রপ্তানি তহবিলের অধীনে ডলারে নেওয়া ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ থার্মেক্স গ্রুপ: কেন্দ্রীয় ব্যাংক
পোশাক ও বস্ত্র খাতের শিল্পপ্রতিষ্ঠান থার্মেক্স গ্রুপের ৭টি প্রতিষ্ঠানের বকেয়া ৭৯০ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে বিপাকে পড়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, অগ্রণীসহ ৯টি ব্যাংকের কাছে থার্মেক্স গ্রুপের এই ৭ প্রতিষ্ঠানের বকেয়া রয়েছে ১,৮২২ কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঋণ দেওয়ায় সময় থার্মেক্সের প্রতিষ্ঠানগুলোর অন্য ব্যাংকের কাছে কী পরিমাণ ঋণের দায় রয়েছে, তা বিবেচনা না করেই ঋণ দিয়েছে অগ্রণী ব্যাংক; ফলে স্পষ্টতই ঋণঝুঁকি (ক্রেডিট রিস্ক) বেড়েছে।
এই গ্রুপের ৬ প্রতিষ্ঠানের কাছে মেয়াদোত্তীর্ণ রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ) ঋণ রয়েছে ২৫২ কোটি টাকা। যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্ধারিত সময় পরই অগ্রণী ব্যাংকের ফরেন কারেন্সি অ্যাকাউন্টস থেকে তাদের দায়গুলো কেটে নিয়েছে।
অগ্রণী ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, "থার্মেক্সকে ডলারে ঋণ দেওয়া হয়েছিল। প্রতিষ্ঠানটি যথাসময়ে এই ঋণ পরিশোধ না করায় আমাদের ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলার কেটে নিয়েছে।"
চলতি বছরের মার্চে থার্ম্যাক্স গ্রুপের প্রতিষ্ঠানের ঋণ পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি পরিদর্শন দল।
ইডিএফ হলো রপ্তানিকারকদের ডলারে ঋণ নিয়ে কাঁচামাল আমদানি করার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি বিশেষ সুবিধা। এই ঋণ পরিশোধ করতে সর্বোচ্চ ২৭০ দিন পর্যন্ত সময় নিতে পারেন উদ্যোক্তারা। এদিকে, থার্মেক্সের প্রতিষ্ঠানগুলো আমদানির বিপরীতে পণ্য রপ্তানি না করলেও স্টকলটের গোডাউনে মালামাল পায়নি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যদিও এসব ফরেন কারেন্সি ঋণ কীভাবে পরিশোধ করবে তাও স্পষ্ট ব্যাখ্যা দিতে পারেনি প্রতিষ্ঠানগুলো।
রাজধানীর মতিঝিলে অগ্রণী ব্যাংকের প্রিন্সিপাল শাখার মহাব্যবস্থাপক ফজলুল হক– যিনি এ ঋণ মঞ্জুর করেছেন– রোববার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "থার্মেক্স গ্রুপের সমস্ত ওভারডিউ ইডিএফ ঋণ বাধ্যতামূলক ঋণে পরিণত করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি অনুযায়ী, যথাযথ ডাউন-পেমেন্টের মাধ্যমে ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়েছে। বর্তমানে ঋণগুলো নিয়মিত।"
থার্মেক্সের প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঋণ দেওয়ার সময় অন্যান্য ব্যাংকের দায় যথাযথভাবে মূল্যায়ন করা হয়নি– এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুসন্ধানের নিয়ে ফজলুল হক বলেন, "বোর্ডের যথাযথ নিয়ম মেনেই আমাদের ঋণ অনুমোদন করা হয়েছে। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক অস্থিরতার কারণে গ্রাহকদের ইডিএফ ঋণ বকেয়া হয়েছে।"
৯ ব্যাংকে ১,৮২২ কোটি টাকা ঋণ
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, থার্মেক্স গ্রুপের ৭টি প্রতিষ্ঠানের নয়টি ব্যাংকের কাছে ১,৮২২ কোটি টাকা ঋণ রয়েছে; এরমধ্যে অগ্রণী ব্যাংকের পাওনা সবচেয়ে বেশি।
ঋণ দেওয়া অন্যান্য ব্যাংকগুলো হলো— সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ, রূপালী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, আল-আরাফা ইসলামী ব্যাংক, এনআরবিসি ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক এবং এই তালিকায় আরেকটি শরিয়া ভিত্তিক ব্যাংক রয়েছে, যেটির নাম প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, অগ্রণী ব্যাংকসহ ছয়টি ব্যাংকের কাছে থার্মেক্স ব্লেন্ডেড ইয়ার্ন লিমিটেডের মোট ঋণ রয়েছে ৫৬৬ কোটি টাকা। এরমধ্যে বর্তমানে বকেয়া আছে ৩৬৬ কোটি টাকা।
প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন দেশ থেকে টেক্সটাইল কাঁচামাল আমদানির জন্য ১৪টি এলসির বিপরীতে ইডিএফ থেকে ১০.৮৯ লাখ ডলার মূল্যের এলসি খোলে। যদিও ইডিএফএ'র ২৭০ দিন মেয়াদ শেষ হলেও গ্রাহক এই ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়। যার বিপরীতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক অগ্রণী ব্যাংকের ফরেন কারেন্সি অ্যাকাউন্ট থেকে ৯০ কোটি টাকা মূল্যের ডলার কেটে নিয়েছে।
থার্মেক্সের আরেক প্রতিষ্ঠান আদুরী অ্যাপারেলস লিমিটেডের অগ্রণী ব্যাংকসহ তিনটি ব্যাংকের কাছে ঋণের পরিমাণ ৩৩৯ কোটি টাকা; যদিও প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান বকেয়া স্থিতির পরিমাণ রয়েছে ২৬৫ কোটি টাকা।
এই গ্রাহক প্রতিষ্ঠান তার উৎপাদন সক্ষমতা দেখিয়েছে বার্ষিক ৫৪ লাখ পিস পণ্য। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন দলের পাওয়া তথ্য মোতাবেক দেখা যায়, বছরে প্রতিষ্ঠানটির উৎপাদন হয় ২ কোটি ৪৮ লাখ পিস। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানটি তার উৎপাদন সক্ষমতার তথ্য গোপন করেছে।
গ্রুপের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও একই রকম অমিল পাওয়া গেছে।
ব্যাংকের বর্তমান ঋণ নীতি উল্লেখ করে ফজলুল হক জানান, ঋণ পুনরুদ্ধারের জন্য চাপ দেওয়ার সময় তারা কোম্পানিগুলোকে তাদের ব্যবসা পরিচালনায় সহায়তা করছে।
"এখন আমরা গ্রাহকের বিজনেস অপারেশন থেকে ১০০ টাকা ফেরত নিলে, তার ব্যবসায়িক কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখতে আবারও ৮০ টাকার একটি নতুন ব্যাক-টু-ব্যাক ঋণ সুবিধা দিচ্ছি," যোগ করেন তিনি।