যেভাবে মাত্র ৪ দিনে ইরানের গণতন্ত্রকে হত্যা করেছিল আমেরিকা ও ব্রিটেন
প্রথম দেখায় হঠাৎ করে তার দিকে তাকালে মনেই হতো না যে তিনি জাতীয় নেতাগোছের কেউ একজন। তার গড়নে, তার চলনে, তার গাম্ভীর্যে যে ভাবটি বারংবার ফুটে উঠতো তাতে অনেকের কাছেই অনুমেয় হতে পারে, তিনি বোধয় একজন কবি। দেখতে রোগা আর লিকলিকে এই মানুষটি ছিলেন বেশ লম্বা। তার বাঁশির মতো নাক, সরু ঠোঁট, অকৃত্রিম আর নিষ্পলক চাহনি দেখে একবারের জন্যে হলেও যে কারও মনে হতো লোকটি ভীষণ আবেগী।
নিজের আদর্শ আর বিশ্বাসের জায়গাগুলো নিয়ে কেউ আঘাত করলে শিশুদের মতোই কেঁদে ফেলতেন তিনি। কথা বলতে বলতে ধরে আসতো তার গলা।
এই লোকটির একটি ছবি দিয়ে ১৯৫২ সালের ৭ জানুয়ারি বিশ্ববিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিন তাদের প্রচ্ছদ করেছিল। ছবির নিচে ক্যাপশনে লেখা ছিল- ‘বিশৃঙ্খলার তেলের চাকা ঘোরান তিনি’। ওই আর্টিকেলের ভেতর তার পরিচয়ে লেখা হয়- ‘নতুন হুমকি’।
এভাবেই ইরানের ইতিহাসের সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী এবং অসাম্প্রদায়িক গণতন্ত্রের সাহসী বীর মোহাম্মদ মোসাদ্দেগকে বিশ্ববাসীর কাছে পরিচিত করায় পশ্চিমারা। আরও স্পষ্ট করে বললে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য।
মোসাদ্দেগের অপরাধ ছিলো, দখলদারদের হাত থেকে বাঁচাতে তিনি নিজ দেশ ইরানের তেল শিল্পকে জাতীয়করণ করেছিলেন। তার বিশ্বাস ছিলো, ইরানের ভূমি থেকে উত্তোলন করা তেলের মালিক ইরানেরই জনগণ। অ্যাঙলো-ইরানিয়ান অয়েল কোম্পানি নামে ব্রিটিশ মালিকানাধীন একটি কোম্পানি সেসময় ইরানে বসেই পুরো দেশের তেল বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ করতো। বিষয়টি ভীষণ পীড়া দিতো মোসাদ্দেগকে।
১৮৮২ সালে মোহাম্মদ মোসাদ্দেগের জন্ম হয়েছিল তৎকালীন পারস্যের নামকরা এক পরিবারে। তেহরান স্কুল অব পলিটিক্যাল সায়েন্সের আইনের অধ্যাপক মোসাদ্দেগ বরাবরই ছিলেন গণতন্ত্র ও সাংবিধানিক শাসনের পক্ষে। পারিবারিকসূত্রে অল্প বয়স থেকেই ইরানের রাজনীতিতে হাতেখড়ি তার। ১৯১৭ সালে তিনি হন ইরানের উপ-অর্থমন্ত্রী, ১৯২১ সালে হন অর্থমন্ত্রী এবং পরবর্তীতে হন প্রভাবশালী মজলিস সদস্য।
সম্পর্কে ইরানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রেজা খানের বন্ধু ছিলেন তিনি। ১৯২৫ সালে প্রধানমন্ত্রী রেজা যখন ইরানের শাহ হওয়ার ইচ্ছেপোষণ করেন তখন এর বিরোধিতা করেছিলেন মোসাদ্দেগ। মোসাদ্দেগ বলেছিলেন, এটি হবে ইরানের ১৯০৬ সালে তৈরি করা সংবিধানের লঙ্ঘন। এ ঘটনায় স্বৈরশাসক রেজা ক্ষুব্ধ হন তার ওপর। শাহ এর সঙ্গে রাজনৈতিকভাবে দ্বিমত পোষণ করা মোসাদ্দেগ হতাশ হয়ে শেষ পর্যন্ত রাজনীতি থেকে বিদায় নেন।
১৯৪১ সালে রেজা খানের ছেলে মোহাম্মদ রেজা পাহালভী ইরানের পরবর্তী শাহ হলে ফের রাজনীতিতে যোগ দেন মোসাদ্দেগ। রাজনীতির মাঠে এসেই ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রিত অ্যাঙলো-ইরানিয়ান তেল কোম্পানির বিরুদ্ধে জোরালো প্রচারণায় নামেন তিনি।
নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে একটা সময় তিনি ইরানের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। প্রধানমন্ত্রী হয়েই দেশের তেলসম্পদকে জাতীয়করণ করতে একটি বিল পাস করিয়ে নেন তিনি।
নয়া প্রধানমন্ত্রীর এমন পদক্ষেপের পর ব্রিটিশরা বহুবার মোসাদ্দেগকে বোঝানোর চেষ্টা করলেও নিজ দেশের এই সম্পদ রক্ষায় কোনোপ্রকার ছাড় দিতে রাজি হননি তিনি। উপায়ান্তর না দেখে ব্রিটিশরা দ্বারস্থ হয় তাদের সবসময়ের মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ব্রিটিশ এবং আমেরিকানরা বুঝতে পারে, মোসাদ্দেগের প্রতিটি পদক্ষেপ তাদের স্বার্থের বিরুদ্ধে যাচ্ছে। সেকারণে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ এবং ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা যুগপৎভাবে মোদাদ্দেককে গদিচ্যুত করতে পরিকল্পনা শুরু করে। ইরানের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি হিসেবে শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভিকে সামনে রেখে এই পরিকল্পনার ছক আঁকে তারা।
মোসাদ্দেগকে ক্ষমতা থেকে উৎখাতের ৬০ বছর পর পর্যন্ত বিশ্ববাসী জানতো না, ঠিক কে বা কারা নেড়েছিলো ওই অভ্যুত্থানের কলকাঠি। ২০১৩ সালে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা- সিআইএ’র এক গোপন নথি থেকে বেরিয়ে আসে মূল তথ্য।
‘দ্য ব্যাটেল ফর ইরান’ শিরোনামের ওই নথিতে বলা হয়, “যে সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মোসাদ্দেগকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছিল তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতির অধীনে সিআইএ’র নেতৃত্বে পরিচালিত হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় কর্তৃক পরিকল্পিত ও অনুমোদিত ছিল।”
পুরো অভ্যুত্থানের সেই পরিকল্পনার নেতৃত্বে ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ২৬তম প্রেসিডেন্ট থিওডর রুজভেল্টের নাতি কেরমিত রুজভেল্ট জুনিয়র যিনি সিআইএ’র মধ্যপ্রাচ্য নীতি বিষয়ক প্রধান ছিলেন।
১৯৫৩ সালের আগস্টে মাত্র চারদিনের ব্যবধানে সিআইএ ইরানে দুটি অভ্যুত্থানের সৃষ্টি করে যার প্রথমটি ব্যর্থ হলেও দ্বিতীয়টিতে ক্ষমতাচ্যুত হন প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মোসাদ্দেগ।
ওই পরিকল্পনায় সিআইএ সরাসরি কাজ করেছিল ইরানের রাজকীয় বাহিনীর সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে। দুর্বলচিত্তের শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভিকে সাহস যোগাতে সিআইএ বারবার তার কাছে বিভিন্ন লোকজনকে পাঠাতো। ইরানিদের দিয়ে বোমা হামলা করিয়ে তা কমিউনিস্ট পার্টির নামে চালিয়ে দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়ার পাশাপাশি পত্রপত্রিকায় মোসাদ্দেগবিরোধী বিভিন্ন লেখা ও কার্টুন প্রচার করতে থাকে সিআইএ। এর সবই জানা যায়, সিআইএর ওই গোপন নথি থেকে।
ওই নথি থেকে আরও জানা যায়, ১৯৫২ সালের নভেম্বর ও ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত হওয়া কয়েকটি বৈঠকে মোসাদ্দেগকে উৎখাতের বিষয়ে যৌথ অভিযানের একটি পলিকল্পনা দিয়ে সিআইএকে চমকে দেন তাদেরই মিত্র ব্রিটিশ গোয়েন্দারা।
ব্রিটিশ ও ইরানের মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে যে আমেরিকার একটা সময় কোনো মাথাব্যথাই ছিলো না, সেই আমেরিকাই ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের দেওয়া ওই পরিকল্পনা গ্রহণ করে। কারণ আমেরিকার শঙ্কা ছিল, মোহাম্মদ মোসাদ্দেগের নেতৃত্বে ইরান হয়তো সোভিয়েত ইউনিয়ন নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট ব্লকে যোগ দিতে পারে।
১৯৫৩ সালের মার্চে সিআইএ’র তেহরান স্টেশন জানায়, সেনাবাহিনী নেতৃত্বাধীন একটি অভ্যুত্থানের বিষয়ে সহায়তা করতে পারবেন বলে ইরানি একজন জেনারেল মার্কিন দূতাবাসকে জানিয়েছেন।
ওই তথ্যের পর ‘যেকোন উপায়ে মোসাদ্দেগকে উৎখাত করতে’ ওই সময়ই ১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচের অনুমোদন পেয়ে যায় সিআইএ।
কয়েকদিনের মধ্যেই জেনারেল ফাজলুল্লাহ জাহেদি নামে ইরানি সেনাবাহিনীর একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে খুঁজে বের করেন সিআইএ’র অফিসাররা। সিআইএ’র পরিকল্পনা ছিল, সেনা অভ্যুত্থানের অগ্রভাগে থাকবেন জেনারেল জাহেদি আর ক্ষমতাচ্যুত করার এই পুরো ঘটনায় নেতৃত্বদাতা হিসেবে জনগণের সামনে উপস্থাপন করা হবে তৎকালীন শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভীকে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এটি ছিলো ‘ক্ল্যাসিক ক্যুপ প্ল্যান’। এই পরিকল্পনায় ছিল, সেনাবাহিনী ও গণমাধ্যকে কিনে ফেলা হবে। প্রধানমন্ত্রী মোসাদ্দেগের ওপর অনাস্থা জানাবে সেনাবাহিনী, একই সময় রাস্তায় নেমে আসবে জনতা যারা সরকারবিরোধী নানা মনোভাব ছড়াতে থাকবে।
সাইপ্রাসে বসে যখন সিআইএ এই পরিকল্পনার চূড়ান্ত ছক আঁকছিলো, এখন তাদের মধ্যেই প্রশ্ন ওঠে এতো বড় একটি অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেওয়ার মতো যথেষ্ট সাহস শাহ পাহলভির আছে কিনা। অন্যদিকে জেনারেল ফাজলুল্লাহ জাহেদির দক্ষতা নিয়েও ছিল অনেকেরই প্রশ্ন। শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভীর মধ্যে সাহসের সঞ্চার যোগাতে তার বোন প্রিন্সেস আশরাফকে ফ্রান্স থেকে নিয়ে আসে সিআইএ।
ওই বছর জুনের শুরুতে আমেরিকা ও বৃটিশ গোয়েন্দারা লেবাননের রাজধানী বৈরুতে মিলিত হন এবং পরিকল্পনার সর্বশেষ কৌশল চূড়ান্ত করেন। এর ঠিক পরপরই পরিকল্পনার বাস্তবায়ন ঘটাতে সিআইএ’র মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকা বিভাগের প্রধান কেরমিত রুজভেল্ট তেহরানে পৌঁছে যান।
পরিকল্পনা অনুযায়ী সিআইএ তখন কাজ শুরু করে দেয়। আগে থেকেই ঠিক করে রাখা কিছু লোককে কমিউনিস্ট সাজিয়ে তাদের দিয়ে মুসলিম নেতাদের হুমকি-ধমকি দেওয়ানো শুরু করে। তারা বলতে থাকে, ‘মোল্লারা যদি প্রধানমন্ত্রী মোসাদ্দেগের বিরোধিতা করে তবে তাদেরকে কঠিন শাস্তি দেওয়া হবে’। মসজিদ এবং ধর্মীয় নেতাদের বাড়িতে বোমা হামলা শুরু হয়। ফলে ধর্মীয় নেতা ও সাধারণ মানুষের মধ্যে কমিউনিস্ট বিরোধী মনোভাবের সৃষ্টি হয়।
১৫ আগস্ট রাতে প্রথমবারের মতো অভ্যুত্থানের চেষ্টা চালানো হয়। তবে তালগোল পাকিয়ে ফেলা ওই অভ্যুত্থান সম্পর্কে আগেভাগেই অনুমান করতে পেরে পাল্টা ব্যবস্থা নেয় প্রধানমন্ত্রী মোসাদ্দেগ।
মোসাদ্দেগ বুঝতে পারে তাকে উৎখাত করতে একটি গভীর চক্রান্ত হচ্ছে। ক্ষমতাকে আরও দৃঢ় করতে সংসদ ভেঙে দিয়ে গণভোট আয়োজনের ঘোষণা দেন তিনি।
প্রথম অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কয়েক ঘণ্টা আগে মোসাদ্দেগ তা সম্পর্কে জানতে পারেন। সঙ্গে সঙ্গেই তিনি তার প্রতিনিধিকে রাজকীয় রক্ষীবাহীনির ব্যারাকে পাঠিয়ে দেন। শাহকে সমর্থন দেওয়া ওই বাহিনীর সৈনিকরা প্রধানমন্ত্রী মোসাদ্দেগের ডেপুটিকে গ্রেপ্তার করার পর বাহিনীটির উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদেরও গ্রেপ্তার করা শুরু করে।
তবে প্রধানমন্ত্রী মোসাদ্দেগকে গ্রেপ্তার করতে গেলে উল্টো সরকারী অনুগত সৈন্যদের দ্বারা আটক হয় শাহপন্থী রাজকীয় বাহিনীর সৈনিকরা। সেনা সদর দপ্তরে কামানসহ সরকারি সৈন্যদের উপস্থিতি দেখে পালিয়ে যান জেনারেল জাহিদি।
পরদিন তেহরান রেডিওতে ঘোষণা দেওয়া হয়, সরকারের বিরুদ্ধে চালানো একটি অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়েছে।
এসময় পরিস্থিতি এলোমেলো হয়ে গেলে সিআইএ প্রধান রুজভেল্ট মার্কিন দূতাবাস ত্যাগ করেন এবং জেনারেল জাহিদিকে খুঁজে বের করেন যিনি উত্তর তেহরানে লুকিয়ে ছিলেন। তখনো জেনারেল জাহিদির বিশ্বাস ছিলো, এই অভুত্থানকে পুনরায় সাজিয়ে এটির সফল বাস্তবায়ন সম্ভব।
নতুন পরিকল্পনা অনুযায়ী, সিআইএ’র তেহরান স্টেশন থেকে নিউ ইয়র্কে অবস্থিত প্রভাবশালী গণমাধ্যম দ্য অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের অফিসে একটি বার্তা পাঠানো হয়। ওই বার্তায় সিআইএ দাবি করে, শাহের কাছ থেকে পাওয়া দুটি রাজকীয় ফরমান অনুযায়ী সশস্ত্র অভ্যুত্থানকারীরা প্রধানমন্ত্রী মোসাদ্দেগকে অপসারিত করেছে এবং তার স্থলাভিষিক্ত করা হয়েছে জেনারেল জাহেদিকে।
একই গুজব তেহরানেও ছড়িয়ে দেওয়া হয়।
কিন্তু অদ্ভুত হলেও সত্য অভ্যুত্থানের ভয়ে আগে থেকেই ভীত থাকা শাহ তেহরান থেকে পালিয়ে বাগদাদে চলে যান। পুরো পরিকল্পনার তথাকথিত মূল ‘নায়কের’ এমন পলায়ন সিআইএর কাছে ছিলো বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো। অভ্যুত্থানের পরিকল্পনাকারীদের একটাই আশা ছিলো যে তেহরান থেকে রেডিওতে শাহ পাহলভি একটি ঘোষণা দেবেন। আর তা হল, তিনি ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন এবং প্রধানমন্ত্রী মোসাদ্দেগকে তার পদ থেকে সরিয়ে দিয়েছেন।
অবশেষে ১৭ই আগস্ট সকালে পাহলভি বাগদাদ থেকে ঘোষণাটি দেন এবং এ বিষয়ে রাজকীয় ফরমান জারির কথা জানান।
এরপর জেনারেল জাহেদি মার্কিন দূতাবাসে সিআইএ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বসে এর পরদিন মোসাদ্দেগের ওপর কীভাবে আক্রমণ হবে তার ছক আঁকেন। তেহরান থেকে কমিউনিজমের বিরুদ্ধে একটি জিহাদের ডাক দেওয়া হবে পরিকল্পনা করেন তারা।
কিন্তু আবারও গণ্ডগোল বাঁধান দুর্বলচিত্তের ওই শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভি। অভ্যুত্থানের পরিকল্পনাকে আরও জটিলতার মধ্যে ফেলে দিয়ে বাগদাদ ছেড়ে রোমে পালিয়ে যান তিনি।
শাহের এমন কর্মকাণ্ডে ব্যাকফুটে থাকা সিআইএ কীভাবে অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা থেকে বের হয়ে আসা যায় তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা শুরু করে।
কিন্তু ওই সময়ই আগে থেকে বীজ বপন করে রাখা এক পরিকল্পনার সুফল পায় সিআইএ। মসজিদে ও ধর্মীয় নেতাদের বাড়িতে হামলা চালিয়ে কমিউনিজমের বিরুদ্ধে যে বিষবাষ্প ছড়িয়েছিলো সিআইএ তারই ফলাফল হিসেবে মোসাদ্দেগের বিরুদ্ধে রাজপথে নেমে আসে উত্তেজিত জনতা। সিআইএ এজেন্টদের সরাসরি মদদে তারা পার্লামেন্ট অভিমুখে রওনা দেয়।
ওই সময় সেনাবাহিনীর এমন একজন কর্নেল যিনি কয়েকদিন আগে পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, একটি ট্যাংক নিয়ে পার্লামেন্টের সামনে হাজির হন। একই সময়ে অনেকটাই পর্যুদস্ত থাকা রাজকীয় বাহিনীর সদস্যরা বাহিনীর গাড়িগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় এবং রাজপথ মহড়া দিতে থাকে।
ফলে ব্যর্থ হয় মোসাদ্দেগের ক্ষমতা বহাল রাখার শেষ প্রয়াস। ক্ষমতার পালাবদলের এই মুহুর্তে অভুত্থানকারীদের কাছে একের পর এক আত্মসমর্পণ করতে থাকে প্রধানমন্ত্রী মোসাদ্দেগের সরকারের বিভিন্ন দপ্তর। মোসাদ্দেগ ও অন্যান্য কর্মকর্তাদের ঘিরে ফেলে তারা। একটি ব্যর্থ অভ্যুত্থানের মাত্র চার দিনের মাথায় আরেকটি সফল অভ্যুত্থানের সৃষ্টি করে ইরানের গণতান্ত্রিক ও সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মোসাদ্দেগকে ক্ষমতাচ্যুত করে সিআইএ।
যার ফলাফল হিসেবে ইরানে সূচনা হয় নতুন যুগের। গণতন্ত্র ও নাগরিক অধিকারকে তোয়াক্কা না করা শাহ পাহলভি’র শাসনামলে ইরানি জনতা ধীরে ধীরে প্রত্যক্ষ করেন একজন শাসক কতোটা স্বৈরাচারী হয়ে উঠতে পারে।
১৯৫৩ সালে সিআইএ’র এই অভ্যুত্থান ইরানিদের মনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিষয়ে ঘৃণার বীজ বপন করে। ৬৭ বছরের ব্যবধানে যে বীজ অঙ্কুরিত হয়ে ডালপালা মেলে এখন বিশাল বৃক্ষে পরিণত হয়েছে।
২০০০ সালের মার্চে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ম্যাডেলেইনে কে অলব্রাইট এ বিষয়ে তার এক বক্তব্যে বলেছিলেন, “তৎকালীন প্রেসিডেন্ট এইজেনহাওয়ারের প্রশাসন কৌশলগত কারণে বিশ্বাস করেছিলো, তাদের পদক্ষেপ সঠিক ছিল। কিন্তু ওই অভ্যুত্থানের ফলে স্পষ্টতই ইরানের রাজনৈতিক পরিস্থিতির অবনতি হয়। এবং এ থেকে সহজেই বোঝা যায়, কী কারণে ইরানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে আমেরিকার হস্তক্ষেপকে ইরানিরা বিরক্তির চোখে দেখে।”