এস আলমের দুই ব্যাংককে দেওয়া ১,০০০ কোটি টাকার শর্ট লোন আদায় করতে পারছে না সোনালী ব্যাংক
ঋণ বিতরণে ব্যাপক জালিয়াতি ও অনিয়মের ঘটনায় জড়িত এস আলম গ্রুপের মালিকানায় থাকা ব্যাংকগুলো। তারা ঋণ নিয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক থেকে, যা আদায় করতেই এখন হিমশিম খাচ্ছে ব্যাংকটি।
জরুরি টাকার সংকট মেটাতে ১১.৫ শতাংশ সুদে শর্ট নোটিশ ডিপোজিট খাতে রাষ্ট্রায়ত্ব সোনালী ব্যাংক থেকে ১৪ দিন মেয়াদে ১,০০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি। তারপর ২৪৮ দিন কেটে গেছে, এখনও ঋণের ৮৭০ কোটি টাকা পরিশোধ করেনি ইসলামী ব্যাংক।
ঋণটি এর মধ্যে ১৬ বার মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে। সর্বশেষ গত ২৯ জুলাই আবারও ১৪ দিন মেয়াদে ঋণটি নবায়ন করেছে সোনালী ব্যাংক। প্রতিবার মেয়াদ পূর্তিতে ঋণের সুদ এবং তার সঙ্গে মূল ঋণ থেকে নামমাত্র পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করে পুনঃনবায়নের আবেদন করছে এক সময়কার শক্তিশালী ইসলামী ব্যাংক। বার বার তাগাদা দিয়েও ঋণের অর্থ আদায় করতে ব্যর্থ হয়ে সোনালী ব্যাংকও বাধ্য হয়ে তা নবায়ন করে যাচ্ছে।
শর্ট নোটিশ ডিপোজিট বা এসএনডি খাতে এই বিনিয়োগের পাশাপাশি ফান্ড প্লেসমেন্টখাতে বিনিয়োগসহ সোনালী ব্যাংকের মোট ১,০৭০ কোটি টাকার বিনিয়োগ আটকে আছে ইসলামী ব্যাংকে।
এসআলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণাধীন ন্যাশনাল ব্যাংক পিএলসি-ও একইভাবে সোনালী ব্যাংকের ১৩০ কোটি টাকা নিয়ে ফেরত দিচ্ছে না।
সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ১,০০০ কোটি টাকার ঋণের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে সোনালী
এই দুই ব্যাংকে বিনিয়োগ আটকে যাওয়ার কারণে এসআলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণাধীন আরেক ব্যাংক সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড (এসআইবিএল) এর ১,০০০ কোটি টাকার এসএনডি প্রস্তাব অনুমোদন করেনি সোনালী ব্যাংক। অন্য কোনো গ্রহণযোগ্য ব্যাংক গ্যারান্টি না দিলে এই ঋণ দেবে না বলে সিদ্ধান্ত দিয়েছে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ।
গত ৯ জুলাই অনুষ্ঠিত সোনালী ব্যাংকের বোর্ড মিটিং এর কার্যবিবরণীতে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে, ''পর্ষদ লক্ষ্য করে যে, সাম্প্রতিক বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ফান্ড প্লেসমেন্টখাতের বিনিয়োগগুলো সুদাসলে ফেরত আনা সম্ভব হচ্ছে না। প্রায় সকল ক্ষেত্রেই ফান্ড গ্রহণকারী ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অনুরোধের প্রেক্ষিতে বিনিয়োগকৃত ফান্ডের মেয়াদ পূর্তিতে শুধু সুদ বা ক্ষেত্রবিশেষে সামান্য আসল আদায় করে তা নবায়ন অনুমোদন করা হচ্ছে।''
''পর্ষদ আরও লক্ষ্য করে যে, গত বছরের শেষ দিকে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসির অনুকূলে শর্ট নোটিশ ডিপোজিট খাতে ১৪ দিন মেয়াদে ১,০০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হলেও ব্যাংকটি প্রতিশ্রুত সময়ে তা ফেরত দিতে পারেনি। প্রাপ্য সুদসহ ন্যূনতম পরিমাণ আসল পরিশোধ করে বার বার তা নবায়ন করতে হচ্ছে। ফলে ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোর প্রেক্ষাপট বিবেচনায়, গ্রহণযোগ্য কোনও ব্যাংকের গ্যারান্টি প্রদান ব্যতিরেকে ফান্ড প্লেসমেন্টখাতে বিনিয়োগ ঝূঁকিপূর্ণ বলে মনে করে পর্ষদ। তাই এসআইবিএলের প্রস্তাবে অসম্মতি জানায় পর্ষদ''- বলেছে সোনালী ব্যাংকের পর্ষদ।
গণমাধ্যমের কাছে মুখ খুলছেন না ব্যবস্থাপকরা
এ বিষয়ে ইসলামী ব্যাংকের ঊধ্বর্তন কোনো কর্মকর্তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মনিরুল মওলা এবং ভারপ্রাপ্ত সিএফও মো. ফরিদ উদ্দিন এর মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করলেও তারা রিসিভ করেননি।
পরে ব্যাংকটির জনসংযোগ কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করে ঊধ্বতন কর্মকর্তাদের বক্তব্য চাওয়া হলে, তিনি জানান, বোর্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী একমাত্র এমডি স্যার ছাড়া আর কেউ কোনো বক্তব্য দিতে পারেন না।
'তারল্য সমস্যা'
তবে সোনালী ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, "তারল্য সংকটের কারণে ব্যাংকটি বিনিয়োগের অর্থ ফেরত দিতে পারেনি বলে আমাদেরকে জানিয়েছে। আমরা দোয়া করি যেন ইসলামী ব্যাংক টিকে থাকে। ব্যাংকটি টিকে থাকলে এক সময় সোনালী ব্যাংক বিনিয়োগের অর্থ ফেরত পাবে।"
দেশের ব্যাংকখাতে সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যাংক হিসেবে দীর্ঘদিন অবস্থান ধরে রাখা ইসলামী ব্যাংক এসআলম গ্রুপের আগ্রাসী ঋণ জালিয়াতিতে ধসে পড়েছে। নামে-বেনামে এই ব্যাংক থেকে এস আলম গ্রুপ একাই ৭৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। ফলে ব্যাংকটি গ্রাহকদের আমানতের অর্থ পরিশোধ করতে বাংলাদেশ ব্যাংক, সোনালী ব্যাংকসহ বিভিন্ন ব্যাংক থেকে উচ্চ সুদে স্বল্পমেয়াদে ঋণ করে চলছে।
সোনালী ব্যাংককে বার বার আসল পরিশোধে ব্যর্থ হওয়া
গত ৯ জুলাই ও ২৯ জুলাই অনুষ্ঠিত সোনালী ব্যাংকের দু'টি বোর্ড সভার কার্যবিবরণীতে দেখা যায়, ইসলামী ব্যাংক ফান্ড প্লেসমেন্ট ও এসএনডি খাতে সোনালী ব্যাংক থেকে স্বল্প মেয়াদে ঋণ নিলেও – মেয়াদ শেষে ঋণের আসল অর্থ পরিশোধ করছে না। প্রতিবার ঋণের সুদ ও তার সঙ্গে নামমাত্র পরিমাণ আসল অর্থ পরিশোধ করে – বাকি অর্থ পুনঃনবায়নের আবেদন করছে ব্যাংকটি।
এই অবস্থায়, সোনালী ব্যাংক বার বার সুদাসলের পুরো অর্থ ফেরত চেয়ে তাগাদা দিয়েও আসল অর্থ উদ্ধার করতে পারছে না। ফলে বাধ্য হয়ে বার বার ঋণ নবায়ন করতে হচ্ছে। ৯ জুলাই অনুষ্ঠিত পর্ষদ সভায় ইসলামী ব্যাংকের এ ধরণের তিনটি ঋণ পুনঃনবায়ন করে সোনালী ব্যাংক।
গত বছরের শেষ দিকে ১৪ দিন মেয়াদে এসএনডি খাতে সোনালী ব্যাংক থেকে নেওয়া ১,০০০ কোটি টাকা ঋণ কয়েক দফা নবায়নের পর— গত ১৩ জুন মেয়াদ শেষে বকেয়া আসলের পরিমাণ দাঁড়ায় ৮৯০ কোটি টাকা। পরে এর মেয়াদ আরও ১৪ দিন বাড়িয়ে ২৬ জুন পর্যন্ত নবায়ন করে ইসলামী ব্যাংক।
এই মেয়াদ শেষ হলে মুনাফার সঙ্গে মূল ঋণের ১০ কোটি টাকা ফেরত দিয়ে – বাকি ৮৮০ কোটি টাকা নবায়নের আবেদন করে ইসলামী ব্যাংক। তার প্রেক্ষিতে এই ঋণের মেয়াদ ১০ জুলাই পর্যন্ত নবায়ন করে সোনালী ব্যাংক।
এই মেয়াদ শেষ হলে ইসলামী ব্যাংক সুদ বাবদ ৩ কোটি ৯৩ লাখ টাকা এবং ঋণের আসল থেকে ১০ কোটি টাকা পরিশোধ করে। বাকি ৮৭০ কোটি টাকা পুনঃনবায়নের আবেদন করলে, সোনালী ব্যাংক তা ২৪ জুলাই পর্যন্ত মেয়াদে নবায়ন করে। এই মেয়াদ শেষেও ইসলামী ব্যাংক অর্থ পরিশোধ করেনি।
একইভাবে ইসলামী ব্যাংকে ফান্ড প্লেসমেন্ট খাতে সোনালী ব্যাংকের বিনিয়োগ করা ২০০ কোটি টাকার মেয়াদ শেষ হয়েছে গত ১৩ জুন। কিন্তু, ব্যাংকটি তা পরিশোধ না করায় ৯১ দিন মেয়াদে আগামী ১১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময় দিয়ে নবায়ন করেছে সোনালী ব্যাংকের পর্ষদ।
এসআলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণাধীন ন্যাশনাল ব্যাংকের অনুকূলে সোনালী ব্যাংকের ফান্ড প্লেসমেন্টখাতে বিনিয়োগ করা ১৩৫ কোটি টাকার মেয়াদ শেষ হলেও ব্যাংকটি অর্থ পরিশোধ করেনি। এই ঋণের সুদ বাবদ ৭ কোটি .৯৪ লাখ টাকা ও আংশিক আসল বাবদ ৫ কোটি টাকা পরিশোধ করে— বাকি ১৩০ কোটি টাকা পুনঃনবায়নের আবেদন করে ব্যাংকটি। ফলে বাধ্য হয়ে সোনালী ব্যাংক ১৮২ দিন মেয়াদে ওই ঋণ নবায়ন করেছে সোনালী ব্যাংক।
সোনালী ব্যাংক থেকে ফান্ড প্লেসমেন্টখাতে ১,০০০ কোটি টাকা চেয়ে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের একটি আবেদন ৯ জুলাইয়ের বোর্ড সভায় গেলে তা বাতিল করে দেয় পর্ষদ।