প্রতিবেশী যে দেশটির লাখ লাখ মানুষ করোনাভাইরাসের নামও শোনেননি
দেশটিতে দীর্ঘদিন ধরে সেনাবাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহীদের সংঘাত চলছে। বিদ্রোহীদের দমনে যে খড়গ সেনাবাহিনী চালায় তার বোঝা প্রায়ই গিয়ে পড়ে সাধারণ জনগণের ওপর। সরকারও ভাবে, তথ্যের অবাধ প্রবাহ থাকলে জনগণের মনস্তত্ত্বে আন্দোলন ডালপালা মেলবে; তাই সমাধান হিসেবে ইন্টারনেট বন্ধ। দেশটির নাম মিয়ানমার। প্রতিবেশী এই দেশটির সেনাবাহিনীর নির্মম নির্যাতনেই বছর দুয়েক আগে লাখ লাখ অসহায় রোহিঙ্গা নিজেদের ঘর বাড়ি, সমস্ত কিছু ছেড়ে পালিয়ে বাংলাদেশে চলে আসে।
গত বছরের জুনে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অং সাং সুচি দেশটির পশ্চিমাঞ্চলীয় নয় জেলায় ইন্টারনেট বন্ধ করে দেন। এরমধ্যে গত মে'তে একটি জেলায় ইন্টারনেট চালু হলেও বাকী আট জেলার প্রায় ৮ লাখ মানুষ এখনো ইন্টারনেটের মাধ্যমে তথ্যের প্রবাহ থেকে অন্ধকারেই আছেন।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম সিএনএন এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, মিয়ানমারে আন্দোলন দমাতে ইন্টারনেট বন্ধ কাজে দিলেও হিতে বিপরীত হয়েছে অন্যক্ষেত্রে। বিশ্বব্যাপী যে মহামারিতে লাখ লাখ মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে, ইন্টারনেট নেই বলে সেই ভাইরাস সম্পর্কে ন্যুনতম ধারণাও নেই দেশটির এই আট জেলার মানুষের। স্থানীয়রা জানেনই না, করোনাভাইরাস কী বা কীভাবে এর মোকাবিলা করা যায় অথবা পরিচ্ছন্ন থাকা এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার ব্যাপারেও এখানকার মানুষের তেমন কোনো ধারণা নেই।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এ ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছে, ইন্টারনেট বন্ধ রাখায় এখানকার মানুষেরা যেমন নিজেদের সঙ্গে ঘটা মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো সম্পর্কে জানাতে পারে না, তেমনি মহামারি করোনাভাইরাসের মোকাবিলায় যে তথ্যগুলো জানা জরুরি সেগুলোও জানতে পারেন না।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া বিষয়ক লিগ্যাল অ্যাডভাইজর লিন্ডা লাখদির এক বিবৃতিতে বলেন, "মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও রাখাইন রাজ্যের আরাকান আর্মির মধ্যে চলমান সংঘর্ষের কারণে মহামারির মধ্যে নিরাপদ থাকার জন্য তথ্য প্রাপ্তির বিষয়টি সাধারণ জনগণের জন্য খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে।"
মিয়ানমার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বুধবার পর্যন্ত দেশটিতে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ২৯২ জন রোগীকে শনাক্ত করা হয়েছে যার মধ্যে ৬ জন মারা গেছেন।
করোনার সংক্রমণ শুরু হলে ভাইরাসটির মোকাবিলায় জনগণকে সচেতন করতে সুচি'র নেতৃত্বাধীন সরকার দেশে 'নো পারসন লেফট বিহাইন্ড' নামে একটি কর্মসূচি চালু করে। কিন্তু ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় এই কর্মসূচির খবর দেশের বহু মানুষই জানেন না।
মিয়ানমার ইউনিয়ন পার্লামেন্টে উচ্চ কক্ষের সদস্য এবং আরাকান ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতা হুতুত মে জানান, উত্তরাঞ্চলীয় রাজ্য রাখাইন এবং তার পার্শ্ববর্তী রাজ্য চিনে ফেসবুক, মেসেজিং অ্যাপ বা সরকারি ওয়েবসাইটের মাধ্যমে লোকজন করোনাভাইরাস সম্পর্কে কোনো তথ্যই জানতে পারেনি।
সিএনএনকে তিনি বলেন, "আমি আমার নির্বাচনী আসনের জনগণকে যখন জিজ্ঞেস করেছিলাম, তারা করোনাভাইরাস সম্পর্কে কিছু জানে কিনা, তারা আমাকে কিছু বলতে পারেনি। পরে পুরো বিষয়টা তাদেরকে বুঝিয়ে বলতে হয়েছে আমাকে। সামাজিক দূরত্ব কী বা কেনো হাত ধুতে হবে এই বিষয়গুলো তাদেরকে বুঝিয়ে বলেছি আমি।"
"করোনা ভাইরাসের কারণে আমিও তো সবখানে যেতে পারি না। ইন্টারনেট চালু থাকলে একসঙ্গে বহু মানুষকে সচেতন করতে পারতাম আমি।"
এই জনপ্রতিনিধি আরও বলেন, "সাধারণ মানুষ করোনাভাইরাসকে ভয় পায় না, কারণ তার জানেই না করোনাভাইরাস কী। এই মুহুর্তে করোনার চেয়েও এখানকার চলমান সংঘাত নিয়ে তাদের উদ্বেগ বেশি।"