সবুজের দিকে যাত্রা: শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো কেন ছাদে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনে ঝুঁকছে
উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে বিদ্যুতের জাতীয় গ্রিডের সক্ষমতা; ১৫ হাজার মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে যা ২৫ হাজার মেগাওয়াটকে ছাড়িয়েছে। তারপরও শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো সৌরবিদ্যুতের মতো বিদ্যুতের বিকল্প উৎসের দিকে ঝুঁকছে। এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও বাড়ছে। বিদ্যুতের নবায়নযোগ্য ও বিকল্প এই উৎস তাদের কাছে আকর্ষনীয় হয়ে উঠছে।
বিদ্যুৎ চাহিদার কিছু অংশ মেটাতে ইতোমধ্যেই সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার করছে বা এজন্য বিভিন্ন বিনিয়োগ মডেল অনুসন্ধানের কথা জানিয়েছে অন্তত এক ডজন প্রধান প্রধান কোম্পানি। তাদের সঙ্গে কথা বলেছে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড।
শিল্প সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, নির্ভরযোগ্যতা ও খরচ-সাশ্রয়ী হওয়ার ফলে ছাদে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এ ধরনের উদ্যোগে সহজে অর্থায়ন লাভের সুবিধার থাকার কারণেও শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর আগ্রহ বাড়ছে।
তাছাড়া, সাম্প্রতিক সময়ে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির ঘটনা এবং উদ্বৃত্ত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে বিক্রির সুবিধা – সৌরশক্তিকে কাজে লাগানোর তুলনামূলক নতুন এই পদ্ধতি গ্রহণের অনুকূলে গেছে।
বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর উদ্যোগ
ছাদে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের নজিরবিহীন এক উদ্যোগ নিয়েছে মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ। মেঘনা ঘাট শিল্পাঞ্চলে ২৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে তারা প্রায় ১০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করছে। শিল্পগোষ্ঠীটি নিজস্বভাবে প্রকল্পের অর্থায়ন করছে, এবং ওমেরা সোলার আগামী সপ্তাহে এর বাস্তবায়ন কাজ শুরু করবে।
মানিকগঞ্জে অবস্থিত বিটপী গ্রুপের প্রতিষ্ঠান- তারাসিমা অ্যাপারেলস, শীর্ষ একটি গ্রিন ফ্যাক্টরি হিসেবে স্বীকৃত। বর্তমানে এ কারখানার ছাদে ৩.৫৭ মেগাওয়াট সক্ষমতার সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থা (সোলার প্যানেল) স্থাপনের কাজ চলছে। ২০২০ সালে প্রাথমিকভাবে ১.৫ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থা স্থাপন করেছিল ফকির ফ্যাশনস। চলতি বছর তারা আরো ১.৬৮ মেগাওয়াট সক্ষমতা স্থাপনের কাজ শুরু করেছে। দুটি কোম্পানিই ক্যাপিটাল-লিজ অর্থায়নের মডেল গ্রহণ করেছে।
দেশের অন্যতম বৃহৎ পোশাক রপ্তানিকারক ভিয়েলাটেক্স গ্রুপও তাদের সব কারখানার ছাদে সোলার প্যানেল স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আগামী মাস থেকেই তারা এই উদ্যোগ শুরু করবে। অন্যতম প্রধান ডেনিম প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক প্যাসিফিক জিন্স গ্রুপ বর্তমানে তাদের চাহিদার ১২-১৫ শতাংশ বিদ্যুৎ ছাদে উৎপাদনের মাধ্যমে মেটাচ্ছে। এর আর্থিক সুবিধার দিকটি উপলদ্ধি করে তারা তাদের সকল ইউনিটে তা সম্প্রসারণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আরেকটি পোশাক রপ্তানিকারক, জায়ান্ট গ্রুপও তাদের কারখানাগুলোর ছাদে সৌরবিদ্যুৎ স্থাপনের জন্য সোলার ডেভেলপারদের সাথে আলোচনা করছে।
অর্থায়নের বিভিন্ন মডেল
উপকরণ, স্থাপন ও রক্ষণাবেক্ষণ-সহ সব ধরনের খরচ বহন করে সোলার পাওয়ার প্রোভাইডার ও ডেভেলপাররা। বিনিময়ে ব্যবহারকারীরা জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুৎ বিলের সাথে তুলনীয় পরিমাণের মূল্য দেন। একারণে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের জন্য সৌরবিদ্যুতের দিকে রুপান্তর – একটি আকর্ষনীয় ও ঝামেলা-মুক্ত উপায় হয়ে উঠছে। এ ধরনের সুবিধাকে সাধারণত বলা হয় অপএক্স (OpEx) মডেল।
সৌরবিদ্যুৎ গ্রহণের আরেকটি মডেল হলো ক্যাপএক্স (CapEx)। এর আওতায় ব্যবহারকারীই শুরুতে সব খরচ দিয়ে দেন, ফলে মাসিক মূল্য পরিশোধের বাধ্যবাধকতা থাকে না। উদ্বৃত্ত নগদ অর্থ থাকা শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো এই মডেল পছন্দ করে।
তৃতীয় উপায়টি হচ্ছে, ক্যাপিটাল-লিজ ফাইন্যান্সিং। এই মডেলে ডেভেলপার কোম্পানি ব্যবহারকারীদের অর্থ ধার দেয়, যা পাঁচ বছর মেয়াদে সুদসহ পরিশোধ করতে হয়। এইক্ষেত্রেও মাসিক বিল দিতে হয় না।
সৌরবিদ্যুৎ সক্ষমতা স্থাপনে আলোচিত তিনটি ব্যবসায়ী গোষ্ঠী – ক্যাপএক্স, অপএক্স এবং ক্যাপিটাল-লিজ ফাইন্যান্সিং মডেল খতিয়ে দেখছে বলে জানান এসব প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা।
দেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী সিটি গ্রুপ- এরমধ্যেই তাদের চা বাগানগুলোয় সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদন ও ব্যবহার করছে। এখন নিজেদের অর্থনৈতিক অঞ্চলের কারখানার ছাদে সোলার পাওয়ার স্থাপনের লক্ষ্যে তারা ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড (ইডকল)- এর সাথে আলোচনা করছে।
ইস্ট কোস্ট গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান– ওমেরা সোলার এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মাসুদুর রহিম জানান, 'অনেক কারখানাই বর্তমানে ছাদে সৌরবিদ্যুৎ স্থাপনের বিষয়ে আমাদের সাথে যোগাযোগ করছে। এই আগ্রহের ঘটনা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। ইতোমধ্যেই আমরা ৬৬ মেগাওয়াট সক্ষমতার রুফটপ সোলার স্থাপন করেছি, আরো ৫০ মেগাওয়াট স্থাপনের কাজ চলছে।'
তিনি বলেন, বেশিরভাগ কোম্পানিই অপএক্স মডেলে আগ্রহী। কিন্তু, শিল্প প্রতিষ্ঠানের আর্থিক অবস্থার অবনতি হতে পারে। তারা বিদ্যুতের দাম পরিশোধে ব্যর্থ বা এমনকি দেউলিয়াও হতে পারে। এজন্য এই মডেলটি সোলার ডেভেলপারদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। এই মডেলে ব্যবহারকারীরা ২০ বছর ধরে অফ-পিক গ্রিড বিদ্যুতের চেয়ে ১৫ শতাংশ কম মাসিক মূল্য দেন। 'তাই অপএক্স মডেলের ক্ষেত্রে, আমরা যেন এসব ঋণ ফিরে পাই, সেবিষয়ে আমাদের আগে নিশ্চিত হতে হয়।'
বর্তমান চাহিদা ভিত্তিতে, ২০২৫ সাল নাগাদ শুধু ওমেরা-ই ২০০ মেগাওয়াট রুফটপ সোলার ব্যবস্থা স্থাপনের লক্ষ্য নিয়েছে। অন্যদিকে, পরিবেশসম্মত বিদ্যুৎকেন্দ্রের সবচেয়ে বড় অর্থায়নকারী– রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান ইডকল এপর্যন্ত বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের ছাদে ৫১ মেগাওয়াট সক্ষমতার সোলার সিস্টেম স্থাপন করেছে। তারা আরো ১০০ মেগাওয়াট সক্ষমতা স্থাপনের অর্ডারও পেয়েছে।
২০২৫ সাল নাগাদ ছাদে ৩০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার সোলার সিস্টেম স্থাপন করতে পারবে বলে আশাবাদী ইডকল।
ছাদে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন আকর্ষনীয় হয়ে উঠলো?
বেশকিছু কারণেই ছাদে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের চাহিদা বাড়ছে। এরমধ্যে অন্যতম দুটি হলো, ২০১৮ সালে কার্যকর করা নেট এনার্জি মিটারিং স্কিম; এবং ২০২২ ও ২০২৩ সালে একাধিকবার বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির ঘটনা। কেবলমাত্র এবছরের জানুয়ারিতেই বিদ্যুতের দাম দু'বার বাড়ানো হয়। ফলে প্রতি কিলোওয়াট ঘণ্টার মূল্য প্রায় ৮ টাকার কাছাকাছি পৌঁছায়।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বিশ্বব্যাপী সরবরাহ শৃঙ্খল ব্যাহত হওয়া এবং আন্তর্জাতিক বাজারে দ্রব্যমূল্যের তীব্রভাবে বেড়ে যাওয়ার ঘটনাও – ব্যবসাগুলোকে প্রতিকূলতার মধ্যে ফেলে।
ফলস্বরূপ, লোকসান মোকাবিলা করতে এবং ভর্তুকির বোঝা কমানোর জন্য সরকার জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়। তবুও নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ না পাওয়ার সমস্যায় জর্জরিত হয় শিল্প প্রতিষ্ঠান। এ ঘটনাও সৌর শক্তির মতো বিকল্প উৎসগুলোর সন্ধানে তাদের বাধ্য করেছে।
ওমেরার মাসুদুর রহিম বলেন, নেট মিটারিং ব্যবস্থা ও গ্রিড বিদ্যুতের দাম বাড়ার কারণে শিল্প প্রতিষ্ঠানের ছাদে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের চাহিদা বাড়ছে।
নেট মিটারিং স্কিমের আওতায়, বিদ্যুতের গ্রাহক তার নিজস্ব প্রতিষ্ঠানের সোলার সিস্টেমে উৎপাদিত বিদ্যুৎ ব্যবহারের পর যা উদ্বৃত্ত থাকে– সেটুকু গ্রিড নেটওয়ার্কে রপ্তানি করতে পারবেন। বর্তমানে ছাদের সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১,৯৪১ – যাদের বেশিরভাগই শিল্প প্রতিষ্ঠান– তাদেরকে এই নেট মিটারিং ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে বলে টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (স্রেডা) তথ্যসূত্রে জানা গেছে।
ঘন ঘন বিদ্যুতের দাম বাড়ার পাশাপাশি, নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ না পাওয়ায় উৎপাদনের খরচ লক্ষণীয়ভাবে বেড়েছে। একারণে, অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানই বিদ্যুতের বিকল্প উৎস নিয়ে ভাবতে বাধ্য হয়েছে।
প্যাসিফিক জিন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ এম তানভির বলেন, 'আমরা দেখেছি, ছাদে সোলার সিস্টেম স্থাপনে যে বিনিয়োগ করতে হয়, তা ফেরত পেতে মাত্র ৫-৬ বছর সময় লাগে।'
সিটি গ্রুপের উপদেষ্টা পবন চৌধুরী জানান, গ্রিড বিদ্যুতের দামে অনিশ্চয়তা থাকায় তারা সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থা স্থাপন করছেন।
তিনি বলেন, বিদ্যুতের সরবরাহে ব্যাঘাত এবং ডিজেল-চালিত বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ বেড়ে যাওয়ার কারণেই সিটি গ্রুপ সৌরবিদ্যুতের সম্ভাবনার দিকে ঝুঁকেছে।
সৌরবিদ্যুতে সাশ্রয় অনেক
সোলার মডিউল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের মহাসচিব গোলাম বাকী মাসুদ বলেন, গ্রিড বিদ্যুতের জন্য গ্রাহক যে দাম দেন, ছাদে উৎপাদিত সৌরবিদ্যুৎ তার ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ সাশ্রয় করতে পারে।
মাসুদ যিনি গ্রিনফিনিটি এনার্জিরও ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, 'সম্প্রতি আমরা চট্টগ্রামের তিনটি ছোট শিল্প প্রতিষ্ঠানকে তাদের কারখানার ছাদে সোলার সিস্টেম স্থাপনে সহায়তা করেছি। আকারে ছোট হলেও, সৌরবিদ্যুতের সুবাদে তাদের মাসিক ব্যয় অনেকটাই কমেছে। মাসে তাদের ৩ থেকে ৪ লাখ টাকা সাশ্রুয় হচ্ছে।
বাংলাদেশে ছাদে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, 'শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো রাজি থাকলে – আগামী পাঁচ বছরে আমরা তাদের পাঁচ হাজার মেগাওয়াট সোলার পাওয়ার উৎপাদনে সহায়তা দিতে পারব।'
দেশী-বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও আগ্রহী
সৌরশক্তি-সহ নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিনিয়োগের জন্য আলোচনা করছে দেশী ও বিদেশী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান।
গত সপ্তাহে সৌদি আরব-ভিত্তিক এসিডব্লিউএ পাওয়ার কোম্পানি এবং বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড-সহ তিনটি স্থানীয় প্রতিষ্ঠান – বাগেরহাটের রামপাল উপজেলায় ৩০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে সম্মত হয়। নির্মিত হলে এটি দেশের সর্ববৃহৎ সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র হবে।
বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণে ৪৩ কোটি ডলার বা ৪ হাজার ৭০০ কোটি টাকা বিনিয়োগের প্রয়োজন হবে।
এছাড়া, বাংলাদেশ জুট মিলস কর্পোরেশন (বিজেএমসি)- এর আওতাধীন পাটকল ও গোডাউনের ছাদে সোলার পার্ক স্থাপনে বিনিয়োগ করার আগ্রহ দেখিয়েছে কয়েকটি বিদেশি প্রতিষ্ঠান।
সম্প্রতি, বেক্সিমকো গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান তিস্তা সোলার লিমিটেড তাদের সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন শুরু করেছে। দুইশ মেগাওয়াট সক্ষমতার এই স্থাপনাটি বর্তমানে দেশের সর্ববৃহৎ সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র।
এনারগন রিনিউয়েবলস নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠান মোংলায় ১৩৪ মেগাওয়াটের আরেকটি সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করেছে।