লাইন অফ ক্রেডিট: অর্থছাড়ের গতি বাড়াতে আবারও একমত বাংলাদেশ, ভারত
ভারতীয় লাইন অফ ক্রেডিট (এলওসি)-এর আওতাধীন প্রকল্পগুলো নিয়ে অনুষ্ঠিত ২১তম পর্যালোচনা সভায় অর্থছাড়ের গতি বাড়ানোর বিষয়ে আবারও একমত হয়েছে বাংলাদেশ ও ভারত। কারণ গত ১৩ বছরে ভারতীয় এলওসির আওতায় অর্থছাড় হয়েছে মাত্র ২০ শতাংশ।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০১০ সালে প্রথম এলওসি চুক্তি সই হওয়ার পর থেকে প্রতিবছরই দুই দেশের প্রতিনিধিদের মধ্যে পর্যালোচনা সভা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। তবে সভা অনুষ্ঠিত হলেও সমস্যাগুলোর সমাধন হচ্ছে খুব কমই। দীর্ঘদিন ধরে নানান সমস্যার সমাধান না হওয়ায় অনেক প্রকল্প ভারতীয় ঋণের তালিকা থেকে বাদ দিয়েছে বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলো।
তিনটি লাইন অফ ক্রেডিট চুক্তির আওতায় বাংলাদেশকে ৭.৩৬২ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিচ্ছে ভারত। এরমধ্যে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ১.৪৮৯ বিলিয়ন বা মোট ঋণের ২০ শতাংশ বিতরণ করা হয়েছে।
২০১০ সালের আগস্টে দুই দেশের মধ্যে ৮৬২ মিলিয়ন ডলারের প্রথম লাইন অফ ক্রেডিট চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তির অধীনে এখন পর্যন্ত ৭৪৭.৫২ মিলিয়ন ডলার ছাড় হয়েছে।
দ্বিতীয় এলওসি ঋণ চুক্তিটি হয় ২০১৬ সালের মার্চে। এই চুক্তির অধীনে ভারতের প্রতিশ্রুত ২ বিলিয়ন ডলার থেকে ছাড় হয়েছে ৩৩৬.৮ মিলিয়ন ডলার।
এছাড়া, ভারতের সঙ্গে সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলারের তৃতীয় এলওসি চুক্তি স্বাক্ষর হয় ২০১৭ সালের মার্চে। এই এলওসি থেকে ছাড়া হয়েছে ৪০৫.১৪ মিলিয়ন ডলার।
এদিকে, ঋণের শর্ত এবং বাস্তবায়ন পর্যায়ে জটিলতার কারণে ভারতীয় ঋণের তালিকা থেকে বাদ পড়ায় প্রক্রিয়াধীন রয়েছে আরও চার উন্নয়ন প্রকল্প। এসব প্রকল্পে ১.০১ বিলিয়ন ডালার ঋণ দেওয়ার কথা ছিল ভারতের।
বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলো অনাগ্রহের কারণে এসব প্রকল্প ভারতীয় লাইন অফ ক্রেডিটের (এলওসি) তালিকা থেকে প্রত্যাহারে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে বলে জানান অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) কর্মকর্তারা।
তারা জানান, গত মে মাসে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সম্মতিতে দুটি প্রকল্প এলওসি তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়। তবে প্রস্তাবিত ৪ প্রকল্প তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার সম্মতি এখনো ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে পাওয়া যায়নি। গত ডিসেম্বরের এসব প্রকল্প এলওসি থেকে বাদ দেওয়ার প্রস্তাব দেয় সরকার।
ইআরডি সূত্রে জানা গেছে, যেসব প্রকল্প প্রত্যাহার করা হচ্ছে, তারমধ্যে রয়েছে- সৈয়দপুরে ৭০.২৮ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে নতুন ক্যারেজ ওয়ার্কশপ নির্মাণের রেলওয়ে প্রকল্প, ১৬৫ মিলিয়ন ডলারের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্প নগর প্রকল্প, ৪০০ মিলিয়ন ডলারের বে কনটেইনার টার্মিনাল প্রকল্প এবং ৩৭৫ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে সৈয়দপুর বিমানবন্দর প্রকল্প।
ইআরডির কর্মকর্তারা আরও জানান, এলওসি তালিকাভুক্ত ৪০ প্রকল্পের মধ্যে ১৪টি প্রকল্প শেষে হয়েছে এবং ৮টি প্রকল্প অনুমোদন পর্যায়ে আছে। আর বাকি প্রকল্পেগুলো রয়েছে বাস্তবায়ন পর্যায়ে।
জানা যায়, ২০২৩ সালের মে মাসে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সম্মতিতে বাদ দেওয়া দুটি প্রকল্পসহ গত তিন বছরের ভারতীয় এলওসি তালিকা থেকে এখন পর্যন্ত মোট ৬টি প্রকল্প বাদ পড়েছে।
এছাড়া, রূপপুর বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন নির্মাণ এবং খুলনা-মোংলা রেললাইন প্রকল্পের দুটি প্যাকেজও বাদ পড়েছে এলওসি তালিকা থেকে। এসব প্রকল্পে ভারতের ঋণ প্রস্তাব ছিল ১.১৩ বিলিয়ন ডলার।
তবে সম্প্রতি ভারতীয় এলওসি ঋণের অর্থছাড় বেড়েছে বলে জানান ইআরডির কর্মকর্তারা। গত অর্থবছরে সর্বোচ্চ ৩৩৭ মিলিয়ন ডলার ছাড় হয়েছে, যা আগের যেকোনো অর্থবছরের চেয়ে বেশি। এর আগে ২০২০-২১ অর্থবছরে ছাড় হয়েছিল ২২৮ মিলিয়ন ডলার।
ধীরগতির প্রকল্প, সমস্যা সমাধানে নেই অগ্রগতি
গত বুধ ও বৃহস্পতিবার (২-৩ আগস্ট) ভারত ও বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের মধ্যে ২১তম এলওসি পর্যালোচনা সভাটি রাজধানীর শের-ই-বাংলা নগরের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত হয়।
বৈঠকে নিজ নিজ দেশের পক্ষে নেতৃত্ব দেন অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. আনোয়ার হোসেন এবং ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব অজয় কুমার।
বৈঠকে উপস্থিত কর্মকর্তারা জানান, এবারের পর্যালোচনা সভায় কাজ বন্ধ থাকা কুলাউড়া-শাহবাজপুর রেল লাইন নির্মাণ প্রকল্প নিয়ে জোরালো সিদ্ধান্তের আশা ছিল। কিন্ত ২৫ শতাংশ ভৌত অগ্রগতির পর তিন বছরের বেশি সময় ধরে কাজ বন্ধ থাকা এ প্রকল্পের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি।
ইআরডি সূত্রে জানা গেছে, এই প্রকল্পে বিষয়ে রেলওয়েকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। প্রকল্পটি পুনরায় পর্যালোচনা করে পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
টেকনিক্যাল কমিটির বৈঠক নিয়ে অনিশ্চয়তা
চলতি বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি দুই দেশের মধ্যে অনুষ্ঠিত একটি উচ্চ-পর্যায়ের বৈঠকে, বাংলাদেশের অনুরোধে ভারত তাদের এলওসি ঋণের শর্ত পর্যালোচনা করতে সম্মত হয়।
সভায় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, দুই দেশের সমন্বয়ে টেকনিক্যাল কমিটি এলওসি ঋণের শর্তের বিষয়ে চূড়ান্ত সিন্ধান্ত নেবে। এর জন্য ভারতের একটি প্রতিনিধি দল আগামী এপ্রিলে বাংলাদেশ সফর করবে বলে আশাও করছে ইআরডি।
তবে এই টেকনিক্যাল কমিটির সভা কবে হবে, তা নিয়ে অশ্চিয়তা তৈরি হয়েছে বলে ইআরডি সূত্রে জানা গেছে।
নাম প্রকাশ না শর্তে ইআরডির এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, বিষয়টি এখন ভারতের হাতে; তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী টেকটিক্যাল কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হবে। তবে কবে নাগাদ টেকনিক্যাল কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হবে, তা বলা যাচ্ছে না।