৪৬ স্টার্টআপ কোম্পানির জন্য ১০০ কোটি টাকা বিনিয়োগের পরিকল্পনা
দেশের প্রায় চার ডজন স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠানে আরও ১০০ কোটি টাকা বিনিয়োগের পরিকল্পনা নিয়েছে সরকারের একমাত্র ভেঞ্চার ক্যাপিটাল প্রতিষ্ঠান- স্টার্টআপ বাংলাদেশ লিমিটেড। ৪৬টি স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠানে নতুন এই বিনিয়োগ করতে চাচ্ছে কোম্পানিটি।
এজন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে সম্প্রতি টাকা চেয়ে চিঠি দিয়েছেন স্টার্টআপ বাংলাদেশ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সামি আহমেদ।
২০২০ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে এপর্যন্ত ২৮ কোম্পানিতে মোট ৭৩.৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে স্টার্টআপ বাংলাদেশ। এর মধ্যে এপর্যন্ত ৬৪ কোটি টাকা ছাড় করা হয়েছে। কৌশলগত এসব বিনিয়োগ– হেলথটেক, এগ্রিটেক, এডটেক, লজিস্টিকস, ফিনটেক, ই-কমার্স ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে করা হয়েছে।
এসব খাতে আরও প্রবৃদ্ধির অনুমান করে, নতুন করেও একই ধরনের স্টার্টআপ কোম্পানিতে বিনিয়োগ করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। অর্থ বিভাগে পাঠানো চিঠিতে সামি আহমেদ বলেছেন, স্টার্টআপ বাংলাদেশ লিমিটেডের বিনিয়োগ প্রক্রিয়া চলমান রাখতে এবং কোম্পানির কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে আরও ১০০ কোটি টাকা প্রয়োজন। তিনি আগের বিনিয়োগ– কোথায় কত টাকা করা হয়েছে, সে তথ্য জানিয়ে নতুন বিনিয়োগের তহবিল চেয়েছেন।
অর্থ বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেছেন, বিনিয়োগ চাহিদা পূরণে স্টার্টআপ বাংলাদেশকে অর্থায়ন করার বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। 'দ্রুত অর্থ ছাড় করা হবে।' এর মাধ্যমে দেশের স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম শক্তিশালী করতে সরকারের উদ্যোগ নেওয়ার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।
সরকারের এই ভেঞ্চার ক্যাপিটাল প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ যেসব কোম্পানি পেয়েছে তারা বলছে, স্টার্টআপ বাংলাদেশের বিনিয়োগের ফলে তাদের আর্থিক সক্ষমতা যেমন বেড়েছে, তেমনি দেশি-বিদেশি সেবাগ্রহীতা ও বিনিয়োগকারীদের কাছে কোম্পানির গ্রহণযোগ্যতাও বেড়েছে।
২০২০ সালে অনুমোদিত মূলধন ৫০ কোটি টাকা মূলধন নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি যাত্রা শুরু করলেও– তা বর্তমানে বাড়িয়ে ৫০০ কোটি টাকা করা হয়েছে।
সামি জানান, স্টার্টআপগুলোয় মূলধন বিনিয়োগের সাথে সাথে সরকার থেকেও পর্যায়ক্রমে তহবিল ছাড় পাওয়ার আশা করা হচ্ছে। শুরুতে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে যে ৫০ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছিল, তা এরমধ্যেই বিনিয়োগ করা হয়ে গেছে। 'পরবর্তী ধাপের ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দটি পেতে আমরা অর্থ মন্ত্রণালয়ে আগের বিনিয়োগের রিপোর্ট জমা দিয়েছি'- বলেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, 'যেসব কোম্পানি তাদের সিড (যাত্রা শুরুর মূলধন) বা গ্রোথ (আয়ে প্রবৃদ্ধি থাকাকালীন) পর্যায়ে আমাদের বিনিয়োগ পেয়েছে, অর্থনৈতিকভাবে এটা তাদেরকে বড় হতে সাহায্য করেছে। এসব স্টার্টআপ বিকশিত হয়ে তাদের কার্যক্রম সম্প্রসারণ করেছে, অতিরিক্ত জনবল নিয়োগ করেছে, এবং সৃজনশীল পণ্য ও সেবা বাজারে এনেছে।'
'ফলে এই বিনিয়োগ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে অবদান রেখেছে, এবং একটা টেকনিক্যাল ইনোভেশন সেন্টার হিসেবে আমাদের অবস্থানকে দৃঢ় করেছে। আমাদের বিনিয়োগের ফলে হওয়া উল্লেখযোগ্য অর্জনগুলোর মধ্যে – আড়াই কোটির বেশি শিক্ষার্থীকে একাডেমিক ও কারিগতি শিক্ষা প্রদান, ৫ কোটির বেশি গ্রাহককে পণ্য ও সেবার সুবিধা প্রদান, ১৫ হাজারের বেশি সরাসরি কর্মসংস্থান এবং ৩ লাখের বেশি পরোক্ষ কর্মসংস্থান তৈরি হওয়ার মতো দিক রয়েছে। এ ছাড়া, দেশের কিছু স্টার্টআপ বা নবউদ্যোগ বিদেশেও তাদের ব্যবসা সম্প্রসারণ করে সেখান থেকে আয় করছে।'
'স্টার্টআপ বাংলাদেশের বিনিয়োগ একটি স্টার্টআপ কোম্পানির জন্য বিভিন্ন ধরনের সুবিধা সৃষ্টি করছে। অর্থের পাশাপাশি এটি একটি কোম্পানির ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করে। দেশি-বিদেশি সেবা গ্রহীতা ও বিনিয়োগকারীর কাছে কোম্পানির গ্রহণযোগ্যতা বাড়ে।'
যেসব কোম্পানিতে নতুন করে বিনিয়োগ অনুমোদন করা হয়েছে :
সাজগোজ, জাহাজী, ডানা-ফিনটেক, হিসাব, বাড়ি কই, অন্য, লুজলি ক্যাপলড, এলিস ল্যাবস, উইগ্রো, সেবা প্লাটফর্ম লিমিটেড, ফেব্রিক লাগবে' নামের ১১ স্টার্টআপ কোম্পানিতে বিনিয়োগের প্রস্তাব স্টার্টআপ বাংলাদেশের পরিচালক বোর্ড অনুমোদন করেছে। এসব কোম্পানিতে ১৮ কোটি টাকা বিনিয়োগের চুক্তি প্রক্রিয়াধীন।
এর বাইরে আরও ৩৫টি স্টার্টআপে প্রায় ৭৫ কোটি টাকা বিনিয়োগের অনুমোদন প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। এর বাইরে আগে অনুমোদন হয়েছে, কিন্তু অর্থ হস্তান্তর হয়নি এমন ১১টি প্রতিষ্ঠানে ৯.৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হবে। এসকল বিনিয়োগ সম্পন্ন করতে প্রতিষ্ঠানটির ১০০ কোটি টাকা লাগবে। স্টার্টআপ বাংলাদেশের বিনিয়োগ কৌশল ও প্রক্রিয়া রয়েছে। কোম্পানির পোর্টফলিও, বিজনেস ডিউডিলিজেন্স, ইনভেষ্টমেন্ট অ্যাডভাইজরি কমিটির সুপারিশ এবং বোর্ডের অনুমোদনের মাধ্যমে বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
যেসব কোম্পানিতে বিনিয়োগ করা হয়েছে
সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ হয়েছে চালডাল লিমিটেড- এ। মুদিপণ্যের এই প্রতিষ্ঠানে ৯.৯৮ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। এরপর ইন্টেলিজেন্ট মেশিনস লিমিটেড'- নামের স্টার্টআপে ৫.৪৯ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে।
১০ (টেন) এমএস লিমিটেড, শেবা প্ল্যাটফর্ম লিমিটেড, ট্যুর বুকিং বাংলাদেশ লি., কেয়ার নিউট্রিশন লি., সোয়াপ বিডি লি., ট্রাক লাগবে লি. এবং স্টেলার ডিজিটাল লিমিটেড –প্রত্যেকে ৫ কোটি টাকা করে বিনিয়োগ পেয়েছে। রাইড শেয়ারিং কোম্পানি পাঠাও- এ ৪.২৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। সিলভার ওয়াটার টেকনোলজিস বাংলা-তে ৩ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে স্টার্টআপ বাংলাদেশ।
১ কোটি টাকা করে বিনিয়োগ করা হয়েছে যান্ত্রিক লিমিটেড, শাটল টেকনোলজিস বিডি লিমিটেড, লুপ ফ্রেইট লি., ভ্রুম সার্ভিস লি., বিমাফাই লি., ওপেন রিফ্যাক্টরি বাংলাদেশ লি., আমারল্যাব লি., আই-ফার্মার লি., মার্কেটিয়ার এআই লি., আরোগ্য লিমিটেড, মেডইজি, প্যাভিলিয়ন ও আডেফফি- তে।
এর বাইরে ঢাকাকাস্ট- এ ৫০ লাখ, টেক হাইভ লিমিটেডে ৭৫ লাখ, মনের বন্ধু- এ ৭৫ লাখ, হ্যালোটাস্ক প্ল্যাটফর্ম লিমিটেড- এ ৭৫ লাখ টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে।
স্টার্টআপ বাংলাদেশের বিনিয়োগপ্রাপ্ত লজিস্টিক কোম্পানি 'ট্রাক লাগবে' এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) এনায়েত রশিদ টিবিএসকে বলেন, 'স্টার্টআপ বাংলাদেশের বিনিয়োগ একটি স্টার্টআপ কোম্পানির জন্য বিভিন্ন ধরনের সুবিধা সৃষ্টি করছে। অর্থের পাশাপাশি এটি একটি কোম্পানির ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করে। দেশি-বিদেশি সেবা গ্রহীতা ও বিনিয়োগকারীর কাছে কোম্পানির গ্রহণযোগ্যতা বাড়ে।'
তিনি বলেন, বিভিন্ন খাতে গড়ে ওঠা স্টার্টআপ কোম্পানিগুলো নতুন ধরনের ব্যবসা করছে। 'প্রচলিত অনেক আইন, নীতিমালা স্টার্টআপদের কাজে বাধা সৃষ্টি করছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে নতুন ধরনের আইনি সহায়তা দরকার হচ্ছে। স্টার্টআপ বাংলাদেশ এ খাতের জন্য আইন, নীতি প্রণয়ন ও পরিবর্তন করেও কার্যক্রমে সহযোগিতা করছে।'
ভবিষ্যত বিনিয়োগ পরিকল্পনা
২০২৫ সালের মধ্যে পাঁচটি ইউনিকর্ন তৈরির লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে স্টার্টআপ বাংলাদেশ। একইসাথে এই সময়ের মধ্যে ১৫০টি বিনিয়োগে ৫০০ কোটি টাকা অর্থায়ন করতে চায় প্রতিষ্ঠানটি। এ ছাড়া, সরকার অনুমোদন দিলে তারা একটি ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফান্ড, প্রাইভেট ইক্যুইটি ফান্ড, ইমপ্যাক্ট ইনভেষ্টমেন্ট ফান্ড এবং ফান্ড অব ফান্ড প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করতে চায়। যা থেকে ম্যানেজমেন্ট ফি বাবদ আয় করা সম্ভব হবে বলে অর্থ বিভাগকে জানিয়েছে কোম্পানিটি।
স্টার্টআপ বাংলাদেশ লিমিটেড সম্পর্কে
২০২০ সালের মার্চ মাসে প্রতিষ্ঠানটি কোম্পানি আইনে নিবন্ধন নিয়ে মাত্র ৭ কোটি টাকা মূলধন নিয়ে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে। এই কোম্পানির মালিকানা বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের। শুরুতে কোম্পানিটির অনুমোদিত মূলধন ৫০ কোটি টাকা থাকলেও– তা বর্তমানে বাড়িয়ে ৫০০ কোটি টাকা করা হয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে সরকার স্টার্টআপগুলোর জন্য ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখে। যা স্টার্টআপ বাংলাদেশ লিমিটেডকে ফান্ড হিসেবে ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়। ২০২২ সালের জানুয়ারিতে ওই বরাদ্দ থেকে ৫০ কোটি টাকা ছাড় করে অর্থ মন্ত্রণালয়।
এই কোম্পানিটি বেসরকারি খাতের নতুন স্টার্টআপ কোম্পানিতে ইক্যুইটি বা শেয়ারের মাধ্যমে বিনিয়োগ করে থাকে। সীড বা যাত্রা শুরুর সময়ে সর্বোচ্চ ১ কোটি এবং গ্রোথ পর্যায়ে প্রতি দফায় সর্বোচ্চ ৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে থাকে। এ ছাড়া, প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেয়। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারী এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থার মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে দেয়।
স্টার্টআপ কোম্পানির সফলতা সহজ নয়। ভেঞ্চার ক্যাপিটাল বিনিয়োগকারীদের বৈশ্বিক জোট স্বীকার করে যে, ৯০ শতাংশ স্টার্টআপ ব্যর্থ হয়, আর ১০ শতাংশ লাভজনক হয়ে ওঠে। তবে এই লাভজনক কোম্পানিগুলোর রিটার্ন অনেক বেশি, যা ৯০ ভাগ ব্যর্থ কোম্পানিতে বিনিয়োগের লোকসান পুষিয়ে দেয়।
বাংলাদেশে স্টার্টআপ কার্যক্রম
দেশে স্টার্টআপ ইকোসিস্টেমের বয়স এক দশকের কাছাকাছি মাত্র। দেশে বর্তমানে সক্রিয় স্টার্টআপের সংখ্যা ২,৫০০। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষি, আর্থিক অন্তর্ভূক্তি, লজিস্টিকস, ই-কমার্স, পরিবহন-সহ বিভিন্ন খাতে স্টার্টআপদের মাধ্যমে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে।
স্টার্টআপদের মাধ্যমে দেশে বিদেশি বিনিয়োগ আসছে। ২০১৩ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত ৩৭৭টি স্টার্টআপ কোম্পানিতে ৯০৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ হয়েছে, যেখানে বিদেশি বিনিয়োগ ৮৪১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। বাকি ৬৮ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছেন অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগকারীরা। অর্থাৎ, স্টার্টআপে দেশীয় বিনিয়োগের পরিমাণ মাত্র ৭ শতাংশ। ২০২১ সালে স্টার্টআপ খাতে সবচেয়ে বেশি ৪৩২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ হয়। এরমধ্যে ওই বছর মোবাইলে আর্থিক সেবাদাতা কোম্পানি বিকাশ- এ ২৫০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ পায়।