বাংলাদেশের চেয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে গরিব হওয়া মানতে পারছে না ভারত, ক্ষোভ ও অস্বীকারের মাতম
রূপকথার এক রানি ছিল জাদুবিদ্যার অধিকারী, আর দারুণ সৌন্দর্য সচেতন। রাজার মৃত্যুর পর সৎ কন্যা অপরূপ সুন্দরী 'স্নো হোয়াইট'কে দেখতে পারতো না মোটেই। তাই প্রতিদিন জাদুর আয়নাকে জিজ্ঞেস করতো। সবচেয়ে ফর্সা কে তার রাজ্যে। জাদুর আয়না প্রতিদিন তার কথাই বলতো। কিন্তু, স্নো হোয়াইটও তো বড় হচ্ছিল। একদিন সেই বেশি উজ্জ্বল হয়ে গেলো রূপে-গুণে, আর জাদুর আয়নাও সত্যি কথাটা বলে বসলো রানিকে।
তারপর পরশ্রীকাতর রানির প্রতিক্রিয়া কী ছিল, সেটা প্রায় সকলেরই জানা।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হয়, তখন অবশ্য জাদুর আয়নাকে জিজ্ঞাসা করার প্রয়োজন ছিল না। নিঃসন্দেহে বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল যুদ্ধবিধস্ত ভূখণ্ডটি। বাংলাদেশ আজও দরিদ্র দেশ হলেও অর্থনীতির কলেবর কিন্তু বেড়েই চলেছে।
২০১৯ সালে দেশটির প্রকৃত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশ ছাড়ায়। করোনাভাইরাস উৎপাত সেই গতি কমালেও অর্থনীতি বিকাশ চলতি ২০২০ এবং আগামী বছর ২০২১ সালে; ৪ শতাংশের মাঝারি হারে থাকবে, বলে পূর্বাভাস দিয়েছে আন্তর্জাতিক দাতা গোষ্ঠী।
বাংলাদেশে জিডিপি অনুসারে গড় মাথাপিছু আয় এখন ১,৮৮৮ মার্কিন ডলার। ফলে অতীতে ক্রান্তীয় আফ্রিকার যেসব অনুন্নত অতি-দরিদ্র রাষ্ট্রের সঙ্গে তুলনা করা হতো; নিঃসন্দেহে তাদের চাইতে অনেক এগিয়ে গেছে দেশটি।
বিকাশের ধারাবাহিক গতি নিয়ে এখন প্রতিবেশী ভারতের চাইতেও এক ধাপ এগিয়ে গেছে বাংলাদেশ- আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এর দেওয়া সাম্প্রতিক পূর্বাভাস সংশোধনীতে।
ঘোষণার পরপরই ক্ষোভ, পরস্পর অভিযোগ আর বিষয়টি মেনে নিতে নানা পারার; ঝড় শুরু হয় ভারতের সব গণমাধ্যমে। বাংলাদেশে অবশ্য প্রতিক্রিয়াটি ছিল অনেক হিসেবি।
চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত গণমাধ্যম অবশ্য বলছে, 'প্রতিবেশীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতে ভারত সরকারের ক্রমাগত অবহেলার কারণেই, দেশটির অবনতি হয়েছে।'
দক্ষিণ এশীয় রাজনীতিতে ওয়াশিংটন ভিত্তিক দাতা গোষ্ঠীর পূর্বাভাসের ভিত্তিতে এই যে ঝড়, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে কিন্তু তা খুব একটা প্রাধান্য পায়নি।
ব্লুমবার্গ কলামিস্ট অ্যান্ডি মুখার্জি বিষয়টি নিয়ে লিখেছেন। নিজ বিশ্লেষণে তিনি বাংলাদেশের মতো শ্রমঘন এবং সস্তায় পণ্য উৎপাদন ব্যবস্থা তৈরি না করার জন্য ভৎর্সনা করেন ভারতকেই। ওই লেখায় তিনি অর্থনীতিবিদ সৌমিত্র চ্যাটার্জি এবং অরবিন্দ শুভ্রামনিয়ামের এ সংক্রান্ত এক গবেষণার তথ্যও তুলে ধরেছেন।
ওই ব্যাখ্যার সঙ্গে আমি দ্বিমত পোষণ করছি। এবং উল্লেখিত গবেষণার বেশ কিছু ত্রুটিও আলোচনা করা দরকার।
ভারতীয় অর্থনীতির কলেবর স্বভাবতই সুবিশাল। বাংলাদেশের সব সস্তা শ্রমের মাধ্যমে উৎপাদিত রপ্তানি আয় ভারত নিয়ে নিলেও- তাতে দেশটির মোট উৎপাদন ও সেবা প্রবৃদ্ধি (জিডিপি) সামান্যই প্রভাবিত হতো। প্রকৃত অর্থে ভারতে কম মজুরির বেশি লোকের কর্মসংস্থানের দরকার নেই, কিন্তু সাধারণ কর্মীদের জন্য বেশি বেতন-ভাতা সুবিধা দরকার।
গ্রাম হোক বা শহরে সব কর্মীর জন্যই দরকার এমন ন্যায্যতা, শুধু ধনীদের আরও ধনী করে ভারতীয় অর্থনীতি বিকাশের ধারায় ফিরতে পারবে না। আর এজন্য আবশ্যক অর্থনীতির ফলপ্রসূ এবং গভীর সংস্কার।
এসব কথা বলার উদ্দেশ্য পাঠককে বাস্তবতার মুখোমুখি করা। ভারত জিডিপি'র যে আকার নিয়ে বিস্মিত, তা আসলে অত্যাশ্চর্য কিছু নয়। আইএমএফ বলছে, বাংলাদেশ চলতি ২০২০ অর্থবছরে ভারতের চাইতে মাথাপিছু মাত্র ১১.২০ ডলার বেশি উৎপাদন করবে। দুই দেশের অর্থনৈতিক কার্যক্রমকে মার্কিন ডলারের গড় বিনিময় দর অনুসারে তুলনা করে এবং দুই দেশের প্রদত্ত জনসংখ্যা তথ্য সঠিক- এমন অনুমানের উপর ভিত্তি করে তৈরি হয় এ হিসাব।
অবশ্য, জনসংখ্যা নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের দেওয়া হিসাবের চাইতে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দেশটির জনসংখ্যা আরও কোটি খানেক বেশি অনুমান করা হয়। ভারতের ক্ষেত্রে এ অনুমান ৫ কোটি বেশি।তাছাড়া, ভারতীয় রুপির মতো বাংলাদেশি মুদ্রা- টাকা বিশ্ববাণিজ্যে বাধামুক্ত ভাবে লেনদেন হয় না এবং মুদ্রাটি অতি-মূল্যায়িত এমন বিশ্বাস বহুল প্রচলিত।
অর্থনীতি নিয়ে নানা দেশের সরকারি তথ্যের অনির্ভরতার কারণেই আইএমএফ প্রাথমিক হিসাব-নিকাশ মুদ্রা বাজারের বিনিময় দর অনুসারে করে না। বরং মাথাপিছু গড় ক্রয় সক্ষমতার (পিপিপি) ভিত্তিতে তা নির্ধারণ করে। এই উপাত্তটি একটি দেশে জীবন-যাপনের ব্যয় অনুসারে হিসাব করা হয়।
পণ্য ও সেবার এই ক্রয় সক্ষমতার এ অনুপাত, ভারতীয়দের ক্ষেত্রে ৬.২৮৪ মার্কিন ডলার। যা বাংলাদেশের ৫,১৩৯ ডলারের চাইতে অনেকটা বেশি। একারণেই, বাংলাদেশ ভারতকে নূন্যতম আকারেও ছাড়িয়ে গেছে- তা বলা বাবে না। তবে এটা ঠিক করোনাজনিত মন্দায় বিকাশের গতিতে ভারত প্রতিবেশী বাংলাদেশের চাইতে পিছিয়ে পড়েছে।
এই যে শর্তের ভিড়, তার কারণে বাংলাদেশের অর্জনকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। গার্মেন্টস শিল্প ঘিরে হাজারো সমালোচনার পরও তৈরি পোশাক বাংলাদেশি রপ্তানি অর্থনীতির মেরুদণ্ড।
বাংলাদেশ রপ্তানিতে ইতিবাচক অগ্রগতি অর্জন করেছে একথা সত্য। রপ্তানি ভিত্তিক শিল্পায়নের সফলতা এবং ব্যর্থতা উভয় দিক থেকেই দেশটিকে আদর্শ উদাহরণ হিসেবে ধরা হয়। তারপরও, এটাই বাস্তবতা যে সামগ্রীক জিডিপি'তে মাত্র ১৫ শতাংশ অবদান রাখে রপ্তানি খাত। ভারতে যা ১৯ শতাংশ।
১৯৯৭ সালে আসিয়ান দেশগুলোর আর্থিক সঙ্কট চলাকালে ভারত জিডিপি'র রপ্তানি অবদানে বাংলাদেশকে ছাড়িয়ে যাওয়া শুরু করেছিল। এবং তখন থেকেই জিডিপি'তে এর অবদান বাংলাদেশের চাইতে বেশিই আছে। অর্জনটি চমকপ্রদ এবং ইতিবাচক। কারণ বড় দেশগুলোর সিংহভাগ জিডিপি অবদান আসে অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে। সেই তুলনায় তাদের রপ্তানি খাত থেকে অর্থনীতিতে মূল্য সংযোজনটা খুব বেশি হয় না। অথচ ভারতীয় রপ্তানি খাত অবদানের দিক থেকে এখন শুধুমাত্র চীনের সঙ্গে তুলনীয়। তাই কোনোভাবেই একে সামান্য অর্জন বলার সুযোগ নেই।
অ্যান্ডি মুখার্জির মতো যারা ভারতকে বাংলাদেশের মতো সস্তা শ্রম নির্ভর রপ্তানি শিল্প তৈরির পথ অনুসরণের পরামর্শ দিচ্ছেন, তারা ভারতীয় অর্থনীতির ভৌগলিক বাস্তবতাকে মানতে নারাজ। ভারতের সবচেয়ে জনবহুল দুইটি প্রদেশ; উত্তর প্রদেশ এবং বিহারে জনসংখ্যা যথাক্রমে; ২৩ কোটি ৮০ লাখ এবং সাড়ে ১২ কোটি। ভারতের মোট জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ এদুই রাজ্যের বাসিন্দা।
রপ্তানি কেন্দ্রিক এবং সস্তা শ্রমের ভিত্তিতে শিল্প গড়ে তোলার জন্য সম্ভবত এদুটি রাজ্যই আদর্শ। তবে স্থলবেষ্টিত হওয়ায় এদুই রাজ্য থেকে পণ্য সমুদ্রপথে সরাসরি রপ্তানির সুযোগ নেই। সড়কপথে পণ্য বন্দর পর্যন্ত পরিবহনে খরচ বাড়লে, তাতে সস্তা শ্রমের মাধ্যমে পাওয়া বাজার সুবিধা হারিয়ে যায়। আরও নেই এমন শিল্প সহায়ক নানা ভৌত অবকাঠামো।
জুতা, বস্ত্র, খেলনা, অন্যান্য খুচরা পণ্য উৎপাদন সস্তা শ্রম নির্ভর শিল্পের প্রধান খাত। কিন্তু, নিকটতম বন্দর থেকে প্রদেশদুটির দূরত্বের কারণে পণ্য পরিবহন খরচ বাদ দেওয়ার পর তা থেকে খুবই সীমিত লাভ করা সম্ভব হবে। রপ্তানি বাজারে এটাই তাদের জন্য প্রতিযোগী সক্ষমতা বহুগুণে কমাবে।
এ দুই রাজ্যে আসলে দরকার কৃষকদের আয় বৃদ্ধি। ভারত এখনও কৃষকদের দেশ। দেশটির প্রায় ৪০ শতাংশ নাগরিক কৃষি এবং কৃষি সংশ্লিষ্ট শিল্পে জড়িত। ২০ শতাব্দীতে এই হার ছিল ৬০ শতাংশ।
উত্তর প্রদেশ, বিহারের মতো ভারতের সমগ্র উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অধিকাংশ বাসিন্দা ছোট আকারের কৃষি জমিতে চাষাবাদের উপর নির্ভরশীল। সীমিত আয় তাদের দারিদ্র সীমায় আটকে রেখেছে।
ঐতিহাসিকভাবেই, শহুরে ভোক্তা শ্রেণির স্বার্থ বিবেচনায় কৃষকদের কম মূল্যে উৎপাদিত ফসল বিক্রিতে বাধ্য করেছে ভারত সরকার। সাম্প্রতিক সময়ে এর উজ্জ্বল উদাহরণ ছিল নরেন্দ্র মোদি নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকারের পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের সিদ্ধান্ত। স্থানীয় বাজারে মূল্য বৃদ্ধির কারণেই নেওয়া এ সিদ্ধান্ত আবারও কৃষকদের বাড়তি আয়ের সুযোগ বঞ্চিত করে। আবারও তুলনামূলক সম্পন্ন নগরবাসীর সামনে তুচ্ছ হয় কৃষক স্বার্থ।
রপ্তানি বন্ধের কিছুদিন বন্ধেই আবার পুরো ডিগবাজি খেয়ে দিক-পাল্টায় বিজেপি। বিতর্কিত কণ্ঠভোটের সাহায্যে তারা ভারতীয় সংসদের উচ্চকক্ষে একটি বড় আকারের কৃষি সংস্কার বিল পাস করে। কৃষক দরদি সরকারই বটে! ২০২০ সালের এ কৃষি অধ্যাদেশে মধ্যস্বত্ব সমবায়গুলিকে এড়িয়ে সর্বোচ্চ দরদাতা পাইকারি ক্রেতার কাছে চাষিরা তাদের উৎপাদিত ফসল সরাসরি বিক্রি করতে পারবেন, এমন আইন করা হয়েছে।
এমনকি শস্য ফলানোর আগেই, বীজ রোপণের আগে তারা বিক্রয় প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারবেন। সঙ্গে সরকারিভাবে নুন্যতম দর পাওয়ার সহযোগীতাও নিশ্চিত করা হবে। কৃষকরা এর ফলে বাড়তি বিক্রয়মূল্য আর আয়ের সুযোগ পাবেন বলে দাবি করা হচ্ছে।
ভারতীয় অর্থনীতি উত্তরণের প্রধান শর্ত আয় বৃদ্ধি, সস্তা কর্মসংস্থান বাড়ানো নয়। দেশটির অর্থনীতিবিদেরা সচরাচর ভুলটি করে থাকেন কৃষি খাতের বাড়তি কর্মীকে অন্যখাতে চাকরি দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে। তবে তাদের অনেকেই ভুলে যান, কৃষি থেকে আয় চাষিরা অর্থনীতির প্রায় অদৃশ্য এবং নিচু স্তরের অনেক কর্মকাণ্ডে ব্যয় করেন।
সেটা দিয়ে তারা সার কিনুন, বা পায়ের দেওয়ার চপ্পল- অর্থনীতির অন্যখাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে এ চাহিদা শক্তিশালী অনুঘটকের কাজ করে। আর সার্বিকভাবে কর্মীদের আয় বৃদ্ধি করা গেলেই, অন্যান্য পণ্য ও সেবা ভোগের পরিমাণ বাড়ে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি তখন আপনা থেকেই হয়।
জার্মান অর্থনীতিবিদ হার্টমুট এলেনহানসের মতে, ভবিষ্যৎ প্রবৃদ্ধির জন্য রাজনৈতিক পরিবেশকে স্থিতিশীল রেখেই এ সহায়তা দিয়ে থাকে বাড়তি আয়।
পক্ষান্তরে, রপ্তানির জন্য সস্তা শ্রমের মডেল বেঁছে নিয়ে বাংলাদেশ এক অন্ধগলির বাসিন্দা হয়েছে। এই পথ প্রবৃদ্ধির ভবিষ্যতের জন্য আত্মঘাতি হয়ে উঠতে পারে। সেই তুলনায় ভারতীয় অর্থনীতি নমনীয় এবং সংস্কারের উপযুক্ত অনেক সম্ভাবনায় উজ্জ্বল। এজন্য শুধু রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তির বলিষ্ঠ প্রয়োগ এবং প্রয়োজনে চটকদার নয়, এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার সৎসাহস প্রয়োজন। অন্যথায়, বাংলাদেশের আলোচনা- সমালোচনার ঝড় দেশটির জন্য কল্যাণকর কিছু বয়ে আনতে পারবে না।
এখন দেখার বিষয় জনপ্রিয় জাতীয়তাবাদি রাজনীতির ধারক-বাহক বিজেপি এবং নরেন্দ্র মোদির সরকার, সেই পথে হাটতে পারেন কিনা। যদিও, তারা অর্থনীতির প্রকৃত সংস্কারে বারবার অক্ষমতাই দেখিয়েছে।
- মূল থেকে সংক্ষেপিত ভাবানুবাদ: নূর মাজিদ
- আরও পড়ুন: চীন না, আগে বাংলাদেশকে পেছনে ফেলতে হবে ভারতের