অনবদ্য শিল্পসৃষ্টি ও শিল্প চুরি
'পুরাতত্ত্ব হল ইতিহাসের অবশেষ যা কোনভাবে মহাকালের করাল গ্রাস থেকে বেঁচে গেছে।'
-ফ্রান্সিস বেকন
শিল্প চুরি এবং চোরাচালানের মতো ঘটনা বিশ্বের বিভিন্নপ্রান্তে ঘটে চলা এক নিত্তনৈমিত্তিক বিষয়। কঠোর আইনি নিষেধাজ্ঞা ও পুলিশি নজরদারির ফাঁকফোকর গলে কিছুতেই যেন শিল্পচুরি ও তাদের চোরাচালান ঠেকান যাচ্ছে না। ফলে উদ্বেগও বাড়ছে। নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা যাচ্ছে না নিজেদের কৃষ্টি ও পুরোনো সংস্কৃতিকে। বিশ্বখ্যাত চিত্রশিল্পীদের আঁকা বহুমূল্য ছবি থেকে শুরু করে পোড়ামাটি ও পাথরের মূর্তি, ভাস্কর্য, প্রাচীন মুদ্রা, প্রাচীন পাণ্ডুলিপি, টেরাকোটা, হাতির দাঁতের কারুশিল্প, অলঙ্কার--যাতে প্রাচীন সময়ের চিহ্ন আজও টিকে আছে--তার চোরাকারবার সারাবিশ্বে চলছেই। কখনও হয়তো চোরাকারবারিরা ধরা পড়ে, কখনও চুরি যাওয়া শিল্প উদ্ধার হয়, কখনও এসব শিল্পদ্রব্যকে গোপনে ধ্বংস করে ফেলাও হয়!
গত বছরের ৩০ মার্চ রাতে, লকডাউনের মধ্যেই চুরি হয়ে যায় বিশ্বখ্যাত চিত্রশিল্পী ভ্যান গখের চিত্রকর্ম--পারসোনেজ গার্ডেন অ্যাট নিউনেস ইন স্প্রিং। শিল্পী জীবনের শুরুর দিকের আঁকা গখের এই ছবিটির আনুমানিক দাম এখন ৬৬ লাখ ডলার। আমস্টারডামের সিঙ্গার লরেন যাদুঘর থেকে চুরি হয় শিল্পকর্মটি। শিল্পকর্মটি ছিল হল্যান্ডের গ্রোনিগার যাদুঘরের মালিকানাধীন, সিঙ্গার লরেন যাদুঘরকে তারা প্রদর্শনীর জন্য দিয়েছিল। মার্চে ডাচ সরকার দেশটিতে লকডাউন ঘোষণা করে, তখনই জাদুঘরটি বন্ধ করে দেয়া হয়। সে সময় ছবিটির প্রদর্শনী চলছিল। লক ডাউনে প্রদর্শনী বন্ধ করে দেয়া হলেও ছবিটি চুরি হয়ে যায়। যাদুঘরের কাঁচের দরজা ভাঙা পাওয়া যায়।
খবরে বলা হয়-রাতে জাদুঘরের সামনের দরজার কাচ ভেঙে ৫০ লাখ ডলার মূল্যের ওই চিত্রকর্ম চুরি হয়। ছবিটি ১৮৮৪ সালে আঁকা হয় যার ক্যানভাসে লালরঙের ফুল ও গাছ-গাছালিতে ছাওয়া বাগানে এক নারী, ব্যাকগ্রাউন্ডে চার্চের চুড়ো।
গখের ছবি চুরির ঘটনা এবারই প্রথম নয়, এর আগে চুরি হয়ে যায় তার আঁকা 'পপি ফ্লাওয়ার্স' ছবিটিও। গখের ছবিটি কায়রোর মুহম্মদ মাহমুদ খলিল জাদুঘর থেকে ২০১০ সালে হারিয়ে যাওয়ার পর আর পাওয়া যায় নি, ছবিটির আনুমানিক দাম ৫০ মিলিয়ন ডলার। এই 'পপি ফ্লাওয়ার্স' ছবিটি ১৯৭৭ সালেও একবার চুরি হয়েছিল, ১০ বছর পর যাকে কুয়েতে খুঁজে পাওয়া যায়।
২০১০ সালের ২০ মে ঘটে আরও একটি শিল্পচুরির ঘটনা। সেদিন রাতে প্যারিসের বিখ্যাত 'মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্ট' থেকে চুরি হয়ে যায় পাঁচটি বহুমূল্য চিত্রকর্ম। প্যারিস মেয়র বের্ত্র দেলানো জানান--ছবিগুলো পাবলো পিকাসো, অঁরি মাতিস, জর্জ ব্রাক, আমেদেও মোদিগ্লিয়ানি এবং ফেরনঁ লেজারের মতো বিশ্বখ্যাত চিত্রকরদের আঁকা।
রাতের অন্ধকারে জাদুঘরের একটি কাঁচের জানলা ভেঙে ভিতরে ঢুকে পড়ে চোরের দল, নিয়ে যায়- হিস্পানি শিল্পী পাবলো পিকাসোর 'পায়রা এবং কড়াইশুঁটি', মাতিসের 'পাস্তোরাল', ব্রাকের 'এস্তাকের কাছে অলিভ গাছ', মোদিগ্লিয়ানির 'হাতপাখা হাতে মহিলা' এবং লেজারের স্টিল লাইফ 'ঝাড়বাতি'। ২০০৮সালে, ব্রাজিলের সাও পাওলোর যাদুঘর থেকে চুরি হয় পাবলো পিকাসোর আঁকা ৩২টি ছবির একটি স্কেচবুক। এসব শিল্পকর্মের অনুমানিক দাম ১৬২ মিলিয়ন ডলার।
প্রাচীন শিল্পকর্ম এবং তাদের সংরক্ষাণাগার ধ্বংস, পুরাকৃতি লুট এবং বিক্রি করে দেওয়া ইত্যাদির পেছনে ইসলামিক স্টেটের মতো বর্বর জঙ্গিরাও কম ভূমিকা পালন করেনি। তারা ইতিমধ্যে অপূরণীয় ক্ষতি করে ফেলেছে মানুষের সভ্যতার ইতিহাসের। বর্বরোচিত কায়দায় নিরস্ত্র মানুষকে তো তারা হত্যা করছেই, সঙ্গে সঙ্গে ধ্বংসও করে ফেলছে পৃথিবীর প্রাচীন ইতিহাসের অনন্য সব নিদর্শন।
জঙ্গিদের হাতে ধ্বংস হয়ে গেছে ইরাকের নিনেভাহ, যা ছিল খ্রিস্টপূর্ব ৯০০ থেকে ৬০০ বছর আগের এমন এক প্রাচীন শহর, যা ছিল অ্যাসিরীয় সাম্রাজ্যের রাজধানী। খ্রিস্টপূর্ব ৬১২ সালে পরিত্যক্ত হবার আগ পর্যন্ত অন্তত ৫০ বছর ধরে এটি ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শহর। পৃথিবীর বিভিন্ন জাদুঘরে এই শহরের ধ্বংসাবশেষের নমুনা সংরক্ষিত আছে। ২০১৪ সালে আইসিস নিনেভাহর ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলো গুঁড়িয়ে দেয়। শহরের প্রাচীন প্রবেশদ্বারের বিশাল মূর্তিটকে ড্রিল মেশিন ও হাতুড়ি দিয়ে ভাঙার দৃশ্য দেখা যায় আইসিসের প্রকাশিত ভিডিওতে।
তাদের হাতে ধ্বংস হয় ইরাকের প্রাচীন শহর নিমরুদ, যা ছিল অ্যাসিরীয় সাম্রাজ্যের প্রথম রাজধানী। আজ থেকে প্রায় ৩,২০০ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত নিমরুদ ছিল প্রাচুর্য্যের অনন্য নিদর্শন। ১৮৪৫ সালে এখানে খনকাজ শুরু হবার পর এখানকার অনেক পাথর নির্মিত ভাস্কর্য পাঠানো হয় সারা পৃথিবীর বিভিন্ন যাদুঘরে। ২০১৫ সালে এখানে ধ্বংসযজ্ঞ চালায় আইসিস। এখানে অবস্থিত মেসোপটেমিয়ান সভ্যতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা হিসেবে বিবেচিত 'জিগুরাত'কে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে আইসিস।
মসুল জাদুঘর ও লাইব্রেরি, ইরাক
১৯৫২ সালে প্রতিষ্ঠিত ইরাকের দ্বিতীয় বৃহত্তম যাদুঘর হল 'মসুল যাদুঘর'-এখানে অ্যাসিরীয় সাম্রাজ্যের বিভিন্ন নিদর্শনের সমৃদ্ধ সংগ্রহ ছিল। ২০০৩ সালে ইরাকে মার্কিন বাহিনীর আক্রমণের পর বিপুল পরিমাণ লুটপাট হয়েছিল এখানে।
২০১৪ সালে আইসিস মসুল দখল করে মসুল বিশ্ববিদ্যালয়য়ের লাইব্রেরি ও সংরক্ষণাগার থেকে শতাব্দী প্রাচীন পাণ্ডুলিপি ও হাজার হাজার বই চোরাই বাজারে বিক্রি করে দেয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিও তারা পুড়িয়ে দেয়। ২০১৫ সালে মসুলের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিটি বিস্ফোরক দিয়ে উড়িয়ে দেয় তারা। ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত এই লাইব্রেরিতে ছিল হাজারও পাণ্ডুলিপি এবং আরব বিজ্ঞানীদের ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি।
খ্রিস্টপূর্ব ২৯০০ সালে ব্রোঞ্জ যুগে নির্মিত হয় সিরিয়ার শহর মারি। প্রায় ১২০০ বছর ধরে চলেছিল এই শহরের জীবনপ্রবাহ। এই মারিতে প্রত্নতাত্ত্বিকেরা আবিস্কার করেন প্রাসাদ, মন্দির এবং মাটির ফলকে লেখা সে আমলের ইতিহাস। মেসোপটেমীয় আমলের অনেক তথ্য জানা যায় এখানে আবিস্কৃত প্রায় ২৫,০০০ ফলক থেকে। ইতিহাসের এই গুরুত্বপূর্ণ শহরটিতেও লুটতরাজ চালায় আইসিস বাহিনী। বিশেষত এখানকার প্রাসাদগুলো থেকে মূল্যবান সামগ্রী নিয়ে বিক্রি করে দেয় তারা।
ইউফ্রেটিস নদীর তীরে প্রায় ৩০০ ফুট উঁচু পাহাড়ের ওপর গড়ে ওঠা এক শহর ছিল সিরিয়ার দুরা-ইউরোপোস। ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে হেলেনীয়, পার্থীয় এবং রোমান সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল এই শহরটি। সাসানীয়দের দখলের পর খ্রিস্টিয় ২৫৬ সালের দিকে এই শহরটি পরিত্যক্ত হয়ে যায়। বালি ও কাদায় ঢাকা পড়ে যায় দুরা-ইউরোপোস।
এই শহরটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যময়। কারণ পরিত্যক্ত হবার পর এখানে আর কোনো রকম স্থাপনা গড়ে উঠেনি। তাই এখানকার সুপ্রাচীন আমলের স্থাপনাগুলোর কোনো পরিবর্তনও ঘটেনি। দুই রাজ্যের সীমান্তবর্তী শহর হবার কারণে এখানে তৈরি হয়েছিল সাংস্কৃতিক মিথস্ক্রিয়া যার প্রকাশ ঘটেছিল শহরের স্থাপনাগুলোর মধ্যে। পৃথিবীর সর্বপ্রাচীন খ্রিস্টিয় চার্চটি অবস্থিত ছিল এই শহরে।
এই শহরের অমূল্য সম্পদগুলোর কারণে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ চলাকালীন লুটতরাজ হয়েছে প্রচুর পরিমাণে। আইসিস এখানকার প্রাচীন নিদর্শনগুলো লুট করে বিক্রি করে দেয় তাদের যুদ্ধের জন্য টাকা সংগ্রহের জন্য।
দ্য ইকোনমিস্ট জানায়- পুরাকীর্তী ধ্বংসের কথা তারা ব্যাপকভাবে প্রচার করে যাতে করে এগুলোর সরবরাহে সঙ্কট সৃষ্টি করে চাহিদা বাড়ানো যায়। চাহিদা বাড়লে দামও বাড়ে। যারা এসব জিনিসের চোরাচালানে জড়িত তারা তখন বেশি দামে জঙ্গিদের কাছ থেকে এসব সংগ্রহ করে। সিরিয়ার বিভিন্ন জাদুঘরের প্রত্ননিদর্শনগুলো আইসিসের কাছ থেকে চড়া দামে সংগ্রহ করেছিল চোরাচালানকারিরা, বাক্স বোঝাই করে পাচার করতে করতে জাদুঘর খালি করে ফেলেছিল তারা।
এইভাবে পূরাকীর্তির চোরাচালান এখন হয়ে দাঁড়িয়েছে আইএসের রাজস্বের অন্যতম প্রধান উৎস এবং এই চোরাচালানের এক বিশাল চক্র গড়ে উঠেছে। আইএসের দখলে থাকা তেলকূপে পাশ্চাত্যের বিমান হামলা যত বেশি হয়েছে, পূরাকীর্তি বেচে ডলার সংগ্রহের প্রয়োজনও তত বেশি হয়েছে।
শুধু যে আইএস এ কাজ করছে তা নয়, ফ্রি সিরিয়ান আর্মি থেকে শুরু করে অপরাধী চক্র পর্যন্ত বিভিন্ন সশস্ত্র গ্রুপ এ কাজে যুক্ত। এরা পূরাকীর্তির গুদাম পরিচালনা করছে। অনেকে জীবিকার তাগিদে এই লুটপাটে জড়িয়ে পড়েছে। লিবিয়ার বেনগাজীর প্রধান বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে উধাও হয়ে গেছে ৭৭০০ প্রাচীন স্বর্ণমুদ্রা, অলঙ্কার ও মূর্তি। মেসোপটোমিয়ার পূরাকীর্তির কোন কোনটি পাশ্চাত্যের নিলামে উঠেছে। এক তথ্যে জানা যায়, ২০১১ সালে হোসনি মোবারকের পতনের পর থেকে ৩শ কোটি ডলার মূল্যের মিসরীয় পূরাকীর্তি চুরি হয়ে গেছে!
কলকাতার বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে নবম ও একাদশ শতকের ব্রোঞ্জ নির্মিত দু'টি বিষ্ণু মূর্তির হারিয়ে যাওয়া, আলমোড়া জেলার কাটারমলের সূর্য্যমন্দির থেকে একটি বহুমূল্য অষ্টধাতুর মূর্তি ও শিবপুরমের নটরাজ মূর্তি চুরিও একটি বিশাল ঘটনা। এসব ঘটনার পর ভারত সরকার পুরাকীর্তি সংরক্ষণ ও চোরাকারবার বন্ধে 'এন্টিক এন্ড আর্ট ট্রেজার এক্ট-১৯৭২ পাশ করেন।
গত বছরের অক্টোবরে, গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের প্রতিষ্ঠাতা ও নেতা মাও সেতুংয়ের একটি হস্তলিপি (ক্যালিগ্রাফি) উদ্ধার করা হয় ছিঁড়ে দু-খণ্ড করে ফেলা অবস্থায়; মূল্যবান এই হস্তলিপি একজন সংগ্রাহকের বাড়ি থেকে চুরি হয়ে গিয়েছিল। ওই শিল্পকর্মে মাওয়ের হাতে লেখা বেশ কয়েক ছত্র কবিতা রয়েছে। খবরে জানা যায়- চোরেরা মাওয়ের মূল্যবান ক্যালিগ্রাফিটি এক সংগ্রাহকের বাড়ি থেকে চুরি করে, অল্প দামে বিক্রি করে দেয়। ন'ফুট লম্বা ওই ক্যালিগ্রাফিকে কেটে দু-খণ্ড করে ফেলে তারা, বেশি লম্বার কারণে প্রদর্শনের সমস্যা এড়াতে। যার বাড়ি থেকে চুরি হয়েছিল, তিনি এটির দাম ৩০০ মিলিয়ন ডলার দাবি করেন। দুই খণ্ড করার কারণে এটির মূল্যমান অনেক কমে গেছে বলেও মনে করছেন তিনি। ফু চুনজিয়াও নামে ওই শিল্প সংগ্রাহক ডাকটিকিট ও বিপ্লবসংশ্লিষ্ট শিল্পকর্ম সংগ্রহের জন্য বিখ্যাত। গত ১০ সেপ্টেম্বর চোরেরা তার বাড়ি থেকে মাও সেতুংয়ের আরও কিছু ক্যালিগ্রাফি এবং অনেকগুলো প্রাচীন ডাকটিকিট ও কপারের মুদ্রাও নিয়ে যায়। এগুলোর আনুমানিক মূল্য কমবেশি ৬৪৫ মিলিয়ন ডলার।
সারাবিশ্ব কোভিড-১৯ প্যানডেমিকের কারণে মারাত্মক স্বাস্থ্য সংকটে পতিত হয়ে কার্যত অচল, এখনও ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে লকডাউন চলছে। কিন্তু এমন সংকটময় সময়েই একটি কাজ থেমে নেই- মূল্যবান প্রত্নসম্পদের অবৈধ পাচার ও চোরাচালান। এসব প্রত্নসামগ্রীর পাচার ও চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা পুরাকীর্তি ও প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানের এবং সংরক্ষণাগারের নিরাপত্তা ব্যবস্থার দুর্বলতার সুযোগ নিয়েছে, জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত জাদুঘরগুলোর দুর্বল নিরাপত্তা ব্যবস্থার সুযোগে প্রত্ন সম্পদের পাচারের সুযোগ হাতছাড়া করেনি। বিশ্ববরেণ্য চিত্রশিল্পী লিওনার্দো দা ভিঞ্চির 'মোনালিসা' থেকে শুরু করে পিকাসো, রেমব্রা, ভ্যান গখ, মাতিস, ক্লদ ম্যনে সহ অসংখ্য শিল্পীর শিল্পকর্ম চুরি ও পাচারের শিকার হয়েছে। এসব মূল্যবান শিল্প ও প্রত্নসামগ্রীর কিছু কিছু যদিও উদ্ধার করা হয়, বেশির ভাগই বিভিন্ন দেশে অবৈধভাবে পাচার হয়ে যায়।
পরিসংখ্যান প্রমাণ করেছে- মোজাইকের সমাধিফলক, শবাধার, মূর্তি, স্ট্যাচু কিংবা প্রাচীন বইয়ের পাণ্ডুলিপির কালের আবেদন, পাচারকারীদের মধ্যে কোনও বেদনার জন্ম দেয় না, তাদের লক্ষ্য ব্যবসা, মুনাফা; বরং পাচারকারীদের এবং এসবের সংগ্রহকারীদের কাছে অবৈধভাবে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষাই দিনে দিনে বেড়েছে। ফলে শিল্পকর্ম ও এন্টিক দ্রব্যের কালোবাজার যেমন তৈরি হয়েছে, তেমনি এখন অনলাইনেও এসব ব্যবসা চলছে রমরমা।
হিটলারের নাজি বাহিনীও শিল্প লুটে নেমেছিল। এখনও জার্মানির ন্যুশভাইনস্টাইন প্রাসাদে রাখা নাৎসিদের লুট করা শিল্পকর্মগুলো রক্ষিত আছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার ইউরোপের মন্যুমেন্টস ম্যানের কথা আপনাদের মনে আছে নিশ্চয়ই। সে গল্প বেদনার হলেও, এর ভেতরে আশাবাদও লুকিয়ে ছিল- ইউরোপ জুড়ে বিখ্যাত শিল্পকর্মগুলো চুরি হয়ে যাচ্ছে, গোপনে লুকিয়ে রাখা হচ্ছে হচ্ছে লবণ খনির ভেতরে। অ্যাম্বুলেন্স দিয়ে বিশ্বখ্যাত যাদুঘরের সমস্ত নিদর্শন সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। চিত্রশিল্পী, ইতিহাসবিদ এবং যাদুঘরের তত্ত্বাবধায়কদের নিয়ে গঠিত একটি ছোট দল ইউরোপের সাংস্কৃতিক ইতিহাসকে বাঁচানোর জন্য সময়ের বিরুদ্ধে লড়ছে। এটাই মন্যুমেন্টস ম্যানের গল্প।
১৯৩৯ সালের ১লা সেপ্টেম্বর পোল্যান্ড আক্রমণের মাধ্যমে ইউরোপে নাজি বাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হয়। তারা সফলতার সাথে ইউরোপের ইঞ্চি ইঞ্চি জায়গায় লুটতরাজ শুরু করলে ফ্রান্স ও ব্রিটেন জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে।
নাজিরা কয়েক মিলিয়ন মানুষের ভবিষ্যৎ ছিনিয়ে নিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, তারা তাদের অতীতকেও মুছে দিতে চেয়েছিল। হিটলারের বাহিনী ইউরোপের চার্চ, বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্রখ্যাত ইহুদিদের ব্যক্তিগত সংগ্রহশালা থেকে অমূল্য চিত্রকর্ম, ভাস্কর্য, ধর্মীয় প্রতীক এবং সাংস্কৃতিক নিদর্শনগুলো লুট করে। তারা বাদ্যযন্ত্র, পুরোনো গ্রন্থাগার, মোজেসের অনুশাসন সম্বলিত কয়েক শতাধিক প্রাচীন স্ক্রল, হাজার হাজার চার্চের ঘণ্টা, এমনকি স্ট্রাসবার্গ ক্যাথেড্রালের ঠিক বাইরের কাচও লুট করে নেয়। এই লুটতরাজের নেতৃত্বে ছিলেন অ্যাডলফ হিটলার, যিনি শিল্পের প্রতিও ছিলেন মোহগ্রস্ত। ভিয়েনার একাডেমি অফ ফাইন আর্টস কিশোর হিটলারকে অযোগ্য বলার পর শিল্পী হওয়ার স্বপ্ন শেষ হয়ে গেলেও শিল্পের প্রতি তার আগ্রহ কখনোই কমেনি বরং অদম্য হয়েছে। জন্মস্থান অস্ট্রিয়ার লিঞ্জে বিশ্বের মূল্যবান সব শিল্পকর্ম দিয়ে পূর্ণ ব্যক্তিগত যাদুঘর তৈরি করতে চেয়েছিলেন তিনি, যার নাম হতো 'ফারমিউজিয়াম'।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিস্তৃতির সঙ্গে সঙ্গে হিটলারের নাজি জেনারেলরা শিল্পকর্ম চুরি করতে শুরু করেন। তারা ইআরআর 'আইনস্টাস্টাব রেইচস্লেটার রোজেনবার্গ' দল গঠন করেন, যাদের সুস্পষ্টভাবে পূর্বের পরিকল্পনানুযায়ী পুরো ইউরোপ জুড়ে শিল্প ও সাংস্কৃতিক নিদর্শনগুলোতে লুটপাট চালানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়। প্যারিসের 'গ্যালারি নেশিওনালে দ্যু জিউ দি পাউম' জাদুঘরকে নাজি বাহিনীর লুট করা প্রত্নসম্পদ সংরক্ষণ করার প্রধান সংরক্ষণাগার হিসাবে তৈরি করা হয়। নাৎসিরা জার্মানি এবং অস্ট্রিয়ার বিভিন্ন লবণের খনি ও প্রাচীন দুর্গকেও লুট করা প্রত্নসম্পদ লুকিয়ে রাখার জন্য ব্যবহার করতো।
এভাবে নাজিদের হাতে এসে পড়ে শিল্পী রেমব্রা, ভিঞ্চি, পিকাসো, মাতিস, ফারমির, ভ্যান গখসহ বহু শিল্পীর অসংখ্য কাজ, যা বিভিন্ন জাদুঘর, পাবলিক গ্যালারি এবং ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে লুট করা হয়। হিটলারের ডান-হাত বলে ইতিহাসে পরিচিত হারমান গোরিং কমপক্ষে বিশবার প্যারিসের 'গ্যালারি নেশিওনালে দ্যু জিউ দি পাউম' পরিদর্শন করেন এ উদ্দেশ্যে যেন তিনি তার কাঙ্ক্ষিত মাস্টারপিসগুলো দখলে নিতে পারেন; অবশেষে- দুটি মালবাহী রেলভর্তি শিল্পকর্ম নিয়ে বাড়ি ফেরেন তিনি। লুটতরাজের পরিমাণ এত বিশাল ছিল যে জেনারেল ডুয়াইট ডি আইজেনহাওয়ারের মতো যারা বন্দিশিবির এবং যুদ্ধক্ষেত্রের নৃশংস ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছিলেন, তাদেরকেও হতবাক হতে হয়। আইজেনহাওয়ার ১৯৪৬ সালের এপ্রিলে মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম অফ আর্টে একজন শ্রোতাকে বলেন, 'আমরা দেখতে পেয়েছিলাম হিটলার এবং তার দল গুহা, খনি এবং বিচ্ছিন্ন পাহাড়ের আড়ালে সমগ্র ইউরোপের শিল্পকর্ম এনে জমিয়ে রেখেছিল।'
যুদ্ধের শুরু থেকেই শিল্পবোদ্ধা, ইতিহাসবিদ এবং জাদুঘরের পরিচালকরা প্রত্নসম্পদ ও সাংস্কৃতিক সম্পদের চুরি ও ধ্বংসযজ্ঞের ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। যুদ্ধে ধ্বংসের আশঙ্কায় থাকা ইউরোপের বিভিন্ন নির্দশন এবং শিল্পকর্মগুলোকে সনাক্ত এবং সুরক্ষার জন্য ১৯৪৩ সালে এমএফএএ মন্যুমেন্টস, ফাইন আর্টস, এন্ড আর্কাইভ' প্রতিষ্ঠা করেন, মিত্রবাহিনীর সহায়তায়, যাতে ছিলেন ইতিহাসবিদ, স্থপতি, যাদুঘর তত্ত্ববধায়ক এবং অধ্যাপকদের দল, যাদের বেশিরভাগই ছিলেন মধ্যবয়স্ক, যাদের যুদ্ধের কোনও পূর্বঅভিজ্ঞতাও ছিল না, কিন্তু ইউরোপের শিল্পকর্ম পুনরুদ্ধারের জন্য তারা ছিলেন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। ১৩টি দেশের প্রায় ৩৫০ জন নারী-পুরুষ 'মন্যুমেন্টস ম্যান'-এ যোগ দেন, যাদের অন্যতম প্রধান সাফল্য ছিল ভিঞ্চির 'মোনালিসা'কে ফ্রান্সের গ্রামাঞ্চলের বিভিন্ন বাড়িতে লুকিয়ে রেখে নাজিদের হাত থেকে রক্ষা করা।
১৯৪৫-এর মে মাসে যুদ্ধ থেমে গেলেও মন্যুমেন্টস ম্যানের কাজ জোর কদমে শুরু হয়। ইউরোপ নাজিদের ধ্বংসযজ্ঞ থেকে মুক্তি পেলেও তার সাংস্কৃতিক সম্পদ তখনও নিরুদ্দেশ। জানা গেল- ১৯৪৩-৪৫ সালের মধ্যে নাজিরা জার্মানি এবং অস্ট্রিয়ার আলতাউসি, মিকার্স এবং সিগেন জুড়ে অবস্থিত খনিগুলোতে তাদের চুরি করা শিল্পের বিশাল সংগ্রহ লুকিয়ে রেখেছে। ৪০-৪৭ ডিগ্রী ফারেনহাইট তাপমাত্রা এবং ৬৫ শতাংশ আর্দ্রতা খনিগুলোতে মূল্যবান শিল্পকর্মগুলোকে লুকিয়ে রাখতে উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করেছিল।
অস্ট্রিয়ার মিকার্স লবণখনিতে তারা ৩০ মাইল লম্বা একটি গ্যালারি এবং এক বিলিয়ন ইউরো মূল্যমানের স্বর্ণমুদ্রা পেয়েছিলেন আর আলতাউসি লবণখনির ১৩৭টি টানেলের মধ্যে কয়েক হাজার চিত্রকর্ম, ৯৫৪টি আলোকচিত্র এবং ১৩৭টি ভাস্কর্য ছিল। মন্যুমেন্টস ম্যান-রা না থাকলে ইউরোপের অনেক মূল্যবান নিদর্শন চিরতরে হারিয়ে যেত।
আজকের দিনের বাস্তবতা হচ্ছে- মাদক এবং অস্ত্রের পরেই তৃতীয় বৃহত্তম বাজারটি হচ্ছে সাংস্কৃতিক পণ্যের অবৈধ বাজার। শিল্পের পাচার ও চোরাকারবারের কারণে বিভিন্নভাবে আন্তর্জাতিক নানা সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে, বিভিন্ন দেশের মধ্যে দূরত্ব বেড়ে যাওয়াও এর একটি প্রধান কারণ। ১৯৭০ সালের ইউনেস্কো কনভেনশন দ্বারা প্রত্নসামগ্রী আমদানি, রপ্তানি, মালিকানা ও হস্তান্তর প্রতিরোধ ও নিষিদ্ধ করা হয়, যদিও এখনও বেআইনিভাবে এই বাণিজ্য চালুই আছে। এই কনভেনশনের ৫০ বছর পূর্তি হয়েছে গত বছর, যা বেশ দীর্ঘ জটিল এক পথে পেরিয়ে এসেছে। ইউনেস্কোর কনভেশনের ফলে, গত অর্ধশতকে, এক দেশের চুরি যাওয়া প্রত্ন সম্পদ অন্য দেশ ফিরিয়ে দিয়েছে, পাচার প্রতিরোধে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে; আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করেছে; প্রত্নসম্পদের অবৈধ পাচারের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা তৈরি হয়েছে। জাতিসংঘ প্রত্নসামগ্রীর পাচারকে যুদ্ধাপরাধ হিসেবে ঘোষণা করেছে। ইউনেস্কো প্রতি বছরের ১৪ নভেম্বরকে সাংস্কৃতিক সামগ্রী পাচার বিরোধী দিবস হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। ইউনেস্কো এবার গুরুত্ব দিচ্ছে প্রত্নসামগ্রীর অনলাইন বাজারের ওপর, কারণ, প্রযুক্তি প্রসারের সঙ্গে প্রত্নসামগ্রীর অবৈধ পাচার ও চোরাচালান অনেকটাই বেড়ে গেছে।
ইরাক এবং সিরিয়া থেকে লুট হওয়া কয়েক হাজার বছরের প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন এবার অনলাইনে কেনাবেচার একটি সাইটের মাধ্যমে বিক্রি করে দিচ্ছে জঙ্গি সংগঠন- আইসিস। তাদের বিরুদ্ধে আগেই চোরাচালানের অভিযোগ উঠেছিল।
অনলাইনে বিক্রি করা প্রত্নসামগ্রির মধ্যে রয়েছে- প্রাচীন মুদ্রা, দুর্লভ অলঙ্কার এবং স্থাপত্য। পশ্চিম সিরিয়ার আপামিয়া শহর থেকে হারিয়ে যাওয়া প্রাচীন দু'টি মুদ্রারও সন্ধান মিলেছে ওই ওয়েবসাইটে। শুধু বিজ্ঞাপনই নয়, অনলাইনে মুদ্রা দু'টির দামও উল্লেখ করেছে আইএস। একটির দাম ৫৭ ইউরো, অন্যটি ৯০।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, ইরাকের টাইগ্রিস নদীতীরের অ্যাসিরীয় শহর নিমরুদে হামলা চালায় আইসিস, সেখানে ব্যাপক ধ্বংসের পাশাপাশি চলে প্রত্নসম্পদের লুটপাট। একই তাণ্ডব চালানো হয় মসুলের জাদুঘরে, বিশ্ববিদ্যালয়য়ের লাইব্রেরিতে। এ সব জায়গা থেকেই লুট করা দুর্লভ সব প্রত্নসামগ্রী অলনাইনে বিক্রির চেষ্টা চালাচ্ছে তারা। এসব মূল্যবান প্রত্নপণ্যের ব্যাপক চাহিদাও আছে, তারা এ ব্যাপারটা খুব ভাল করেই জানে।
চোরাপথে আগেও প্রত্নসামগ্রী বিক্রি করেছে আইসিস। আন্তর্জাতিক বাজার ধরতে তারা অনলাইনের সাহায্য নিয়েছে। নিয়মিত 'অর্ডার'ও আসছে এসব পণ্যের জন্য। আর এ কারণেই দেশের প্রত্নতত্ত্বগুলোর দিকেই বেশি চোখ আইসিস জঙ্গিদের। কারণ তাদের টাকা দরকার। এমন পরিপ্রেক্ষিতে অনলাইনে প্রত্নসামগ্রীর প্রচার ও বিক্রয় নিয়ন্ত্রণের জোর দাবিও উঠেছে।