চিংড়ির রপ্তানি বাড়লেও কমেনি দুশ্চিন্তা
ওমিক্রনের প্রভাব চলাকালীন ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) গত বছরের একই সময়ের তুলনায় রপ্তানির পরিমাণ ৩৮ দশমিক ২৩ শতাংশ বৃদ্ধি পাওয়ায় লাভের মুখ দেখেছেন চিংড়ি রপ্তানিকারকরা।
এক্সপোর্ট প্রোমোশন ব্যুরো, বাংলাদেশ (ইপিবি) এর তথ্য অনুসারে, গত ছয় মাসে চিংড়ি রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ২৬৮ দশমিক ৯৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। যা ২০২০-২১ অর্থবছরের একই সময় ছিল ১৯৪ দশমিক ৫৬ মিলিয়ন ডলার।
ক্রিমসন রোজেলা সিফুড লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ দেলোয়ার হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "২০২০ সালে কোভিড আসার পর বাগদা রপ্তানি বন্ধ হয়ে যায়। তখন দাম ভালো না পাওয়ায় উৎপাদনেও আগ্রহ পায়নি চাষীরা। তবে ২০২১ সালে আমাদের আগের ব্যবসা ফিরে আসে। ২০১৯ এর তুলনায় বরং আমরা ২০২১ সালে ভালো ব্যবসা করেছি।"
বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএফইএ) সভাপতি কাজী বেলায়েত হোসেন টিবিএসকে বলেন, "অন্যান্য বছরের তুলনায় উৎপাদন খুব বেশি হয়েছে এমনটা বলা যাবে না। তবে বিশ্ববাজারে আমরা ব্ল্যাক টাইগার (বাগদা) চিংড়ির ভালো দাম পেয়েছি। ফলে রপ্তানিও বেড়েছে।"
বিএফএফইএর সূত্র জানায়, বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হওয়া চিংড়ির ৮৫ শতাংশ যায় ইউরোপের দেশগুলোতে। ১৫ শতাংশ যায় আমেরিকা, জাপানসহ অন্যান্য দেশে।
এছাড়া চিংড়ির পাশাপাশি লাইভ ফিশের রপ্তানিতেও বড় প্রবৃদ্ধি হয়েছে। লাইফ ফিশের ৩৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলেও এই সেগমেন্টে রপ্তানির পরিমাণ এখনো খুবই কম। ছয় মাসে রপ্তানি হয়েছে ৪ দশমিক ৪১ মিলিয়ন ডলার। তবে চিংড়ি ও লাইফ ফিশ রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি আসলেও কমেছে ফ্রোজেন ফিশ রপ্তানির পরিমাণ। এই সেগমেন্টে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি ছিল ২৩ দশমিক ৯০ শতাংশ।
২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে ৬৬ দশমিক৩৩ মিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি হলেও ২০২১-২২ এর প্রথম ছয় মাসে রপ্তানি হয়েছে ৫৩ দশমিক ০৫ মিলিয়ন ডলার।
তবে এই ব্যবসা আবার হারোনার শঙ্কা করছে রপ্তানিকারকরা। বিএফএফইএ-এর সদস্যরা জানান, বিশ্বব্যাপী ওমিক্রনের সংক্রমন বাড়তে থাকায় গত এক সপ্তাহে অর্ডার কমতে শুরু করেছে। ওমিক্রমের সংক্রমন আরও বাড়লে আবারও রপ্তানিতে বড় ধাক্কা আসবে।
রুচির পরিবর্তন ও অপরিবর্তিত পদ্ধতি
রপ্তানিকারকরা বলছেন, বিশ্ব্যব্যপি চাহিদার শীর্ষে থাকা ভেন্নামি চিংড়ির বাণিজ্যিক উৎপাদন করে বিশ্ববাজারে ব্যবসার দখল বাড়াচ্ছে ভারত, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ডসহ বেশকিছু দেশ। কিন্তু বাংলাদেশ কয়েক বছর ধরে চেষ্টা করলেও এখনও বাণিজ্যিক উৎপাদনে যেতে পারেনি।
বিশ্ব বাজারে বর্তমানে গলদা ও বাগদার চাহিদা কমে, বেড়েছে ভেন্নামি শ্রিম্প বা প্যাসিফিক হোয়াইট-লেগড শ্রিম্পের চাহিদা।
বিশ্বের মোট চিংড়ি রপ্তানির ৭৭ শতাংশই এখন ভেন্নামির দখলে। আর বাগদা চিংড়ির দখলে রয়েছে মাত্র ১১ শতাংশ। বর্তমানে ভেন্নামি চিংড়ির চেয়ে বাগদা চিংড়ির দাম পাউন্ডপ্রতি ২ ডলার বেশি। বৈশ্বিক অর্থনীতির ধীর গতির কারণে ক্রেতারা খরচ কমানো শুরু করেছেন।
জানা গেছে, ২০১৩-১৪ থেকে ২০১৮-১৯ অর্থবছর পর্যন্ত পাঁচ বছরে চিংড়ির বিশ্ব বাজারে বাংলাদেশের দখল ৪ শতাংশ কমে ২ শতাংশে নেমেছে। আর এ সময় ধারাবাহিকভাবে চিংড়ি রপ্তানি কমেছে ৩৩ শতাংশ।
এ সময় চিংড়ির উৎপাদনও ২৮ দশমিক ৩৫ শতাংশ কমে গেছে। ফলে দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত চিংড়ি রপ্তানিকারক কোম্পানিগুলোর শেয়ার যুক্ত করেও নেতিবাচক ধারা দেখা গেছে সে সময়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উচ্চ ফলনশীল এবং দাম কম হওয়ায় হাইব্রিড জাতের এ চিংড়ি চাষ করে ইতোমধ্যে ভারত, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশ ব্যাপক সফলতা পেয়েছে। তবে বাংলাদেশে এ চিংড়ি চাষের বাণিজ্যিক অনুমতি দেয়নি সরকার।
কাজী বেলায়েত হোসেন টিবিএসকে বলেন, "হাইব্রিড জাতের এই সাদা চিংড়ি উচ্চ ফলনশীল এবং দামেও সস্তা। চিংড়ি রপ্তানিতে প্রতিযোগী দেশগুলো এই চিংড়ি উৎপাদন করে অনেক এগিয়েছে। সেখানে আমরা উচ্চ মূল্যের বাগদা চিংড়ি নিয়ে আছি। দ্রুত কীভাবে ভেন্নামির বাণিজ্যিক উৎপাদনে যাওয়া যায় তা নিয়ে আমরা কাজ করছি।"
তিনি বলেন, ভেন্নামির জন্য ২০ বছরের চেষ্টা তদবিরের পর পরীক্ষামূলক চাষের অনুমতি পাওয়া গেছে। এর সময় কম হওয়ার কারণে বিনিয়োগে ঝুকিও নিতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের।
রপ্তানি ধারাবাহিকভাবে কমছে
ইপিবির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩-১৪ হিসাব বছরে বাংলাদেশ মোট ৫৪৫ মিলিয়ন ডলারের ৪১,২৩৬ মেট্রিক টন চিংড়ি রপ্তানি করে। এরপর থেকেই বাংলাদেশ ধারাবাহিকভাবে চিংড়ির বাজার হারাতে থাকে। সেই সাথে উৎপাদনও ধারাবাহিকভাবে কমেছে।
২০১৩-১৪ অর্থ বছর থেকে চিংড়ি রপ্তানি ৩৪ শতাংশ কমে ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে হয়েছে ৩৬১ মিলিয়ন ডলার। সে বছর ২৯ হাজার ৫৪৩ মেট্রিক টন চিংড়ি রপ্তানি হয়েছিল।
২০১৯-২০ সালে আরও কমে চিংড়ি রপ্তানি দাড়ায় ৩৩২ মিলিয়নে এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে রপ্তানি কমে আরও দুই মিলিয়ন।