আওয়ামী লীগের সময় জোর করে দখল হওয়া ব্যাংকগুলো নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে, বিভিন্ন ব্যাংকে বিক্ষোভ
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এটির সময়ে জোরপূর্বক নির্দিষ্ট কিছু গোষ্ঠীর দ্বারা দখল হওয়া ব্যাংকগুলো নিয়ন্ত্রণ হারাতে শুরু করেছে। গত তিনদিনে বেশকিছু ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ের কিছু কর্মকর্তা পদত্যাগ করে ব্যাংক ছেড়ে যাচ্ছেন।
বৃহস্পতিবার (৮ আগস্ট) এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে থাকা এসআইবিএল (সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক পিএলসি)-এর নিয়ন্ত্রণ নেন আগের উদ্যোক্তা পরিচালকেরা। এছাড়া একই গ্রুপের অধীনে কয়েকমাস আগে নিয়ন্ত্রণে যাওয়া ন্যাশনাল ব্যাংকে আবার মালিকানা বদলের তোড়জোড় চলছে।
বর্তমানে ন্যাশনাল ব্যাংকের চেয়ারম্যান এবং পরিচালকরা পালিয়ে রয়েছেন। সব মিলিয়ে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বেশিরভাগ ব্যাংক ঋণ অনুমোদন ও বিতরণ বন্ধ রেখেছে বলে জানা গেছে।
এর আগে গত ৬ আগস্ট ইসলামী ব্যাংকে এস আলম গ্রুপের কাউকে ঢুকতে না দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
ব্যাংক কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০১৭ সালে নিয়ন্ত্রণ হারানো বেসরকারি খাতের এসআইবিএল-এ গতকাল দলবল নিয়ে যান সাবেক চেয়ারম্যান মেজর (অব.) ডা. রেজাউল হকসহ কয়েকজন পরিচালক। তারা দুই ডিএমডিকে পদত্যাগে বাধ্য করেন। আর এদিন এমডি উপস্থিত ছিলেন না।
এছাড়া ২০১৭ সালে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরি জাবেদের পরিবার ইউসিবির পর্ষদ থেকে পারটেক্স গ্রুপের সবাইকে সরিয়ে কর্তৃত্ব নেয়।
জানা গেছে, বর্তমান পরিচালকদের আর ব্যাংকে ঢুকতে না দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন শেয়ারহোল্ডার ও বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা।
এছাড়া নামে-বেনামে ঋণ দিয়ে তা পাচারে সহায়তাকারীদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা, অবৈধ নিয়োগ বাতিল, জোর করে চাকরিচ্যুতদের পুনর্বহালসহ বিভিন্ন দাবিতে কিছু সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকে সম্প্রতি বিক্ষোভ হয়েছে।
ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নিচ্ছেন পুরোনো পরিচালকেরা
২০১৭ সালে ইসলামী ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নেয় এস আলম গ্রুপ। তাদের নিয়োগ দেওয়া পরিচালক বা কর্মকর্তাদের আর ঢুকতে না দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
অবশ্য এস আলম গ্রুপের নিয়োগ দেওয়া বড় পর্যায়ের কেউ গত মঙ্গলবার থেকে ব্যাংকটিতে আসছেন না। ২০১৭ সালের পর নিয়োগ পাওয়া কয়েকজন কর্মচারী গতকাল ব্যাংকে এলে তাদের বের করে দেওয়া হয়।
এদিকে জানা গেছে, ইউসিবির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা পারটেক্স গ্রুপের এম এ হাসেম পরিবার মালিকানা ফেরত পাওয়ার চেষ্টা করছে।
এ লক্ষ্যে বুধবার কয়েকজন শেয়ারহোল্ডারের নামে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ও বিএসইসি চেয়ারম্যান বরাবর একটি চিঠি দেওয়া হয়। চিঠিতে ব্যাংকের আর্থিক খারাপ অবস্থার চিত্র তুলে ধরে অবিলম্বে মালিকানা বদল চাওয়া হয়।
অন্যদিকে গতকাল ব্যাংকটির শেয়ারহোল্ডারদের ব্যানারে সাইফুজ্জামান চৌধুরি জাবেদ ও তার পরিবারের বিচারের দাবিতে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় অবৈধভাবে লন্ডনে ইউসিবি ব্যাংকের ১২ হাজার কোটি টাকা পাচারকারী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ ও পরিবার থেকে ইউসিবি ব্যাংকের মুক্তি ও তাদের শাস্তি দাবি করা হয়।
২০১৭ সালে শরীয়াভিত্তিক পরিচালিত এসআইবিএল-এর মালিকানা নেয় এস আলম গ্রুপ। বাংলাদেশ ব্যাংক ও একটি গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তায় রাজধানীর ওয়েস্টিন হোটেলে সব পরিচালককে তুলে নিয়ে এই ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নেওয়া হয়।
গতকাল ওই সময়কার চেয়ারম্যান মেজর (অব.) ডা. রেজাউল হক, তখনকার অন্যতম পরিচালক আনিসুল হকসহ কয়েকজন পরিচালক ব্যাংকে যান। তারা ব্যাংকে গিয়ে বোর্ডরুম ও চেয়ারম্যানের জন্য নির্ধারিত কক্ষে গিয়ে বসে পড়েন। এ সময় অনেক কর্মকর্তা সেখানে জড়ো হয়ে ব্যাংকটি 'এস আলমমুক্ত' করার দাবি তোলেন।
উপস্থিত আন্দোলনকারীদের চাপে পদত্যাগে বাধ্য হন এস আলম গ্রুপের আস্থাভাজন, ব্যাংকের ডিএমডি আব্দুল হান্নান খান ও মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান। অবশ্য পরিচালনা পর্ষদের সবাই পলাতক থাকায় তাদের পদত্যাগপত্র গৃহীত হবে কি না, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
ব্যাংকগুলোতে বিক্ষোভ
নামে-বেনামে ঋণ দিয়ে তা পাচারে সহায়তাকারীদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা, অবৈধ নিয়োগ বাতিল, জোর করে চাকরিচ্যুতদের পুনর্বহালসহ বিভিন্ন দাবিতে কিছু সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকে সম্প্রতি বিক্ষোভ হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকে বুধবার নজিরবিহীন বিক্ষোভের মাধ্যমে ঊর্ধ্বতন কয়েকজন কর্মকর্তাকে বের করে দেওয়ার পর গতকাল বৃহস্পতিবার আবারও বিক্ষোভ হয় বলে জানা গেছে।
বিক্ষুব্ধ কর্মকর্তারা গত বুধবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চার ডেপুটি গভর্নর, বিএফআইইউ প্রধান ও নীতি উপদেষ্টাকে বের করে দেন। তারা কেউ আজ আর অফিসে আসেননি।
গত সোমবার থেকে আর অফিস করছেন না বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। তিনি কোথায় আছেন তাও জানেন না কর্মকর্তারা।
বর্তমানে নির্বাহী পরিচালকেরা নিজেদের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের দৈনন্দিন কাজ অব্যাহত রেখেছেন। কোনো ধরনের সংকট যেন তৈরি না হয়, সে জন্য তারা গতকাল বৈঠক করেন।
জানা গেছে, গতকাল বেসরকারি খাতের আইএফআইসি, বাংলাদেশ কমার্সসহ কয়েকটি ব্যাংকে বিক্ষোভ হয়েছে।
অন্যদিকে সুযোগ-সুবিধা ও ইনসেনটিভের দাবিতে গতকাল রাষ্ট্রীয় মালিকানার সোনালী, জনতা ও অগ্রণী ব্যাংকে বিক্ষোভ হয়। পদোন্নতির ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার কর্মকর্তারা বিক্ষোভ করেন।
ব্যাংক খাতের এ পরিস্থিতিতে বেশিরভাগ ব্যাংকের ঋণ অনুমোদন ও বিতরণ বন্ধ রয়েছে বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা।