এপ্রিল থেকে ক্রয়াদেশ বাড়ার আশা তৈরি পোশাক খাতে
দেশের তৈরি পোশাক খাতের ধূসর সময় পার হয়ে সামনে উজ্জ্বল দিনের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে।
দেশের রপ্তানিকারকেরা ২০২৪ সালের দ্বিতীয় প্রান্তিকের শুরু থেকে পোশাকের ক্রয়াদেশ বাড়বে বলে আশা করছেন। বিশেষ করে পশ্চিমাবিশ্বের মূল্যস্ফীতি কমা, বৈশ্বিক খুচরা পর্যায়ের দোকানগুলো বিভিন্ন উৎসবে তাদের শীতকালীন পোশাকের মজুত বিক্রি করে ফেলায় সামনে তৈরি পোশাকের ক্রয়াদেশ বাড়তে পারে।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর সঙ্গে আলোচনায় দেশের পোশাক শিল্পের ব্যবসায়ী-নেতা এবং বৈশ্বিক ক্রেতাদের প্রতিনিধিরা বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের মতো রপ্তানি গন্তব্যের প্রধান দেশসমূহের খুচরা পর্যায়ের দোকানগুলো ব্ল্যাক ফ্রাইডে, সাইবার মানডে, ক্রিসমাস ডে ও বক্সিং ডে'র মতো বিভিন্ন উৎসবের কল্যাণে নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে প্রচুর পণ্য বিক্রি করতে পেরেছে।
ইউএস সেন্সাস ব্যুরোর উপাত্তও বলছে, গত এক বছরে তৈরি পোশাকের দোকানগুলোতে বিক্রি ধারাবাহিকভাবে ঊর্ধ্বমুখী ছিল। এ বিক্রি ২০২৩ সালের জানুয়ারির মাসিক ১৩.৭ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে নভেম্বরে ২১.৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে।
গত বছরের ডিসেম্বরে মার্কিন দোকানগুলোতে মাসিক বিক্রি হয়েছিল আনুমানিক ২৯ বিলিয়ন ডলার যা ২০২২ সালের ডিসেম্বরের তুলনায় ৯ শতাংশ বেশি। ভারতীয় মার্কেট গবেষণা ফার্ম ওয়াজির অ্যাডভাইজর-এর মতে, ইয়ার-টু-ডেট হিসেবে ২০২৩ সালে পোশাক বিক্রয়ের পরিমাণ ২০২২ সালের তুলনায় ৬ শতাংশ বেশি ছিল।
বৈশ্বিক থিংক ট্যাংক দ্য কনফারেন্স বোর্ড মার্কিন ভোক্তাদের মনোভাব, ব্যয়ের অভিপ্রায় এবং মুদ্রাস্ফীতি, স্টকের দাম ও সুদহার নিয়ে তাদের দৃষ্টিভঙ্গির মাসিক মূল্যায়ন পরিচালনা করে।
এটির সর্বশেষ সমীক্ষা অনুসারে, ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে আগের মাসের ১০২.০ থেকে বেড়ে মার্কিন ভোক্তা আস্থা সূচক ১১০.৭ হয়েছে। আর এ সূচক ২০২২ সালের ডিসেম্বরের সূচকের চেয়েও কিছুটা বেশি।
এদিকে যুক্তরাজ্যের বাজারেও খুচরা পর্যায়ে তৈরি পোশাকের বিক্রি বাড়ার কথা জানা গেছে।
ইউকে স্ট্যাটিস্টিক্স অথোরিটির কার্যনির্বাহী দপ্তর অফিস অভ ন্যাশনাল স্ট্যাটিস্টিক্সের তথ্য অনুসারে, যুক্তরাজ্যের বাজারে ২০২৩ সাল জুড়েই খুচরা পর্যায়ে মাসিক পোশাক বিক্রি ঊর্ধ্বমুখী ছিল। যদিও সর্বশেষ প্রান্তিকে সামান্য মন্দারও সম্মুখীন হয়েছে বাজারটি।
২০২৩ সালের ডিসেম্বরে সারা বছরের ১২ মাস মিলিয়ে বাংলাদেশ সর্বোচ্চ মাসিক পোশাক রপ্তানি মূল্য ৪.৫৬ বিলিয়ন ডলার অর্জন করে। তবে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুসারে, ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসের তুলনায় ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে রপ্তানি ২.৪ শতাংশ কম ছিল।
২০২৩ সালে রপ্তানির সামগ্রিক প্রবৃদ্ধি হয় সামান্যই – ৩.৬৭ শতাংশ। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে মোট রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৪৭.৩৯ বিলিয়ন ডলার। আর ২০২২ সালে মোট রপ্তানি করা হয়েছিল ৪৫.৭১ বিলিয়ন ডলারের।
দ্বিতীয় প্রান্তিক থেকে ক্রয়াদেশ বাড়ার আশা
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, 'আমাদের রপ্তানিকারকেরা চলতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিক থেকে বৈশ্বিক ক্রেতাদের কাছ থেকে পোশাকের অর্ডার বাড়বে বলে আশা করছেন।'
ইউরোপ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতি হ্রাসের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'বিগত এক বছরে ব্র্যান্ডগুলো সফলভাবে তাদের মজুত বিক্রি শেষ করায় বাংলাদেশ থেকে তাদের পোশাকের সোর্সিং বাড়াবে বলে আশা করা হচ্ছে। কিছু ক্রেতা ইতোমধ্যেই আমাদের রপ্তানিকারকদের সঙ্গে অর্ডার বাড়াতে আলোচনা শুরু করছে।'
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সহ-সভাপতি ফজলে শামীম এহসান বলেন, ২০২৪ সালে অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ওইসিডি)-এর অন্তর্গত দেশগুলোর প্রত্যাশিত ১.২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধিসহ মূল্যস্ফীতি ৩.২ শতাংশে হ্রাস পাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
'আমরা ২০২৪ সালের দ্বিতীয় প্রান্তিকে দেশের পোশাক রপ্তানি বৃদ্ধির পূর্বাভাস দেখতে পাচ্ছি,' শামীম এহসান বলেন। তিনি আরও মনে করেন, মুদ্রাস্ফীতি কমে যাওয়ার সাথে সাথে ভোক্তাদের পোশাকক্রয়ে আরও বেশি ব্যয় করার সম্ভাবনা রয়েছে।
নোমান গ্রুপ অফ ইন্ডাস্ট্রিজের বৃহত্তম টেক্সটাইল বিভাগ জাবের অ্যান্ড জুবায়ের ফ্যাব্রিক্স লিমিটেডের নির্বাহী পরিচালক (বিক্রয় ও বিপণন) শফিকুর রহমানও পোশাক শিল্পের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী ও নেতাদের প্রকাশিত আশাবাদের কথা পুনর্ব্যক্ত করেছেন।
'মহামারি-পরবর্তী সময়ে বৈশ্বিক ব্র্যান্ডগুলো ব্যাপক আমদানি করেছিল। এসব পণ্যের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ তাদের কাছে মজুত ছিল। তা সত্ত্বেও গত বছর পশ্চিমা দেশগুলোতে শীত একটু তাড়াতাড়ি পড়ায় বেশিরভাগ খুচরা আউটলেট ইতোমধ্যেই তাদের সংগ্রহে থাকা পোশাক বিক্রি করে ফেলেছে,' তিনি টিবিএসকে বলেন।
গত বছর ডেনমার্কে তার ব্যক্তিগত সফরের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে শফিকুর বলেন, সাধারণত পশ্চিমে শীতকালীন তুষারপাত হয় ডিসেম্বরের শেষের দিকে। কিন্তু এবার এক মাস আগেই তুষার পড়তে শুরু করে। এতে খুচরা দোকানগুলোর পোশাক দ্রুত বিক্রি হয়ে যায়।
'ব্যবসায়িক সুযোগ বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। কিছু রপ্তানিকারক মে থেকে জুনের মধ্যে ক্রয়াদেশের জন্য বর্তমানে ক্রেতাদের সঙ্গে আলোচনা করছেন,' শফিকুর রহমান বলেন।
তিনি আরও বলেন, টেক্সটাইল উৎপাদনকারীরা জুনের শুরু থেকে ফ্যাব্রিক উৎপাদন শুরু করার পরিকল্পনা করছে। পোশাক উৎপাদন জুনের পর শুরু হয়ে নভেম্বর পর্যন্ত চলবে বলে আশা করা হচ্ছে।
একটি ইউরোপীয় ব্র্যান্ডের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা টিবিএসকে জানিয়েছেন, তারা বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে সম্ভাব্য রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার আশঙ্কা করছিলেন। কিন্তু নির্বাচন শেষ হওয়ায় তারা এখন পরিস্থিতি নিয়ে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করছেন।
অন্য একটি বহুজাতিক বায়িং হাউসের ব্যবসায়িক উন্নয়ন বিষয়ক প্রধান — যিনি দক্ষিণ কোরিয়ার বাজারও তত্ত্বাবধান করেন — বিভিন্ন দেশে মুদ্রাস্ফীতি হ্রাসের কথা উল্লেখ করে বর্তমান বছরটি পোশাক ব্যবসার জন্য অনুকূল হবে বলে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন।
এ কর্মকর্তা বলেন, কোরিয়ার আমদানি বাজার আগের বছরের তুলনায় স্থিতিশীল রয়েছে এবং বাংলাদেশি রপ্তানিকারকেরা তাদের প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশের কারণে প্রবৃদ্ধি দেখতে পাচ্ছেন।
কিছু চ্যালেঞ্জ এখনো মোকাবিলা বাকি
বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, উজ্জ্বল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও আগামী দিনে দেশের পোশাক শিল্প অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে চলেছে। গত বছরের ডিসেম্বর থেকে কারখানাগুলোয় কর্মীদেন ন্যূনতম মজুরি বাড়ানো, ঋণের হার বৃদ্ধি এবং গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ার কারণে উৎপাদন খরচ উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
জাবের অ্যান্ড জুবায়ের ফ্যাব্রিক্স লিমিটেডের শফিকুর রহমান বলেন, লোহিত সাগরের সংঘর্ষের কারণে ফ্রেইট খরচ এবং লিড টাইম [ক্রয় আদেশের পর থেকে ক্রেতার কাছে পণ্য পৌঁছানো পর্যন্ত সময়] বেড়েছে। এখন প্রতিটি কারখানাকে তাদের চালানের সময় বাড়াতে হচ্ছে যা কেবল বাংলাদেশ নয়, সমস্ত পোশাক রপ্তানিকারক দেশের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তবে যেসব দেশে গভীর সমুদ্র বন্দর রয়েছে তারা প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা পাবে। ফ্রেইট খরচ বাড়ার ফলে কাঁচামাল আমদানি খরচও বাড়াবে। এ মুহুর্তে আমাদের ক্রেতারা পণ্যের প্রকৃত খরচের তুলনায় কম দাম আশা করেন।
বর্তমানে কিছু শিল্প অঞ্চল শীতকালীন গ্যাস সরবরাহের ঘাটতির সম্মুখীন হচ্ছে। তবে সরকার এলএনজির জন্য দীর্ঘমেয়াদি আমদানি-অংশীদার খুঁজছে, যা গ্যাস সরবরাহের জন্য একটি সমাধান হতে পারে, বলেন শফিকুর রহমান।
টেক্সটাইল উৎপাদনকারীরা উৎপাদন খরচে এবং কিছু ক্ষেত্রে তার চেয়েও কমে পণ্য বিক্রি করে তাদের ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন, বলেন তিনি।
তবে তিনি উল্লেখ করেন, বাংলাদেশের পোশাক শিল্প গত ৪০ বছরে প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলায় সহনশীলতা দেখিয়েছে।
'আমাদের পোশাক, টেক্সটাইল এবং আনুষঙ্গিক সুবিধা কাছাকাছি রয়েছে, যা অন্যান্য দেশের সাপেক্ষে একটি তুলনামূলক সুবিধা,' তিনি বলেন।
শফিকুর রহমান আরও বলেন, 'আমাদের কর্মীরা তাদের সর্বোচ্চ শারীরিক সক্ষমতা ব্যবহার করেও চীনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারছেন না কারণ চীন সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রপাতি ব্যবহার করছে। আমাদের শ্রমিকেরা বহুমুখী কাজ করেন; তারা বিভিন্ন ধরনের মেশিন পরিচালনা করতে পারেন।'