বিশ্বকে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের পথ দেখাচ্ছে উহান
অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পুনরায় চালু করার তিন মাস পর, পুনরুদ্ধারের পথ অমসৃণ হওয়া সত্ত্বেও, করোনাভাইরাসের উৎপত্তিস্থল চীনের উহান দেখিয়েছে স্বাভাবিক পর্যায়ে ফিরে আসার ঝলক।
মে মাসে শহরটিতে কারখানায় উৎপাদন, খুচরা বিক্রি ও রপ্তানির চেহারা কোনোভাবেই গত বছরের ধারে-কাছেও ছিল না। এপ্রিলে লকডাউন চলাকালে কিছু কারখানা খোলা থাকা এবং তাতে স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড চলা সত্ত্বেও এ রকমই ছিল অবস্থা। ব্যক্তিগত খরচ কমে যাওয়ায় কারখানায় উৎপাদন কমতে থাকে, আর তার ছাপ পড়ে চীনজুড়ে।
এপ্রিলের ৮ তারিখ উহানের কোয়ারেন্টিন শেষ হওয়া ছিল চীনের জন্য একটি বিজয়ের মুহূর্ত; আর যেখানে এই প্রাণঘাতী ভাইরাসটির প্রথম আবির্ভাব ঘটেছিল, সেখানে সেটির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সফল হয়েছে- এমন আত্মবিশ্বাসের গুরুত্ব ফুটে ওঠে। কারখানা ও অফিসগুলো যখনই আবারও কাজ শুরু করে দেয়, তাতে ভোক্তাদের অংশগ্রহণে দেখা দেয় ধীর গতি; এর কারণ, ৭৬ দিনের লকডাউন শেষে ঘরে থাকা মানুষগুলোর মধ্যে অনেক বেশি সতর্কতা এবং বাসায় রান্নাবান্না ও অনলাইনে কেনাকাটা করার অভ্যাস গড়ে ওঠা।
এরপর, সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে এবং শরীরের তাপমাত্রা নিয়মিত পরীক্ষা করার নতুন অভ্যাসের সঙ্গে মানিয়ে যখন মানুষ মাত্রই ঘর থেকে বেশি হারে বের হতে শুরু করেছে, মে মাসে আবারও আচমকাই ভাইরাসের নতুন আক্রমণ শহরটিকে আক্রান্ত করে। আবারও জারি করা হয় বিধি-নিষেধ; দুই সপ্তাহের মধ্যেই শহরের ১ কোটি ১০ লাখ নাগরিকের পরীক্ষা করে ফেলে স্থানীয় সরকার। এরপর থেকে শহরটিতে আর কারও করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া যায়নি।
বেইজিংয়ের চায়না মিনশেং ব্যাংকিং কর্পের গবেষক ওয়েন বিন বলেন, 'উহানের এবং বাকি চীনের অর্থনীতির ট্রাজেকটরি জানান দিচ্ছে, একটি দ্বি-স্তরি রাস্তায় খুব দ্রুততার সঙ্গে ভাইরাস-পরবর্তী পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার ঘটানো সম্ভব। পুনরুদ্ধারের সময়কালে নতুন সংক্রমণের ছোট ছোট প্রাদুর্ভাব ঘটতে পারে ঠিকই, তবে ইকোনোমিক মোমেন্টামে সেটি সম্ভবত বড় কোনো প্রভাব ফেলবে না।'
উহানে সাম্প্রতিক সুতীব্র বৃষ্টিপাতও পুনরুদ্ধারের পথ কঠিন করে তুলেছে, বলেছেন ওয়েন। চীনের দক্ষিণাঞ্চলে প্রবল বর্ষণ ও তার ফলে হওয়া বন্যায় ৩ কোটিরও বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে; অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে ৬১.৮ বিলিয়ন ইয়ুন (৮.৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার)- সরকারি তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে শুক্রবার এ হিসেব জানিয়েছে চায়না সেন্ট্রাল টেলিভিশন।
চীনের ভয়ানক বন্যা, আবহাওয়ার চূড়ান্ত রকমের হুমকি
রেল যোগাযোগ স্বাভাবিক হলেও উহান মেট্রোতে যাত্রীসংখ্যা এখনো ভাইরাস-পূর্ব সময়ের তুলনায় অর্ধেকেরও কম। এর অন্যতম কারণ, লোকজন গণপরিবহনে অচেনা মানুষের সঙ্গে ওঠার বদলে বরং নিজের গাড়ি নিজে চালিয়েই চলাফেরা করা নিরাপদ ভাবছে। এপ্রিলে ব্লুমবার্গকে মোটরযান ডিলাররা বলেছেন, ভাইরাসের জাগরণে গাড়ির ব্যাপক চাহিদা তারা লক্ষ্য করছেন।
প্রণোদনা বৃদ্ধির পরিমাপও নির্ধারণ করে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ; এরমধ্যে রয়েছে, কিছু পরিবারের জন্য ৫০ কোটি ইয়ুনের শপিং বাউচারে ও ক্যাশ পেমেন্ট, বছরের শেষবেলা পর্যন্ত আয়কর বিরতি। বিনামূল্যের বাণিজ্য অঞ্চলের পরিসর সেই হুবেই প্রোভিন্সে আরও বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার- উহান যে প্রোভিন্সের রাজধানী। উদ্দেশ্য- ওই অঞ্চলে বিনিয়োগের পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে উৎসাহিত করা।
ভোক্তার অভ্যাস
মাস টেস্টিং ক্যাম্পেইন বা গণহারে পরীক্ষার ব্যবস্থাও আত্মবিশ্বাস বাড়াতে ব্যাপক সাহায্য করেছে বলে অভিমত রেস্তোরাঁর মালিক জিয়ং ফেই'র; যিনি শহরটি জুড়ে ভিন্ন ভিন্ন রন্ধনশালায় সুপ্রতিষ্ঠিত পাঁচটি রেস্তোরাঁ পরিচালনা করছেন। মে মাসে উহান যেদিন নতুন অপারেশনের ফল ঘোষণা করল, এর পরদিন তার রেস্তোরাঁগুলো দেখেছে স্মরণকালের সবচেয়ে বেশি ভিড়।
'যেকোনো ছোটখাট ঝলকই লোকেদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে দিতে পারে, যার ফলে তারা আর বাইরে খেতে আসবে না', বলেন জিয়ং। নিজের মালিকানাধীন আরও পাঁচটি রেস্তোরাঁ অবশ্য এখনো খোলেননি তিনি। জিয়ং বলেন, তার লাভ ৮০ শতাংশ কমে গেছে; কেননা, দ্বিধাগ্রস্ত ভোক্তাদের আকৃষ্ট করতে প্রচারণা কাজে তাকে অনেক বেশি টাকা করতে হয়েছে ব্যয়।
বিপরীতে, ভোক্তার অভ্যাস বদলের ফলে, যারা বাড়িতে খেতেই পছন্দ করেন, তাতে ক্যাটারিং সার্ভিস লাভবান হয়েছে।
'হট ড্রাই নুডলসে'র একটি ইনস্ট্যান্ট ভার্সন উৎপাদনকারী কারখানার মালিক ইয়ু ইয়াং জানিয়েছেন, দিনে ৭ থেকে ৮ হাজার বোল নুডলস তিনি বিক্রি করতেন ভাইরাস আসার আগে; এখন শুধু সেই অবস্থা ফিরেই পাননি, বরং লোকে অনলাইনে আরও বেশি কিনছে তার পণ্য। এর ফলে অনলাইনে ব্যবসার বিস্তার বাড়িয়েছেন তিনি, এবং পার্শ্ববর্তী শহরেও বিক্রি শুরু করেছেন।
বাণিজ্য নির্ভরতা
সবকিছু আবার খুলে যাওয়ার পর, উৎপাদন কেন্দ্র হিসেবে বাণিজ্যের এক দারুণ ঢেউ দেখছে উহান। শহরটির আমদানি-রপ্তানির মূল্যমান মে মাসে এক বছর আগের এ সময়ের চেয়ে ১৯.৩ শতাংশ বেড়েছে, যা কি না বৃদ্ধির বিচারে চীনে চতুর্থ সর্বোচ্চ গতি, বলছে স্থানীয় ভোক্তাদের তথ্য-উপাত্ত।
সুরক্ষা পণ্য ও মেডিকেল সাপ্লাইয়ের অর্ডার বিদেশে শিপমেন্টে ঢেউ এনে দিয়েছে; এরমধ্যে মাস্ক এবং অন্যান্য টেক্সটাইল পণ্যের চাহিদা বেড়েছে সাত গুণ। এছাড়া, মেমোরি চিপ জায়ান্ট- ইয়াংজে মেমোরি টেকনোলজি ও লেনোভো গ্রুপ লিমিটেডের মতো টেকনোলজি কোম্পানিগুলোর আবাসস্থল হিসেবেও খ্যাতি আছে উহানের; মে পর্যন্ত এখান থেকে সেমিকন্ডাকটর ও সার্কিটের মতো মেকানিক্যাল ইকুপমেন্টের রপ্তানি বেড়েছে ২১ শতাংশ।
তবে কনজাম্পশন-ফুয়েলড ইন্ডাস্ট্রির ওপর নির্ভরশীল রপ্তানিকারকদের ভুগতে হচ্ছে। মূলত এয়ারলাইন ও হোটেলগুলো কাপ সরবরাহকারী উহান বয়ুয়ান পেপার অ্যান্ড প্লাস্টিক কোং-এর ইন্টারন্যাশনাল অপারেশনস ডিরেক্টর বেনি জিয়াও জানান, গত বছরের আগস্টের পর এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে তার কোম্পানি একটা অর্ডারও পায়নি।
অন্যদিকে, হেলমেট ও ফেস শিল্ড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান উহান ওয়েলহেল ফটোইলেক্ট্রিক কোং-এর প্রতিষ্ঠাতা ইয়াও জুনের অবস্থা উজ্জ্বল। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব বাড়তে থাকায় তার উৎপাদিত সুরক্ষামূলক পণ্যের অর্ডার দক্ষিণ আমেরিকা থেকে প্রতিনিয়ত বাড়ছে; আবার, তার যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের ইন্ডাস্ট্রিয়াল কাস্টমারেরাও অর্ডার খুব একটা বাতিল করেনি।
'ব্যবসা এখন দারুণ চলছে,' বলেন ইয়াও, 'ভাইরাসটির আবছায়া থেকে অবশেষে বেরিয়ে এসেছে উহান।'
- ব্লুমবার্গ থেকে অনূদিত