পণ্য ওঠানামা হলেও পরিবহন বন্ধ, কন্টেইনার জটের শঙ্কা
জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির ফলে পরিবহন মালিকদের ভাড়া বৃদ্ধির দাবিতে চলমান ধর্মঘটের কারণে বেসরকারী কনটেইনার ডিপোগুলো (আইসিডি) থেকে বন্দরে প্রবেশ করছে না রপ্তানি পণ্যবাহী কন্টেইনার। বন্দর থেকেও ডেলিভারি হচ্ছে না আমদানি পণ্য।
এতে চট্টগ্রাম বন্দরে কন্টেইনার জটের পাশাপাশি সঠিক সময়ে বিদেশি ক্রেতাদের কাছে রপ্তানি পণ্য পৌঁছানো নিয়ে তৈরী হয়েছে শঙ্কা।
পরিবহন ধর্মঘটের কারণে চট্টগ্রাম বন্দরে প্রবেশ করছে না পণ্যবাহী কোন গাড়ি। বন্দর থেকেও পণ্য ডেলিভারি বন্ধ রয়েছে। বন্দরে পণ্য আটকা পড়ায় কারখানাগুলোতে উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
চট্টগ্রাম সিএন্ডএফ এজেন্টস এসোসিয়েশনের ফাস্ট জয়েন্ট জেনারেল সেক্রেটারি কাজী মাহমুদ ইমাম বিলু বলেন, "শুক্রবার পণ্য পরিবহন বন্ধ থাকায় আমদানিকারকরা পণ্য ডেলিভারি নিতে পারেনি। শনিবারও ডেলিভারি নেওয়া যাচ্ছে না। আগামীকাল রোববারও যদি ধর্মঘট অব্যাহত থাকে তাহলে চট্টগ্রাম বন্দরে ১০ হাজার থেকে ১২ হাজার কন্টেইনারের জট তৈরী হবে।"
তিনি আরো বলেন, "এর আগেও পরিবহন শ্রমিকদের বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে বন্দর থেকে পণ্য ডেলিভারি বন্ধ ছিলো। এভাবে কিছু দিন পরপর এসব কর্মসূচী দেওয়া হলে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়। দেশের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়ে। তাই ধর্মঘট নয়, যথাযথ কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনার ভিত্তিতে সংগঠনগুলো তাদের দাবি আদায় করতে পারে।"
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মোঃ ওমর ফারুক বলেন, "ধর্মঘটের কারণে পণ্য ডেলিভারি বন্ধ রয়েছে। চার নভেম্বর পর্যন্ত বন্দরে ৩৪ হাজার ৭৩৮ টিইইউএস কন্টেইনার ছিলো। ৫ নভেম্বর এই সংখ্যা আরো ২ হাজার বাড়তে পারে।"
রপ্তানি পণ্য বন্দরে না আসায় জাহাজ জেটিতে অপেক্ষা করছে কিনা বা পণ্য না নিয়ে বন্দর ত্যাগ করার ঘটনা ঘটেছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, "এই তথ্য পরে জেনে বলতে হবে। তবে বন্দরের ভেতরে জাহাজ থেকে পণ্য ওঠানামা স্বাভাবিক রয়েছে।"
এদিকে ধর্মঘটের কারণে বন্দরে পণ্য ডেলিভারি বন্ধ হয়ে গেলেও এখনো শুল্কায়নে তেমন প্রভাব পড়েনি চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে। খোলার দিনগুলোতে প্রতিদিন ৭ হাজার বিল এব এন্ট্রি দাখিল হয়। এর মধ্যে ৫ হাজার রপ্তানি পণ্যের এবং বাকি ২ হাজার বিল এব এন্ট্রি আমদানি পণ্যের। শুক্র ও শনিবার বিল অব এন্ট্রি দাখিলের পরিমাণ তুলনামূলক কম হয়। রবিবার এই কর্মসূচী অব্যাহত থাকলে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসেও এর নেতিবাচক প্রভাব দেখা দেবে।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের ডেপুটি কমিশনার (প্রিভেনশন) সালাহউদ্দিন রিজভি বলেন, "পরিবহন ধর্মঘটের কারণে বন্দরে পণ্য ডেলিভারি হলেও চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে শুল্কায়নে এর কোন প্রভাব শনিবার সকাল পর্যন্ত পড়েনি। ধর্মঘট স্থায়ী হলে এর প্রভাব কাস্টম হাউসে পড়তে পারে।"
এদিকে গণপরিবহন বন্ধ থাকায় চট্টগ্রাম নগরীতে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন যাত্রীরা। দূরপাল্লার বাস টার্মিনাল এলাকাগুলোতে দেখা গেছে যাত্রীদের আনাগোনা। গণপরিবহন না চলায় সিএনজি অটোরিকশা, রিকশা, মোটরসাইকেলে দুই থেকে তিনগুণ ভাড়া দিয়ে যাত্রীদের গন্তব্যে যেতে হয়েছে।
শুক্রবারের চেয়ে শনিবার এই দুর্ভোগ আরো বাড়ে। শনিবার সকাল থেকেই অফিসগামী যাত্রীদের পোহাতে হয়েছে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ। নগরীর বিভিন্ন মোড়ে দেখা গেছে হাজারো অফিসগামী যাত্রীদের জটলা। গাড়ি না পেয়ে অনেকেই পায়ে হেঁটে গেছেন গন্তব্যে। এদিকে পোশাক শিল্প কারখানার শ্রমিকদের কারখানায় যেতে বাধা দিয়েছে পরিবহন শ্রমিকরা।
বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সহ-সভাপতি রাকিবুল আলম চৌধুরী জানান, চট্টগ্রামে ৩টি ইপিজেড সহ বিভিন্ন পোশাক কারখানার শ্রমিক পরিবহনে ভাড়ার ভিত্তিতে প্রায় ৪ হাজার বাস চলাচল করে। শনিবার সকালে কারখানার শ্রমিকরা নিজেদের কর্মস্থলে যেতে চাইলে পরিবহন শ্রমিকরা বাধা দেয়। নগরীর বহদ্দারহাট, দেওয়ানহাট, টাইগার পাস, অলংকার, আগ্রাবাদ সহ বিভিন্ন মোড়ে পরিবহন শ্রমিকদের সাথে গার্মেন্টস কর্মীদের মধ্যে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে। শ্রমিকরা কারখানায় পৌঁছাতে না পারায় শনিবার উৎপাদন শুরু করা যায়নি।
আইসিডিতে আটকা পড়েছে রপ্তানি পণ্য
ধর্মঘটের কারণে ১৯টি বেসরকারী আইসিডি থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে প্রবেশ করছে না রপ্তানি পণ্যবাহী কন্টেইনার। প্রতিদিন প্রায় ২ হাজার রপ্তানি পণ্যবাহী কন্টেইনার প্রবেশ করে বন্দরে। শুক্রবার কিছু পণ্য বন্দরে প্রবেশ করলেও শনিবার রপ্তানি পণ্য যায়নি বন্দরে। এর ফলে নির্দিষ্ট গন্তব্যে রপ্তানি পণ্য পৌঁছানো নিয়ে শঙ্কা তৈরী হয়েছে।
আইসিডি মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো অ্যাসোসিয়েশনের (বিকডা) মহাসচিব রুহুল আমিন শিকদার বলেন, প্রতিদিন চট্টগ্রাম বন্দর থেকে রপ্তানি, আমদানি পণ্যবাহী এবং খালি কন্টেইনার পরিবহনে ১৯টি আইসিডি থেকে প্রায় ৫ হাজার গাড়ি বন্দরে যাতায়াত করে। শুক্রবার প্রায় ২ হাজার গাড়ি যাতায়াত করেছিলো। শনিবার সকাল সাড়ে ১১টা পর্যন্ত একটি গাড়িও যাতায়াত করেনি।
তিনি আরো বলেন, আইসিডিগুলোর কন্টেইনার ধারণ ক্ষমতা ৭৮ হাজার ৭০০ টিইইউস। শনিবার পর্যন্ত আইসিড়িগুলোতে কন্টেইনার ছিলো প্রায় ৫১ হাজার। ধর্মঘট ৩ থেকে ৪ দিন স্থায়ী হলে আইসিডিগুলোতে জট সৃষ্টি হবে।
বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস এসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ বলেন, "বন্দরের হুক পয়েন্টে রপ্তানি পণ্যবাহী কন্টেইনার না এলে সময়মতো জাহাজ বন্দর ছেড়ে যেতে পারবে না। অথবা রপ্তানি পণ্য না নিয়েই বন্দর ত্যাগ করবে জাহাজ। সময়মতো জেটি থেকে জাহাজ বন্দর ত্যাগ না করলে বহির্নোঙ্গরে জাহাজের অপেক্ষমাণ সময় বাড়বে। এতে ১ দিন বেশি অপেক্ষার জন্য একটি জাহাজকে আকারভেদে ১০ হাজার থেকে ১২ হাজার ডলার জরিমানা গুনতে হবে। অন্যদিকে রপ্তানি পণ্য না নিয়ে জাহাজ ছেড়ে গেলে নির্ধারিত সময়ে বিদেশী ক্রেতার হাতে পণ্য পৌঁছানো যাবে না। এতে আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি হতে হবে রপ্তানিকারকদের।"
এদিকে পরিবহন ধর্মঘটের কারণে দেশের বৃহৎ পাইকারি পণ্যের বাজার খাতুনগঞ্জে প্রবেশ করছে না পণ্যবাহী কোন গাড়ি। ধর্মঘট স্থায়ী হলে পণ্যমূল্যের দাম বেড়ে যেতে পারে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।
চট্টগ্রাম ডাল মিল ব্যবসায়ী সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক বলেন, "খাতুনগঞ্জ চাক্তাই বাজারে প্রতিদিন পণ্যবাহী ৩০০টি গাড়ি প্রবেশ করে। শুক্রবার ৫০টি গাড়ি প্রবেশ করে। শনিবার পণ্য নিয়ে কোন গাড়িই প্রবেশ করেনি। গুদামে যে পণ্য রয়েছে তা দিয়ে আরো দুয়েকদিন বাজার স্বাভাবিক থাকবে। এর মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে পণ্যের দাম বেড়ে যেতে পারে।"