ইরাক-ইরান নিষেধাজ্ঞা
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অনেক দিন ধরেই বহির্বিশ্বের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে অজ্ঞাতসারে নতুন সমস্যার জন্ম দিয়ে আসছে। আশির দশকে রেগান সরকারের আমলে আফগানিস্থানের সোভিয়েত মদদপুষ্ট সরকারকে উৎখাত করার জন্য বিপ্লবীদের অস্ত্র দেয়া হয়। কিন্তু এতে হিতে বিপরীত হয়, এবং পরবর্তীতে এই সশস্ত্র বিপ্লবীদের কেউ কেউ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেই প্রতিপক্ষ হিসেবে বেছে নেয়। একই দশকে আমেরিকা এল সালভাদরের রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধে বামপন্থী বিপ্লবীদের সাথে লড়ার জন্য ক্ষমতাসীন সরকারকে অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করে, যে যুদ্ধ থেকে জন্ম নেয় আরো কুখ্যাত এমএস-১৩ দলটি।
পুরনো এসব ঘটনাকে স্মরণ করার এখনই উপযুক্ত সময়, কারণ ট্রাম্প প্রশাসন ইরানের সঙ্গে ২০১৫ সালে করা পারমাণবিক চুক্তি থেকে বেরিয়ে এসে, দেশটির ওপর নতুন নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।
চুক্তি অনুযায়ী ইরান ১৫ বছর পর (২০১৫ থেকে) পুনরায় বাধাহীন ভাবে পারমাণবিক শক্তি ব্যবহার করতে পারবে, এই শর্তটিকে "ত্রুটিপূর্ণ" দাবী করে ট্রাম্প সরকার বলেছে যে "পনেরো বছর যথেষ্ট নয়"। এদিকে ইরান সরকার এই দাবির বিপরীতে বলে আসছে যে তারা আর কোন নিষেধাজ্ঞা মানবে না। কথার চাপানউতোরে ইরান এও বলেছে পনের বছর নয়, বরং পাঁচ বছরের মধ্যেই ইরান পারমাণবিক চুল্লি বানাতে চাই, তারা মার্কিন চাপের মুখে নতি স্বীকার করবে না। এতে আবার মার্কিন বিশেষজ্ঞরা খুশি হয়ে বলছে যে, 'এতদিনে ইরান তার আসল চেহারা দেখিয়েছে, তারা আসলে কখনোই তাদের পারমাণবিক প্রকল্পকে পুরোপুরি বন্ধ করে রাখতে রাজি ছিল না।'
তবে এসব কথার যুদ্ধ এবং প্রেক্ষাপট ভালোভাবে বোঝার জন্য ইতিহাসের পাতায় চোখ বোলানো জরুরি।
ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা কি ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্র বানাতে আরো উৎসাহিত করবে কিনা, (যদিও দেশটি মারাত্মক রকম অর্থনৈতিক সংকটে নিমজ্জিত)এটা নিয়ে মার্কিন রাজনীতিবিদ এবং পণ্ডিতগণ বেশ কিছুদিন ধরেই বিতর্ক করেছেন। যে ব্যাপারটা সবাই অবজ্ঞা করেছেন সেটা হচ্ছে বছরের পর বছর ধরে চলা এসব বাড়তি নিষেধাজ্ঞার প্রভাব কিভাবে ইরানের ওপর পড়ছে।
অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা কখনোই উদার গণতন্ত্র প্রচার করে না, এটি বরং দেশের শাসন ব্যবস্থাকে শোষণমূলক একনায়কতন্ত্রের দিকে ঠেলে দেয়। অন্তত বই পুস্তকের উদাহরণে তাই দেখা যায়। ২০০৯ সালে মেমফিস বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ডারসেন পেকসনের গবেষণায় প্রকাশ পায় যে, ১৯৮১ থেকে ২০০০ সালের মাঝে যেসব দেশের বিরুদ্ধে অন্যান্য দেশ অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগ করেছে, তাদের মানবাধিকারের সূচকগুলো উল্লেখযোগ্য ভাবে কমে গিয়েছে। পরের বছর মিসৌরি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কুপার ড্রুরির সাথে করা ভিন্ন একটি গবেষণায় তিনি দেখতে পান যে, নিষেধাজ্ঞার শিকার দেশগুলো ক্রমশ অগণতান্ত্রিক হয়ে উঠছে।
এসব অবরোধ বা নিষেধাজ্ঞার কারণে ক্ষমতার ভারসাম্য জনগণ থেকে সরকারের দিকে হেলে পড়ে, যার পরিণতিতে গণতন্ত্রের চর্চা বাধাগ্রস্থ হয়। যেহেতু অবরোধের কারণে জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণগুলো দুষ্প্রাপ্য হয়ে পড়ে, ক্ষমতাসীনরা সুযোগ বুঝে সেগুলোকে নিজেদের কব্জায় রেখে দেয়। তারা তখন জনগোষ্ঠীকে তাদের ঔদার্যের মুখাপেক্ষী করে তোলে, আর যারা তাদের বিরুদ্ধে কথা বলে, তাদেরকে রাষ্ট্রীয় সম্পদ থেকে বঞ্চিত করে রাখে। পেকসন আর ড্রুরি লিখেছেন, 'যেহেতু রাষ্ট্রযন্ত্র বাজারে যথেচ্ছ হস্তক্ষেপ করতে পারে, তারা সহজেই বিদেশি নিষেধাজ্ঞার কারণে দুষ্প্রাপ্য হয়ে যাওয়া সীমিত পরিমাণ পণ্যের বিতরণকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।' তারা আরো বলেন 'শাসকগোষ্ঠী তাদের প্রতিপক্ষদের কাছ থেকে সব সম্পদকে দূরে সরিয়ে নিজেদের এবং মিত্রদের দিকে প্রতিবাহিত করে কারণ তারা অবরোধের কারণে উদ্ভুত বাড়তি খরচকে পুষিয়ে নিতে চায় এভাবে।'
অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞাগুলো শুধু স্বৈরাচারী সরকারগুলোকেই তাদের লৌহ মুষ্টি শক্ত করার কাজে সাহায্য করে না। দীর্ঘ মেয়াদে এরকম ভাবে চলতে থাকলে তা উদারপন্থী গণতন্ত্রের চর্চার জন্য প্রয়োজনীয় সব আচার-আচরণ এবং সক্ষমতাকে ধীরে ধীরে ক্ষয় করতে থাকে। অবরোধের কারণে দেশের অর্থনীতির বারোটা বেজে যায়, আর শিক্ষিত ও পেশাদার লোকজন বিদেশে অভিবাসী হতে শুরু করে। অর্থনৈতিক চাপে থাকা পরিবারগুলো মেয়েদেরকে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে আনতে শুরু করে, এবং তাদেরকে কম বয়সে বিয়ে দিয়ে দেয়া শুরু হয়। আর যেহেতু অবরোধের কারণে বৈধ উপায়ে পণ্য আসার সুযোগ সংকুচিত হয়ে যায়, মানুষ কালোবাজারের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে দ্রুতই। ২০০৫ সালের একটি গবেষণায় ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের পিটার আন্দ্রেয়াস উল্লেখ করেন যে "অবরোধের কারণে প্রায়শই আইনভঙ্গ করার ধারণাটির ব্যাপারে মানুষের সহনশীলতা বেড়ে যায়, এবং তাদের মনে আইন-কানুনের প্রতি এক ধবনের বীতশ্রদ্ধ ভাব জেগে ওঠে। নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হলেও আইনের প্রতি শ্রদ্ধা পুনরায় প্রতিষ্ঠা করা সবচেয়ে কঠিন কাজগুলোর একটি হয়ে ওঠে, কারণ মানুষ সহজে পুরনো অভ্যাস ত্যাগ করতে পারে না।'
ট্রাম্প প্রশাসনের কর্মকর্তাদের উচিত ছিল পুনরায় নিষেধাজ্ঞা বহাল করার আগে এই বিষয়গুলোকে ধর্তব্যে নেয়া। তাদের অবশ্যই এ ধরণের পদক্ষেপের পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক থাকা উচিত, কেননা আমেরিকা এরকম অনেক অনিচ্ছাকৃত ঝামেলা সৃষ্টি করেছিল সাদ্দাম হোসেনের ইরাকে এরকম নিষেধাজ্ঞা জারি করে। ১৯৯০ সালে ইরাক, কুয়েত আক্রমণ করার পর যে বিধিনিষেধ বলবৎ করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, তার ফলশ্রুতিতে কার্যত বহির্বিশ্বের সাথে ইরাকের যাবতীয় বাণিজ্যিক কার্যক্রম থেমে গিয়েছিল। মানবিক কারণে ১৯৯৫ সালে জাতিসঙ্ঘ ইরাককে অনুমতি দেয় সীমিত পরিমাণে তেল রপ্তানী করতে, যা থেকে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে খাদ্য আমদানী করেছিল দেশটি
যদিও ক্লিনটন প্রশাসন পণ করেছিল যে তারা ইরাকে সরকার পরিবর্তন ঘটাবে, আদতে সেটা হয়নি—বরং সাদ্দাম এই "তেলের বিনিময়ে খাদ্য" পন্থার মাধ্যমে তার অবস্থানকে আরো শক্ত করে তোলে। খাদ্য সরবরাহের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে তিনি সাধারণ ইরাকীদের নিজ কব্জায় নিয়ে আসেন। যারা আগে খোলা বাজারে বাধাহীন ভাবে খাদ্য বেচা কেনা করতো, তারা তখন খাদ্যের জন্য সরকারের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।
সাংবাদিক ডেভিড রেইফ রিপোর্ট করেন যে, তেলের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচির আওতায় "প্রতিটি ইরাকী পরিবার প্রধানকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক ইস্যুকৃত একটি রেশন বই সংরক্ষণ করতে হতো, যেখানে তার পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের নাম তালিকাভুক্ত থাকতো এবং তার জন্য বরাদ্দকৃত প্রতিটি খাদ্যকণার সূচারু বর্ণনা দেয়া থাকতো। প্রতিটি খাদ্য-এজেন্টের কাছে মন্ত্রণালয় থেকে প্রাপ্ত ডিজিটাল তালিকা থাকতো, যেখানে লেখা থাকতো কাকে কতখানি খাদ্যশস্য সরবরাহ করতে হবে। এর অন্তর্নিহিত মানে ছিল যে সরকারের কাছে সর্বদা প্রতিটি ইরাকী নাগরিকের ডাটাবেস থাকতো, যা নিয়মিত হালনাগাদ হতে থাকতো। কোনো ধরণের আলোচনা ও সমালোচনা ছাড়া, কোনো নিরাপত্তা বাহিনী কিংবা বেতনভুক্ত ইনফর্মারের সহায়তা ব্যাতিরেকে এরকম একটি ডাটাবেস ছিল পুলিশ বাহিনির সদস্যদের জন্য স্বপ্নের মত ব্যাপার।
অবরোধের কারণে সাদ্দামকে উৎখাত করা ইরাকীদের জন্য যতটা কঠিন ছিল, ঠিক ততটাই কঠিন ছিল উপসাগরীয় যুদ্ধে মার্কিনরা যেসব অবকাঠামোর ক্ষয়ক্ষতি করেছিল, সেগুলো মেরামত করা। জয় গর্ডন, 'ইনভিজিবল ওয়ারঃ দ্যা ইউনাইটেড স্টেটস এন্ড দ্যা ইরাক স্যাংশান্স' বইয়ে বিস্তারিত লিখেছেন কিভাবে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার বেড়াজালে পড়ে ইরাকের পুনর্গঠন স্থবির হয়ে পড়ে। 'ইরাকের পানি পরিশোধন ব্যবস্থা প্রথম হুমকির মুখে পড়ে যথোপযুক্ত বৈদ্যুতিক সরবরাহের অভাবে, কারণ বৈদ্যুতিক জেনারেটর এবং তদসংক্রান্ত যন্ত্রপাতি মার্কিন বোমা হামলায় ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, এবং এগুলোকে মেরামত করার জন্য যে যন্ত্রাংশের দরকার ছিল, তাও মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে আমদানী করা সম্ভব হচ্ছিল না।'
যদিওবা যে কোনোভাবেই হোক ইরাক যথেষ্ট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারতো, কিন্তু তারা বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করতে পারতো না, কারণ বোমাবর্ষণের কারণে পানির পাইপগুলোর অনেক বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল, এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র "ওয়েপন অফ মাস ডেস্ট্রাকশান" তৈরিতে ব্যবহার হতে পারে এই অজুহাতে পানির পাইপ আমদানীর উপরেও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে রেখেছিল। কোনোভাবে চোরাকারবারীদের মাধ্যমে পাইপ সংগ্রহ করা গেলেও সেগুলোকে সংযুক্ত করা যেত না, কারণ এই কাজটির জন্য অবশ্যপ্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি খননযন্ত্র বুলডোজার কিংবা ক্রেনও তাদের ছিল না, এবং এগুলোর আমদানীও মার্কিনরা বন্ধ করে রেখেছিল।
কিন্তু এসব অবরোধের কারণে ইরাকের কৃত্তিম অবকাঠামোই শুধু ক্ষতিগ্রস্থ হয়নি, এতে মানব-অবকাঠামোরও সার্বিক ক্ষতি সাধিত হয়েছে। প্রায় ত্রিশ লাখ বুদ্ধিজীবী এবং পেশাদার ব্যক্তি নব্বইয়ের দশকে ইরাক ছেড়ে চলে যান, এবং যেসব সরকারী কর্মচারী থেকে যান দেশে, তারাও অফিসে যাওয়া বন্ধ করে দেন, কারণ তারা বেতন হিসেবে যে সামান্য অর্থ পেতেন, তা দ্রুত বাড়তে থাকা মুদ্রাস্ফীতির কারণে অর্থহীন হয়ে গিয়েছিল। এসবের ফলাফল হিসেবে অদক্ষ, স্বল্প যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন একদল লোকের হাতে সমগ্র অবকাঠামোর দায়িত্ব চলে যায়।
আর নিষেধাজ্ঞা সংক্রান্ত যাবতীয় নথির ভবিষ্যদ্বাণীকে সত্য প্রমাণ করে ইরাকীরা ক্রমশ কালোবাজারের দিকে ঝুঁকে পড়ে। গর্ডন বলেন 'বেকারত্ব এবং দরিদ্রতা শুধুমাত্র অপুষ্টি এবং রোগশোকই আনেনি, বরং একই সাথে অপরাধও বাড়িয়েছে এবং সামাজিক সম্পর্কগুলোরও অবনতি ঘটিয়েছে।' তেল ও অন্যান্য দ্রব্য রপ্তানী করার জন্য সাদ্দাম নির্ভরশীল ছিল সুন্নী আদিবাসীদের তৈরি করা চোরাকারবারী নেটওয়ার্কের উপর, যার মাধ্যমে বর্ডার থেকে এসব পণ্য দেশের বাইরে যেত। এতে করে এই আদিবাসীদের ক্ষমতাও অনেক বেড়ে যায়। দারিদ্র্যের হাত থেকে বাঁচার জন্য অনেক শিয়া ইরাকী স্থানীয় চরমপন্থী ইসলামিক দলগুলোর কাছ থেকে সাহায্য নিতে শুরু করে। কুইন মেরি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী লি জোনাস তার ১৯৯০ সালে লেখা বই "সোসাইটিস আন্ডার সিজ" ইরাক নিয়ে গবেষণা করেছিলেন। তিনি বলেন "একনায়কতন্ত্র এবং নিষেধাজ্ঞার কারণে সাদ্দামের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো ধর্মনিরপেক্ষ প্রতিপক্ষরা ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। শুধু টিকে ছিল কিছু ক্ষুদে জনগোষ্ঠী, যারা পরবর্তীকালে আল কায়েদা, আইসিস এবং শিয়া রাজনৈতিক দলগুলোর গোড়াপত্তন করেন।'
২০০৩ সালে সাদ্দামকে উৎখাত করার পর বুশ প্রশাসন অচিরেই টের পেয়ে যায় যে ইরাককে পুনর্গঠন এবং পরিচালনা করা অভাবনীয় রকমের কঠিন এক কাজ। হাস্যকর হলেও সত্য যে এই কঠিন কাজটির পেছনে আমেরিকার আরোপ করা নিষেধাজ্ঞাই সর্বাংশে দায়ী। তাদের আরোপিত অবরোধের কারণেই ইরাক একটি কম আধুনিক, কম ধর্মনিরপেক্ষ এবং স্বল্প শিক্ষিত সমাজে রূপান্তরিত হয়েছে।
ইরানের অবস্থা ইরাকের মত নয়, কারণ তারা গালফ ওয়ারের মত কোনো যুদ্ধের মধ্য দিয়ে যায়নি, এবং তাদের উপর বোমাবর্ষণের কোনো ঘটনাও ঘটেনি। তাদের অবকাঠামো তুলনামূলকভাবে অনেক উন্নত অবস্থাতেই আছে। কিন্তু ইরানের ওপর বছরের পর বছর ধরে আরোপিত মার্কিন ও আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাব এখন ইরাকের মতই হয়ে গেছে প্রায়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রথম ইরানের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ১৯৭৯ সালে, জিম্মী সংকটের সময়। কিন্তু ইরানের বৈদেশিক বাণিজ্য তখন সেভাবে বিঘ্নিত হয়নি। পরবর্তীতে ওবামা প্রশাসন এবং তার ইউরোপীয় মিত্ররা ২০১০ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে এমন সব নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন যাতে বস্তুত ইরানী কোম্পানিগুলোর জন্য পাশ্চাত্য থেকে কোনো কিছু আমদানী করা ও সেখানে কিছু রপ্তানী করা, কিংবা কোনো আন্তর্জাতিক ব্যাংকে টাকা ট্রান্সফার করা পুরোপুরি অসম্ভব হয়ে যায়। এতে দেশের অর্থনীতি এবং জনগোষ্ঠীকে চরম মূল্য দিতে হয়, এবং এই প্রভাব সুদূরপ্রসারী। যার কারণে ২০১২ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে ইরানে দরিদ্র্যসীমার নিচে থাকা পরিবারের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়। ২০১৬ সালে বিবিসি প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯৬ সালের তুলনায় ইরানী পরিবারগুলো প্রায় অর্ধেক পরিমাণ গবাদী পশুর মাংস ও রুটি খেয়ে বাঁচতে বাধ্য হচ্ছিল। ২০১৬ সালের এক গবেষণায় প্রকাশিত হয় যে ডাক্তারের প্রেসক্রিপশনে লেখা ওষুধ দেশে না থাকায়, অর্থাৎ আমদানী করতে না পারার কারণে, এবং সেসব ওষুধ বানানোর কাঁচামাল আমদানী করতে না পারায়, ইরানে প্রায় ষাট লাখ রোগী অত্যাবশ্যকীয় চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
ওয়াশিংটনে সর্বজনবিদিত ধারণা হচ্ছে যে এসব নিষেধাজ্ঞার কারণেই ইরানীরা ২০১৩ সালের নির্বাচণে সংস্কারপন্থী প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানীকে জয়যুক্ত করেছে, রুহানী ইরানীদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি একটি পারমাণবিক চুক্তি করতে সক্ষম হবেন, যার মাধ্যমে ইরানের অর্থনীতির ওপর থেকে সব বিধিনিষেধ উঠে যাবে। অবশ্য এখানে এটা বলতে হবে, ইরানীরা ১৯৯৭ সালেও মোহাম্মদ খাতামি নামের আরেকজন সংস্কারপন্থী নেতাকে ভোট দিয়েছিলেন, যা নিষেধাজ্ঞা আরোপের আগের ঘটনা।
রুহানী জিতলেও ইরানীরা সবাইকে সতর্ক করেন এই বলে যে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা ইরানেও ১৯৯০ সালের ইরাকের মত বিষাক্ত পরিবেশ তৈরি করছে। ২০১৩ সালে, শত শত ইরানী প্রেসিডেন্ট ওবামার কাছে একটি চিঠি পাঠান, যেখানে তারা তাদের আশংকা ব্যক্ত করেন এভাবে: 'আমরা আশংকা করছি যে ইরানেও ইরাকের দুঃস্বপ্নের পুনরাবৃত্তি হতে যাচ্ছে, যা আমাদের দেশে শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক পরিবর্তন আনার শেষ সুযোগটিকে ধ্বংস করে দিতে পারে। আমরা নিশ্চিত যে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ইরানের সুশীল সমাজকে দূর্বল থেকে দূর্বলতর করতে থাকবে, এবং চরমপন্থীদের হাতকে আরো শক্তিশালী করে তুলবে।'
প্রকৃতপক্ষেই, ইরান সরকার, এবং নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে, চরমপন্থী দল "ইসলামিক রেভোল্যুশনারি গার্ডস কর্প্স" (আইআরজিসি) ওবামা যুগের নিষেধাজ্ঞার সুযোগ নিয়ে অর্থনীতির একচেটিয়া দখল নিয়ে নিয়েছে, যার কারণে ইরানের বেসরকারী খাত পুরোপুরি ধ্বসে পড়েছে এবং মধ্যবিত্তরাও সব বৈধ ব্যবসা বাণিজ্য থেকে ছিটকে গেছে। এবং ইরাকের মতই, এখানেও নিষেধাজ্ঞার কারণে অপরাধমূলক কাজের ব্যপ্তি বেড়েছে, দুইজন ইরানী পরিদর্শক বলেছেন যে "মাফিয়াদের মত একটি শ্রেণি" ইরানের "দম বন্ধ করা অর্থনীতি এবং সাথে সহাবস্থানরত কালো বাজারগুলোকে" ব্যবহার করে "অর্থনীতির একচেটিয়াকরণ" সম্পন্ন করে ফেলেছে।
ইরানের সরকারবিরোধী আন্দোলনের মূল চালিকাশক্তি, মধ্যবিত্তরা ক্রমশ দূর্বল হয়ে পড়েছে, অন্যদিকে আইআরজিসি অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার সুযোগ নিয়ে তাদের সম্পদ ও ক্ষমতা বহুগুণে বাড়িয়ে নিয়েছে। তেহরানের শাসকগোষ্ঠী ইরানী বংশোদ্ভুত মার্কিন নাগরিক ও ওয়াশিংটন পোস্টের রিপোর্টার জেসন রেজাইয়ানকে একবার কয়েদ করেছিল। তিনি তার উপলব্ধির কথা বলেছিলেন এভাবে, "ইরানের বিরুদ্ধে জারি করা সর্বশেষ নিষেধাজ্ঞার পরিণতিতে, ইরানের মানুষকে অর্থনৈতিকভাবে আরো চাপের মুখে ঠেলে দেয়া হয়েছে, এবং তাদের চাওয়া পাওয়াগুলো এখন কোনোমতে জীবিত রয়েছে কেবল; সমাজের কোনোরকম পরিবর্তন সাধনের চিন্তা করার মত অবস্থা তাদের আর নাই।'
ইরানী বংশোদ্ভুত মার্কিন চিত্রনির্মাতা এবং লেখক বেহেশতেহ ফার্শনেশানি ২০১৩ সালে উল্লেখ করেন যে "ইরানের ওপর আরোপিত নিষেদ্ধাজ্ঞায় শুধু মধ্যবিত্তরাই শোচনীয়ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। তাদের সমষ্টিগত মনোবল ভেঙ্গে পড়ছে এবং গণতান্ত্রিক চিন্তা ও চেতনাকে খর্ব করা হয়েছে, যার কারণে অভিজাত শাসক গোষ্ঠীর ক্ষমতা আরো সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে।' সিএনএন এর ভাষায়, ইরানের নিম্নগামী অর্থনীতি আর ব্যক্তি-স্বাধীনতার অভাবের কারণে "সব মেধা পশ্চিমে পাচার হয়ে যাচ্ছে"।
১৯৯০ সালের ইরাকের মত, ওবামা যুগে আরোপিত নিষেধাজ্ঞার কারণে ইরানের সমাজব্যবস্থা অনেকটাই রক্ষণশীল হয়ে যায়। ২০১২ সালের একটি রিপোর্টে ইন্টার্ন্যাশনাল সিভিল সোসাইটি অ্যাকশান নেটওয়ার্ক উল্লেখ করেছিল, 'নারী অধিকার বিশেষজ্ঞরা ইরানেও একটি আর্থ-সামাজিক প্যাটার্ন লক্ষ করছেন যা আগে ইরাকে দেখা গিয়েছিল, নিষেধাজ্ঞার পর। ইরাকে নিষেধাজ্ঞা থেকে জন্ম নেয়া দারিদ্রের কারনে মেয়েদেরকে পড়ালেখা থেকে ছাড়িয়ে নেয়া হয় এবং বাল্য বিবাহের সংখ্যা বহুগুণ বেড়ে যায়। পরিবারগুলোতে ক্ষুধার্ত মুখ কমানোর জন্য কন্যা শিশুদের কম বয়সে বিয়ে দিয়ে দেয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। ইরানী মেয়েরাও এই একই ধরণের শংকার মধ্যে রয়েছে।' ইরানের পরিসংখ্যান অধিদপ্তরের ভাষ্য অনুযায়ী ২০১২ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে শিশু বিবাহের হার শতকরা বিশ শতাংশ বেড়ে গিয়েছিল।
ইরানী ভিন্নমতাবলম্বীরা পরিবর্তনের আশায় ২০১৫ সালের পারমাণবিক চুক্তিকে প্রবলভাবে সমর্থন জানিয়েছিল, কারণ এটা নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া এবং পরিস্থিতি উন্নয়নের একটা আশাবাদ তৈরি করেছিল। ইরানী শাসক গোষ্ঠীর দুর্নীতি ও অযোগ্যতা, আর সাথে কিছু আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের খামখেয়ালি আচরণ স্বত্তেও ২০১৬ সালে ইরানের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ছিল শতকরা ১২ ভাগেরও বেশি। এর আগের দুই বছর অর্থনীতি ব্যাপকভাবে সংকুচিত হয়ে পড়ে ছিল।
ট্রাম্প প্রশাসন এ সব প্রত্যাশার উপর শ্রেফ পানি ঢেলে দিয়েছে। পারমাণবিক চুক্তি থেকে নিজেদেরকে প্রত্যাহার করে নেয়ার আগেও তারা ইউরোপীয় সরকারগুলোর কাছে তদবির করেছে ইরানের সাথে ব্যবসা না করার জন্য, এবং কোনো আমেরিকান প্রতিষ্ঠানকে অনুমতি দেয়নি তাদের সাথে ব্যবসা করার। এখন চুক্তি থেকে প্রত্যাহারের অংশ হিসেবে ট্রাম্প ২০১৫ সালে ওবামা প্রশাসন কতৃর্ক প্রত্যাহার করা সব নিষেধাজ্ঞাগুলো বলা যায় পুনর্বহাল করেছে, সঙ্গে আরও নতুন নিষেধাজ্ঞাও দিয়েছে। ইউরোপীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপরেও ক্রমাগত চাপ প্রয়োগ করছে ইরানের সাথে ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিন্ন করার জন্য—নয়তো তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ব্যবসা হারাবে বলে হুমকি দেওয়া হচ্ছে।
ইউরোপীয় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো এখন পর্যন্ত পুরোপুরি মেনে নেয়নি এই দাবী, আর ইরানও চীন এবং ভারতের সাথে বাণিজ্য সম্পর্ক চালু রেখেছে। কিন্তু এটা মোটামুটি নিশ্চিত যে ইরানের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আগের তুলনায় স্লথ হয়ে পড়েছে। ট্রাম্প, চুক্তি থেকে প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়ার পরপরই ইরানের মুদ্রা, রিয়ালের মূল্য কমে যায়, আর মুদ্রাস্ফীতির আশংকা দেখা দেয়। আগেই অনুমেয় ছিল: এই পরিণতির সম্মুখে দাঁড়িয়ে ক্ষমতাসীন দলের সমর্থক রক্ষণশীলরা একটি "প্রতিরোধক অর্থনীতি" গড়ে তোলার আহ্বান জানাবে, যেখানে রাষ্ট্রই সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করবে। কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রিচার্ড নেফিউ ইরানের অবরোধ এবং তদসংক্রান্ত আলোচনায় ওবামা প্রশাসনের সাথে কাজ করেছিলেন। তিনি বলেন 'নিষেধাজ্ঞা পুনর্বহাল করার মানে হচ্ছে দেশটিতে প্রবেশাধিকার সীমিত করা এবং দেশটির মানুষদের বর্হিবিশ্বে প্রবেশাধিকার ক্ষুন্ন করা। শাসক গোষ্ঠীর কাছে এ ধরণের অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা খুবই লোভনীয়, কারণ মুক্ত বাজার অর্থনীতি তাদের নিয়ন্ত্রণকে শিথিল করে রাখে।
ইরানে হয়তো এখনো গণঅভ্যুত্থানের সুযোগ রয়েছে, কিন্তু মধ্যবিত্ত শ্রেণির দূর্বল থেকে দূর্বলতর হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এ ধরণের বিপ্লবও অপরিকল্পিত এবং অসুসংহত হয়ে পড়বে। ইরান বিশেষজ্ঞ মোহাম্মাদ সাদেঘি এশফাহলানি এবং জালাম আব্দি ভবিষ্যদ্বানী করেন যে 'যদিওবা নিষেধাজ্ঞার কারণে কোনো আভ্যন্তরীণ গোলযোগ দেখা দেয়, তা গণতন্ত্রের জন্য বিপ্লব হবে না, বরং খাবারের জন্য রায়ট হবার সম্ভাবনাই বেশি; আর সেক্ষেত্রে ইরানের শাসক গোষ্ঠি তাদের উপর নীপিড়নের খড়্গ চাপিয়ে দিতে একটুও দ্বিধা করবে না।' এটিও সম্ভাব্য যে ট্রাম্পের চুক্তি প্রত্যাহারের কারণে ইরানীদের মাঝে মার্কিন-বিরোধী মনোভাব বেড়ে গেছে প্রবলভাবে। ইরানীরা আগে এই চুক্তিটি নিয়ে অনেক উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছিল, কারণ তারা নিষেধাজ্ঞা দূর করার জন্য মরিয়া ছিল। এখন অবশ্য সরকারের সবচেয়ে কড়া সমালোচক ইরানী ব্যক্তিটিও স্বীকার করবে যে তাদের নেতারা পারমাণবিক চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করেছে দেখে নিষেধাজ্ঞা ফিরে আসেনি, বরং আমেরিকাই তা ভঙ্গ করেছে।
(পিটার বেইনার্ট দ্যা আটলান্টিক পত্রিকার লেখক এবং নিউ ইয়র্কের সিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক।)
রূপান্তর: ইশতিয়াক খান