আমার ক্যামি আমার সিটিজেন
আমার শৈশবের প্রিয় কাজগুলোর একটি ছিল রেডিওর দুটি নবের একটি ঘুরিয়ে রেডিওর বিভিন্ন স্টেশন ধরা, আর অন্যটি ডানে ও বাঁয়ে ঘুরিয়ে রেডিওর কথা ও গান জোরে শোনা, আস্তে শোনা। দ্বিতীয় প্রিয় কাজটি ছিল সুযোগ পেলেই আমার বাবার হাতঘড়ির চাবি ঘুরানো। এ পর্যন্ত তিনি সহ্য করেছেন। কিন্তু চাবিটা একটু ওপরে টেনে ঘুরাতে থাকলে যে সময়ও বদলে দেওয়া, তা-ও শিখে ফেলি। টেবিলঘড়িতে চাবি দিতে বেশ গায়ের জোর লাগত। কিন্তু ছয়টাকে আটটা আর দশটাকে বারোটা বাজানো যেত অনায়াসে।
ফলে আমার হস্তক্ষেপের কারণে সময়বিভ্রম ঘটতে শুরু করল। আমাদের এক প্রতিবেশীর বাড়িতে বেশ কারুকাজ করা একটা দেয়ালঘড়ি আমার ধরাছোঁয়ার বাইরে সিলিংয়ের কাছাকাছি ঝোলানো ছিল। পেন্ডুলামের দোল খাওয়া দেখতাম হা করে ওপরের দিকে তাকিয়ে। সপ্তাহের নির্ধারিত দিনে চাবিটা গৃহকর্তাই দিতেন। যেহেতু দেয়ালঘড়ির পশ্চাৎদেশ আমার তখনো দেখা হয়নি। চাবিটা দেখিনি।
১৯৬৭ সালে বিদেশগামী আমাদের এক দূরসম্পর্কীয় আত্মীয় সপ্তাহ তিনেক আমাদের বাড়িতে ছিলেন। তাঁকে সি-অফ করতে তেজগাঁও এয়ারপোর্টেও এসেছিলাম। সৌজন্যের ফল পেতে লাগল মাত্র দুই মাস। আমার নামে এবং বাবার প্রযত্নে বিদেশ থেকে একটি পার্সেল এল। সেই আত্মীয় বেশ চকচকে ইস্পাতের চাকতিতে বসানো একটি হাতঘড়ি পাঠিয়েছেন। ঘড়ির নাম ক্যামি। আমার আনন্দিত মুখাবয়বে মেঘ নামতে বেশি সময় লাগেনি। কারণ, ততক্ষণে সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে ঘড়িটা আমার নামে পাঠানো হলেও যেহেতু ক্লাস ফাইভের ছাত্রের হাতে ঘড়ি মানায় না, আমাকে আরও কিছুকাল অপেক্ষা করতে হবে। আর যেহেতু অব্যবহৃত অবস্থায় থাকলে ঘড়িটাতে জং ধরে যেতে পারে। এই বিপর্যয় থেকে ঘড়িটাকে রক্ষা করার জন্য দয়া করে আমার বাবাই ঘড়িটা ব্যবহার করবেন।
ঘড়িটা কেন আমাকে দেওয়া যাবে না, তার পেছনে যেসব কারণ উত্থাপন করা হয়েছে, তার একটি সারসংক্ষেপ :
১. ক্লাস ফাইভের ছাত্রের হাতে ঘড়ি মানায় না।
২. ক্লাস ফাইভের ছাত্র বারবার ঘড়ি দেখে সময় নষ্ট করবে।
৩. ঘড়ি হাতে এত কম বয়সেই ফুটানির অভ্যাস হয়ে যাবে।
৪. ঘড়িটার জন্যই ক্লাস ফাইভের ছাত্র চোর-ডাকাতের কবলে পড়বে।
৫. বারবার চাবি দিতে চেষ্টা করে ঘড়ির স্প্রিং নষ্ট করে ফেলবে, ঘড়িটার বারোটা বাজিয়ে ফেলবে।
সুতরাং ঘড়ি হাতছাড়া হয়ে গেল। তবে এতকাল ধরে ব্যবহৃত আমার বাবার পুরোনো ঘড়িটা বছরে তিনটি উপলক্ষে হাতে পরার অনুমতি লাভ করলাম। তিনটি উপলক্ষ একই ধাচের : ত্রৈমাসিক পরীক্ষা, ষান্মাষিক পরীক্ষা ও বার্ষিক পরীক্ষা। নতুন ঘড়ি হাতছাড়া হলেও শর্তযুক্ত একটি আশ্বাস আমার বাবা দিলেন, প্রাইমারিতে বৃত্তি পেলে সেই বৃত্তির টাকায় ঘড়ি কিনে দেবেন।
সুতরাং ঘড়ির প্রত্যাশায় আমাকে প্রাইমারি বৃত্তি পেতেই হলো। টাকা পেতে পেতে পুরো বছর গড়িয়ে গেল। সিক্স থেকে সেভেনে উঠে গেছি। যথারীতি বই কেনার টাকাসহ একসাথে এক বছরের টাকা পেয়ে গেলাম। একালের স্কুলছাত্রের একটি বার্গারের দাম আমার তখনকার মাসিক বৃত্তির টাকার চেয়ে বেশি। আমার বাবা সদয় হয়ে আমাকে নিয়ে এলেন নিউমার্কেটে ঘড়ির দোকানে। আমার বাবা এমন একটা ধারণা দিলেন যে পৃথিবীতে দুটো ব্র্যান্ডের ঘড়িই ভালো, ক্যামি আর সিটিজেন। আর বাকি সব বাজে ঘড়ি তিন দিনও টিকে থাকবে না।
আমার বাবার পছন্দ অনুযায়ী দোকানদার স্বচ্ছ কাচের ওপর দুটো ঘড়ি রাখলেন : ক্যামি আর সিটিজেন। তারপরও স্বচ্ছ কাচের ভেতর দিয়ে যে ঘড়িটার ওপর আমার নজর পড়ল তার নাম টিসেটে (অনেক বছর পর জানলাম শব্দটা ফরাসি, সুতরাং টিসেটে নয়, বলতে হবে টিসো)।
সে আমলে বাবার ইচ্ছের বাইরে যাওয়া খুব কঠিন ব্যাপার ছিল। তবুও টিমোর দিকে আঙুল নির্দেশ করে বললাম, এটা তো খুব খারাপ ঘড়ি, তাই না?
জবাব না দিয়ে বাবা ক্যামি আর সিটিজেন নিয়ে দামাদামি শুরু করলেন : সাব্যস্ত হলো ক্যামি নিলে ৮০ টাকার কম দেওয়া যাবে না, আর সিটিজেন নিলে একদাম ৯০ টাকা। তবুও আমার পরলোকগত বাবাকে ধন্যবাদ দিই, আমার সামনে দুটো ঘড়ি রেখে একটা পছন্দ করতে বলেছিলেন। আমি সিটিজেন পছন্দ করি। এর মধ্যে স্কুল বদলে তখনকার সেরা স্কুলে ভর্তি হই। গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাইস্কুল। ১৯৬৯ সালে আমি ক্লাস সেভেন সেকশন বিতে ক্লাস শুরু করি। যথারীতি নতুন ঘড়ি পরে স্কুলে যাই। আমার সহপাঠীদের কার হাতে কী ঘড়ি দেখতে চেষ্টা করি। কারও হাতে রোলেক্স, কারও হাতে টিমো, কারও হাতে ওমেগা। কারও ঘড়িতে রেডিয়াম লাগানো, অন্ধকারেও কাটা জ্বলজ্বল করে।
কারও ঘড়ির ভেতর আর একটি ঘড়ি, আসলে এটা কম্পাস, কারও ঘড়িতে লেখা ওয়াটারপ্রুফ। আমার বাবার ভাষায় এগুলো সব বাজে ঘড়ি। ক্যামি কিংবা সিটিজেনের মতো নব্বই টাকা দামের ঘড়ি চোখে পড়ল না।
অগত্যা আমার বৃত্তির টাকায় বাবার পছন্দে নতুন কেনা ঘড়িটা নিয়ে ভিন্ন একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম। ঘড়িটা কেবল পরীক্ষার সময়ই হাতে পরব। অন্য সময় ঘড়ির কী এমন দরকার। ক্লাসে নির্ধারিত সময় পরপর ঘণ্টা তো বাজেই। টিফিনের ঘণ্টা, ছুটির ঘণ্টার ছন্দ ভিন্ন, শুনলে বোঝা যায় মাকসুদ ভাই (আমাদের স্কুলজীবনের ঘণ্টাবাদক) কোনটা বোঝাতে চাচ্ছেন। স্কুল ছেড়ে যখন কলেজে এলাম, আমার সেই সিটিজেন ঘড়ির দুই দিকের দুটো ফিতের গুরুত্বপূর্ণটি ছিঁড়ে গেল। সুতরাং প্যান্টের পকেটে ঘড়িটা রাখতে শুরু করলাম। আমার রিস্টওয়াচ পকেটওয়াচে পরিণত হলো। রবীন্দ্রনাথও পকেটওয়াচ ব্যবহার করতেন। তলস্তয়ও। ১৯৬৯ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত তিন দশক যত কম দামিই হোক, আমি একটা না একটা ঘড়ির মালিক ছিলাম। নতুন সহস্রাব্দের শুরুতেই একটি মোটোরলা ফোল্ডিং ফোনের মালিক হয়ে দেখি, এটা কেবল ফোনই নয়, ঘড়িও।
সুতরাং অতিদ্রুত কেবল নববর্ষের নয়, নতুন মিলেনিয়ামের রেজল্যুশন নিলাম, যেহেতু ফোন হাতে থাকবেই, আর কোনো দিন ঘড়ি কিনব না, হাতে পরব না, পকেটেও রাখব না।
নিজেকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছি, গত একুশ বছর ঘড়ি পরিনি, সামনে যে কটা বছর আছে, আদৌ যদি থাকে, ঘড়ি ছাড়াই বেশ কাটিয়ে দিতে পারব।
এখন তো হাতে হাতে স্মার্টফোন।
২০১৬ সালে সুইজারল্যান্ডে পৃথিবীর বিভিন্ন অংশের মোট দেড় হাজার ঘড়ি নির্মাতা একটি সম্মেলনে মিলিত হন। তাঁদের প্রায় সকলেরই মোট ঘড়ি উৎপাদনে ভাটা পড়েছে। সাধারণ ফোন এবং স্মার্টফোন উভয়কেই তাঁরা দায়ী করেছেন। ২০২০ সালে ঘড়ির বিশ্ববাজার ছিল ৬২ বিলিয়ন ডলারের আর স্মার্টফোনের বাজারে আনার ৭১৫ বিলিয়ন ডলার। ঘড়ি নির্মাতারা জানিয়েছেন, সাধারণভাবে তরুণেরা হাতঘড়ি থেকে নজর সরিয়ে নিয়েছেন। তাঁদের স্মার্টফোনে কী নেই? ঘড়ির ভবিষ্যৎ এখন প্রশ্নের সম্মুখীন। এর জন্য আমিও কম দায়ী নই। ক্যামি কিংবা সিটিজেন আমার কিছুই নেই।
চাঁদের প্রথম ঘড়ি ওমেগা
চাঁদের প্রথম মানুষ নিল আর্মস্টং যখন খানিকটা হাঁটাহাঁটি করেন, তাঁর হাতে কোনো ঘড়ি ছিল না। কিছুক্ষণের মধ্যেই চাঁদের দ্বিতীয় মানুষ এডউইন অলড্রিন এসে যখন যোগ দিলেন, তাঁর হাতের কবজিতে তখন ওমেগা স্পিডমাস্টার।
ঘড়ি নিয়ে কিছু তথ্য না জানলেই নয়
আধুনিক যান্ত্রিক ঘড়ির জনকের সম্মান দেওয়া হয় জার্মানির নুরেমবার্গের তালাওয়ালা ও ঘড়িওয়ালা পিটার হেনলিনকে। তাঁর জন্ম ১৪৮৫ সালে, মৃত্যু ১৫৪২, তিনি জার্মান রেনেসাঁ যুগের বিজ্ঞানী হিসেবে আবির্ভূত হন। তাঁর প্রাথমিক প্রশিক্ষণ তালামিস্ত্রি হিসেবে। সে আমলে দক্ষ তালামিস্ত্রিদের কেউ কেউ ঘড়ির মিস্ত্রিও হয়েছেন। ১৫১১ সালে তাঁর তৈরি বহনযোগ্য ডিম্বাকৃতির জেটি ঘড়িই প্রথম দক্ষ যান্ত্রিক ঘড়ি হিসেবে পরিচিতি পায়। তবে এই ঘড়িতে সারা দিনে ৩০ মিনিটের মতো সময়ের হেরফের হয়ে যেত বলে সূর্যঘড়ির সাথে মিল রেখে নিয়মিত সময় সংশোধন করা হতো, ১৫২৪ সালে একটি ঘড়ির জন্য হেনলিন ১৫ ফ্লোরিন দাম পেতেন। বলাবাহুল্য সাধারণ মানুষের ঘড়ির প্রয়োজন তখনো দেখা দেয়নি। তাঁর ক্রেতারা ছিলেন সমাজের বিশিষ্ট ও ধনাঢ্যজন। ১ ফ্লোরিনের এ কালের অর্থমূল্য সর্বোচ্চ ১০০০ ডলার পর্যন্ত হতে পারে।
প্রথম পকেটঘড়ির নির্মাণকাল ১৫০৫ সাল, ১৯০৫ সালে জার্মানির ওয়াচমেনার অ্যাসোসিয়েশন পকেটঘড়ির ৪০০ বছর পূর্তি উদ্যাপন করেছে। ঘড়ির মেইনস্প্রিং আবিষ্কারের কৃতিত্ব তাঁকে দেওয়া হলেও প্রকৃতপক্ষে তা আবিষ্কৃত হয়েছে আরও শতবর্ষ আগে।
হাঙ্গেরির কাউন্টেস কসকোভিচের জন্য ১৮৬৮ সালে প্রথম পাটেক ফিলিম্পি অ্যান্ড কোম্পানি প্রথম হাতঘড়ি তৈরি করে। ঘড়িটি ছিল ডায়মন্ডখচিত।
১৭৯০ সালে জেনেভা থেকে ৬০,০০০টি ঘড়ি রপ্তানি হয়। রোলেক্স ওয়েস্টার ওয়াটার রেজিস্ট্যান্ট ঘড়ি সত্যিই পানি প্রতিরোধ করতে পারে কি না, তা প্রমাণ করতে মাসিডিস গ্লিৎজ নামের একজন নারী সাঁতারু এই ঘড়ি হাতে দিয়ে ইংলিশ চ্যানেল সাঁতরে পাড়ি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। দশ ঘণ্টা সাঁতার কেটে চ্যানেল পেরিয়ে সবাইকে দেখালেন ঘড়ি ঠিকই আছে, ঠিকভাবেই চলছে।
১৮৫১ সালে লন্ডনের গ্রেট এক্সিবিশনে প্রথম ওয়াটারপ্রুফ ঘড়ি প্রদর্শিত হয়। লন্ডনের ২ নম্বর ক্রসবি রোডে অবস্থিত ডব্লিউ পেটিট অ্যান্ড কোম্পানি প্রদর্শনীতে একটি গোলাকার কাচের পানিপূর্ণ পাত্রে ডুবে থাকা একটি ঘড়ি উপস্থাপন করে। পানির ভেতরে উল্টেপাল্টে যে অবস্থায়ই রাখা হোক, ঘড়িতে পানি ঢুকবে না, ঘড়ি নষ্ট হবে না। কাচের গ্লোবে পানির ভেতর ঘড়িটিকে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। এ ধরনের ঘড়ি উদ্ভাবনের জন্য কোম্পানিকেই আবিষ্কারকের মর্যাদা দেওয়া হয়।
প্রথমদিকের বাণিজ্যিকভাবে সফল ওয়াটারপ্রুফ ঘড়ির নির্মাতা ডেনিসন। অ্যারন ডেনিসন ১৮৭২ সালে কার্ডিফের ইউকে ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টি অফিস থেকে পেটেন্ট গ্রহণ করেন।
প্যাটেক ফিলিম্পি নির্মিত ১৯৪৩ সালের পার্পিচুয়াল হাতঘড়ি ২০১৬ সালে ১১ মিলিয়ন ডলার মূল্যে বিক্রয় হয়। সর্বোচ্চ মূল্যের এটাই বিশ্বরেকর্ড।
বাজারে রাজত্ব করত পকেটঘড়ি। সৈনিকদের প্রয়োজনে হাতঘড়ির ব্যাপক উৎপাদন শুরু হয়। পকেটঘড়ি ধীরে ধীরে বিলীন হতে থাকে।
এই নিবন্ধের শিরোনামের ক্যামি ঘড়ির যাত্রা ১৯১৩ সালে, সুইজারল্যান্ডে। আর জাপানি ও সুইস বিনিয়োগকারীদের যৌথ উদ্যোগে ১৯৩০ সালে সিটিজেন ঘড়ি কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয়।
এমন একটা চাবি মাইরা...
জীবন ও ঘড়ি নিয়ে শ্রেষ্ঠ গানটি আবদুর রহমান বয়াতির। গীতিকার, সুরকার ও শিল্পী তিনি।
এমন একটা চাবি মাইরা দিলা ছাইড়া
জলম ভরে চলিতেছে
মন আমার দেহ ঘড়ি সন্ধান করি
কোন মিস্ত্রি বানাইয়াছে
খাকের একখান কেস বানাইয়া মেশিন দিলা তার ভিতর
ওরে রং বেরং-এর বার্নিশ করা দেখতে ঘড়ি কি সোন্দর...
ঘড়ির কেসটা বত্রিশ চাকের কলে কব্জা বেসুমার
দুইশ ছয়টা হাড়ের জোড়া বাহাত্তর হাজার তার
ও মন দেহঘড়ি চৌদ্দতলা তার ভিতরে দশটি নালা
একটা বন্ধ নয়টা খোলা গোপনে এক তালা আছে।