ডলার সংকটে লোকসানের আশঙ্কা, চালের ওপর শতভাগ শুল্ক মওকুফের দাবি আমদানিকারকদের
বাজারের চাপ কিছুটা কমাতে চালের উপর সমস্ত শুল্ক মওকুফ করার দাবি জানিয়েছেন পণ্যটির বেসরকারি আমদানিকারকরা। ইতোমধ্যেই ডলারের ঘাটতির মধ্যে থাকায় লেটার অফ ক্রেডিট (এলসি) খুলতে পারছেন না তারা।
তারা বলছেন, চলমান ডলার সংকটের মধ্যে ব্যাংকগুলো এলসি খুলতে না পারায় তারা চাল আমদানি করছেন না; এর পাশাপাশি স্থানীয় বাজারেও লোকসান দেখতে হচ্ছে।
এতসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় এখন চালের ওপর শতভাগ শুল্ক মওকুফ করাকেই সর্বোত্তম পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন ব্যবসায়ীরা।
ব্যবসায়ীদের মতে, দুই দফায় আমদানির উপর ৬২.৫ শতাংশ থেকে শুল্ক-কর কমিয়ে ১৫.২৫ শতাংশ করা হয়। এই শুল্ক-করের কারণে প্রতি কেজি চালে ৫-৮ টাকা পর্যন্ত বাড়তি খরচ পড়ে। এই খরচ দিয়ে চাল আমদানি করে লোকসান গুনতে হচ্ছে, কারণ এর চেয়ে দেশে চালের দাম কম।
চাল আমদানিকারক ও বাংলাদেশ অটো মেজর এন্ড হাস্কিং মিল মালিকদের সংগঠনের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট শহিদুর রহমান পাটোয়ারী টিবিএসকে বলেন, "চাল আমদানির উপর থেকে শুল্ক-কর পুরোপুরি তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আমরা খাদ্য মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করেছি। শুল্ক-কর তুলে দিলে আমদানির খরচ কমবে এবং কম দামের চাল বাজারে প্রবেশ করবে। এতে করে স্থানীয় বাজারে সরবরাহ বৃদ্ধির পাশাপাশি বর্তমান চালের দামও কমে আসবে।"
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই বাজারে চালের দাম বাড়তে থাকে। খাদ্য মন্ত্রণালয় বেসরকারি পর্যায়ে প্রায় ১৫ লাখ টন চাল আমদানির অনুমতি দিলেও ছয় মাসে আমদানি হয়েছে মাত্র ৩ লাখ ৬০ হাজার টন।
সম্প্রতি খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বাংলাদেশ অটো মেজর এন্ড হাস্কিং মিল মালিক ও আমদানিকারকদের এক সভা হয়। এই সভায় ব্যবসায়ীরা চালের এই শুল্ক-কর তুলে দেওয়ার দাবি করেন।
এরইমধ্যে সরকার আন্তর্জাতিক উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতিতে এলসির মাধ্যমে ৫০ হাজার টন নন-বাসমতি চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
সোমবার প্রকাশিত বাংলাদেশের খাদ্য অধিদপ্তরের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ব্যবসায়ীদের দরপত্রে দর জমা দেওয়ার জন্য ২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় আছে।
তবে চাল ব্যবসায়ীরা মনে করেন তাদের সমস্যা আগে সমাধান করা দরকার।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. ইসমাইল হোসেন টিবিএসকে বলেন, "ব্যবসায়ীরা হয়তো ভেবেছিল আমনের ধান এলে চালের দাম কমবে। সেক্ষেত্রে তারা আমদানি করে লোকসান করতে পারে। সে কারণে হয়তো চাল আমদানির গতিটা শ্লথ।"
তিনি বলেন, 'তবে আমরা আরও অন্তত ৪-৫ লাখ টন চাল বেসরকারিভাবে আনতে পারলে আরও একটু স্বস্তির জায়গায় থাকবো। এজন্য আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।"
দেশে চালের বাড়তি দাম ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে বিশ্বব্যাপী খাদ্য সংকটের আশঙ্কা থেকে স্থানীয় উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজার থেকে খাদ্যশস্য সংগ্রহের উপর জোর দেয় সরকার।
এ প্রেক্ষিতে সরকারিভাবে ভারত, ভিয়েতনাম ও মিয়ানমার থেকে ৫.৩০ হাজার টন চাল আমদানির চুক্তি করার পাশাপাশি বেসরকারিভাবেও প্রায় ১৫ লাখ টন চাল আমদানির অনুমতি দেয় সরকার।
বেসরকারি আমদানি সহজ করতে সরকার শুল্ক কমানোরও সিদ্ধান্ত নেয়।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) চাল আমদানিতে শুল্ক কমানোর সুপারিশ করে। এই সুপারিশের ভিত্তিতে এনবিআর প্রথম দফায় চাল আমদানির উপর ৬২.৫ শতাংশ শুল্ক কমিয়ে ২৫ শতাংশে নামিয়ে আনে।
এতেও যখন চাল আমদানি স্বাভাবিক করা যাচ্ছিল না তখন ব্যবসায়ীদের দাবির প্রেক্ষিতে দ্বিতীয় দফায় আগষ্টের শেষে এটিকে ১৫.২৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়। এই সুবিধা প্রথমে ছিল ডিসেম্বরের ৩১ তারিখ পর্যন্ত। এনবিআর পরে এ সুবিধার সময় আগামী মার্চের ৩১ তারিখ পর্যন্ত বাড়িয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে।
কিন্তু এসব সুবিধার পরও দেশে চাল আমদানিতে খুব বেশি গতি আসেনি।
ব্যবসায়ীদের দাবি অফিসিয়ালি ব্যাংকাররা এলসি খুলতে নিষেধ না করলেও আন-অফিসিয়ালি তারা ব্যবসায়ীদের কাছে অপরাগতা প্রকাশ করেন।
এদিকে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, আমন মৌসুমের কারণেও বেসরকারি আমদানিতে গতি কিছুটা কম ছিল। ধানের এই মৌসুমে চাল এনে বিক্রি করতে পারবে কি না তা নিয়েও শঙ্কা ছিল।
তবে, বেসরকারি আমদানি কম হলেও সরকারিভাবে আমদানি স্বাভাবিক রয়েছে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, সরকারিভাবে তিনটি দেশ থেকে ৫.৩০ লাখ টন চাল আমদানির চুক্তির বিপরীতে ২.৫৯ লাখ টন দেশে এসেছে। পাইপলাইনে আছে আরও ২.১২ লাখ টন।
এরইমধ্যে সরকার অভ্যন্তরীণ উৎস থেকেও ধান-চাল সংগ্রহ শুরু করেছে।
দেশের কৃষকদের কাছ থেকে ৩ লাখ টন ধান ও মিলারদের থেকে ৫ লাখ টন চাল কিনবে সরকার।
যেখানে ২৮ টাকা কেজি দরে ধান ও ৪২ টাকা কেজি দরে চাল কেনার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
তবে যেসব মিলার সরকারের কাছে চুক্তি করছে তাদের লোকসান হলেও এই চাল সরবরাহ করতে তারা বাধ্য থাকবে। সরবরাহ না করলে তাদেরকে শাস্তির আওতায় পড়তে হবে।
বর্তমানে সরকারের কাছে ১৬.৩৯ লাখ টন চাল ও গমের মজুদ রয়েছে বলে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য থেকে জানা গেছে।