বগুড়ায় বন্যায় ফসলের ক্ষতি পৌনে ১০০ কোটি টাকা
বগুড়ায় এবার বন্যায় প্রায় পৌনে ১০০ কোটি টাকার ফসলের ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে শুধু সারিয়াকান্দি উপজেলায় ক্ষতি হয়েছে ৬৮ কোটি টাকা। সোনাতলা আর ধুনট মিলে ফসলের ক্ষতি হয়েছে আরও ১৫ কোটি টাকা।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অফিস ও কৃষি কর্মকর্তারা বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য দিয়েছেন।
এবারের বন্যায় শুধু সারিয়াকান্দি উপজেলায় অন্তত ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়েছেন। উপজেলা কৃষি কার্যালয় বলছে, ওই উপজেলায় সাত হাজার ৫৩৫ হেক্টর জমি পানির নিচে তলিয়ে গেছে।
এর মধ্যে পাটের জমি পাঁচ হাজার ২০ হেক্টর, আউশ ধান দুই হাজার ৩৭৭ হেক্টর, শাক সবজি ৫৬, রোপা আমন বীজতলা ৬৫, মরিচ দুই ও ভুট্টা ১৫ হেক্টর জমি পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে।
এর মধ্যে বেশি ক্ষতি হয়েছে চালুয়াবাড়ি ইউনিয়নে। এরপর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কাজলা, কর্নিবাড়ি, বোহাইল, সারিয়াকান্দি সদর, চন্দনবাইশা, কুতুবপুর, কামালপুর ও হাটশেরপুর।
উপজেলার কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, বন্যায় এবার টাকার অংকে আউশের ক্ষতি হয়েছে ২৭ কোটি ৯৫ লাখ ৪৫ হাজার টাকা। পাটের ক্ষতি ৩৯ কোটি ৫১ লাখ ২০ হাজার, আমন বীজতলার ৪৬ লাখ ৫০ হাজার, শাক সবজি ৫৬ লাখ, ভুট্টা ১০ লাখ ৮০ হাজার, মরিচ সাত লাখ ৮০ হাজার টাকা। মোট ৬৮ কোটি ৬৭ লাখ ৭৮ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে।
চাষীরা বলছেন, এক বিঘা জমিতে পাট চাষ করতে অন্তত ১০ হাজার টাকা খরচ হয়। এর মধ্যে পাটের জমি তৈরি, বীজ রোপন, সার, শ্রমিকের খরচ রয়েছে।
চালুয়াবাড়ি ইউনিয়নের বিরামের পাঁচগাছী চরের বাসিন্দা বুলু মণ্ডল আড়াই বিঘা জমিতে পাট চাষ করেছিলেন। পাট কাটবেন বলে শ্রমিকও ঠিক করেছিলেন। কিন্তু হঠাৎ উজান থেকে আসা ঢলে তলিয়ে গেছে জমি।
বিরামের পাঁচগাছী চরের উত্তর দিকে একরের পর একর জমিতে পাট চাষ হয়। ওই জমিগুলো এখন তলিয়ে গেছে বানের পানিতে। গত মঙ্গলবার দুপুরে গিয়ে দেখা যায়, বিস্তীর্ণ এলাকায় মাঝে মধ্যে কোথাও পাটের পাতা কচুরিপানার মতো দেখা যাচ্ছে। নদীর বুক বেয়ে ভেসে যাচ্ছে পাট। প্রবল স্রোতের কারণে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে পাটের জাগ।
বিরামের চর থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার উত্তরে খাটিয়ামারি চর। এই চরের বাসিন্দা মো. আলমগীর। এবার পাঁচ বিঘা জমিতে পাট চাষ করেছিলেন তিনি। বন্যার কথা শুনে দুই বিঘা কেটে জাগ দিয়েছিলেন। আঁশ ছাড়ানোর আগেই ভেসে গেছে সেগুলো। বাকি দু'বিঘার পাট কাটা নিয়েও শঙ্কা রয়েছে তার।
আলমগীর জানান, ঢলের পানি বড় ধরনের সর্বনাশ করে গেলো। পানি নেমে গেলেও চাষীরা টাকার অভাবে চাষাবাদ করতে পারবেন না।
এই গ্রামের অন্তত ২০ জন বাসিন্দা জানান, পাট ভেসে যাওয়ায় অনেকে নিঃস্ব হয়েছেন। অনেক বর্গাচাষী চিন্তায় রয়েছেন সংসার চালানো নিয়ে।
ওই গ্রামের সাহেনা বেগম জানান, তিনি সাত হাজার টাকা করে দু'বিঘা জমি ইজারা নিয়েছিলেন। এবার পাটের ফলন ও দাম- দুটোই ভালো ছিল। স্বপ্ন ছিল আগামী বছর এবারের টাকা দিয়ে বেশি জমি ইজারা নেবেন। কিন্তু সেই স্বপ্ন কান্নায় রূপ নিল।
সারিয়াকান্দি উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আবদুল হালিম বলেন, এখন পাট কাটার মৌসুম নয়। পাটের বর্তমান বয়স ৬০ থেকে ৬৫ দিন। কিন্তু বন্যার কারণে অনেক কৃষক অপুষ্ট পাট কাটছেন। ফলে ভালো আঁশ বা ফলন পাবেন না।
তিনি আরও বলেন, পাট পরিপূর্ণ হতে সময় লাগে ৮৫ থেকে ৯৫ দিন। এর মধ্যে পাট কাটলে আঁশের পরিমাণ পাওয়া যায় ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ। কিন্তু এখন সেটা হচ্ছে না। লোকসান হচ্ছে চাষীদের। এখনকার পাট কাটলে ফলন বিঘা প্রতি অর্ধেকও পাবেন না। যেমন, কোনো জমিতে পরিপূর্ণ পাট হলে ফলন হয় ৯ মণ। কিন্তু সেটা এখন হচ্ছে চার থেকে পাঁচ মণ।
সারিয়াকান্দির বেশিরভাগ ইউনিয়ন যমুনা ও বাঙ্গালী নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা। এ কারণে ক্ষতিও বেশি। তবে বগুড়ার সোনাতলা ও ধুনট উপজেলার কৃষকরাও বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
সোনাতলা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাসুদ আহম্মেদ বলেন, এবারের বন্যায় সোনাতলায় এক হাজার ৪৫ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে পাকুল্লা, তেকানিচুকাইনগর বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আর আংশিক ক্ষতি হয়েছে মধুপুর, সোনাতলা, জোড়গাছা ইউনিয়নে। এসব এলাকায় পাট, আউশ আর শাক সবজি নিমজ্জিত হয়েছে। টাকার অংকে অন্তত ১৫ কোটি টাকার বেশি হবে বলে কৃষি কর্মকর্তারা জানান।
ধুনট উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মুশিদুল ইসলাম জানান, এবারে ধুনট উপজেলায় মোট ২৫১ হেক্টর জমি নিমজ্জিত হয়েছে। এর মধ্যে পাট ২২০ হেক্টর, আউশ ধান ২০, সবজি পাঁচ, অন্যান্য (আখ-কলা) পাঁচ, আমন বীজতলায় এক হেক্টর জমি বন্যার পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। এর মধ্যে বেশি ক্ষতি হয়েছে ভান্ডারবাড়ি ইউনিয়নে।
গত বছর বন্যায় বগুড়ায় ১২৬ কোটি টাকার সর্বোচ্চ ক্ষতি হয়েছে কৃষকের। ২০১৬ সালের বন্যায় ৪৯ কোটি টাকার ফসলের ক্ষতি হয়েছে। ২০১৫ সালে ফসলের ক্ষতি হয়েছে ১১ কোটি টাকার। সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যা হয়েছে ২০১৪ সালে। ওই বছর ৩৯৪ গ্রাম প্লাবিত হয়ে প্রায় চার লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ওই বছর শুধু ফসলহানি হয়েছে ১৫ কোটি টাকার।
বগুড়া জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দায়িত্বে থাকা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, জেলা প্রশিক্ষক কর্মকর্তা সামসুল ওয়াদুদের কাছে এ বছর বন্যায় ফসলের ক্ষতি সম্পর্কে জানতে চাইলে বলেন, এখন এই হিসাব পুরোপুরি বলা কঠিন। ক্ষতির বিবরণ পেতে আরও সময় লাগবে।