নোয়াখালীতে বন্ধ অর্ধশতাধিক লাইব্রেরি, ক্ষতি ৭ কোটি টাকা
মোহাম্মদ ইউছুফ গত কয়েক মাস আগেও ছিলেন একজন লাইব্রেরি ব্যবসায়ী। চৌমুহনী বাজারে পাইকারি ও খুচরা বই বিক্রেতা হিসেবে খ্যাতি ছিল তার। নিজ জেলা ছাড়িয়ে পার্শ্ববর্তী ফেনী ও লক্ষীপুর জেলার খুচরা ব্যবসায়ীরাও তার প্রতিষ্ঠান থেকে বই নিতেন। হঠাৎ করে দেশে শুরু হয় করোনা ভাইরাসের সংক্রমন। একে একে বন্ধ হতে থাকে সরকারি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো। ব্যবসায় নামে ধস, ধীরে ধীরে কমতে থাকে বিক্রি। লোকসান, ধার, দেনা, ব্যাংকের ঋণের টাকা সামাল দিতে না পেরে বর্তমানে নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান মিল্লাত লাইব্রেরি বন্ধ করে বেকার জীবন কাটাচ্ছেন তিনি। শুধু মোহাম্মদ ইউছুফ নয়, নোয়াখালী পুস্তক প্রকাশনী সমিতির মতে গত ৭-৮ মাসে জেলায় লাইব্রেরি ব্যবসা ছেড়ছেন অন্তত অর্ধশতধিক ব্যবসায়ী। আর এতে প্রতি মাসে লাইব্রেরি ব্যবসায়ীরা ক্ষতির মুখে পড়েছেন প্রায় ৭ কোটি টাকার। ভালো নেই জেলার কোন লাইব্রেরি ব্যবসায়ী।
সরজমিনে জেলার প্রধান বাণিজ্যিক কেন্দ্র চৌমুহনী, মাইজদী ও সোনাপুর বাজার ঘুরে দেখা যায়, চৌমুহনী বাজারে ৩৭টি, মাইজদীতে ১২টি ও সোনাপুর বাজারে বর্তমানে ৮টির মত লাইব্রেরি রয়েছে। যেখানে আগে লাইব্রেরির সংখ্যা ছিল প্রায় দুই শতাধিক। গত এক বছর আগেও লাইব্রেরিগুলোতে গ্রাহকদের ভিড়ের কারনে দাঁড়িয়ে কথা বলার সুযোগ হতো না। করোনার আগে ক্রেতাদের ভিড়ে ব্যস্ত থাকতেন লাইব্রেরিগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। বর্তমানে ক্রেতা না থাকায় অলস সময় পার করছেন তারা। কয়েকটি লাইব্রেরিতে আধা থেকে এক ঘন্টা থেকেও কোন ক্রেতার দেখা পাওয়া যায়নি। জেলার প্রধান শহরগুলোর একাধিক লাইব্রেরি রয়েছে যারা গত ২-৩ দিনে একজন ক্রেতাও পাননি।
জেলার লাইব্রেরি ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, দেশে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হওয়ায় গত বছরের মার্চ মাস থেকে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। জেলার ৯টি উপজেলার অন্তত ৪০০ লাইব্রেরির মালিক গত ৮মাস ধরে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। ব্যবসা ছেড়েছেন অনেকে। এরমধ্যে বেশির ভাগ ব্যবসায়ীর রয়েছে ব্যাংকের বিভিন্ন সমিতি ও এনজিও থেকে নেওয়া ঋণ। এ ঋণের টাকা পরিশোধ করতে না পেরে ব্যাংক থেকে অনেককেই নোটিশও জারি করা হয়েছে। অফিস আদালত খোলা থাকার কারনে কিছু স্টেশনারি সামগ্রী, চাকরি বই বিক্রি হচ্ছে। আর এখান থেকে যা লাভ হচ্ছে তা দিয়ে বিদ্যুৎ বিলের টাকা হয়না বলেও অভিযোগ ব্যবসায়ীদের।
চৌমুহনী ব্যাংক সড়কে অবস্থিত রেখা প্রকাশনীর কর্মকর্তা শাহ্ নেওয়াজ রাজু জানান, বৃহত্তর নোয়াখালীর বড় কয়েকটি লাইব্রেরির মধ্যে তাদেরটি অন্যতম। পাইকারি ও খুচরা বিক্রি করা এ লাইব্রেরি থেকে সর্বনিম্ন ১৫% থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ৪০% কমিশন দিয়ে বই বিক্রি করেন তারা। স্কুল, কলেজ খোলার সময় গ্রাহকের চাপে দোকানে দাঁড়ানোর সময় পাওয়া যেত না। সকাল ৯টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত ৫ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী গ্রাহকদের সামাল দিতে হিমশিম খেতো। যেখানে প্রতিদিন গড়ে বিক্রি হতো দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা। আর বর্তমানে গড়ে প্রতিদিন বিক্রি হচ্ছে মাত্র ৩০-৩৫হাজার টাকা। চাকরি, বিসিএস ও ইসলামি কিছু বই এখন বিক্রি হচ্ছে। খরচ বহন করতে না পেরে করোনাকা্লীন সময় দুই জন কর্মচারীকে বাদ দেওয়া হয়েছে।
হাজী বই মার্কেটের আজিজিয়া লাইব্রেরির এক কর্মকর্তা (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) জানান, এই মার্কেটটিতে মোট ১১টি লাইব্রেরি ছিল। যার মধ্যে কারো কারো ব্যবসার বয়স প্রায় ২০ থেকে ২৫ বছর। কিন্তু সম্প্রতি বিক্রি না থাকায় ইতোমধ্যে ৫টি লাইব্রেরি বন্ধ হয়ে গেছে। যার মধ্যে মিল্লাত লাইব্রেরি, মোহাম্মদিয়া লাইব্রেরি, সন্ধানি লাইব্রেরি, শিক্ষা বিপনী ও ইসলাম মার্কেটের মিনার প্রকাশনী অন্যতম। চাকরি ছাড়া হয়েছেন ৫ জন কর্মচারী। আগে আজিজিয়া লাইব্রেরিতে মাসে বিক্রি হতো ৪৫ লাখ টাকার বই, অথচ বর্তমান সময়ে সবকিছু মিলে মাসে ১লাখ টাকারও বই বিক্রি হচ্ছে না। গত দুই দিন তার লাইব্রেরিতে একজন ক্রেতাও আসেন নি। এ প্রতিবেদককে তিনি দোকানের দৈনিক লেনদেনের খাতা খুলে দেখিয়েছেন। তিনি আরও জানান, ফেব্রুয়ারির শেষ বা মার্চের প্রথম দিকে এ প্রতিষ্ঠানটিও বন্ধ করে দেওয়া হবে।
স্টেশন সড়কের ভাই ভাই লাইব্রেরির পরিচালক মো. কামরুজ্জামান বলেন, যেখানে গড়ে প্রতিদিন তার লাইব্রেরি থেকে ৮০ হাজার টাকার বই বিক্রি হতো, তা এখন নেমে এসেছে মাত্র ৭ হাজারে। মাঝে মাঝে কয়েকজন ক্রেতা পাওয়া যায় যারা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের বই/গাইড ক্রয় করে। ২টি ব্যাংকে বর্তমানে তার লোনের অংক ৫০ লাখ টাকা। যা প্রতিমাসে ৫০ হাজার টাকা করে জমা দেওয়া লাগে। কিন্তু গত ৩ মাস ধরে বিক্রির অবস্থা এতই খারাপ যে ব্যাংকের টাকা দেওয়াতো দূরের কথা, দোকান ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল ও একজন কর্মচারীর বেতন দিতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে। ব্যাংকের মাসিক কিস্তি জমা দিতে না পারায় গত জানুয়ারিতে আমাকে শোকজ নোটিশ দেওয়া হয়েছে। প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলো একসময় বাকীতে বই দিলেও বর্তমানে যে পরিমান টাকা দেওয়া হয় সে পরিমান বই দিচ্ছে তারা। প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে কোন সুযোগ সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে না। গত কয়েক মাস ধরে প্রকাশনা থেকে ২০% কমিশন করে বই এনে ১৫% কমিশন দিয়ে বিক্রি করার পরও বই বিক্রি হচ্ছে না।
রেল স্টেশনের হক লাইব্রেরির মালিক জিয়াউল হক জানান, বিক্রি সংকটে পড়ে প্রতি মাসে প্রায় ৫০ লাখ টাকার লোকসানে পড়েছেন তিনি। ব্যাংক, সমিতিসহ বিভিন্ন স্থান থেকে লোন নিয়ে আজ বিপাকে। ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে মানসিক অস্থিরতায় দিন কাটছে তার। দোকান ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল ও কর্মচারীদের বেতন সব মিলে মানবেতর জীবন কাটছে। শুধু মাত্র ব্যবসাটি ধরে রাখতেই প্রতি মাসে লোকসান দিয়ে লাইব্রেরিটি এখনো চালু রেখেছি। তবে কতদিন এ ব্যবসা ধরে রাখতে পারবেন তা নিয়ে সন্দিহান তিনি।
আক্ষেপ প্রকাশ করে এ ব্যবসায়ী বলেন, 'দ্রুত স্কুল কলেজগুলো খুলে না দিলে নিজের বাবা-দাদাদের তিন প্রজন্মের এ ব্যবসা বন্ধ করে দিতে হবে। আমার জীবনে বই ব্যবসায় এত হাহাকার আগে কখনো দেখিনি'।
স্টেশনারি সামগ্রি ক্রয় করতে আসা সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী মাকসুদা বেগম বলেন, 'দীর্ঘদিন থেকে আমাদের বিদ্যালয় বন্ধ। প্রাইভেট পড়ার জন্য মাঝে মাঝে কিছু খাতা ও কলমের দরকার হওয়ায় তা নিতে এসেছি। এখন বইয়ের দরকার নেই। নতুন শ্রেণিতে উঠলে যখন বইয়ের দরকার হবে তখন বই কিনবো'।
নোয়াখালী পুস্তক প্রকাশনী সমিতির সাধারণ সম্পাদক গিয়াস উদ্দিন কাউছার জানান, করোনার আগ পর্যন্ত জেলার বিভিন্ন বাজারে ৫২০টি লাইব্রেরি ছিল। লাইব্রেরি গুলোতে প্রতি মাসে বিক্রির পরিমাণ ছিল প্রায় ১০ কোটি টাকা। করোনার কারণে বর্তমানে সেই বিক্রি নেমে এসেছে ৩ কোটি টাকা বা তারও কম। সমিতির হিসেব মতে গত ৭-৮ মাসে জেলায় অন্তত অর্ধশতাধিক লাইব্রেরি বন্ধ হয়ে গেছে, বন্ধের পথে আছে আরও অনেকগুলো। বিক্রি কমে যাওয়া ও লাইব্রেরিগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় প্রতিমাসে অন্তত ৭ কোটি টাকা লোকসানে পড়েছে ব্যবসায়ীরা। দ্রুত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেওয়া না হলে ঐতিহ্যের এ লাইব্রেরি ব্যবসা একটা সময় এসে একবারে বন্ধ হয়ে যাবে।
তিনি সরকারের কাছে দাবী করে বলেন, করোনাকালীন সময় সকল লাইব্রেরির মালিক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন। তাই সরকারের পক্ষ থেকে লাইব্রেরি ব্যবসায়ীদের জন্য প্রনোদনার ব্যবস্থা করা দরকার।