অলস পড়ে আছে দেশের প্রথম বেসরকারি কন্টেইনার টার্মিনাল
মুন্সিগঞ্জের মুক্তারপুরে ধলেশ্বরী নদীর তীরে তৈরি বেসরকারিখাতে দেশের প্রথম ইনল্যান্ড ওয়াটার কন্টেইনার টার্মিনাল থেকে ঢাকার কারখানাগুলোতে এক ট্রাক দিয়ে রাতের মধ্যেই তিনবার কন্টেইনার আনা-নেয়া করা সম্ভব। নারায়ণগঞ্জের একদম কাছে, ধলেশ্বরী নদীর তীরে গড়ে উঠা এই টার্মিনাল থেকে চট্টগ্রামে কন্টেইনার আনা-নেওয়াও সময়সাশ্রয়ী।
২৪ ঘন্টার মধ্যে আমদানি পণ্য খালাসের ব্যবস্থা, আমদানি-রপ্তানির কন্টেইনার চট্টগ্রাম বন্দরে দ্রুত পৌঁছে দিতে ডেডিকেটেড শিপ, বন্ডেডওয়্যার হাউজ সুবিধা ও কাস্টমস ফ্যাসালিটিসহ পূর্ণাঙ্গ একটি বন্দরের সব সুবিধা নিয়ে প্রস্তুত থাকলেও আমদানি-রপ্তানিকারকদের আকৃষ্ট করতে পারছে না বন্দরটি। ৪০০ জনবলের মধ্যে সেখানে এখন কাজ করছে মাত্র ৪৮জন।
২০১৬ সালে ৪০০ কোটি টাকা ব্যয়ে 'সামিট অ্যালায়েন্স পোর্ট লিমিটেড' নামের বন্দরটি গড়ে তোলে সামিট গ্রুপ।
চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরের ওপর চাপ কমানো এবং সড়ক পথে কন্টেইনার পরিবহনে আমদানি-রপ্তানিকারকদের বাড়তি সময় ও ব্যয় কমাতে ২০১৩ সালে 'বেসরকারি উদ্যোগে অভ্যন্তরীণ নৌ-কন্টেইনার টার্মিনাল নির্মাণ ও পরিচালনা নির্দেশিকা' জারি করে সরকার।
ব্যবসা-বাণিজ্যের গতি, ল্যান্ডিং ও শিপিং সুবিধা বাড়ানোর মাধ্যমে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে গতিশীলতা সৃষ্টি এবং ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা কাজে লাগাতে বেসরকারি খাতকে টার্মিনাল নির্মাণে সম্পৃক্ত করার কথা বলা হয় তাতে।
২০১৩ সালে দেশের দুই সমুদ্রবন্দরের মাধ্যমে ১৫ লাখ টিইইউস কন্টেইনার পণ্য আমদানি-রপ্তানি হয়েছে, যার পুরোটাই সড়ক ও রেলপথে চলাচল করেছে। গত অর্থবছরে (২০১৯-২০) তা বেড়ে প্রায় ২৯ লাখ টিইইউস হয়েছে।
কিন্তু চট্টগ্রাম বন্দরে মাঝে মাঝেই তৈরি হওয়া কন্টেইনার জট, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যানজটের ভোগান্তি, বাড়তি পরিবহন ব্যয় সত্বেও নদীপথে মুক্তারপুরের সামিটের টার্মিনাল পোর্ট ব্যবহারে আমদানি-রপ্তানিকারকদের আগ্রহ কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বাড়েনি।
সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, বেসরকারি আইসিডিতে কোন ধরনের মিসডিক্লারেশনের সুযোগ না থাকা এই পোর্ট ব্যবহারে অনাগ্রহের বড় কারণগুলোর একটি। সরকারি বন্দরে অনেক সময় পণ্যের পরিমাণ কম দেখানো যায়, এক পণ্যের নামে অন্য পণ্য আমদানি করেও কম শুল্ক দিয়ে খালাস করার অবৈধ সুযোগ থাকে।
ঘুষের বিনিময়ে আমদানিকারকদের অনেকেই এ সুযোগ নিয়েও থাকেন। বেসরকারি আইসিডিতে নজরধারী বেশি থাকায় তা সম্ভব নয়। ফলে আমদানিকারকদের বেসরকারি বন্দর ব্যবহারে আগ্রহও কম।
অন্যদিকে, রপ্তানি পণ্যের কন্টেইনার সময়মত চট্টগ্রাম বন্দরের বর্হিনোঙ্গরের মাদারভেসেলে পৌঁছানোর তাগিদ থেকে এ টার্মিনাল ব্যবহারে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না রপ্তানিকারকরা। তারা বলছেন, প্রতিদিন সামিটের টার্মিনাল থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে কন্টেইনারবাহী জাহাজ চলাচল করলে এখান থেকে রপ্তানি করা সম্ভব হবে।
গত নভেম্বরে বাল্ক ও ব্রেক বাল্ক (নন-কন্টেইনারাইজড) আমদানি-রপ্তানি পণ্য হ্যান্ডেলিংয়ের অনুমোদন পাওয়ায় এবং বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে বিদ্যমান নৌ-প্রটোকল চুক্তি 'প্রটোকল অন ইনল্যান্ড ওয়াটার ট্রানজিট এন্ড ট্রেড'-এর আওতায় পূর্ণাঙ্গ পোর্ট অব কল হিসেবে ঘোষিত হওয়ায় আগামী জানুয়ারি থেকে বড় সম্ভাবনার স্বপ্ন দেখছে সামিট।
ভারত থেকে আমদানি হওয়া শিল্পের কাঁচামাল ও ভোগ্যপণ্যের বড় অংশই আমদানি হয় বাল্ক ও ব্রেক বাল্ক আকারে। বেনাপোল বন্দরে পণ্যবাহী ট্রাক লম্বা সময় আটকে থাকে। দুদেশের মধ্যে সৃষ্ট জটিলতায় মাঝে মাঝেই এ বন্দর অচল থাকে। বিকল্প হিসেবে মুক্তারপুর দিয়ে নৌপথে ভারতের সঙ্গে আমদানি কার্যক্রম অনেক সহজ হবে।
মুক্তারপুর আইসিডির চিফ অপারেটিং অফিসার আবদুল হাকিম বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'আমাদের সক্ষমতার এক শতাংশও এখন পর্যন্ত ব্যবহার হচ্ছে না। তবে আগামী বছর থেকে আমরা বড় সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছি।'
তিনি জানান, 'ডিবিএল গ্রুপ, বাদশা গ্রুপ, আকিজ ফুড, তমা স্টিলসহ বেশকিছু প্রতিষ্ঠান এই বন্দর ব্যবহার করে আমদানি করছে। ডেমকো, মাস্কস, এমএনএস, মাইকেল কস পণ্য রপ্তানি করছে। আশা করছি, আগামী এক বছরের মধ্যে ব্রেক ইভেনে পৌঁছা সম্ভব হবে। ভবিষ্যতে বন্দর সম্প্রসারণের জন্য আরো প্রায় ১৪ একর জমি কিনে রাখা হয়েছে।'
তিনি বলেন, 'বড় প্রত্যাশা নিয়ে শুরু করেছিলাম আমরা। কিন্তু উদ্যোক্তারা আগে থেকে যে যেভাবে ব্যবসা করে অভ্যস্ত, তারা সেটা থেকে বের হতে আগ্রহী হচ্ছে না। এখনো মাসে মাসে বিশাল লোকসান গুণতে হচ্ছে।'
তবে ভবিষ্যত সম্ভাবনাময় বলে মনে করছেন তিনি। জানান, 'একসময় বন্দর ব্যবহার করতে যাদের আমরা অনুরোধের পর অনুরোধ করে যেতাম, এখন তারাই নিজেরাই যোগাযোগ শুরু করেছে। ফ্রেইট ফরোয়ার্ডারদেরও অনেকে যোগাযোগ করছে।'
নিটওয়্যার শিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর প্রথম সহ-সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম টিবিএসকে বলেন, মুক্তারপুর বন্দর নারায়ণগঞ্জের আমদানি-রপ্তানিকারকদের জন্য খুবই কাজে লাগবে। তবে বন্দর কর্তৃপক্ষকে এটি নিশ্চিত করতে হবে, রপ্তানি পণ্যের কন্টেইনার নিয়ে প্রতিদিন চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ যাবে।
তিনি বলেন, 'রপ্তানির ক্ষেত্রে লিড টাইম মেইনটেইন করতে হয়। কন্টেইনার পাঠাতে কয়েক ঘন্টা দেরি হলে চট্টগ্রামে মাদার ভেসেল মিস হওয়ার আশঙ্কা থাকে। সেক্ষেত্রে ওই পণ্য চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ফেরত আনতে হবে।'
সামিট অ্যালায়েন্স পোর্টের কর্মকর্তারা জানান, চট্টগ্রাম বন্দর ও মুক্তারপুরের মধ্যে জরুরি আমদানি-রপ্তানি পণ্যের কন্টেইনার পরিবহনের জন্য তারা একটি শিপ কিনেছেন। আরো একটি শিপ কেনার অনুমতি সরকার থেকে নিয়ে রাখা হয়েছে। বন্দরের ব্যবহার বাড়লেই নতুন শিপ কেনা হবে। এছাড়া, চট্টগ্রাম-মুন্সিগঞ্জ নৌ রুটে প্রতিদিন বিভিন্ন শিপিং লাইনের ১৪টি জাহাজ চলাচল করে।
২০১৩ সালে নৌ মন্ত্রণালয় নির্দেশিকা জারির পর বেসরকারিখাতে বন্দর স্থাপন উন্মুক্ত করার পর সামিট, একে খান, রূপায়ন গ্রুপ, আনন্দ শিপইয়ার্ড ও কুমুদিনি ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট বেসরকারি উদ্যোগে বন্দর স্থাপনের লাইসেন্স পায়।
এদের মধ্যে শুধু সামিট বন্দর স্থাপন করেছে। বাকিদের মধ্যে একে খান গ্রুপ নরসিংদীর পলাশে এবং কুমুদিনি নারায়ণগঞ্জের কানপুরে বন্দর স্থাপনের জন্য জমি কিনে রাখলেও কাজ শুরু করেনি। সামিটের বন্দরের ব্যবসায়িক সফলতা বিশ্লেষণ করে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিতে আগ্রহী তারা।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, ৪০ টন ওজনের কন্টেইনার হ্যান্ডেলিংয়ে সক্ষম চারটি ক্রেন; আমদানি, রপ্তানি ও নিলামযোগ্য পণ্য রাখার বিশাল ওয়্যারহাউজ ও পণ্যের কায়িক পরীক্ষার আধুনিক আয়োজনসহ আধুনিক বন্দরের সব প্রস্তুতি নিয়ে অনেকটা ফাঁকা পড়ে আছে ১৫ একরেরও বেশি জমিতে গড়ে উঠা বন্দরটি।
জেটিতে আমদানি-রপ্তানি পণ্যবাহী জাহাজ না ভেড়ায় কাস্টমস কর্মকর্তাদের কেউই উপস্থিত নেই। আব্দুল হাকিম জানান, কোন জাহাজ ভেড়ার খবর মোবাইল ফোনে দেয়া মাত্রই পৌঁছে যান কাস্টমস কর্মকর্তারা। ২৪ ঘন্টার মধ্যে কোন হয়রানি, বাড়তি খরচ ছাড়াই আমদানি পণ্যের কন্টেইনার খালাস হয় এখান থেকে।
সামিট গ্রুপের কর্মকর্তারা জানান, লাইসেন্স পাওয়ার পর বন্দর স্থাপনে সরকারের ৩৭টি সংস্থার অনুমোদন পেতে অনেক সময় লেগেছে। ২০১৬ সালে টার্মিনালটি যখন পুরোপুরি অপারেশনের জন্য প্রস্তুত তখন বেসরকারি আইসিটির কাস্টমস বন্ড লাইসেন্স নীতিমালা জারি করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড।
তাতে শুরুতে শতভাগ রপ্তানি পণ্যের কন্টেইনার হ্যান্ডেলিংসহ চাল, গম, আটা, বিটুমিন, সিমেন্ট ক্লিংকার, সয়াবিন, কটনসহ ২০টি আমদানি পণ্যের কন্টেইনার হ্যান্ডেলিং করার অনুমোদন দেয়ার কথা বলা হয়।
আমদানি পণ্য সংখ্যা বাড়ানোর আবেদন করলে পরের বছর সার, চিনি, মার্বেল স্টোনসহ ১৯টি পণ্যের কন্টেইনার হ্যান্ডেলিংয়ের অনুমতি পাওয়া যায়। ২০১৮ সালের জুলাই মাসে সামিট সব ধরণের পণ্যের কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়র সুবিধা চেয়ে আবেদন করলে নভেম্বরে তা অনুমোদন পায়। আর গত নভেম্বরে বাল্ক ও ব্রেক বাল্ক (কন্টেইনারে আমদানি হয় না এমন পণ্য) হ্যান্ডেলিংয়ের অনুমতি মিলেছে।
বন্দরের সক্ষমতা পুরোপুরি কাজে লাগাতে ভারতের সঙ্গে নৌ বাণিজ্যে পোর্ট অব কল হিসেবে অন্তর্ভূক্ত হওয়ার চেষ্টা করতে থাকে সামিট। গতবছর ডিসেম্বরে বাংলাদেশ-ভারত নৌ সচিব পর্যায়ে বৈঠক থেকে অন্তর্ভুক্তির ঘোষণা আসে।
এরপর বন্দরটির ব্যবহার যখন বাড়তে শুরু করে, তখনই দেশে শুরু হয় কোভিড সংক্রমণ। কমতে থাকে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ব্যবসায়ীরা আবার এই বন্দর ব্যবহার করবেন বলে আশাবাদী মুক্তারপুর টার্মিনালের কর্মকর্তারা। তবে এক্ষেত্রে সরকারের পলিসি সহায়তা প্রয়োজন বলে মনে করছেন তারা।
ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জভিত্তিক উদ্যোক্তাদের বহির্বানিজ্যের একটি অংশ পানগাঁও এবং মুক্তারপুর আইসিডির মাধ্যমে বাধ্যতামুলক করার নীতি সরকার গ্রহণ করলে এসব বন্দরের সক্ষমতার পুরোটা ব্যবহার হবে জানিয়ে হাকিম বলেন, এর আগে র কটন আমদানির ২০ শতাংশ পানগাঁও দিয়ে খালাস করার কথা বলেছিল সরকার। কিন্তু তা কার্যকর করতে পারেনি। এক্ষেত্রে বন্দর ব্যবহারকারীদেরও উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
এই পোর্ট ব্যবহারে পরিবহন সুবিধার ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি হাকিম বলেন, রাতে গাজীপুর থেকে মুক্তারপুরে একটি ট্রাক আসতে ২ ঘন্টার বেশি সময় লাগে না। ঢাকা থেকে একটি ট্রাক রাতের মধ্যেই তিনবার আসা-যাওয়া করতে পারে।
তিনি জানান, নারায়ণগঞ্জের প্রবেশমুখ পঞ্চবটি থেকে মুক্তারপুর পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ প্রকল্প অনুমোদন পেয়েছে। এটি হলে কন্টেইনার আনা-নেওয়া আরো সহজ হবে।
দেশের অভ্যন্তরে জাহাজে পণ্য পরিবহনে নৌ মন্ত্রণালয় যে ভাড়া নির্ধারণ করেছে, তা অনেক বেশি বলে জানান আব্দুল হাকিম। তিনি বলেন, শিপিংলাইনগুলো নির্ধারিত ভাড়ার চেয়েও বেশি নিচ্ছে। সিঙ্গাপুর থেকে চট্টগ্রাম বন্দর পর্যন্ত একটি কন্টেইনার পরিবহনে ভাড়া লাগে ২০০ ডলার, আর চট্টগ্রাম থেকে মুক্তারপুর আসতে খরচ হয় ৩৫০-৪০০ ডলার। তা সত্বেও চট্টগ্রাম থেকে সড়ক পথে কন্টেইনার পরিবহনের তুলনায় নদীপথে পরিবহন খরচ প্রায় অর্ধেক।
পরিকল্পনা কমিশনের সাম্প্রতিক এক স্টাডিতে বলা হয়েছে, সড়ক পথে প্রতিটন পণ্য পরিবহনে কিলোমিটার প্রতি খরচ হয় ৪.৫ টাকা, রেলপথে ২.৭৪ টাকা ও নৌপথে ০.৯৯ টাকা। তৈরি পোশাকখাতের ৯০ শতাংশ আমদানি-রপ্তানি হয় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মাধ্যমে। কোন কারণে এ সড়ক বন্ধ থাকলে ক্ষতিগ্রস্ত হয় পোশাক রপ্তানি।