সবচেয়ে দূষিত ১০০ শহরই এশিয়ায়, ৮৩টি ভারতের!
গত বছর বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর ১০০ টি শহরের মধ্যে একটি বাদে সবগুলোই ছিল এশিয়ার।
একটি সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুসারে, জলবায়ু সংকট বায়ু দূষণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে, যা বিশ্বব্যাপী কোটি কোটি মানুষকে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে ফেলছে।
বিশ্বব্যাপী বায়ুর গুণমান পর্যালোচনা করা আইকিউএয়ারের প্রতিবেদন অনুসারে, ভারতের ৮৩টি শহরের বায়ুতে ক্ষতিকর বস্তুকণার পরিমাণ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বেঁধে দেওয়া সীমার দশগুণের বেশি।
গবেষণায় ফুসফুসের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকারক ক্ষুদ্র বস্তুকণা বা পিএম ২.৫ -এর দিকে বিশেষ আলোকপাত করা হয়েছে।
৭ হাজার ৮০০টিরও বেশি শহরের মধ্যে মাত্র ৯ শতাংশ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মানদণ্ড পূরণ করতে পেরেছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ড অনুযায়ী, পিএম২.৫-এর গড় বার্ষিক মাত্রা প্রতি ঘনমিটারে ৫ মাইক্রোগ্রামের বেশি হওয়া উচিত নয়।
আইকিউএয়ার গ্লোবালের সিইও ফ্র্যাঙ্ক হ্যামেস বলেন, 'আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমরা বায়ু দূষণের প্রভাব দেখতে পাচ্ছি। এর কারণে সবচেয়ে দূষিত দেশগুলোর নাগরিকদের গড় আয়ু তিন থেকে ছয় বছর কমে যাচ্ছে। এছাড়া বায়ু দূষণের কারণে অনেকেই ফুসফুসের নানা রোগে আক্রান্ত হন।'
অতিসূক্ষ্ম বলেই পিএম ২.৫ নিঃশ্বাসের সঙ্গে আমাদের দেহে প্রবেশ করলে ফুসফুস, হার্ট ও মস্তিষ্কে ছড়িয়ে যায়। এটি জীবাশ্ম জ্বালানি, ধূলিঝড় ও দাবানলের মতো উ ৎস থেকে নির্গত হয়। এর ফলে মানুষ হাঁপানি, হৃৎপিণ্ড ও ফুসফুসের রোগ, ক্যান্সার এবং অন্যান্য শ্বাসকষ্টজনিত রোগে আক্রান্ত হয়।
উত্তর ভারতের বিহার রাজ্যের পাঁচ লাখ মানুষের শহর বেগুসরাই ছিল গত বছর বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহর। সেখানে পিএম ২.৫-এর গড় বার্ষিক ঘনত্ব ছিল ১১৮.৯, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিকার চেয়ে ২৩ গুণ বেশি।
আইকিউএয়ার র্যাংকিংয়ে এর পরেই রয়েছে আসামের গুয়াহাটি, রাজধানী দিল্লি এবং পাঞ্জাবের মুল্লানপুর।
২০২৩ সালের বায়ু দূষণের শীর্ষে এশিয়ার দেশগুলো
২০২৩ সালে বাংলাদেশের বায়ুতে ক্ষতিকর বস্তুকণার পরিমাণ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) দেওয়া সুরক্ষা সীমার চেয়ে প্রায় ১৬ গুণ বেশি ছিল। তাই ওই বছর বাংলাদেশ ছিল বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর দেশ। এরপরেই ছিল পাকিস্তান ও ভারত।
বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত ১০টি শহরের মধ্যে ৯টিই ছিল ভারতের।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সারা ভারতে ১৩০ কোটি মানুষ তথা মোট জনসংখ্যার ৯৬ শতাংশ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেওয়া সুরক্ষাসীমার চেয়ে সাত গুণ বেশি দূষিত বায়ুতে নিঃশ্বাস নেয়।
মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়া ছিল বিশ্বের সবচেয়ে খারাপ বায়ুর অঞ্চল। এখানে গত বছর সবচেয়ে দূষিত চারটি দেশের অবস্থান।এগুলো হলো: বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভারত ও তাজিকিস্তান।
তবে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো নিয়ে বিশেষ উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। কারণ সবচেয়ে দূষিত ৩০টি শহরের মধ্যে ২৯টিই ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের।
এর মধ্যে লাহোর ৫ম, নয়াদিল্লি ৬ষ্ঠ এবং ঢাকা ২৪তম অবস্থানে রয়েছে।
হ্যামস বলেন, 'জ্বালানি অবকাঠামো এবং কৃষি পদ্ধতির বড় সংস্কার ছাড়া' এই অঞ্চলে দূষণের মাত্রায় কোনো উল্লেখযোগ্য উন্নতি সম্ভব নয়।
তিনি আরও বলেন, 'উদ্বেগের আরেকটি কারণ হলো যে বিষয়গুলো বাইরে বায়ু দূষণ ঘটাচ্ছে, কখনও কখনও সেগুলো বাড়ির ভেতরেও বায়ু দূষণ ঘটায়। তাই নোংরা জ্বালানি দিয়ে রান্না করলে তা বাড়ির ভেতরের বায়ুকে বাইরের চেয়েও বহুগুণ দূষিত পারে।'
বৈশ্বিক সমস্যা
গত বছর ১৩৪টি দেশ, অঞ্চল ও ভূখণ্ডের ৭ হাজার ৮১২টি স্থানের ৯২ দশমিক ৫ শতাংশ বায়ুর গড় মান বিশ্লেষণ করে আইকিউএয়ার দেখেছে, এসব স্থানের বায়ু দূষণ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত পিএম২.৫ সীমার বেশি।
কেবল ১০ টি দেশ ও অঞ্চলে 'স্বাস্থ্যকর' বায়ু ছিল। এগুলো হলো: ফিনল্যান্ড, এস্তোনিয়া, পুয়ের্তো রিকো, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, বারমুডা, গ্রেনাডা, আইসল্যান্ড, মরিশাস ও ফ্রেঞ্চ পলিনেশিয়া।
প্রতি বছর লাখ লাখ মানুষ বায়ু দূষণজনিত বিভিন্ন রোগে মারা যায়।
গত নভেম্বরে বিএমজেতে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে সৃষ্ট বায়ু দূষণের কারণে বিশ্বে প্রতি বছর ৫১ লাখ মানুষের মৃত্যু হচ্ছে।
অন্যদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, পরিবেশ ও গৃহস্থালির বায়ুদূষণের সম্মিলিত প্রভাবে বছরে ৬৭ লাখ মানুষ মারা যায়।
আইকিউএয়ারের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর ফলে সৃষ্ট মানবসৃষ্ট জলবায়ু সংকট বায়ু দূষণের মাত্রাকে প্রভাবিত করতে 'গুরুত্বপূর্ণ' ভূমিকা পালন করে।
জলবায়ু সংকট আবহাওয়া পরিবর্তনে ভূমিকা রাখছে। যার ফলে বাতাস ও বৃষ্টিপাতের পরিবর্তন ঘটছে, যা দূষণকারী পদার্থের ছড়িয়ে পড়াকে প্রভাবিত করে।
এতে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তন দূষণকে আরও খারাপ পর্যায়ে নিয়ে যাবে, কারণ চরম তাপ আরও তীব্র ও ঘন ঘন হবে।
জলবায়ু সংকট অনেক অঞ্চলে আরও মারাত্মক ও দীর্ঘস্থায়ী দাবানল সৃষ্টি করবে এবং অ্যালার্জি মৌসুম আরও দীর্ঘায়িত করতে। এগুলো বায়ু দূষণের সঙ্গে যুক্ত স্বাস্থ্য সমস্যাগুলোকে আরও প্রকট করবে।
আঞ্চলিক র্যাংকিং
গত বছরের মে থেকে অক্টোবর পর্যন্ত কানাডায় ছড়িয়ে পড়া দাবানলে উত্তর আমেরিকা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।
প্রতিবেদনে দেখা গেছে, মে মাসে আলবার্টায় বায়ুদূষণের মাসিক গড় ২০২২ সালের একই মাসের তুলনায় ৯ গুণ বেশি ছিল।
আর প্রথমবারের মতো আঞ্চলিক দূষণের র্যাংকিংয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে গেছে কানাডা।
মিনিয়াপোলিস ও ডেট্রয়েটের মতো মার্কিন শহরগুলোতেও প্রভাব ফেলেছে দাবানল। সেখানকার বার্ষিক দূষণের গড় আগের বছরের তুলনায় ৩০% থেকে ৫০% বেড়েছে।
২০২৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে দূষিত শহর ছিল ওহাইওর কলম্বাস।
তবে পোর্টল্যান্ড, সিয়াটল ও লস অ্যাঞ্জেলেসের মতো বড় শহরগুলোতে বার্ষিক গড় দূষণের মাত্রা উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেয়েছে।
তবে এশিয়ার অনেক অংশে দূষণের মাত্রা আরও বেড়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চীন পাঁচ বছরের লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করে তার দূষণের মাত্রা হ্রাসের দৃষ্টান্ত রেখেছে। একসময় চীনের শহরগুলো বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর তালিকায় উপরের দিকে থাকত।
তবে গত দশকে নেওয়া 'ক্লিন এয়ার পলিসি' বিষয়টিতে অবিশ্বাস্যভাবে পরিবর্তন করেছে।
গত বছর এক গবেষণায় দেখা গেছে, এই পদক্ষেপের ফলে চীনা নাগরিকদের গড় আয়ু ২.২ বছর বেড়েছে।
কিন্তু গত বছর বেইজিংয়ে ঘন ধোঁয়াশা দেখা যায়। আইকিউএয়ারের প্রতিবেদন অনুসারে, সেখানকার নাগরিকদের বার্ষিক গড় পিএম ২.৫ ঘনত্ব ১৪% বৃদ্ধি পেয়েছে।
চীনের সবচেয়ে দূষিত শহর হোতান আইকিউএয়ার র র্যাংকিংয়ে ১৪তম স্থানে ছিল।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় কেবল ফিলিপাইনে আগের বছরের তুলনায় বার্ষিক দূষণের মাত্রা কমেছে।
এই অঞ্চলের সবচেয়ে দূষিত দেশ ইন্দোনেশিয়া, ২০২২ সালের তুলনায় এর দূষণ ২০% বৃদ্ধি পেয়েছে। ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ডের সব শহরের বায়ুই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পিএম ২.৫ গাইডলাইনের চেয়ে ১০ গুণ বেশি ছিল।
রয়টার্সের তথ্যমতে, গত মাসে থাই কর্তৃপক্ষ রাজধানী ব্যাংকক ও আশপাশের এলাকায় অস্বাস্থ্যকর মাত্রার দূষণের কারণে সরকারি কর্মচারীদের বাড়ি থেকে কাজ করার নির্দেশ দেয়।
মৌসুমি ফসল পোড়ানোর ফলে সৃষ্ট বিষাক্ত ধোঁয়াশায় ঢেকে যাওয়ায়, গত শুক্রবার থাইল্যান্ডের পর্যটন হটস্পট চিয়াং মাই ছিল বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহর।
বৈষম্য... এবং একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত
প্রতিবেদনে একটি উদ্বেগজনক মাত্রার বৈষম্যও তুলে ধরা হয়েছে। তা হলো আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকা এবং মধ্য প্রাচ্যের দেশগুলোতে পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের অভাব। এর ফলে এই অঞ্চলগুলোর বায়ু মানের তথ্যের ঘাটতি রয়েছে।
যদিও আগের বছরগুলোর তুলনায় এই বছরের প্রতিবেদনে আফ্রিকার দেশগুলো অন্তর্ভুক্তির সংখ্যা বেড়েছে।
আইকিউএয়ারের তথ্য অনুযায়ী, আফ্রিকার ৫৪টি দেশের মধ্যে মাত্র ২৪টিতে তাদের পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র থেকে পর্যাপ্ত তথ্য পাওয়া গেছে।
২০২৩ সালের র্যাংকিংয়ে অন্তর্ভুক্ত নতুন দেশগুলোর মধ্যে সাতটি আফ্রিকান, যার মধ্যে বিশ্বের পঞ্চম দূষিত দেশ বুরকিনা ফাসো এবং ১৫তম স্থানে রয়েছে রুয়ান্ডা।
পর্যাপ্ত তথ্যের অভাবে গত বছরের সবচেয়ে দূষিত বেশ কয়েকটি দেশকে ২০২৩ সালের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এর মধ্যে রয়েছে ২০২২ সালে সবচেয়ে দূষিত দেশ চাদ।
হ্যামস বলেন, 'পৃথিবীতে এখনও অনেক অপ্রকাশিত বায়ু দূষণ রয়েছে।'
তিনি বলেন, তবে একটি ইতিবাচক বিষয় হলো বায়ুমান নিরীক্ষণের জন্য নাগরিক সমাজ, এনজিও, বিভিন্ন সংস্থা এবং বিজ্ঞানীদের কাছ থেকে চাপ এবং নাগরিকদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ছে।
ভাবানুবাদ: তাবাসসুম সুইটি