কোভিড-১৯ টিকাদান: ভারত কি নিজেই ভ্যাকসিনের ডোজ সঙ্কটে পড়েছে?
ভারতের উত্তর প্রদেশের গাজিয়াবাদ জেলার বাসিন্দা ড. সঞ্জয় কুমার। পেশায় সমাজ বিজ্ঞানী। তিনি গত দু'দিন ধরে তার বয়োবৃদ্ধা মাকে দেওয়ার জন্য করোনাভাইরাস ভ্যাকসিন খুঁজছেন।
"আমার এলাকার তিনটি বেসরকারি হাসপাতালে ফোন করে খোঁজ নিয়েছি। তারা সবাই ডোজ শেষ হয়ে যাওয়ার কথা বলেছে," ড. কুমার বলছিলেন।
ওই তিনটি হাসপাতালের মধ্যে একটি ছিল ৫০ শয্যার। সেখানে বিবিসি প্রতিনিধিও খোঁজ নেন। হাসপাতালের অভ্যর্থনা কেন্দ্রের কর্মী তাকে জানান, "আমাদের কাছে ভ্যাকসিনের কোনো মজুত নেই, আর বুকিং দেওয়া লোকদের একথা বললেই তারা ক্ষিপ্ত আচরণ করেন, অগত্যা আমরা বুকিং নেওয়াও বন্ধ করেছি।"
ড. কুমারের ব্যর্থ অনুসন্ধানের তালিকায় থাকা অপর এক হাসপাতালের কর্মকর্তারা জানান, গত বুধবার বিকেলেই তাদের হাতে থাকা ডোজ ফুরিয়ে যায়। "কোনো উপায় না থাকায় মানুষকে ফিরিয়ে দিতে হচ্ছে" এক কর্মকর্তা বলেন।
করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ে নাভিশ্বাস উঠছে ভারতে, গত ১ এপ্রিল থেকে দৈনিক সংক্রমণের গড় সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৯০ হাজারে। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে টিকাদান চালাতেই হিমশিম খাচ্ছে কর্তৃপক্ষ। ইতোমধ্যেই, ডোজ সঙ্কটের কথা কেন্দ্রীয় সরকারকে জানিয়েছে ৬টি রাজ্যের প্রশাসন। যথেষ্ট মজুত না থাকার মতো পরিস্থিতি নিয়েও অভিযোগ ওঠে।
ভারতের পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য মহারাষ্ট্রের অবস্থা সবচেয়ে অবনতিশীল, পুরো দেশের নতুন সংক্রমণের অর্ধেকই সেখানে শনাক্ত হচ্ছে। তার মধ্যেই বন্ধের দোরগোড়ায় টিকা কর্মসূচি। স্থানীয় সরকার জানিয়েছে, তাদের মজুতে থাকা ১৫ লাখ ডোজ দিয়ে আর মাত্র তিন দিন টিকাদান চালানো সম্ভব।
রাজ্যের প্রাদেশিক রাজধানী মুম্বাইয়ে বন্ধ করা হয়েছে টিকাকেন্দ্র, এর বাইরে কোলাপুর, সাংলি ও সাতারা জেলার কেন্দ্রগুলোর একাংশ বন্ধ রাখা হয়েছে। রাজ্যের স্বাস্থ্যমন্ত্রী রাজেশ টোপে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, "তিন দিনের মধ্যে ভ্যাকসিনের চালান না এলে, আমরা কর্মসূচি বন্ধ করতে বাধ্য হব।"
কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী হর্ষবর্ধন অবশ্য প্রতিষেধক সঙ্কটের দাবিকে 'সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন' দাবি করে জানান, ৪ কোটি ডোজ মজুত আছে যা সরবরাহের জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে। "ইচ্ছেমতো লক্ষ্যমাত্রা পরিবর্তন করে রাজ্যগুলো তাদের টিকাদান কর্মসূচি দুর্বল করেছে, সেই ব্যর্থতা থেকে জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে নিতেই" তারা অভিযোগ তুলছে বলেও দাবি করেন তিনি। হর্ষবর্ধন মনে করেন, যেসব রাজ্য ডোজ সঙ্কটের কথা বলছে তারা নিজেদের সম্মুখভাগের কর্মীদেরও সম্পূর্ণভাবে টিকার আওতায় আনতে পারেনি।
কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর এই অভিযোগগুলো সর্বাঙ্গে সত্যি নয়। বরং বাস্তবে ঘটেছে উল্টোটাই। যেসব রাজ্য এখন সঙ্কটের কথা বলছে, তারা প্রথমদিকে খুব দ্রুত টিকাদান সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়, বলে জানান দিল্লিভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের স্বাস্থ্য খাত গবেষক ওম্মেন সি. কুরিঁয়া।
তিনি বিবিসি'কে বলেন, "গত চার মাস ধরে ভারতীয় ভ্যাকসিন উৎপাদকদের দাবীকৃত উৎপাদন সক্ষমতা এবং বাস্তবে উৎপাদিত ডোজের সংখ্যায় পার্থক্য থাকার কারণেই" সঙ্কট দেখা দিয়ে থাকতে পারে।
গত ১৬ জানুয়ারি বিশ্বের সর্ববৃহৎ কোভিড টিকাদান কর্মসুচি চালু করে ভারত, জুলাই নাগাদ ২৫ কোটি মানুষকে এর আওতায় আনার লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। প্রথমদিকে, শুধু স্বাস্থ্যকর্মী ও সম্মুখভাগের যোদ্ধাদের মধ্যে টিকাদান সীমিত থাকলেও, পরে তার পরিধি বিস্তৃত করে ৬০ বছর ঊর্ধ্ব সকল ব্যক্তিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পাশপাশি টিকা পাওয়ার যোগ্য নির্ধারিত হয়েছেন; ৪৫ থেকে ৫৯ বছরের মধ্যে অন্যান্য রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা। পরে ৪৫ বছরের বেশি বয়সী সকলকেই অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
এপর্যন্ত ভারতে অনুমোদিত দুটি ভ্যাকসিন; অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার কোভিশিল্ড এবং ভারত বায়োটেকের কোভাক্সিনের ৯ কোটির বেশি ডোজ দেওয়া হয়েছে। প্রতিদিন গড়ে ৩০ লাখ ডোজ দেওয়া হয়। এর বাইরে ৮৫টি দেশে সাড়ে ৬ কোটি ডোজ রপ্তানি করেছে ভারত। বেশ কিছু চালান যায় উপহার হিসেবে, বাকিগুলো বাণিজ্যিক চুক্তির আওতায় পাঠানো হয়। আর কিছু গেছে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার কোভ্যাক্স উদ্যোগের আওতায়।
তবে উৎপাদন সক্ষমতার প্রসঙ্গ উঠলে ভ্যাকসিন প্রস্তুতে বৈশ্বিক ভরকেন্দ্র ভারত। বিশাল জনসংখ্যার কারণে ভারতকে সংক্রামক রোগের বিরুদ্ধে অনেক আগে থেকেই বড় পরিসরের টিকাদান চালাতে হয়। সেই বাজার চাহিদা পূরণে দেশটিতে গড়ে উঠেছে আধা ডজন বৃহৎ ভ্যাকসিন উৎপাদক সংস্থা। এদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সেরাম ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়া। এটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারক।
তবে প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যার সকলকে টিকাদানের আওতায় আনার মাধ্যমেই সার্স কোভ-২ ভাইরাস থেকে সুরক্ষা অর্জন করা সম্ভব, যা এমনকি ভারতের জন্যেও এক পর্বতপ্রমাণ চ্যালেঞ্জ। এরমধ্যেই, বিশেষজ্ঞরা বলছেন জুলাই নাগাদ লক্ষ্যমাত্রা পূর্ণ করতে হলে বর্তমান টিকাদানের হার আরও গতিশীল করতে হবে। সেই অনুসারে ভারতের যথেষ্ট পরিমাণ উৎপাদন সক্ষমতা আছে কিনা তা এখনও স্পষ্ট নয়। তাছাড়া, আগামীতে টিকাদানে আরও কম বয়সীদের অন্তর্ভুক্ত করলে তখন সেই চাহিদা পূরণ করা যাবে কিনা- তা নিয়েও রয়েছে সন্দেহ।
যা নিয়ে অনেকে জল্পনা-কল্পনা শুরু করছেন সেই মূল প্রশ্ন দুটি হলো; টিকা কর্মসুচির গতি বাড়ানোর মতো যথেষ্ট মজুত কি আছে? অথবা তরুণদের অন্তর্ভুক্ত করা হলে তাদের সবাইকে কি বর্তমান সক্ষমতায় টিকা দেওয়া যাবে? অতিরঞ্জিত করে প্রচারিত 'ভ্যাকসিন কূটনীতি'র মাধ্যমে লাখ লাখ ডোজ দেশের বাইরে পাঠিয়ে ভারত সঠিক কাজ করেছে কিনা- তা নিয়েও জনমনে প্রশ্ন উঠছে।
এব্যাপারে কিছু ইঙ্গিত মিলেছে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিনের উৎপাদক সেরাম ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়ার সূত্রে। চলতি সপ্তাহে সংস্থাটির প্রধান আদর পুনেওয়াল্লা ভারতীয় টেলিভিশন চ্যানেল এনডিটিভি'কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে, উৎপাদন সক্ষমতায় প্রচণ্ড চাপ পড়ার কথা জানান। "সকল ভারতীয় নাগরিকের চাহিদা পূরণের আমাদের এখনও ঘাটতি রয়েছে" বলেন তিনি।
সেরাম জানায়, তারা প্রতিমাসে ভারত সরকারকে সাড়ে ৬-৭ কোটি ডোজ সরবরাহ করছে, সেই তুলনায় চলতি বছরের প্রথমদিক থেকে উৎপাদন শুরু হলেও মোট রপ্তানি করেছে সাড়ে ৬ কোটি ডোজ।
জানুয়ারিতে সংস্থাটি বিবিসিকে বলেছিল, তারা মাসিক উৎপাদন সক্ষমতা ১০ কোটি ডোজে উন্নয়নের লক্ষ্য নিয়েছে। এখন তারা আগামী জুনের আগে এই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা যাবে না বলে জানিয়েছে। জানুয়ারিতে তাদের পুনে শহরের প্রধান কারখানায় আগুন লেগে যে ক্ষয়ক্ষতি হয়, তা কাটিয়ে ওঠার পরই বাড়তি যোগানের আশা করছে সেরাম। অথচ, আগুনের ঘটনার সময় পুনেওয়াল্লা আশ্বস্ত করে বলেছিলেন, উৎপাদন কাজ একাধিক ভবনে চলমান থাকায় এতে কোভিশিল্ড উৎপাদন কোনোভাবে প্রভাবিত হবে না। আর এমন জরুরী পরিস্থিতি বিবেচনা করেই এভাবে বিকল্প ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
এর বাইরে আবার তহবিল সঙ্কটের কথা জানিয়েছেন পুনেওয়াল্লা। তিনি দাবি করেন, একারণেই উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধিতে বিনিয়োগ করা যাচ্ছে না। এজন্য তিনি ৪০ কোটি ডলারের সরকারি সহায়তা বা ব্যাংক থেকে ঋণ চান। সেরাম নির্বাহী'র মতে, " ভারত সরকারের কাছে ২ মার্কিন ডলার মূল্যে ডোজ বিক্রিতে তেমন লাভ করা যাচ্ছে না। এত কম লাভে নতুন বিনিয়োগ করাও অসম্ভব হয়ে পড়েছে।"
ভারত সরকারের রপ্তানি নিষেধাজ্ঞাকে বিনিয়োগের প্রধান অন্তরায় বলে অভিযোগ করেন পুনেওয়াল্লা। "আমাদের বাজেট পরিকল্পনা শুরুতে এমন ছিল না, কারণ আমরা বেশি পরিমাণে রপ্তানি করার লক্ষ্য নিয়েছিলাম, সেটি চালু থাকলে নতুন বিনিয়োগের জন্য যথেষ্ট অর্থও পাওয়া যেতো। এখন আমাদের জাতীয় কর্মসূচিকে সমর্থন দিতে গিয়ে বিকল্প উপায়ে উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা করতে হচ্ছে।"
- সূত্র: বিবিসি