উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও রাজস্ব আহরণ বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয়: আইএমএফ
উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও রাজস্ব আহরণ কমে যাওয়া বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় বলে অর্থ মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছে আইএমএফ-এর সফররত ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং টিম। বাংলাদেশের রাজস্ব-জিডিপি অনুপাতকে দক্ষিণ সুদানের সঙ্গে তুলনা করে তারা বলেছেন, রাজস্ব আহরণ বাড়াতে সংস্কার কাজে জোর দিতে হবে।
আইএমএফ প্রতিনিধিদের সঙ্গে মঙ্গলবার (২৪ সেপ্টেম্বর) অর্থ উপদেষ্টা, অর্থ সচিবসহ অর্থ মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন অনুবিভাগের কর্মকর্তাদের ৪টি সভা হয়েছে। এতে অর্থনীতির বর্তমান পরিস্থিতি ও আগামী দিনের পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন আইএমএফ কর্মকর্তারা।
এসব সভায় অংশ নেওয়া অর্থ বিভাগের একাধিক অতিরিক্ত সচিব দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ছাত্র-জনতা অভ্যুত্থান-পরবর্তী অর্থনৈতিক পরিস্থিতি জানতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) এ টিম বাংলাদেশে এসেছে।
ব্যাংক ও আর্থিক খাত, রাজস্ব খাত সংস্কার করার জোরালো সুপারিশ করার পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও জিডিপির অনুপাতে রাজস্ব আহরণ বাড়ানোকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় উদ্বেগ বলে উল্লেখ করেছেন প্রতিনিধি দলটির সদস্যরা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন অতিরিক্ত সচিব টিবিএসকে বলেন, সরবরাহের সমস্যার কারণে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে, না-কি ডিমান্ড সাইড ম্যানেজমেন্টে সমস্যার কারণে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে, তা জানতে আইএমএফ-এর সহায়তা চাওয়া হয়েছে।
ওই কর্মকর্তা বলেন, চাঁদাবাজি মূল্যস্ফীতির অন্যতম প্রধান কারণ বলে মনে করেন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। 'ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের পর টাকার ২৫ শতাংশ দরপতন হয়েছে। সে হিসেবে জিনিসপত্রের দাম সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে। কিন্তু গত দুবছরে অনেক পণ্যের দাম দ্বিগুণ হয়েছে। বাজার ব্যবস্থাপনায় কোন ধরনের পরিবর্তন আনার মাধ্যমে এটি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে, সে বিষয়ে আইএমএফ-এর সহায়তা চেয়েছি আমরা,' বলেন তিনি।
অন্য একজন কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, গত জুলাই ও আগস্ট মাসের অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে রাজস্ব আহরণ অনেক কমে গেছে। আইএমএফ কর্মকর্তারা ভবিষ্যতে ব্যবসায়িক আস্থা তৈরির মাধ্যমে রাজস্ব সংগ্রহ কীভাবে বাড়ানো হবে, সে বিষয়ে খোঁজখবর নেন।
চলতি অর্থবছরের বাজেট ঘাটতি লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে থাকবে কি না, তা জানতে চেয়েছে আইএমএফ। এ প্রশ্নের সুনির্দিষ্ট কোনো উত্তর দিতে পারেননি অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা। তবে বাজেট ঘাটতির পরিমাণ কমবে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন তারা।
এ বিষয়ে অর্থ বিভাগের সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানান, বাজেট ঘাটতির পরিমাণ শুধু রাজস্ব আয়ের ওপর নির্ভরশীল নয়, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি থেকে কী পরিমাণ প্রকল্প বাদ দেওয়া হবে, তার ওপর নির্ভর করবে।
'পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় কতগুলো প্রকল্প বাদ দেবে, সে তথ্য এখনও অর্থ মন্ত্রণালয় জানে না। তাই আইএমএফকেও স্পষ্টভাবে বলা সম্ভব হয়নি,' বলেন তিনি।
অর্থ বিভাগের কর্মকর্তাদের কাছে বকেয়া ভর্তুকি পরিশোধের পরিকল্পনা ও আগামীতে ভর্তুকি কমাতে সার ও জ্বালানির দাম বাড়ানোর পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন আইএমএফ কর্মকর্তারা।
এছাড়া চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে সরকারের ব্যয় অন্যান্য বছরের একই সময়ের তুলনায় অনেক কম হওয়ার কারণও জানতে চেয়েছেন তারা।
এ বিষয়ে অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ছাত্র আন্দোলন ও হাসিনা সরকারের পতনের প্রেক্ষাপটে এ দুমাসে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে ব্যয় কম হওয়ার পাশাপাশি সরকারের পরিচালন ব্যয়ও অনেক কম হয়েছে। এ দুমাসে সরকারের পণ্য ও সেবা ক্রয়ও কম ছিল।
সংস্কারে ব্যবহার হবে আইএমএফ-এর বাড়তি ঋণ
সকালে আইএমএফ প্রতিনিধিদের সঙ্গে উদ্বোধনী বৈঠক শেষে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, আইএমএফ-এর কাছ থেকে যে বাড়তি ঋণ নেওয়া হবে, তা অর্থ পাচার প্রতিরোধ, ব্যাংক ও রাজস্ব খাতের সংস্কারসহ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নানা সংস্কার কাজে ব্যয় করা হবে।
তবে আইএমএফ-এর কাছে কত ঋণ চাওয়া হবে, তা এখনো নির্ধারণ করা হয়নি উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিশ্বব্যাংক, এডিবিসহ [এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক] অন্য দাতা সংস্থাগুলো কী পরিমাণ সহায়তা দেবে, সেটা জানার পর আইএমএফ-কে সহায়তার অঙ্ক জানানো হবে।
সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নানা রকম সংস্কার ও পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য সম্পদ দরকার। 'আমরা যতটুকু পারি দেশীয় সম্পদ আহরণ করব, কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিদেশি সহায়তা লাগবে। যে-সব ক্ষেত্রে বিদেশি সহায়তা লাগবে, তার মধ্যে অন্যতম হলো বাজেট-সহায়তা।'
এ ছাড়া সংস্কারের বিষয়ে সরকার মোটামুটি পদক্ষেপ নিয়েছে। ব্যাংক খাতসহ অন্যান্য খাতে সরকার পদক্ষেপ নিয়েছে, যদিও এ ক্ষেত্রে কিছু সময় লাগবে বলে জানান অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ।
অর্থ উপদেষ্টা বলেন, সম্পদের ঘাটতির পরিমাণ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আরও বিশদ আলোচনা হবে। নীতি ও মূল উদ্দেশ্য নিয়েও আলোচনা হয়েছে।
'আইএমএফ বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গেও আলোচনা করবে। বিদেশি মুদ্রার বাজার ও ব্যাংক খাত সংস্কারে কী করতে হবে, সেটাও জানাবে আইএমএফ। তারা এনবিআর-এর [জাতীয় রাজস্ব বোর্ড] সঙ্গে আলোচনা করবে,' বলেন তিনি।
উপদেষ্টা আরও বলেন, অক্টোবর মাসে আমরা বিশ্বব্যাংকের বার্ষিক সাধারণ সভায় যাব, সেখানে আইএমএফ-এর নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে আলোচনা হবে। 'বর্তমান ঋণ কর্মসূচি নিয়েও আলাপ হবে। ভবিষ্যতের জন্যও আমরা কিছু অনুরোধ করেছি।'
আইএমএফ-এর কাছে কী চেয়েছেন, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের উত্তরে সালেহউদ্দিন বলেন, ব্যাংকিং খাতের সংস্কার, মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ, কর ব্যবস্থাপনা এবং আয়কর ও ভ্যাট সংস্কারে কারিগরি সহায়তা চাওয়া হয়েছে।
শুধু আইএমএফ নয়, অন্যান্য সংস্থা থেকেও সহায়তা চাওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, 'কারা কী সাহায্য করবে, সেটা সমন্বয় করে আইএমএফ-কে সুনির্দিষ্টভাবে বলা হবে। তাদের কাছ থেকে কী সাহায্য দরকার, তাও বলা হবে।'