ঈদের বাজার চড়া, সেমাইয়ের দাম বেড়েছে কেজিতে ৫০ টাকা
আন্তর্জাতিক বাজারে গমের দাম বৃদ্ধি ও দেশে সরবরাহ সল্পতার প্রভাব পড়েছে ঈদ পণ্যের উপর। সেমাই, নুডলসসহ ময়দায় তৈরি অন্যান্য খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে।
সেমাইয়ের স্বাদে ঈদ শুরুর রেওয়াজ অনেকদিনের। তবে এবার সেমাই কিনতে গুনতে হবে বাড়তি টাকা। গতবছরের তুলনায় কেজিতে প্রায় ৫০ টাকা বেড়ে গেছে সব ধরনের লাচ্ছা সেমাইয়ের দাম। ইউক্রেন রাশিয়ার যুদ্ধের প্রভাবে গমের দাম বাড়ায় ময়দার দাম বৃদ্ধির প্রভাব এটি, বলছেন ব্যবসায়ীরা।
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ১৪ বছরে সর্বোচ্চ দামে বৈশ্বিক গমের বাজার।
বনফুল ও কুলসন, কিষোয়ানসহ বিভিন্ন কোম্পানির ২০০ গ্রাম সেমাইয়ের প্যাকেটে এ বছর ১০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৪৫ টাকা। প্রতি কেজি লম্বা খোলা সেমাই কেজিতে ২০ টাকা বেড়ে ৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
রাজধানীর হাতিরপুল, মগবাজারসহ বিভিন্ন দোকাদারদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে।
মগবাজার, আমবাগান এলাকার খুচরা দোকানদার মোহম্মদ আনিসুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, গত বছর ২০০ গ্রাম প্যাকেটজাত লাচ্ছা সেমাইয়ের দাম ছিল ৩৫ টাকা। সেটা এখন ১০ টাকা বেড়ে হয়েছে ৪৫ টাকা। ৮ প্যাকেট নুডলসের ওজন প্রায় ৫০০ গ্রাম, এর দাম ৬ মাস আগেও ছিল ১২৫ টাকা যেটা এখন ১৪০ টাকা। ৩ মাস আগে ৬০ টাকা দাম ছিল ৪০০ গ্রামের কুলসন ম্যাকারনি পাস্তার। সেটা ধাপে ধাপে ১৫ টাকা বেড়ে হয়েছে ৭৫ টাকা হয়েছে।"
মূল্য বৃদ্ধির প্রসঙ্গে কারওয়ান বাজারের বিক্রিতা তৌহিদুল ইসলাম বলেন, "ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের প্রভাবে দেশে সেমাই তৈরির সব ধরনের কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে, এ অজুহাতে সেমাই প্রস্তুতের কোম্পানি দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। আমরা বেশি দামে কিনি তাই বিক্রিও করি বেশি দামে।"
ঈদ ঘিরে প্রতিবছরই চাহিদা বাড়ে পোলাওয়ের চালের। এক মাসের ব্যবধানে খোলা ও প্যাকেটজাত পোলাওয়ের চালের দাম ধাপে ধাপে কেজিতে বেড়েছে ২০ থেকে ২৫ টাকা। ভালো মানের খোলা পোলাউয়ের চাল কেজিতে ২০-২৫ টাকা বেড়ে ১১০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর প্যাকেটজাত পোলাওয়ের চাল কেজিতে ২০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ১৩০-১৪০ টাকা।
গত দুই মাসের ব্যবধানে ফুলক্রিম গুঁড়াদুধের দাম বেড়েছে কেজিতে ৪০ টাকা। ৫০০ গ্রাম গুঁড়াদুধ এখন ৩৬৫ টাাকা।
গত ৯ সেপ্টেম্বর প্রতিকেজি খোলা চিনির মূল্য ৭৪ টাকা ও প্যাকেটজাত চিনি ৭৫ টাকা ঠিক করে দেয় সরকার।
কিন্তু এই নির্ধারিত দামের বেশি বিক্রি হচ্ছে সব দোকানে। প্রতি কেজি প্যাকেটজাত সাদা চিনি বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকা। আর লাল চিনি বিক্রি হচ্ছে ৯০ টাকা। খোলা সাদা চিনি ৮০ টাকা ও লাল চিনি ৯০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে।
একই পরিস্থিতি দেখা গেছে ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম, রাজশাহী, বগুড়া, সিলেট ও ব্রাহ্মণবাড়িয়াতেও।
চট্টগ্রাম
খাতুনগঞ্জের পাইকারি বাজারে গত বছর ৩৫ কেজির ভালো মানের দেশি ভার্মিসেলি সেমাইয়ের দাম ছিল ১৩০০-১৫০০ টাকা। এ বছর দাম বেড়ে হয়েছে ১৫০০-১৬০০ টাকা।
শুকনা সেমাইয়ের দাম কেজিতে অন্তত ৩০ থেকে ৪০ টাকা বেড়েছে বলে জানিয়েছেন খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা।
খাতুনগঞ্জের নাজিম অ্যান্ড ব্রাদার্সের মালিক অমল সাহা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "ভার্মিসেলি তৈরির প্রধান উপকরণ হল ভোজ্যতেল এবং ময়দা। স্থানীয় বাজারে ভার্মিসেলির দাম বেড়ে যাওয়ায় এই দুটি উপাদানের দাম বেড়েছে।"
ভার্মিসেলির পাশাপাশি নুডলসের দামও বেড়েছে। ১২টি ছোট নুডল প্যাকেটের একটি ফ্যামিলি প্যাকের দাম ছিল ১৯০ টাকা। এখন দাম বেড়েছে ২১০ টাকা।
চট্টগ্রামের রিয়াজউদ্দিন বাজারের আল-ফারুক অ্যান্ড সন্সের মালিক সৈয়দ হক টিবিএসকে বলেন, রমজানের আগে ভার্মিসেলি ও নুডলসের দাম কম ছিল।
রাজশাহী
রাজশাহীর বাজারে গড়ে কেজিতে ৩০ থেকে ৪০ টাকা বেড়েছে সেমাইয়ের দাম। গতবছর যেখানে ১০০ থেকে ১২০ টাকা কেজি দরে সেমাই বিক্রি হয়েছে এবার সেখানে তা বিক্রি হচ্ছে ১৪০ টাকা থেকে ২০০ টাকা কেজি দরে। বিশেষত সেমাই তৈরির উপকরণের মূল্যবৃদ্ধির কারণে সেমাইয়ের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
রাজশাহীর বিসিকে কারখানা আছে রাতুল বেকারীর সত্ত্বাধিকারী মো. মানিক জানান, এবছর প্রত্যেকটি উপকরণের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। গতবছর যেখানে তেলের দাম ছিলো ৮০ টাকা লিটার, এবার তা বৃদ্ধি পেয়ে ১৬০ টাকা থেকে ১৮০ টাকা লিটার পর্যন্ত কিনতে হচ্ছে।
ডালডা ৮০ টাকা কেজি থাকলেও এবছর তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৮০ টাকা। এছাড়া আটা যেখানে গতবছর ১৮০০ টাকা বস্তা ক্রয় করেছি এবার তার দাম দিতে হচ্ছে ৩২০০ টাকা বস্তা। ফলে প্রত্যেকটি উপকরণের দাম দ্বিগুণ হয়ে গেছে।
"স্বাভাবিকভাবেই সেমাইয়ের দামও বৃদ্ধি পেয়েছে। তারপরও সেমাই তৈরি করে বিক্রি করছি কাস্টমারদের কথা বিবেচনা করে," বলেন তিনি।
এছাড়া কারিগররাও যাতে বেকার না থাকেন সেজন্য সেমাই তৈরি করে বিক্রি করছেন তারা। তিনি জানান, গড়ে প্রতিদিন ১০০ কেজির মতো লাচ্ছা সেমাই তৈরি করে বিক্রি করছেন তারা। কেজিপ্রতি ১৪০ টাকা দরে তারা লাচ্ছা সেমাই বিক্রি করছেন। গতবছর যা ৮০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেছেন।
বেলীফুলের সত্ত্বাধিকারী প্রদীপ কুমার ঘোষও জানান, সেমাই তৈরির উপকরণের দাম বৃদ্ধির কারণে এবছর সেমাইয়ের দাম দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। তার দোকান থেকে নিজস্ব কারখানায় তৈরি লাচ্ছা সেমাই বিক্রি হচ্ছে, স্পেশাল ঘি লাচ্ছা ১ কেজি ৭৫০ টাকা, লাচ্ছা সেমাই ডালডা ভাজা কেজিতে ৩০০ টাকা, লাচ্ছা সেমাই (ঘি/ডালডা ভাজা) ১ কেজি ৪০০ টাকা। তিনি জানান, এখন বিক্রি খুব কম হচ্ছে। ঈদের তিন চারদিন প্রধানত লাচ্ছা সেমাই বিক্রি হয়।
বগুড়া
বগুড়ায় অবস্থিত বাংলাদেশ ব্রেড বিস্কিট এন্ড কনফেকশনারী দ্রব্য প্রস্তুতকারক সমিতি উত্তরবঙ্গ পরিষদের সহসভাপতি বায়েজিদ শেখ সেমাইয়ের দাম বৃদ্ধির বিষয়টি জানান।
সংগঠন সূত্রে জানা গেছে, বগুড়ায় ব্র্যান্ড (প্যাকেট জাত সেমাই) ও নন ব্র্যান্ড (খোলা সেমাই) মিলে রমজানে অন্তত ১৫০ কারখানা বিভিন্ন প্রকার লাচ্ছা সেমাই তৈরি করে থাকে।
এসব কারখানায় জেলার প্রায় চার হাজার কারিগর লাচ্ছা সেমাই তৈরির কাজ করছে। এবার ঈদুল ফিতরে এসব কারখানায় উৎপাদন হবে সাড়ে ১৬ হাজার মেট্রিক টন লাচ্ছা সেমাই। যার বাজার মূল্য প্রায় ৩০০ কোটি টাকা।
সিলেট
সিলেটেও বেড়েছে সেমাইয়ের দাম। তবে সরবরাহে কোনো ঘাটতি নেই বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। ঈদ উপলক্ষে সেমাই বিক্রি এখন পর্যন্ত তেমন বাড়েনি বলেও জানিয়েছেন তারা।
সিলেটের কালিঘাট এলাকার খুচরা ব্যবসায়ী কয়েস উদ্দিন বলেন, বাজারে সকল ব্র্যান্ডের সেমাইয়ের দামই বেড়েছে। দেড়শ গ্রাম অর্জনের ছোট প্যাকেট সেমাই আগে বিক্রি হতো ৩৫ টাকায়, এখন ৪৫ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে। এছাড়া ৫০০ গ্রাম ওজনের প্যাকেট আগে ছিলো ১১০ টাকা এখন তা ১৪০ টাকা হয়ে গেছে।
কয়েস বলেন, ঈদ উপলক্ষ্যে সেমাই বিক্রি এখনও তেমন বাড়েনি। আরও কিছুদিন যাওয়ার পর বাড়তে পারে।
ভোগ্যপণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান মঞ্জিল ফুড প্রোডাক্টসের চেয়ারম্যান ও সিলেট বিসিক শিল্প নগরী শিল্প মালিক সমিতির সভাপতি আহমদ মঈনুল ইসলাম বলেন, "সব ধরনের উপকরণের দাম বাড়ায় সেমাইয়ের দাম রোজার আগে কিছুটা বেড়েছে। তবে রোজা শুরুর পর আর বাড়েনি।"
তিনি বলেন, ঈদে সেমাইয়ের চাহিদা বাড়লেও দাম বাড়বে না এবং সঙ্কটও সৃষ্টি হবে না। কারণ বাজারে সেমাইয়ের পর্যাপ্ত সরবরাহ রয়েছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া
ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়াতেও লাচ্ছা সেমাই দাম বৃদ্ধির খবর পাওয়া গেছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে কেজিতে ৮ থেকে ১০ টাকা করে বেড়েছে বলে ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন। ১৭৫ টাকা থেকে শুরু করে ২২০ টাকা কেজি দরে সেমাই বিক্রি হচ্ছে সেখানে।
তবে ঈদের দিনের অন্যতম অনুষঙ্গ সেমাইয়ের বেচাকেনা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এখনও জমজমাট হয়ে উঠেনি। ব্যবসায়ীরা বলছেন, সেমাইয়ের বেচাকেনা মূলত ঈদের দুইদিন আগে থেকে বেশি হয়। তখন খুচরা দোকানগুলোতে দৈনিক ২০-২৫ হাজার এবং পাইকারী দোকানগুলোতে ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকার সেমাই বিক্রি হবে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
রোববার (২৪ এপ্রিল) দুপুরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শহরের আনন্দবাজার, জগৎ বাজার ও ফারুকী বাজার ঘুরে দেখা গেছে, সেমাইয়ের দোকানগুলোতে ভিড় কিছুটা কম। এখন টুকটাক যা বেচাকেনা হচ্ছে- সেটি বিক্রেতাদের আশানুরূপ নয়।
ছোট খুচরা দোকানগুলো এখন প্রতিদিন ৫-৭ হাজার টাকার সেমাই বিক্রি করছে। আর পাইকারী দোকানগুলোতে বিক্রি হচ্ছে ২৫-৩০ হাজার টাকার সেমাই। লাচ্ছা ও লম্বা দুই ধরনের সেমাইয়ের মধ্যে ক্রেতাদের কাছে লম্বা সেমাইয়ের চাহিদা বেশি।
জগৎ বাজারের ব্যবসায়ী আব্দুল হাকিম জানান, গত দুইবছর ঈদসামগ্রী বেচাকেনা তেমন হয়নি। এবার ২০ রোজার পর থেকে বেচাকেনা শুরু হয়েছে। তবে এখনও পুরোপুরি শুরু হয়নি। এখন দৈনিক ২০-২৫ হাজার টাকার সেমাই বিক্রি হচ্ছে। ঈদের আগের দুইদিন অন্তত দেড়-দুই লাখ টাকার সেমাই বিক্রি হব বলে আশা করছেন তিনি।
- টিবিএস জেলা প্রতিনিধিরা এই প্রতিবেদন তৈরিতে অংশ নিয়েছেন।