অনিয়মের কারণে ন্যাশনাল ব্যাংকের নতুন পর্ষদ করে দিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক, সিকদার ভাইয়েরা বাদ
বিধিবিধান লঙ্ঘন করে ঋণ অনুমোদন, পরিচালনা পর্ষদের ক্ষমতার অপব্যবহার ও প্রশ্নবিদ্ধভাবে পরিচালক নির্বাচনসহ বেশ কয়েকটি অনিয়মের কারণে ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
পাশাপাশি ব্যাংকটির প্রয়াত প্রতিষ্ঠাতা জয়নুল হক সিকদারের স্ত্রী মনোয়ারা সিকদার এবং ছেলে রিক হক সিকদার ও রন হক সিকদারকে বাদ দিয়ে নতুন পর্ষদ গঠন করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ওই পরিবারের প্রতিনিধি হিসেবে ব্যাংকটির নতুন পর্ষদে স্থান পেয়েছেন কেবল জয়নুল হক সিকদারের মেয়ে পারভীন হক সিকদার।
বৃহস্পতিবার বেসরকারি খাতের ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালককে দেওয়া এক চিঠিতে বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সুপারিশের ভিত্তিতে আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষা এবং জনস্বার্থে ন্যাশনাল ব্যাংকের বর্তমান পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেওয়া হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়েছে ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ কর্তৃক 'ঋণ নিয়মাচার ও বিধিবিধান লঙ্ঘন করে ঋণ অনুমোদন প্রদান করা, পর্ষদ কর্তৃক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনায় অনাকাঙ্ক্ষিত হস্তক্ষেপ করা, পর্ষদের ক্ষমতার অপব্যবহার করে ব্যাংকের শেয়ার একই পরিবারে কেন্দ্রীভূত করা, পরিচালক নির্বাচন বা পুনর্নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন জটিলতা সৃষ্টি, পর্ষদের গোচরে পরিচালকগণ কর্তৃক আর্থিক অনিয়ম সংঘটন, পর্ষদের নীতিনির্ধারণী দুর্বলতার কারণে ব্যাংকের আর্থিক অবস্থার অবনতি, ব্যাংকিং সুশাসন ও শৃঙ্খলা বিঘ্ন করার মাধ্যমে ব্যাংক-কোম্পানি ও আমানতকারীদের স্বার্থের পরিপন্থী কর্মকাণ্ডে পর্ষদ কর্তৃক সম্পৃক্ত থাকার ঘটনা ঘটেছে।'
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, 'পর্ষদের দায়িত্ব ছিল আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষা করা। কিন্তু তারা সেটি না করতে পারায় আগের পর্ষদ বাতিল করে নতুন পর্ষদ গঠন করে দেওয়া হয়েছে।
নতুন পর্ষদ গঠন
বাংলাদেশ ব্যাংক নতুনভাবে ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ গঠনের লক্ষ্যে সাতজনকে পরিচালক ও স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে। নবগঠিত সাত সদস্যের পর্ষদে স্বতন্ত্র পরিচালক হয়েছেন তিনজন; আর উদ্যোক্তা-পরিচালক চারজন।
স্বতন্ত্র পরিচালকেরা হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসা প্রশাসন ইনস্টিটিউটের (আইবিএ) সাবেক অধ্যাপক সৈয়দ ফারহাত আনোয়ার, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম ও সাউথইস্ট ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম কামাল হোসেন।
তাদের মধ্যে পর্ষদের চেয়ারম্যান হয়েছেন অধ্যাপক সৈয়দ ফারহাত আনোয়ার। মেঘনা ব্যাংকের স্বতন্ত্র পরিচালকের পদ থেকে পদত্যাগের শর্তে তাকে এ পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে নতুন চার পরিচালক হলেন: পারভীন হক সিকদার, উদ্যোক্তা পরিচালক খলিলুর রহমান, সিকদার ইনস্যুরেন্স কোম্পানির পক্ষে প্রতিনিধি পরিচালক মো. সফিকুর রহমান ও উদ্যোক্তা শেয়ারধারী হিসেবে পরিচালক মোয়াজ্জেম হোসেন।
প্রয়াত চেয়ারম্যান জয়নুল হক সিকদারের মৃত্যুর পর ব্যাংকটির চেয়ারম্যান নির্বাচন হন তার স্ত্রী মনোয়ারা সিকদার। একইসঙ্গে দুই ছেলে ও এক মেয়ে রিক হক সিকদার, রন হক সিকদার ও পারভীন হক সিকদার উদ্যোক্তা পরিচালক নির্বাচিত হন।
এর আগে ন্যাশনাল ব্যাংকের ৪০তম বার্ষিক সাধারণ সভার (এজিএম) ওপর আগামী ১৬ জানুয়ারি পর্যন্ত স্থিতাবস্থা জারি করেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের চেম্বার জজ আদালত। পারভীন হক সিকদারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এ আদেশ জারি করেন আদালত। এর ফলে ২১ ডিসেম্বর ব্যাংকটির যে ভার্চুয়াল এজিএম হওয়ার কথা ছিল, তা আর অনুষ্ঠিত হয়নি।
ব্যাংকটির আর্থিক অবস্থা
ন্যাশনাল ব্যাংক ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নয় মাসে ১ হাজার ১২৩ কোটি টাকা লোকসান করেছে, যা এর আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ২১৪ শতাংশ বেশি।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)-এর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকটির শেয়ারপ্রতি লোকসান ৩.৪৯ টাকায় দাঁড়িয়েছে।
এদিকে, চলতি বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) ব্যাংকটির ৫০০ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে, যা এক বছর আগে ছিল ১৮৪ কোটি টাকা।
ব্যাংকটি বলেছে, বিশ্ব অর্থনীতির পাশাপাশি বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতির জন্য বাজারে তারল্য সংকটের কারণে ঋণগ্রহীতারা সময়মতো কিস্তি পরিশোধ করতে পারেনি। এতে তাদের খেলাপি গ্রাহকের সংখ্যা বেড়েছে। আর এতে ব্যাংকের আয় কমেছে।
সিকদার গ্রুপের মালিকানাধীন ন্যাশনাল ব্যাংক ২০২১ সাল পর্যন্ত লোকসানে পড়েনি। তবে ২০২২ সালে ব্যাংকটি ৩ হাজার ২৬১ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে।
বিপুল লোকসানের কারণে ব্যাংকটি ২০২২ সালে শেয়ারহোল্ডারদের কোনো লভ্যাংশ দিতে পারেনি। ২০২১ সালেও ব্যাংকটি কোনো লভ্যাংশ দেয়নি।
চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের হার দাঁড়িয়েছে ২৯.৪৭ শতাংশ, যা বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।
উচ্চ খেলাপি ঋণের ফলে ন্যাশনাল ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১৩ হাজার ৭৯৭ কোটি টাকা।
গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার দায়িত্ব নেওয়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংক ১০টি দুর্বল ব্যাংকের একটি হিসেবে ন্যাশনাল ব্যাংককে চিহ্নিত করে।