ইসফাহানকে কেন টার্গেট করল ইসরায়েল? ইরানে আক্রমণ সম্পর্কে যা যা জানা গেল
মার্কিন কর্মকর্তারা বলছেন, ইসরায়েল শুক্রবার (১৯ এপ্রিল) দিবাগত রাতে ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে দেশ দুটির মধ্যে উত্তেজনা বাড়ার পর ইরানে প্রতিশোধমূলক হামলা চালাল ইসরায়েল।
আক্রমণ করা হয়েছে কেন্দ্রীয় প্রদেশ ইসফাহান অঞ্চলে। হামলার মাত্রা ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ সম্পর্কে একেক রকম দাবি করা হচ্ছে। ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম বলছে, হামলায় তেমন কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। এছাড়া ক্ষেপণাস্ত্র নয়, ড্রোন দিয়ে হামলা চালানো হয়েছে বলে উল্লেখ করেছে তেহরান।
গত কয়েক সপ্তাহ ধরে দুই দেশের মধ্যে চরম উত্তেজনা চলছে। গত ১ এপ্রিল সিরিয়ার দামেস্কে ইরানের কনস্যুলেটে হামলায় বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর সিনিয়র কমান্ডারসহ বেশ কয়েকজন সামরিক কর্মকর্তা মারা যান। এ হামলার জন্য ইরান ইসরায়েলকে দায়ী করছিল। দামেস্কের সেই আক্রমণের জবাবে ইসরায়েলে অভূতপূর্ব ড্রোন ও মিসাইল হামলা চালিয়েছে তেহরান। তারই জবাবে আজ ইসরায়েলের এ আক্রমণ।
তবে হামলার জন্য ইসরায়েল ইসফাহানকেই কেন বেছে নিল, এ ঘটনায় উত্তেজনা আরও বাড়বে কি না—এরকম অনেক প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। চলুন এখনও পর্যন্ত সর্বশেষ ঘটনা সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।
হামলার খবর কীভাবে জানা গেল?
ইরান সমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে নেওয়া সামরিক পদক্ষেপের ব্যাপারে নিয়মিত তথ্য দেয় না ইসরায়েল।
তবে মার্কিন কর্মকর্তারা বিবিসির অংশীদার সিবিএস নিউজকে নিশ্চিত করেছেন, শুক্রবার ভোরে ইরানে একটি ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হেনেছে।
এ হামলায় কী ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে বা কোথা থেকে উৎক্ষেপণ করা হয়েছে, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
মার্কিন সূত্র জানিয়েছে, এ আক্রমণে ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে। অন্যদিকে ইরান বলছে, হামলায় ছোট ড্রোন ব্যবহার করা হয়েছে।
ইরানের সরকার দেশটিতে তথ্যের প্রবাহ কড়াভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। ঘটনাস্থল ইসফাহানের কেন্দ্রীয় অঞ্চলে বিবিসির সরাসরি প্রবেশাধিকার নেই।
আক্রমণ নিয়ে ইরান কী বলছে?
ইরানের সংবাদমাধ্যম ও কর্মকর্তারা হামলার চেষ্টার খবর নিশ্চিত করে বলেছেন, এতে তেমন কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। এ আক্রমণে হতাহতের কোনো খবর পাওয়া যায়নি।
ইরানের বার্তা সংস্থা ফারস জানিয়েছে, একটি সেনা ঘাঁটির কাছে বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে এবং বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সক্রিয় করা হয়েছে।
একটি রাষ্ট্রীয় মিডিয়া চ্যানেল ইসফাহানের একজন জেনারেলের বরাত দিয়ে জানিয়েছে, 'সন্দেহজনক বস্তুকে লক্ষ্য করে বিমান প্রতিরক্ষা গুলি চালানোর কারণে' ওই এলাকায় বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। এতে কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি বলে জানায় চ্যানেলটি।
ইরানের শক্তিশালী ইসলামি বিপ্লবী গার্ড কর্পসের সামরিক শাখার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ আধা-সরকারি বার্তা সংস্থা তাসনিম ইসফাহানের একটি পারমাণবিক স্থাপনার একটি ভিডিও পোস্ট করেছে। ওই ভিডিওতে স্থাপনাটির কোনো ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার চিহ্ন দেখা যায়নি।
আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা সংস্থা নিশ্চিত করেছে, ইরানের পারমাণবিক স্থাপনার কোনো ক্ষতি হয়নি।
ইরানের ন্যাশনাল সেন্টার অভ সাইবারস্পেসের মুখপাত্র হোসেইন দালিরিয়ান বলেছেন, 'সীমান্তের বাইরে [বাইরের দেশ] থেকে কোনো বিমান হামলা হয়নি'।
তিনি বলেন, ইসরায়েল 'শুধু কোয়াডোকপ্টার [ড্রোন] ওড়ানোর ব্যর্থ ও ন্যক্কারজনক প্রচেষ্টা চালিয়েছে। আর সেই কোয়াডোকপ্টারগুলোকে গুলি করে ভূপাতিতও করা হয়েছে'।
আক্রমণের পরপরই কয়েক ঘণ্টার মধ্যে বাণিজ্যিক ফ্লাইট চলাচল স্থগিত করেছিল ইরান। তবে এখন সেই স্থগিত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়েছে।
এছাড়া ইরাক ও সিরিয়াতেও ইরান সমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সক্রিয় থাকার অঞ্চলে বিস্ফোরণের খবর পাওয়া গেছে। তবে ওইসব বিস্ফোরণের সঙ্গে ইসফাহান হামলার সরাসরি সম্পর্ক আছে কি না, তা স্পষ্ট নয়।
সিরিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, স্থানীয় সময় শুক্রবার ভোরে দেশটির দক্ষিণাঞ্চলে একটি বিমান প্রতিরক্ষা সাইটে ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হেনেছে। এই হামলার পেছনে যুক্ত থাকার কথা নিশ্চিত করেনি ইসরায়েল।
ইসফাহানকে কেন টার্গেট করা হলো?
ইরানের কেন্দ্রস্থলে এক বিশাল এলাকা ইসফাহান প্রদেশ। এ প্রদেশের নাম রাখা হয়েছে এর বৃহত্তম শহরের নামানুসারে।
এ অঞ্চলে একটি বড় বিমানঘাঁটি, একটি বড় ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদন কমপ্লেক্স এবং বেশ কয়েকটি পারমাণবিক স্থাপনাসহ উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ইরানি সামরিক অবকাঠামো রয়েছে।
ইরান ইসরায়েলে শত শত ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন ছোড়ার এক সপ্তাহেরও কম সময়ের মধ্যে এই পাল্টা হামলা চালানো হয়েছে। এতে দুদেশের মধ্যে উত্তেজনা নাটকীয়ভাবে বেড়ে গেছে।
ব্যাপক পরিসরে আক্রমণ চালালেও যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও অন্য মিত্রদের সহায়তায় ইরানের বেশিরভাগ ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন ঠেকিয়ে দেয় ইসরায়েলি বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা।
গত ১ এপ্রিল সিরিয়ায় ইরানের কনস্যুলেটে হামলার প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েলের মাটিতে এই নজিরবিহীন আক্রমণ চালায় তেহরান।
ওই হামলার পেছনে থাকার কথা ইসরায়েল আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করেনি। তবে প্রায় সবারই ধারণা যে হামলাটির জন্য ইসরায়েলই দায়ী।
এ ঘটনায় কি ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে উত্তেজনা বাড়বে?
সর্বশেষ এই হামলার সম্পূর্ণ তাৎপর্য এখনও পুরোপুরি স্পষ্ট হয়নি। ইরান প্রতিক্রিয়া জানাবে কি না, তা-ও এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
বিবিসির নিরাপত্তা সংবাদদাতা ফ্রাঙ্ক গার্ডেনার শুক্রবারের হামলার মাত্রাকে 'সীমিত, প্রায় প্রতীকী' বলে অভিহিত করেছেন। তার মতে, সংঘাত যেন আর না এগোয়, তা নিশ্চিত করার জন্য সেভাবেই হামলা চালানো হয়েছে।
বিবিসির আন্তর্জাতিক সম্পাদক জেরেমি বোয়েনের মতে, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে ইরানের বিরুদ্ধে পিছু হটার জন্য তার নিজের কয়েকজন জেনারেল ও রাজনৈতিক মিত্রই চাপ দেবেন।
দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা প্রক্সি যুদ্ধকে সরাসরি সংঘাতে পরিণত করবে, এমন কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য পশ্চিমা মিত্রদের কাছ থেকে ব্যাপক আন্তর্জাতিক চাপের মধ্যে রয়েছে ইসরায়েল।
গাজায় যখন ইরান-সমর্থিত হামাসের বিরুদ্ধে লড়াই করছে, সেই যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে এই বৈরিতা আরও বড় আকারে ছড়িয়ে পড়ল।
ইসরায়েল ও সারা বিশ্ব কী প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে?
ইসরায়েলের ভেতর থেকে আসা কিছু প্রতিক্রিয়া দেশটির রাজনৈতিক বিভাজন তুলে ধরেছে।
কট্টর জাতীয়তাবাদী নিরাপত্তামন্ত্রী বেন ভির ইরানের ওপর হামলাকে 'দুর্বল' বা 'খোঁড়া' বলে অভিহিত করেছেন।
এর প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েলের বিরোধীদলীয় নেতা ইয়ার লাপিদ তাকে বরখাস্ত করার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, ভিরের মন্তব্য ইসরাইলকে উপহাস ও বিব্রত করেছে।
যুক্তরাজ্য সরকার বলেছে, হামলা সম্পর্কে না জেনে তারা কোনো মন্তব্য করবে না। তবে ইসরায়েলের 'আত্মরক্ষার অধিকার চর্চা করার' পাশাপাশি 'উত্তেজনা বৃদ্ধি' এড়ানো উচিত।
ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ফন ডার লিয়েন সব পক্ষকে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন।
বিশ্ব অর্থনীতিতে কেমন প্রতিক্রিয়া হয়েছে?
মধ্যপ্রাচ্যে ক্রমবর্ধমান সংঘাতে তেল সরবরাহ ব্যাহত হতে পারে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।
হামলার পর তেলের দামের আন্তর্জাতিক বেঞ্চমার্ক ব্রেন্ট ক্রুডের দাম ১.৮ শতাংশ বেড়ে প্রতি ব্যারেল ৮৮ ডলারে পৌঁছেছে।
তেলের দাম প্রথমে ৩.৫ শতাংশ বেড়ে গিয়েছিল। কিন্তু হামলা সীমিত আকারে হয়েছিল, তা স্পষ্ট হওয়ার পর দাম ফের স্থিতিশীল হয়েছে।
অন্যদিকে সোনার দাম রেকর্ড ছোঁয়ার প্রায় কাছাকাছি গিয়ে বর্তমানে আউন্সপ্রতি ২ হাজার ৪০০ ডলারে পৌঁছেছে।