টিকটক নিয়ে আমেরিকা ভীত কেন?
যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে চীনকে দেখতে চায়; তার সবকিছুই নিজের গুণাবলীর মধ্য দিয়ে ধারণ করেন ঝ্যাং ইমিং। তিনি বাইটড্যান্স নামের একটি প্রযুক্তি কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা ও শীর্ষ নির্বাহী। বাইটড্যান্সের তৈরি তুমুল জনপ্রিয় স্বল্প-দৈর্ঘ্যের ভিডিও শেয়ারিং প্লাটফর্ম হচ্ছে টিকটক।
ঝ্যাং শুধু টিকটক নয়, এমন আরো জনপ্রিয় অ্যাপ তৈরি করেছেন ধারাবাহিক ভাবে। তৈরি করেছেন একাধিক সফল সার্চ ইঞ্জিন। তার উদ্ভাবনগুলোতে অন্যদের আইডিয়া বা প্রযুক্তি অনুকরণ করা হয়নি, বা সেগুলো খরচ কমানোর জন্য উদ্ভাবিত মামুলি ডিজিটাল সেবাও নয়। বরং বিশ্বের বাঘা বাঘা প্রযুক্তি কোম্পানির সঙ্গে পুরোদস্তুর কোমড় বেঁধে লড়াই করতে সক্ষম।
এভাবে চীনা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিকদের সম্পর্কে; স্বস্তা এবং সম্পূর্ণ অনুকরণকৃত পণ্য বাজারজাত করার যে দুর্নাম বাজারে রটানো হয়েছে- তা খণ্ডন করেছেন ঝ্যাং। তিনি নিঃসন্দেহে একজন খাঁটি উদ্ভাবক।
অর্ধ শতকের বেশি সময় ধরে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির মূল লক্ষ্য ছিল চীনে ঝ্যাং' এর মতো উদ্যোক্তাদের তৈরিতে সাহায্য করা। যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বাস ছিল সফল ও প্রগতিশীল পুঁজিবাদি উদ্যোক্তার হাত ধরে সমাজতন্ত্রী চীন রূপান্তরিত হবে যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্মুক্ত, সৃজনশীল এবং ধনী সমাজ ব্যবস্থায়। থাকবে না বাক-স্বাধীনতা রুদ্ধ করা বা জন-জীবনের প্রতিটি স্তরে সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণ। শুধু পুঁজিবাদি আদর্শের প্রচারক নয়, যুক্তরাষ্ট্রের আশা ছিল সৃজনশীল উদ্ভাবকরা চীনের রাষ্ট্রব্যবস্থাকে এমনভাবে পরিবর্তন করবে যা অন্য দেশগুলোর জন্যেও উদাহরণ হবে, বদলে যাবে বিশ্ব।
যুক্তরাষ্ট্র-চীন সহযোগিতা নিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির অতীত লক্ষ্য আকাশছোঁয়া হলেও, তাতে কিছুই যে অর্জন আসেনি একথা ভুল। স্বয়ং ঝ্যাং তার প্রমাণ। তার মতো আরো অনেক চীনা উদ্যোক্তাও আছেন। কিন্তু, তাদের সবার চাইতে ঝ্যাংয়ের উদ্ভাবিত অ্যাপ টিকটককেই বেশি আপন করে নিয়েছে মার্কিনীরা।
কারণ আর কিছু নয়, অভিনব নতুনত্ব আর বৈচিত্র্যের আস্বাদ এনে দেয় এ সেবা। ফেসবুকে আপনার পরিবারের ছবি শেয়ার করতে পারেন আপনি, লিখতে পারেন নিজের চিন্তার কথা। টুইটার আছে রাজনৈতিক মতাদর্শ তুলে ধরার জন্য, ইনস্টাগ্রামের ফলোয়ার সংখ্যা আবার নির্দেশ করে আপনার জনপ্রিয়তাকে।
কিন্তু, টিকটক খুবই সরল ও কৌতুকপূর্ণ এক সেবার সন্ধান দেয় ব্যবহারকারীদের। নিজের শোয়ার ঘরে জলহস্তীর মতো দেহ নিয়ে নাচানাচি, আদি রসাত্মক কৌতুক বা ঘরে পোষা প্রাণীটির অদ্ভুত সব কাণ্ডকারখানা; জীবনের সব মজাদার মুহূর্তের ছোট ভিডিও করে শেয়ার করতে পারবেন টিকটকে। টিকটক আপনাকে দেয় নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা আর অন্য কোনো দক্ষতা নিয়ে জনপ্রিয় হয়ে ওঠার সুযোগ।
তাহলে যুক্তরাষ্ট্র ভীত কেন?
দীর্ঘকাল ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরিচিতি ছিল নতুন কোনো কিছুকে গ্রহণ করার সহজাত স্বভাবের কারণে। যে কোনো নতুন পণ্য বা সেবার জন্য নিজের দ্বার উন্মুক্ত করে রাখে পুঁজিবাদী সৌরজগতের কেন্দ্রে থাকা নক্ষত্রসম দেশটি। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার মাধ্যমে অন্য দেশকেও অবাধ বাণিজ্য ব্যবস্থা প্রণয়নে উৎসাহ যোগায়, ক্ষেত্র বিশেষে চাপও দেয়। মার্কিন পুঁজিবাদের স্লোগান ছিল; জীবনমান উন্নয়নে আবিষ্কৃত যে কোনো সেবা বা পণ্যকে গ্রহণ করাই উচিৎ। এই ভাবধারার আওতায় স্বাগত জানানো হয়েছে- মেধাবি এবং সংকল্পবদ্ধ উদ্যোক্তাদের। তারা কোন দেশে জন্মেছেন তা নিয়েও ভাবতো না যুক্তরাষ্ট্র।
সাম্প্রতিক খোঁজ রাখেন না, এমন অনেকেই তবে ভাবতে পারেন; তাহলে তো টিকটিক বা এর উদ্ভাবক ঝ্যাংকে নিয়ে আমেরিকার মাতামাতির শেষ নেই। ওয়াল স্ট্রিটের পুঁজিবাজারে এখন তাকেই হয়তো যৌথভাবে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের যৌথ অংশীদারিত্বের সফল উদাহরণ বলে 'দেবতা' রূপে পূজা করা হচ্ছে। আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে সামনে রেখে মূল দুই প্রতিদ্বন্দ্বী ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং জো বাইডেন উভয়েই বুঝি তরুণ ভোটারদের আকর্ষণ করতে টিকটকে নিজেদের ভিডিও আপলোড করছেন। আবার হয়তো এমন অভূতপূর্ব সাফল্যের কারণে নিউইয়র্কের শীর্ষ ব্যাংকগুলি বাইটড্যান্সের শেয়ার মার্কিন পুঁজিবাজারে নিবন্ধনের উদ্যোক্তা হতে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত হয়েছে। যদিও এসবের কোনটাই হচ্ছে না।
কয়েক বছর আগে হলে পূর্বের সবগুলো অনুমান সঠিক হতেই পারতো। সেটাই ছিল, তৎকালীন মার্কিন সমাজের প্রতিচ্ছবি। কিন্তু, এখন আর তা সম্ভব নয়। ওয়াশিংটনের ভেতরে ও বাইরে প্রায় সকল প্রভাবশালী মার্কিন নাগরিক- এখন চীনকে দেখেন ভূ-কৌশলগত শত্রু হিসেবে। নিয়মিত টুইটার এবং সংবাদ সম্মেলনে বেইজিংয়ের বিরুদ্ধে বিদ্বেষের ঝুলি খুলে চলেছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। অতি-রক্ষণশীল এ রাষ্ট্রপতি ও তার দল রিপাবলিকানদের মতে, চীনের সঙ্গে সংযম এবং সহযোগিতার সম্পর্ক বজায় রেখে দেশটির পরিবর্তন দেখতে চাওয়া উদারপন্থীদের দিবাস্বপ্ন মাত্র। এ নীতির মাধ্যমে শুধু চীনের কর্তৃত্ববাদী স্বৈরশাসকদের হাতে বিপুল সম্পদ আয় এবং প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতা অর্জনের সুযোগ তুলে দেওয়া হয়েছে। শক্তিশালী হয়ে এ শাসনব্যবস্থা এখন তৈরি করেছে মার্কিন আধিপত্য বিনাশের হুমকি।
এই মতাদর্শের আতশকাঁচের ভেতর দিয়ে দেখলে; টিকটিক আর চীনের (ওয়াশিংটনের মনোপুত) সঠিক উন্নয়নের প্রতিচ্ছবি থাকে না। বরং হয়ে ওঠে তার বিপথগামী হওয়ার চিত্র। যুক্তরাষ্ট্রের লাখ লাখ কিশোর আর তরুণের তাদের নাচ বা পোষা বিড়ালের ভিডিও শেয়ারের অ্যাপটি তখন হয়ে ওঠে- চীনের তরফ থেকে আসা হুমকির অংশ। হয়ে ওঠে চীনা সমাজতন্ত্রী শাসকদের হাতের এমন এক অত্যাধুনিক প্রযুক্তির হাতিয়ার যা মার্কিন সমাজের গহীনে প্রবেশ করে; এর গোপনীয় তথ্য চুরিতে লিপ্ত, মার্কিন নাগরিকদের পর্যবেক্ষনে জড়িত একটি অ্যাপ, যা দিনশেষে বেইজিংয়ের মারাত্মক লক্ষ্যপূরণের হাতিয়ার বৈ অন্যকিছু নয়।
পররাষ্ট্রনীতির এ দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে দিনে দিনে ফাটল বাড়ছে চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে। সাম্প্রতিক সময়ে, দুই দেশের মাঝের রেষারেষিকে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ইতিহাসে সবচেয়ে নিচুস্তর বলছেন ভূ-রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা।
উত্তেজনার বহ্নিশিখায় নির্বাচনের আগে ঘি ঢেলেই চলেছে রিপাবলিকান দলের আইনপ্রণেতারা। যুক্তরাষ্ট্রে টিকটকের পরিচালনার স্বত্ব বাইটড্যান্সের কাছে থেকে কিনে নিচ্ছে মাইক্রোসফট। আর এর পেছনে মার্কিন অর্থ মন্ত্রণালয় মূল ভূমিকা পালন করছে। মার্কিন অর্থমন্ত্রী স্টিফেন মানুচিন জানান, চলতি সপ্তাহের মধ্যেই টিকটকের ব্যাপারে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
- সূত্র: দ্য আটলান্টিক
- অনুবাদ: নূর মাজিদ