছাড়াও ভুট্টা, ডাল, বিস্কিটের গুঁড়ার মতো নানা উপকরণ দিয়ে বানানো ছাতুও আছে মাছের জন্য। মাছের সবচেয়ে প্রিয় খাবার হিসেবে পরিচিত পিঁপড়ার ডিম। গ্রামাঞ্চল থেকে এই পিঁপড়ার ডিম সংগ্রহ করে অ্যাংলারদের জন্য ফ্রিজে সংরক্ষণ করা আছে টিকা বাংলাদেশে। সিজন অনুযায়ী ১,২০০ থেকে ১,৫০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হয় এই ডিম। প্রতি কেজি চার আর ছাতু পাওয়া যায় ৪০০ টাকায়।
১,২০০ টাকা থেকে ৩,০০০ টাকার ভেতর রিল, ৫০০ টাকা থেকে ২,৮০০ টাকার ভেতর ফিশিং রড, ১৫০ টাকা থেকে ৪০০ টাকার ভেতর মাছ ধরার সুতা আর ১০ টাকা থেকে ৬০ টাকার ভেতর পাওয়া যাবে নানা ধরনের বড়শি। মাছের সাইজ আর ধরন ভেদে বড়শির প্রকারভেদ হয়। আলম বলেন, 'রুই মাছের আলাদা, কাতলা মাছের আলাদা আবার বোয়াল মাছের জন্যও আলাদা বড়শি হয়। মাছ শিকার করতে যাওয়ার সময় শিকারিরা ৪-৫ ধরনের বড়শি নিয়ে যায় সাধারণত। যখন যে মাছ ধরার ইচ্ছা থাকে, তখন সে অনুযায়ী চার, ছাতু দিয়ে বড়শি ফেলা হয়।'
শৌখিন মাছ শিকারি হিসেবে নায়ক রিয়াজের নাম সবার কাছেই পরিচিত। প্রায়ই অবসরে পরিবার, বন্ধু-বান্ধবদের সাথে মাছ ধরার নেশায় মেতে থাকেন রিয়াজ। মহাখালীর টিকা বাংলাদেশের নিয়মিত ক্রেতা তিনি। মেয়ে আমিরাকে নিয়ে প্রায়ই মাছ ধরার নানা সরঞ্জাম কিনতে আসেন দোকানে। ক্রিকেটার মুস্তাফিজুর রহমানও তার বাবাকে নিয়ে টিকা বাংলাদেশে আসেন মাছ ধরার রড আর রিল কিনতে। আলম জানান, বিভিন্ন সরকারি কর্মকর্তা, সচিব, সংসদ সদস্য, সেনা ও নৌবাহিনীর কর্মকর্তারা তাদের দোকানের নিয়মিত ক্রেতা।
নূর আলমের সঙ্গে আলাপচারিতার সময়ই টিকা বাংলাদেশে আসেন মক্কাপ্রবাসী জসীম। জানালেন কিছুক্ষণ আগেই দেশে ফিরেছেন তিনি। নোয়াখালী তার গ্রামের বাড়ি। বাড়িতে যাওয়ার আগে এখান থেকে কিছু মাছ ধরার রড কিনতে এসেছেন। জসীম বলেন, 'ছিপ-বড়শিতে মাছ ধরা আমার শখ। ফেসবুক, ইউটিউবে এদের ভিডিও দেখে আগে বন্ধু-বান্ধবদের পাঠয়েছি মাছ ধরার নানা সরঞ্জাম কিনতে। আজ দেশে ফিরেই প্রথমে এখানে আসলাম টিকার নতুন কিছু ছিপ কিনতে।'
দেড় বছর ধরে টিকা বাংলাদেশের নিয়মিত ক্রেতা শ্যামল চন্দ্র বিশ্বাস। তিনি এসেছেন বোয়াল মাছ ধরার সুতা কিনতে। 'ফরিদপুরে পদ্মার পাড়ে আমার বাড়ি। ছোটবেলা থেকেই বড়শি দিয়ে পদ্মায় মাছ ধরা আমার শখ। এখান থেকে প্রায়ই বড়শি, সুতা, ছিপ কিনে নিয়ে যাই বাড়িতে।'
ফেসবুক পেজ ও ইউটিউব চ্যানেলের মাধ্যমে সারাদেশেই ছড়িয়ে আছে টিকা বাংলাদেশের গ্রাহক। আলম বলেন, 'কিছুদিন আগেই কুড়িগ্রামের রৌমারির এক বয়স্ক লোক তার বাড়িতে পালা ছাগল বিক্রি করে আমাদের দোকান থেকে রড আর রিল কিনে নিয়ে গেছেন মাছ ধরতে। এটা আমাদের জন্য অনেক স্মরণীয় একটা ঘটনা। এখন অনেকেই জন্মদিন, বিবাহ-বার্ষিকীর উপহার হিসেবে মাছ ধরার সরঞ্জাম উপহার দেন প্রিয়জনদের। কিশোরদের ক্ষতিকর মাদক পণ্যের নেশা থেকে দূরে রাখতেও গার্ডিয়ানরা মাছ শিকারে আগ্রহী করে তুলতে চাইছেন তাদের। দিন দিন শহুরে মানুষের মধ্যেও মাছ ধরার শখ বাড়ছে।'
মাছ ধরার জন্য সবচেয়ে ভালো সময় বর্ষাকাল। এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত মাছ ধরার যন্ত্রপাতির বেচাকেনা ভালো হয় বলে জানান আলম। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এ বছর বৃষ্টি কম হওয়ায় জলাশয়ে পানি হয়েছে কম। যে কারণে মাছ ধরার সিজনেও খুব একটা জমজমাট হয়নি অ্যাংলিংয়ের সরঞ্জামের ব্যবসা। মাহবুবের মতে, জলাশয় শুকিয়ে মাছ ধরা, কৃষিকাজে কীটনাশকের ব্যবহার ও কারেন্ট জাল, ছাঁকুনি জাল, দুয়ারী জালের মতো নানান নিষিদ্ধ ক্ষতিকর জাল ব্যবহারের কারণে প্রাকৃতিকভাবে মাছের প্রজনন কমে যাচ্ছে।
'বড়শি দিয়ে মাছ ধরার আগ্রহ দিন দিন বৃদ্ধি পেলেও মাছ ধরার জায়গা ক্রমেই কমে যাচ্ছে। আগে নদী ও খাল-বিলে অনেক প্রজাতির মাছ ছিল। যার বেশিরভাগই বিলুপ্ত হওয়ার পথে এখন। শৌখিন শিকারি হিসেবে আমরা অন্যান্য অ্যাংলারদের উৎসাহিত করছি মাছের এই প্রাকৃতিক প্রজননকে রক্ষা করতে। আমাদের স্লোগান 'মৎস্য প্রজনন বান্ধব পরিবেশ রক্ষা করি, ছোট মাছ না ধরি'," বলেন মাহবুবুর রহমান।
মাছ শিকারিদের উৎসাহ দিতে এ বছরের শুরুতে টাংগাইলের সখিপুরে মাহবুবুর রহমান তার ভাইদের নিয়ে শুরু করেছেন 'ফিশ এন্ড প্লে' নামের উদ্যোগ। যেখানে তিনটি ফিশারি আছে তাদের। ব্যক্তিগত উদ্যোগে মাছ চাষ করে শৌখিন শিকারিদের মাছ ধরার সুযোগ করে দেন ফিশ এন্ড প্লে-তে। সেখানে মাছ ধরতে বসার জন্য কোনো টিকেট কিনতে হয় না অ্যাংলারদের। ছিপ-বড়শি দিয়ে যতটুকু মাছ ধরতে পারবেন কেজি দরে সেগুলো কিনে আনতে পারবেন তারা।
মাহবুব বলেন, 'কেউ চাইলে সারাদিনের জন্য পরিবারের সবাইকে নিয়ে ফিশ এন্ড প্লে-তে মাছ ধরে সময় কাটাতে পারবেন। সেখানে আমাদের দুজন কর্মচারী আছে। যাদের একজন ধানমন্ডি লেকের মাছ শিকারি। মাছ ধরার সময় নানা বিষয়ে সাহায্য করেন তিনি অতিথিদের। আর একজন গার্ড সার্বক্ষণিক থাকেন অতিথিদের সাথে। প্রায়ই বিভিন্ন বিদেশি কূটনৈতিক, সামরিক কর্মকর্তা ও নানা অঙ্গনের সেলিব্রিটিরা ফিশ এন্ড প্লে-তে আসেন মাছ ধরতে।'
মাছ ধরার পাশাপাশি সেগুলো রান্নাবান্নার ব্যবস্থাও আছে ফিশ এন্ড প্লে-তে। তাই ঢাকার অদূরে পরিবার, বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে পিকনিক করার জন্যও অনেকেই বেছে নেন জায়গাটিকে। মাছ ধরা ও সারাদিন ঘুরে বেড়ানোর গাইড ফি হিসেবে ৩০০ টাকা দিতে হয় সেখানকার গার্ডকে। কেজি দরে মাছের দাম মৃগেল ৩০০ টাকা, রুই ২৯০ টাকা থেকে ৭০০ টাকা, কাতলা মাছ ২৮০ টাকা থেকে ৮০০ টাকা। মাছ যত বড় হয় সে অনুযায়ী কেজিপ্রতি দাম বাড়তে থাকে। ফেসবুক পেইজ Tica Bangladesh-এ যোগাযোগ করে ফিশ এন্ড প্লে-তে যাওয়ার জন্য বুকিং করতে হয় আগে থেকেই। ভবিষ্যতে ফিশ এন্ড প্লে-তে বড় চিতল মাছ, পাংগাস মাছের পাশাপাশি একুরিয়ামের জন্য রঙিন মাছ চাষ করার পরিকল্পনা রয়েছে মাহবুবুর রহমানের।
শৌখিন অ্যাংলারদের হাতিয়ারের আরেক জনপ্রিয় প্রতিষ্ঠান আকিব'স এক্সক্লুসিভ ট্যাকেল শপ ঢাকা। পূর্ব মেরুল বাড্ডায় অবস্থিত এই দোকানে পাওয়া যায় তাদের নিজেদের তৈরি দেশীয় ফিশিং রড, চার, টোপ, ছাতুসহ নানান বিদেশি সরঞ্জাম। ডাইওয়া, শিমানো, আবু গার্সিয়াসহ নানান আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের মাছ ধরার সামগ্রী মেলে সেখানে। দেশের মৎস্য শিকারিদের কাছে মাছ ধরার নিত্যনতুন সামগ্রীর চাহিদা দিন দিন বেড়েই চলেছে।