চট্টগ্রাম বন্দর থেকে নৌপথে পণ্য পরিবহনে নেই সিন্ডিকেট, পরিবহন ব্যয় কমেছে ২৫%
পণ্য পরিবহনে সিন্ডিকেট না থাকায় এখন চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙর থেকে দেশের ৩৪টি নৌ রুটে পণ্য পরিবহন হচ্ছে ওপেন মার্কেট সিস্টেমে। এর ফলে লাইটার জাহাজে পণ্য পরিবহন ব্যয় অন্তত ২৫ শতাংশ পর্যন্ত কমে গেছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
এর প্রভাবে বাজারে পণ্যমূল্যের ওপর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে আশা করছেন তারা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে লাইটার জাহাজে পণ্য পরিবহন নিয়ন্ত্রণ করত ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেল (ডব্লিউটিসি)। জাহাজ মালিকদের সংগঠনের মধ্যে বিরোধের পর মার্কেন্টাইল মেরিন অফিস (এমএমও) গত এপ্রিলে বাংলাদেশ ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট কোঅর্ডিনেশন সেল (বিডব্লিউটিসিসি) প্রতিষ্ঠা করে।
তবে জাহাজ মালিকরা সংগঠনের অধীনে একত্রিত না হওয়ায় বিডব্লিউটিসিসি চালু হয়নি।
সিন্ডিকেট হিসেবে কাজ করা এসব সংগঠন না থাকায় আমদানি পণ্যের মালিক ও এজেন্টরা এখন তাদের পছন্দমতো জাহাজ ভাড়া করে পণ্য পরিবহন করতে পারছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গণ-আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে সিন্ডিকেটগুলো সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে।
জাহাজের নিবন্ধনকারী সরকারি প্রতিষ্ঠান এমএমও, জাহাজ মালিক ও আমদানিকারকরা জানিয়েছেন, নৌপথে পণ্য পরিবহন কোনো সেলের অধীনে হোক, সেটি তারা চান না।
তারা বলছেন, ওপেন মার্কেট সিস্টেমে পণ্য পরিবহন হলে কমিশন বাবদ টনপ্রতি ২০ টাকা পরিবহন ব্যয় কমে আসবে। একইসঙ্গে কমবে বাড়তি ভাড়া আদায়সহ নৈরাজ্য।
তবে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর চট্টগ্রাম বন্দরে নৌপথে পণ্য পরিবহন ও পণ্য খালাসে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জে আনলোডিং পয়েন্টে ঘাটে ভাঙচুর ও হামলার কারণে জাহাজগুলো অন্তত পাঁচ দিন পণ্য খালাস করতে পারেনি।
সীকম গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আমিরুল হক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, আগে বিভিন্ন সেলের মাধ্যমে পণ্য পরিবহন নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় তাদের নির্ধারিত দরে পণ্য পরিবহন হতো। এখন আর সেটি নেই।
'বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পর এই সিন্ডিকেট পুরোপুরি ভেঙে গেছে,' বলেন তিনি।
আমিরুল হক জানান, আগে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে টনপ্রতি ভাড়া ছিল ৫৮৫ টাকা। এখন সেটি ৪৪০ টাকায় নেমে এসেছে। 'পণ্য পরিবহন ব্যয় কমে এলে স্বাভাবিকভাবে পণ্যের মূল্যও কমে যাবে।'
তিনি আরও বলেন, কোনোভাবেই যাতে আর এই পণ্য পরিবহন ব্যবস্থা কোনো সিন্ডিকেটের দখলে না যায়, সেজন্য সংশ্লিষ্টদের সিদ্ধান্তে আসতে হবে।
সাধারণ জাহাজ মালিক, লজিস্টিক কোম্পানি এবং শিল্প মালিকরা যেন তাদের নিজ নিজ পছন্দ অনুযায়ী পণ্য পরিবহন করতে পারে, এটি নিশ্চিত করতে হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
চট্টগ্রাম বন্দরের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা জাহাজের ৪৫ শতাংশই বাল্ক ক্যারিয়ার বা খোলা পণ্যবাহী। বাল্ক ক্যারিয়ার জাহাজযোগে মুলত গম, চাল, ডাল, চিনি, ভুট্রা, ছোলা, খাদ্যপণ্য, সিমেন্ট ক্লিংকার, স্ক্র্যাপসহ বিভিন্ন পণ্য আসে। এই বন্দরে আসা খোলা পণ্যের ৭৫ শতাংশ বর্হিনোঙরে লাইটার জাহাজে খালাস হয়। বাকি ২৫ শতাংশ পণ্য খালাস হয় বন্দর জেটিতে।
চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে পণ্য লাইটার জাহাজে খালাস করা হয়। এসব পণ্য দেশের ৩৪টি নৌ রুটে পরিবহন করে প্রায় আড়াই হাজার লাইটার জাহাজ।
এর মধ্যে ডব্লিওসিটির নিয়ন্ত্রণে ছিল প্রায় ১ হাজার ৩০০টি জাহাজ। এছাড়া বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন ৪০০টি জাহাজ বন্দর থেকে পণ্য পরিবহনে যুক্ত ছিল।
সেলের বাইরে বিভিন্ন লজিস্টিকস কোম্পানিও লাইটার জাহাজ পরিচালনা করত। পরবর্তীতে ডব্লিওটিসি ভেঙে গেলে চট্টগ্রামভিত্তিক ইনল্যান্ড ভেসেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অভ চট্টগ্রাম (আইভোয়াক) এবং বাংলাদেশ কার্গো ভেসেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিসিভিওএ) আলাদাভাবে জাহাজের সিরিয়াল দিত।
বর্তমানে ব্যক্তিমালিকানাধীন, শিল্প গ্রুপ ও লজিস্টিকস কোম্পানির প্রতিদিন প্রায় ১০০ লাইটার জাহাজ পণ্য পরিবহন করছে।
চট্টগ্রাম বন্দর থেকে লাইটার জাহাজে পণ্য লোডিং স্বাভাবিক থাকলেও ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ সহ বিভিন্ন আনলোডিং পয়েন্টে পণ্য খালাস বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বিভিন্ন ঘাটে হামলা ও পণ্য লুটের আশঙ্কায় জাহাজগুলো ঘাটের অদূরে নদীতে অবস্থান করছে বলে জানিয়েছেন লাইটার জাহাজ শ্রমিকরা।
এমএমওর প্রিন্সিপাল অফিসার ক্যাপ্টেন সাব্বির মাহমুদ টিবিএসকে বলেন, 'নৌপথে পণ্য পরিবহন এখন ওপেন মার্কেটে পরিচালিত হচ্ছে। কার্গো মালিক সরাসরি জাহাজ বুকিং নিচ্ছে।'
তিনি আরও বলেন, 'গত সরকারের সময়ে নতুন সেল গঠনের বিষয়ে একটি চেষ্টা চলছিল। কিন্তু জাহাজ মালিক সংগঠনগুলো ঐকমত্যে না আসায় সেটি সম্ভব হয়নি। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার এই বিষয়ে কী সিন্ধান্ত নেয়, তার ওপর নির্ভর করবে নতুন সেল গঠন হবে কি না।'
সাব্বির আহমেদ বলেন, 'বর্তমানে ওপেন মার্কেট সিস্টেমে জাহাজ ভাড়া নেওয়ায় পণ্য পরিবহনে খরচ আগের তুলনায় কমে এসেছে।'
চট্টগ্রাম, মোংলাসহ বিভিন্ন বন্দরে পণ্য পরিবহনকারী লজিস্টিকস কোম্পানি এএমএমএস গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শফিকুল আলম জুয়েল বলেন, 'ডব্লিওটিসি গঠিত হয়েছিল বন্দরের বহির্নোঙর থেকে পণ্য পরিবহনের সমন্বয় করতে। কিন্তু তারা নৌ রুটে পণ্য পরিবহন ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ শুরু করে। এই সেল টনপ্রতি ২০ টাকা কমিশন নিত। নিজেদের ইচ্ছামাফিক জাহাজ বরাদ্দ দিত। পণ্য পরিবহনে বিলম্ব হলে ডাবল ভাড়া চাপিয়ে দিত।
'এর ফলে পণ্য পরিবহন ব্যয় বেড়ে যেত দ্বিগুণ। কোনো অবস্থাতেই যাতে বন্দরের পণ্য পরিবহন সেল কিংবা সিন্ডিকেটের দখলে না যায়, সেটি নিশ্চিত করতে হবে।'
২০০৩ সালে বাংলাদেশ কার্গো ভেসেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিসিভিওএ), কোস্টাল শিপ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অভ বাংলাদেশ এবং ইনল্যান্ড ভেসেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অভ চট্টগ্রাম (আইভোয়াক) যৌথভাবে ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেল প্রতিষ্ঠা করে।
শিপিং খাতের ব্যবসায়ীরা জানান, ডব্লিওটিসি নিয়ন্ত্রন করত বিসিভিওএ। এর নেপথ্যে ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শিল্প ও বিনিয়োগ উপেদেষ্টা সালমান এফ রহমান, মাদারীপুর-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য নূর-ই-আলম চৌধুরী লিটন ও ডব্লিওটিসির কনভেনর নুরুল হক চৌধুরীসহ একটি চক্র।
চট্টগ্রামভিত্তিক আইভোয়াকের নিয়ন্ত্রণে ছিলেন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র আজম নাছির উদ্দিন, নারায়ণগঞ্জের সাবেক সংসদ সদস্য শামীম ওসমান, নোয়াখালীর সাবেক সংসদ সদস্য একরাম চৌধুরী ও আইভোয়াকের মুখপাত্র পারভেজ আহমেদসহ বেশ কিছু নেতা।
আইভোয়াকের মুখপাত্র পারভেজ আহমেদ টিবিএসকে বলেন, আইভোয়াক ও ডব্লিউটিসির কার্যক্রম নিষ্ক্রিয় থাকার পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমানে নৌপথে পণ্য পরিবহনকারী ঠিকাদাররা তাদের নিজস্ব নৌবহরের মাধ্যমে পণ্য পরিবহন করছে।
বিসিভিওএর সেক্রেটারি নুরুল হক বলেন, বর্তমানে কোনো সেলের অধীনে জাহাজ নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে না। 'এটি এখন এলোমেলো অবস্থায় আছে। তবে আমরা পরবর্তীতে এটি ঠিক করে নেব।'
বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের যুগ্ন-সাধারণ সম্পাদক নবী আলম বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর থেকে লাইটার জাহাজে পণ্য লোডিং স্বাভাবিক রয়েছে। '১০ আগস্ট থেকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে।'