করোনার দূরবস্থা কাটিয়ে চীন বিশ্বকে অর্থনীতির সত্যিকার উত্তরণ দেখিয়ে দিচ্ছে
করোনাভাইরাস সৃষ্ট দূরবস্থা থেকে অর্থনীতিকে বের করে আনার সফলতা বিশ্বকে দেখাতে চলেছে চীন। কোভিড মহামারির মধ্যে যেসব দেশ নতুন করে লকডাউনে পড়ার মতো অবস্থা এড়িয়ে চলতে চাইছে, তাদের সঙ্গে চীনের পার্থ্যকটাও স্পষ্ট হচ্ছে এর মধ্য দিয়ে।
অর্থনৈতিক উত্তরণের ব্যাপারটি নিশ্চিত হয়েছে চলতি ২০২০ অর্থবছরে চীনের তৃতীয় প্রান্তিকের ফল ঘোষণায়। জুলাই- সেপ্টেম্বরের তিন মাসের এ মেয়াদে দেশটি ৪.৯% প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। আজ সোমবার জিডিপি তথ্য ঘোষণা করা হয়।
প্রান্তিক প্রবৃদ্ধির কারণ হিসেবে নতুন বিনিয়োগ এবং চাঙ্গা রপ্তানি খাতের কথা উল্লেখ করা হয় আনুষ্ঠানিক ঘোষণায়।
সার্বিক বাজার অর্থনীতি এবং ভোক্তাচাহিদা শক্তিশালী হয়ে ওঠারও ইঙ্গিত পাওয়া যায়- দ্বিতীয় মেয়াদের ৩.২% অবস্থান থেকে উন্নতির তথ্যে। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় প্রান্তিক প্রবৃদ্ধি ছিল অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে ৬.৮% সঙ্কোচনের সম্পূর্ণ বিপরীত। এবং তা স্থবিরতা কাটিয়ে চীনা অর্থনীতির পূর্ণগতিতে ফেরার ইঙ্গিত।
ব্লুমবার্গের অর্থনীতিবিদেরা অবশ্য সাড়ে ৫% উচ্চ-প্রবৃদ্ধি অনুমান করেছিলেন। তা থেকে কম হলেও, কয়েক দশক পর প্রথম সঙ্কোচনের ঐতিহাসিক ঘটনা থেকে চীন যে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে, সেটাও কম বিস্ময়কর নয়।
বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনীতিটির উত্তরণে চালিকাশক্তি হয়েছে দেশটির আন্তর্জাতিক বাণিজ্য। তাছাড়া, স্থানীয় ভোক্তাদের মধ্যেও সঞ্চয় কমিয়ে খরচ বাড়ানোর প্রবণতা বাড়ছে। ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে সরকারের চমকপ্রদ সফলতা এ মনোভাবের প্রধান কারণ।
সরকারি সচেতনতার কারণে, প্রায়শ'ই দেখা দেওয়া গোষ্ঠীবদ্ধ সংক্রমণগুলো শনাক্ত করাও সম্ভব হচ্ছে।
দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক- পিপলস ব্যাংক অব চায়নার (পিবিওসি) গভর্নর ই-গ্যাং গত রোববার জি-৩০ জোট আয়োজিত এক ওয়েবিনারে অংশ নিয়েছেন।
এসময় তিনি বলেন, ''এই মুহূর্তে চীনে কোভিড-১৯ সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। স্থানীয় অর্থনীতি বিপর্যয় সহ্য করে এখন আরও বড় সম্ভাবনার আশা দেখাচ্ছে। চীনা অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর মধ্যে দিয়ে তা সার্বিকভাবে বিশ্ব অর্থনীতিকেও উদ্দীপ্ত করবে, বলে আমরা আশা করছি।''
ইউরোপ এবং বিশ্বের অন্যান্য স্থানে সংক্রমণ হার আবারও আশঙ্কাজনক। তাই আগামী দিনের সম্ভাবনাও অনেক মলিন। বিশেষ করে, উৎপাদন এবং রপ্তানির উপর নির্ভরশীল বড় অর্থনীতিগুলো রয়েছে চাপের মুখে। চীনের জন্যেও অবশ্য তা খারাপ খবর। কারণ, বৈশ্বিক রপ্তানি বাজার চাঙ্গা না হলে চীনের অগ্রগতির পথ খুব একটা সহজ হবে না।
তবে সেপ্টেম্বর মাসে শিল্পোৎপাদন, খুচরা পণ্য বিক্রি, বিনিয়োগ এবং কর্মসংস্থানের তথ্য এ বিষয়টি ভালো ব্যাখ্যা দিতে পারে।
আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় গত সেপ্টেম্বর নাগাদ সার্বিক জিডিপি'তে ১.২% বেশি মূল্য সংযোজন করেছে শিল্প প্রতিষ্ঠানসুমুহ। বাৎসরিক হিসাবে ওই মাসে সার্বিক উৎপাদন বাড়ে ৬.৯%, যা আগস্টের চাইতে ১.৩% পয়েন্ট বেশি। জাপানি আর্থিক খাত বিশ্লেষক সংস্থা- নোমুরা অবশ্য ৫.৭% পূর্বাভাস দিয়েছিল।
প্রান্তিক ফলাফল ঘোষণার পর নোমুরা জানিয়েছে, 'বিশ্ব বাজার চাহিদা কিছুটা স্তিমিত হয়ে পড়ার কারণে আগামী মাসগুলোতে চীনের শিল্পোৎপাদন প্রবৃদ্ধি আমরা ৬ শতাংশে নেমে আসার অনুমান করছি।'
বছরওয়ারি হিসাবে সেপ্টেম্বরে খুচরা পণ্য বিক্রির পরিমাণও ৩.৩% হারে বেড়েছে। আগস্টে যা দশমিক ৫% হয়েছিল। আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা একারণে তৃতীয় প্রান্তিকে ১.৬% প্রবৃদ্ধির অনুমান করেছিলেন। কিন্তু, দেখা যাচ্ছে এখানেও চীন প্রত্যাশার চাইতে ভালো ফল করেছে। নোমুরা অবশ্য ৩% প্রবৃদ্ধির আভাস দিয়েছিল এ খাতে।
এর আগে জানুয়ারিতে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছিল চীনের খুচরা পণ্য বিক্রিবাট্টা। ওই সময় তা ৭.২% মারাত্মক সংকোচনের শিকার হয়।
অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে (জানুয়ারি- আগস্ট) স্থায়ী সম্পদে বিনিয়োগ দশমিক ৩ শতাংশে নেমে এসেছিল। তৃতীয় প্রান্তিক শেষে এটি দশমিক ৮ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।
এব্যাপারে রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম সিজিটিএন'কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে পিবিওসি গভর্নর ই-গ্যাং বলেন, '' তৃতীয় প্রান্তিকে কিছু শহরে করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ আঘাত হানে। এতে কিছু সংখ্যক সংক্রমণের ঘটনাও ঘটেছে। তবে খুব দ্রুতই নিয়ন্ত্রণে আনার কারণে বেসরকারি বিনিয়োগে নতুন গতি আসে। চীনে মহামারি নিয়ন্ত্রণে আছে এমন বিশ্বাস থেকেই পুঁজি লগ্নি বাড়ান বিনিয়োগকারীরা।''
নোমুরার অনুমান, চীন সরকার অবকাঠামো খাতে আরও বরাদ্দ দেবে। ইতোপূর্বে, ছাড়া সরকারি বন্ড বিক্রির অর্থ থেকে খরচ বৃদ্ধি করা হবে। তবে উৎপাদন খাতে বিনিয়োগ এখনও কম এবং চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের উত্তেজনার কারণে- তা অনিশ্চিত অবস্থায় রয়েছে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি।
সেপ্টেম্বরে শহরাঞ্চলে বেকারত্বের হার কমে ৫.৪% নেমে আসে। এর আগে জানুয়ারি- আগস্ট নাগাদ ৭৮ লাখের বেশি নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির দাবি করেছিল সরকারি তথ্য-উপাত্ত।
এনিয়ে অবশ্য আশা প্রকাশ করে চীনা প্রধানমন্ত্রী লি কেকিয়াং বলেছেন, ''শহরাঞ্চলে বার্ষিক ৯০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হওয়া দরকার। এই লক্ষ্যটি আমরা চলতি বছর পূরণ করতে পারব বলেই আশা করছি।''
ব্লুমবার্গের এশীয় অর্থনীতির প্রধান বিশেষজ্ঞ চ্যাং-সু আশা করেন, '' ভোক্তাদের মধ্যে অর্থনীতি নিয়ে আস্থা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেসরকারি খাতে চাহিদা আরও শক্তিশালী রূপ নেবে। ঋণ সঞ্চালনের গতি ইতোমধ্যেই বাজার চাহিদা বাড়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে। একারণে, উৎপাদনে নতুন গতি যুক্ত হয়ে বছর শেষে সার্বিক অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে।''
- সূত্র: ব্লুমবার্গ, সিজিটিএন