ঋত্বিক ঘটকের ‘আমার লেনিন’
মাস দুই আগে আর্কাইভ থেকে ব্রিটিশ ফিল্ম ইন্সটিটিউটের উদ্ধার এবং পুনঃস্থাপন করা ঋত্বিক ঘটকের স্বল্পদৈর্ঘ চলচ্চিত্র আমার লেনিনের পাবলিক ডোমেইনে মুক্তি পাওয়ায় ইন্টারনেট আবার এর আবির্ভাব প্রত্যক্ষ করেছে। ১৯৭০ সালে ভ্লাদিমির লেনিনের জন্ম শতবার্ষিকী উদযাপনকে সামনে রেখে ১৮ মিনিট দৈর্ঘ্যের ছবিটি নির্মিত হয়েছিল। একটি অস্বাভাবিক ঘরানার সঙ্করের বিরল প্রামাণ্য চিত্র দিয়ে ছবিটি শুরু হয়েছে: গ্রাম বাংলার লোক থিয়েটার যাত্রার আদলে লেনিনের জীবন দর্শনের নাটকীয় উপস্থাপন।
ছবিটির প্রথম কয়েক মিনিট যাত্রা পালার ভেতর দিয়ে লেনিন ও মার্ক্সের শিক্ষার সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া জনৈক কৃষিজীবীর আদলে নামহীন কেন্দ্রীয় চরিত্রকে তুলে ধরেছে। প্রথম নজরেই দৃশ্যটি পরিচিত ঠেকে: মঞ্চের আবয়বগুলোর দিকে রীতিমতো মন্ত্রমুগ্ধ পুরুষ এবং নারী -- কয়েকজন শিশুদের যত্ন নিচ্ছে -- প্রথাগত যাত্রামঞ্চকে ঘিরে আছে। কিন্তু তাদের আচ্ছন্ন করে রাখা বিষয়বস্তু কিংবদন্তীর বীর বা হিন্দু দেবদেবীর বদলে বরং বাংলাভাষী ইউরোপিয় বেশভুষার সুদূর দেশের চিন্তক এবং বিপ্লবী।
পটভূমিতে মিটমিটে গ্যাসের আলোয় গ্রাম বাংলার ঝলমলে রাতের আকাশের বুকে বিছিয়ে থাকা লেনিনের অপার্থিব দাবনীয় ছবির সামনে খোদ লেনিনের ভূমিকায় অভিনয়কারী শিল্পী বামন হয়ে গেছেন। ফলে অতি নাটকীয় হেঁয়ালির পরাবাস্তব প্রভাব আরও বেড়ে গেছে। কণ্ঠস্বর মঞ্চে উচ্চারিত সংলাপকে জোরালো করে আমাদের জানিয়ে দেয় যে এই ধরনের মঞ্চায়ন কতটা কার্যকরভাবে বিপ্লবী বুলিকে অগণন তরুণের কাছে রক্তমাংসে পরিণত করতে পারে, তত্ত্ব এবং ইতিহাসকে কত প্রবলভাবে আন্তরিকতার সাথে প্রাঞ্জল করে তোলা যায়। গানই যেকোনও যাত্রা পালার মূল ভিত্তি। প্রথাগত যাত্রার বাদ্যযন্ত্রের তালে অনায়াসে চেনা বিষয়বস্তুকে অচেনা বিষয়বস্তুর সাথে মিলিয়ে বাংলা ভাষায় ল' ইন্টারন্যাশনালের চড়া কণ্ঠের আবৃত্তির ভেতর দিয়ে এটি শেষ হয়েছে।
চলচ্চিত্রটি যাত্রাকে কমিউনিজমের বিপ্লবী ধ্যানধারণার সাথে বাংলার প্রত্যন্ত গ্রামীণ সম্প্রদায়ের যোগাযোগের প্রথম বিন্দু হিসাবে তুলে ধরেছে। ছবির তরুণ নায়ক লেনিন সম্পর্কে যত বেশি জানছে ততই কোলকাতায় বিভিন্ন রাজনৈতিক মিছিলে অংশ নিতে এগিয়ে যাচ্ছে, শ্রমিকের অধিকার সম্পর্কে পড়াশোনা করে তার বিস্তার ঘটিয়ে গ্রামসির ভাষায় 'অর্গানিক ইন্টেলেকচুয়াল'-এ রূপান্তরের দিকে এগিয়ে গেছে।
সবদিক থেকেই ঋত্বিকের বর্ণনা আদর্শায়িত। কিন্তু ইতিহাসের এই ক্রান্তি লগ্নে দাঁড়িয়ে, আমরা বামপন্থী রাজনীতির যেকোনও নজীরকে ক্রমবর্ধমান সন্দেহের চোখে দেখে অভ্যস্ত এবং এর সমস্ত স্মৃতিকে সমবেত বিস্মৃতির মহাগহ্বরে পাঠানোর ব্যাপারে উৎসাহী বলে মার্ক্সবাদী যাত্রা -- রামপন্থী রাজনীতিকে বাংলার ধর্মীয় লোক থিয়েটারের সাথে একাত্ম করা -- বিশ্বাসযোগ্যতার সীমাকে অতিক্রম করে যাওয়ার পাশপাশি যুগপৎ স্বীকৃতি দাবি করে।
নির্বাচনী উপকরণ হিসাবে যাত্রা
সেই উপনিবেশিক কাল থেকে সামাজিক আচরিক (বিশেষত হিন্দুধর্মীয়) আয়োজনে শেকড় বিস্তৃত হলেও যাত্রাকে বিভিন্ন রাজনীতি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনা, মঞ্চায়ন এবং সচেতনতা সৃষ্টির কাজে ব্যবহার করা হয়েছে। যাত্রায় শ্রেণী সংগ্রামকে তুলে ধরার ক্ষেত্রে স্বাধীনতা পরবর্তী উপনিবেশবাদ বিরোধী বিভিন্ন থিম অভিনেতা ও নাট্যকার উৎপল দত্তের হাতে দারুণভাবে পুনর্জীবিত হয়েছে। জালিয়ানওয়ালা বাগ (১৯৬৯), সন্ন্যাসির তরবারি (১৯৭২), মাও সে তুঙ (১৯৭৪) উৎপল দত্ত রচিত এবং অভিনীত সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং বিপ্লবী পালাগুলোর অন্যতম। শত শত বছরের ইতিহাস এবং অধিকার বঞ্চিত গ্রামীণ দরিদ্র জনগণের জীবন ও মানসিকতার কাছাকাছি হওয়ায় দত্ত এই ঘরানার ব্যাপক সম্ভাবনা চিনতে পেরেছিলেন। সম্মিলিত নিপীড়িত জনগণের মাঝে রুদ্ধ হয়ে থাকা রাজনৈতিক শক্তির নাগাল পাওয়ার লক্ষ্যে একে সক্রিয় করে তোলা যেতে পারে বলে ভেবেছেন তিনি।
গত দশকে শাসক দল পশ্চিম বাংলায় যাত্রাকে নির্বাচনী হাতিয়ার হিসাবে কাজে লাগিয়েছে। জওহরলাল ইউনিভার্সিটির পণ্ডিত গৌরব রাজনৈতিক যাত্রা নিয়ে কাজ করেন। তিনি উল্লেখ করেছেন যে, ২০১১ সালের নির্বাচনে ব্যাপক জনপ্রিয়তা আদায়ে তৃণমুল কংগ্রেসের ব্যবহার করা অন্যতম কৌশল ছিল যাত্রার আদলে কমিউনিস্ট পার্টি অভ ইন্ডিয়ার (মার্ক্সবাদী) কালোত্তীর্ণ বিভিন্ন শ্লোগান অনুকরণ এবং পতন্মেুাখ শাসক দলের সমালোচনার লক্ষ্যে সেগুলোকে গ্রহণ করা। ১৯৭০ সালে একটি পুরোনো পালা ঘুম কেড়েছে মা মাটি মানুষ থেকে তাদের পরিচয়সূচক শ্লোগান 'মা মাটি মানুষ' নেওয়া হয়।
২০০৯ সালে সিঙ্গরি-নন্দীগ্রাম সঙ্কটের প্রেক্ষাপটে সিপিআই (এম) তৃণমূল কংগ্রেসের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তার বিরুদ্ধে আক্রমণ শানাতে এবং 'শিল্পায়ন' কর্মসূচির পক্ষে সচেতনতা সৃষ্টির জন্যে একে চাঙা করে তোলে। কিন্তু, গৌরব যেমন উল্লেখ করেছেন, কৌতূহলোদ্দীপক ব্যাপার হলো তুঙ্গ সময়ে বাম ফ্রন্ট সরকার নির্বাচনী প্রচারণায় বিরল ক্ষেত্রেই যাত্রাকে কাজে লাগিয়েছে।
বাংলায় কার্ল মার্ক্স
বাম ফ্রন্টের শাসন সংহত হয়ে ওঠার আগে নকশালপন্থী আন্দোলন এবং ইউনাইটেড ফ্রন্ট সরকারের বিচ্ছিন্নতার কারণে ছিন্নভিন্ন বাংলা রাজ্য প্রেসিডেন্ট শাসনের ভেতর যাওয়ার আসার উত্তাল সময়ে ঋত্বিকের ছবিতে প্রদর্শিত যাত্রা ১৯৬০-এর দশকের শেষে এবং ১৯৭০ দশকের গোড়ার দিকে জনপ্রিয় হয়েছিল। এইসব ঘটনা উৎপল দত্তের পালার সমসাময়িক ছিল, তবে পার্থক্য ছিল এই যে ভারতীয় ইতিহাস থেকে নেওয়া বিভিন্ন পর্বের উপর নির্ভর না করে এগুলো সুস্পষ্টভাবে মার্ক্স, লেনিন প্রমুখের জীবনী তুলে ধরে নিজস্ব ধরনের মিথোলজি গড়ে তুলেছিল।
সাধারণভাবে হিন্দু মিথোলজির বিভিন্ন ঘটনা তুলে ধরায় ব্যবহৃত যাত্রা এইসব বিকল্প জীবনী তুলে ধরার কাজে অনায়াসে কাজে লেগেছে এবং গ্রামীণ বাংলায় দারুণ জনপ্রিয় প্রমাণিত হয়েছে। কিংবদন্তীসম নাট্যকার শম্ভুনাথ বেশ কিছু এই জাতীয় পালা রচনা করেছেন। বিশ শতকের শেষ কয়েক দশকের যাত্রার শিরোমণি শান্তি গোপাল পাল এমনি বেশ কয়েকটি পালায় লেনিন এবং মার্ক্সের ভুমিকায় অভিনয় করে চিরস্থায়ী খ্যাতি অর্জন করেছেন।
বিপুল জনপ্রিয় আবেদন থাকা সত্ত্বেও এইসব পালা সেভাবে দলিলায়িত হয়নি। ঋত্বিক ঘটকের ছবির ফুটেজ সম্ভবত এই ধরনের কমিউনিস্ট মিথোলজির যাত্রা অভিনয়ের একমাত্র অস্তিত্ববান রেকর্ডিং। টেক্সট পাওয়া বেশ কঠিন।
কার্ল মার্ক্স (১৯৭২) সাবলীল বাংলা ভাষায় শ্রমিকের বিচ্ছিন্নতা, প্রলেতারিয়েত শিল্পকলা, গণতন্ত্রিক সমাজতন্ত্রে মার্ক্সের অবিশ্বাস, উপনিবেশবাদ এবং পুজিবাদের পরস্পর সম্পর্কিত অশুভের ধারণা তুলে ধরেছে। সত্যিকারের যাত্রার চেতনায় এই টেক্সট মার্ক্সের দারিদ্র্য পীড়িত অস্তিত্ব, অনাহারী সন্তানদের মর্মন্তুদ দৃশ্য, ছেলে এডগারের করুণ মৃত্যু, তার এক মেয়েকে জড়িয়ে গোপন প্রেমের একটি পর্বের ভেতর দিয়ে অনন্য অতিনাটকীয়তায় অগ্রসর হয়েছে -- এসবই দর্শকদের মনে আলোড়ন সৃষ্টির লক্ষ্যে পরিকল্পিত ছিল। ল' ইন্টারন্যাশনালে এবং কমরেড, দ্য বিউগলস আর সাউন্ডিংয়ের মতো জনপ্রিয় বিপ্লবী জাতীয় সঙ্গীত বাংলায় পরিবেশন করা হয়েছে।
একটি দৃশ্যে প্রথাগত দেখা যায় বাঙালী আবেগ এবং অবিশ্বাস্যতার মিশেলে মার্ক্সের উপোস মেয়েরা দুধঅলার কাছে ছুটে গিয়ে তাকে আলিঙ্গন করে 'দুধঅলা কাকা' সম্বোধন করে (উনিশ শতকের দুধঅলা দুজন জার্মান ইহুদি মেয়ের মুখে 'কাকা!' ডাক শুনে কেমন প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে সেটা সহজেই অনুমেয়।) বলছে, 'তোমার দুধ খুবই মিষ্টি।' জবাবে দুধঅলা বিনা দ্বিধায় বলছে, 'এটার আমার দুধ নয়, আমার গরুর দুধ।'
আদর্শ এবং বিশ্বাস
যাত্রা পালার ধরন দুটি খুবই দূরবর্তী ঐতিহাসিক মুহূর্তের ভেতর এক অদ্ভুত ধরনের পরিচিত বন্ধন এমনকি পারিবারিক আন্তরিকতার জন্ম দিয়েছে।
রাজনৈতিক আদর্শ এবং ইতিহাস ছড়িয়ে দেওয়ার কাজে খোদ লোক অভিনয় আচারের ব্যবহার ততটা লক্ষণীয় নয়। পৃথিবীব্যাপী ইতিহাস জুড়ে কমিউনিস্ট, সমাজতন্ত্রী, এবং সত্যি বলতে অন্যান্য শাসক গোষ্ঠী ও আন্দোলন একে ব্যবহার করেছে। তবে মোটামুটিভাবে যাত্রা বৃহৎ অংশে প্রায়শই প্রতিক্রিয়াশীল, এমনকি দত্তের বক্তব্য মতে, সাম্প্রায়িক সম্ভাবনায় রঞ্জিত হিন্দু উৎসব এবং আচারের সাথেই সম্পর্কিত থেকে গেছে। ১৯৬০ ও ১৯৭০ দশকের বামপন্থী যাত্রাগুলো এই করুণ ধর্মীয় আয়োজনকে শ্রেণী সংগ্রামের বাণী এবং পুজিবাদী নিপীড়নের ধারণাকে জনপ্রিয় করার কাজেই নয়, বরং দৃঢ়তার সাথে এবং প্রবলভাবে ধর্মবিরোধী চিন্তকদের মাহাত্ম্য এবং ধর্মের ভাওতাবাজী তুলে ধরার কাজেও ব্যবহার করা হয়েছে। দেবদেবীরা যখন সুপ্রিম কোর্টে বিচার করছেন এবং বৈষম্যমূলক রাষ্ট্রীয় নীতিকে ন্যায্যতা দিতে নিয়মিত 'ঈশ্বরের লীলা'র দোহাই দিচ্ছেন, এমন একটা এমন কিছু প্রায় অসম্ভবই মনে হয়।
রূপান্তর: শওকত হোসেন