খ্রিষ্টিয় ফাদারের বাংলাদেশ
ফাদার টিম সাধারণ কোনো পরিব্রাজক নন। পক্ষী-চক্ষু দিয়ে দেখলেন, তারপরই লিখে ফেললেন সফরনামা; ব্যাপারটার মোটেও এমন নয়। বাংলাদেশেই মানুষের সেবায খ্রিষ্টের দেখানো পথে জীবন পর করার প্রত্যয় নিয়ে ১৯৫২-র অক্টোবরে নিউ ইয়র্ক থেকে জাহাজে করাচি বন্দর হয়ে উড়োজাহাজে তেজগাঁয়ের ছোট্ট পরিসরের বিমানবন্দরে এসে নামলেন ফাদার টিম। জীবনটা এখানে কাটাবেন বলেই তো জীববিজ্ঞানে মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি, অন্তত: ২৫০ ধরনের নেমাটোড গোলকৃমি আবিষ্কারক পুরোনো ঢাকার ইঁদুর ও বানরের সহবাসী হয়ে একটি বাড়িতে উঠলেন। শিক্ষকতা শুরু করলেন সেইন্ট গ্রেগরি স্কুলে, তার হাত দিয়ে নটর ডেম কলেজে চালু হলো বিজ্ঞান বিভাগ, জীববিজ্ঞানের বই তার 'টেক্সট বুক অব কলেজ বায়োলজি'র কোনো বিকল্প সেকালে ছিল না। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে পড়ালেন মাইক্রোবায়োলজি। সত্তরের জলোচ্ছাসের পর চলে যান সবচেয়ে দুর্গম দ্বীপ মনপুরায়। একাত্তরে শুরু হয় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞ। তার আগেই ফাদার টিম নটরডেম কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। একাত্তরে বাংলাদেশের পক্ষে মার্কিন সিনেটকে জাগাতে পত্র লিখেছেন--এতো দীর্ঘসময়ের এতো নিবিড় কোনো বিদেশি বাংলাদেশ সাক্ষীর নাম বলা দুষ্কর হবে। সম্ভবত নেই। 'ফাদার টিম' এক নামেই পরিচিত সবার কাছে। তার জন্ম ২ মার্চ ১৯২৩ মিশিগান সিটিতে। পেছনে কর্ম ও সেবার এক দীর্ঘ জীবন রেখে ১১ সেপ্টেম্বর ২০২০ যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা অঙ্গরাজ্যে মৃত্যুবরণ করেন। তার বাংলার স্মৃতি ও বাংলাদেশ বীক্ষণ 'ফোর্টি ইয়ার্স ইন বাংলাদেশ : মেমোয়ার্স অব ফাদার টিম' থেকে কিছু অংশ এই বিদেশির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আংশিক অনুবাদ করলাম। আমার বিশ্লেষণও সাথে যুক্ত হলো। ফাদার টিম তিন প্রধান দলের সরকারের সময়েই নাগরিকত্বের আবেদন করেছেন। কখনো তার আবেদন মঞ্জুর হয়নি। কেনো হয়নি, নিঃস্বার্থ এই মানুষটির সাথে সরকারের সম্পর্ক নিয়ে কেউ হয়ত গবেষণামূলক অডিসন্দর্ভ রচনা করবেন-- এ প্রত্যাশা তো করতেই পারি।
এক্সপেডিশন সোনাদিয়া আইল্যান্ড
১৯৫৬-র জানুয়ারিতে আমি ঢাকার প্রথম বৈজ্ঞানিক অভিযানে বের হই--এটি ব্যক্তিগত ধরনের এবং অনানুষ্ঠানিক অনুষ্ঠান-- গন্তব্য কক্সবাজার উপকূলের সোনাদিয়া দ্বীপ। আমার সাথে এসেছেন ব্রাদার ফ্রাভিয়ান লাপলান্তে, তিনি দিয়াঙ্গ-এর মাষ্টার ফিশারম্যান, তখন ভ্যঙ্কুবার থেকে মৎস বিজ্ঞানে পিএইচডি করে আসা ডক্টর এম আর খান (প্রয়াত), ফাদার জিন বার্ক, ব্রাদার ডোনাল্ড বেকার। তারা আমার সাথে কারণ কলেজের জীববিজ্ঞান জাদুঘরের জন্য বিভিন্ন প্রজাতির নমুনা সংগ্রহ করবেন। পালতোলা সাম্পানে শীতকালে এই জেলেদের দ্বীপের সবচেয়ে উঁচু জায়গার পূর্ব প্রান্তে আমরা তাবু খাটালাম। দক্ষিণে মনোহর এক সৈকত উত্তরে ভাটার সময় মাইলব্যাপী কাদার আস্তরণ। প্রথমরাতে আমরা যখন শুয়ে পড়ি দুদিক থেকে ধেয়ে আসা ঢেউয়ের শব্দ শুনতে পাই। যখন জোয়ার চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছল এত উচুতে থাকার পরও আমাদের চারদিকে কমবেশি পনের ফুট জায়গাই কেবল শুষ্ক থাকল। অবাক হবার কিছু নেই, এ দ্বীপে স্থায়ীভাবে কেউ থাকে না, থাকার সুযোগ নেই।
আমাদের অভিযানের প্রধান উদ্দেশ্য মাছের কর্মকান্ড ও আচরণ পর্যবেক্ষণ, আমি ভাটার সময় দ্রুত সামুদ্রিক নেমাটোড (গোল কৃমি), এক মুঠো অ্যালজি (শ্যাওলা প্রজাতি) তুলে নিলাম, বিভিন্ন স্থানের কাদামাটির আস্তরণও। আমার সংগ্রহ ফাইভ পার্সেন্ট ফরমালিনে চুবিয়ে রাখলাম, পরে এসব নিয়ে ল্যাবরেটরিতে কাজ করব। রাত তিনটায় জেলেদের সাথে বেরিয়ে পড়তাম এবং ভোরের পরপর তাদের জালে ধরা পড়া বিচিত্র সম্ভার থেকে কলেজ জাদুঘরের জন্য প্রচুর অমেরুদন্ডী সামুদ্রিক প্রাণী সংগ্রহ করলাম। জেলেরা সাপ নিয়ে সন্ত্রস্ত থাকত, কারণ সামুদ্রিক সাপ ভয়ঙ্কর বিষাক্ত। জাল টানার পর তাদের প্রথম কাজ হতো জাল থেকে সাপ ছাড়ানো। কিন্তু হিন্দু হবার কারণে সাপের পূজারী, তারা সাপ মারবে না, বরং সাপের লেজে ধরে আবার সমুদ্রে ছুঁড়ে ফেলত।
আমি একদিন দ্বীপে জেলেদের বিভিন্ন কর্মকান্ডের ছবি তুলছিলাম। চোখে পড়ল দুজন গাট্টা গোট্টা শ্যামলা মানুষ পরস্পরকে ভয়ঙ্কর গালাগাল দিয়ে বুনো প্রাণীর মতো ঝগড়া করে চলেছে। আমি তাদের এ অবস্থার ছবি তুলতে ক্যামেরা নিয়ে যখন এগোই, দেখি দুজনই দাঁত বের করা হাসি দিয়ে আমার ক্যামেরার সামনে পোজ দিয়েছে। ছবি তোলা হয়ে গেলে আবার দুজন ক্ষিপ্ত হয়ে তাদের আগের কীর্তি শুরু করে দিল। এমন নাটকীয় অভিনয় আমি আর কখনো দেখিনি।'
সে সময় ফাদার টিম সংগৃহীত নেমাটোডস (গোল কৃমি) সংখ্যায় কম হলেও ৫৬টি প্রজাতি জীব বিজ্ঞানে সম্পূর্ণ নতুন। এসব সংগ্রহের পরিমাপ নিয়ে স্লাইড বানিয়ে একটি বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ 'দ্য মেরিন নেমাটোডস অব বে অব বেঙ্গল' রচনা করে পাকিস্তানের নতুন জার্নাল 'দ্য প্রসিডিংস অব দ্য পাকিস্তান একাডেমি অব সায়েন্স' এ প্রকাশের জন্য পাঠান। ধর্মযাজককে বৈজ্ঞানিক ভাবতে হয়ত পাকিস্তান সায়েন্স একাডেমির সম্পাদকমন্ডলীর সমস্যা হয়ে থাকতে পারে। আর একই সময়ে লোহিত সাগরে একই ধরনের কিছু প্রজাতি নিয়ে অধ্যাপক সেবাস্টিয়ান গেরলাকের প্রবন্ধ প্রকাশিত হওয়ায়, তার গবেষণার গুরুত্ব কিছুটা কমে যায়। শেষ পর্যন্ত অধ্যাপক ওসমান গণি, পরবর্তীকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরের হস্তক্ষেপে ১৯৬১ সালে ৮৮ পৃষ্ঠার গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়।
ফাদার টিম সোনাদিয়া দ্বীপে অবতরনের তিরিশ বছর পর ১৯৮৬ সালে দ্বীপের চিংড়ি জমি জরিপ তত্ত্বাবধান করতে আমি সেখানে যাই। ফাদার টিমের গবেষক মনে আমার ছিল না কিন্তু এটা বুঝতে পেরেছিলাম রাষ্ট্রের সদিচ্ছা আর টাকা পয়সার সংস্থান থাকলে সমুদ্রবেষ্টিত এই দ্বীপটিকে পৃথিবীর অন্যতম আকর্ষণীয় একটি অর্থকরী দ্বীপে পরিণত করা সম্ভব হতো।
সম্ভবত ফাদার টিমই সোনাদিয়া দ্বীপে পা রাখা প্রথম বিজ্ঞান গবেষক।
ভুইয়া অ্যান্ড টিম
পঞ্চাশের দশকের শেষ ভাগ থেকে সত্তরের দশকের শেষভাগ পর্যন্ত যারা ইংরেজি মাধ্যমে বায়োলজি পড়েছেন। এমনকি বাংলা মাধ্যমের অগ্রগামী শিক্ষার্থীদের কাছেও ভুইয়া অ্যান্ড টিম অত্যন্ত পরিচিত নাম। এ দুজনের লেখা 'টেক্সটবুক অব কলেজ বায়োলজি'র বিকল্প কোনো বই তখন ছিল না।
এই বই রচনার ইতিহাস ফাদার টিমের স্মৃতিকথায় পাওয়া যায্ সে সময় অর্থাৎ ১৯৪৭-এর দেশ বিভাগোত্তর পূর্ব বাংলায় উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণীতে জীববিজ্ঞান পড়ানোর তেমন কোনো বই ছিল না। কাজেই কোলকাতায় প্রকাশিত টেক্সট বইয়ের উপর নির্ভর করতে হতো। ব্যবহারিক জীববিজ্ঞান ক্লাস করার জন্য নির্দেশনামূলক কোনো বইই ছিল না। শিক্ষক হিসেবে আর ডব্লিউ টিম এই অভাব অনুভব করে একটি বই লিখে ফেললেন 'অ্যা ল্যাবরেটরি ম্যানুয়াল ফর কলেজ বায়োলজি' এবং ১৯৫৫ সালের ফেব্রুয়ারিরতে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত হলো বইটি, কিন্তু ভালো করে ছাপতে গিয়ে এবং শক্ত মলাট লাগাতে গিয়ে বইটির দাম বেড়ে গেল। তিন টাকা দিয়ে এই বইটি কেনা অধিকাংশ শিক্ষার্থীর পক্ষেই সম্ভব ছিল না। কাজেই বইটি তেমন বাজার পায়নি।
কিন্তু তখন 'টেক্সট বুক অব কলেজ বায়োলজি' কাজ অনেকটাই বাকী। শুরুতে ঠিক করেছিলেন সবগুলো ছবিই তিনি আঁকবেন। তিনি যখন চার ভাগের এক ভাগ ছবি আঁকা শেষ করেছেন বাংলা বাজারের প্রকাশক মল্লিক ব্রাদার্স থেকে তাকে ভিন্ন একটি প্রস্তাব দেওয়া হলো। বাজারে তাদের প্রকাশিত কিউ ভুইয়ার একটি বায়োলজি বই আছে। এর পরও আরও একটি বায়োলজি বই বাজারে ছেড়ে প্রতিযোগিতায় নামাটা কারো জন্যই ভালো হবে না। বাজারের বইটির লেখক ঢাকা সরকারি কলেজের শিক্ষক এবং তিনি তার বইয়ের স্বত্ত্ব প্রকাশকের কাছে বিক্রি করে দিয়ে ফুলব্রাইট বৃত্তি নিয়ে আমেরিকা চলে গেছেন। মল্লিক ব্রাদার্ তাকে প্রস্তাব দেন, তিনি যদি কপিরাইট নিয়ে এই বইটিকেই রিভাইজ করে প্রয়োজনীয় সংযোজন, বিয়োজন করে দেন তাহলে একটি বইই একচেটিয়া বাজার পেয়ে যাববে। ফাদার টিম প্রস্তাবটি ভিন্ন একটি কারণে গ্রহণযোগ্য মনে করলেন কারণ, এই বইয়ে প্রায় ৫০০ ছবির প্লেট তৈরি করাই আছে --এতে তার নিজের অনেকটাই সময় বেচে যাবে। পরিশ্রম ও খরচও। সঙ্গে তিনি চাইলেন বইটির আগের লেখক, প্রকাশকেরও চাওয়া ভুইয়া নামটি থাকলে একজন দেশি ও একজন বিদেশি লেখকের বই হলে ভালো কাটতি হবে। ১৯৫৬ সালে প্রকাশিত বইটির দ্বিতীয় সংস্করণের প্রায় পুরোটিই আসলে ফাদার টিম কর্তৃক পুনর্লিখিত। কলেজগুলো বেশ আগ্রহের সাথেই বইটিকে গ্রহণ কলল। এরপর অনেকবার বইটি রিভাইজ করা হয়েছে। সর্বশেষ সংশোধিত সংস্করণ হয় ১৯৬৭ সালে, তারপর কেবল পুনর্মুদ্রণ। সিলেবাস সংশোধিত হওয়ায় এবং তাতে নতুন বিষয় অন্তর্ভুক্ত করায় চতুর্থ সংস্করণের সময় বইটি নিয়ে অনেক কাজ করতে হয় ফাদার টিমের। এই বইয়ের অনেকগুলো ছবি তিনি নিজেই এঁকেছেন, ভালো কিছু ছবি এঁকে দিয়েছেন কর্ণেল বিশ্ববিদ্যালয়ের তখনকার পিএইচডির ছাত্র এন্ডি কিটরিক।
মল্লিক ব্রাদার্সের মালিক ছিলেন রজব আলী মল্লিক। নিউ মার্কেটে তাদের বইয়ের দোকান এখনও আছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর ইংরেজি ভাষায় লিখিত বইয়ের চাহিদা কমে যায়। আমি সত্তরের দশকের গোড়ার দিকে এই বই কিনেছি, জীববিজ্ঞান কখনোই আমার প্রিয় বিষয় না হওয়ায় বইটির প্রতি সুবিচার করতে পারিনি।
ফাদার টিমের মৃত্যুর খবর জানার পর এক ধরনের স্মৃতি কাতরতা থেকে ভুইযা অ্যান্ড টিম এর বিখ্যাত বইটির খোজ নিতে মল্লিক ব্রাদার্সে খোঁজ নেই, জানতে পারি এখন এ নামের কোনো লেখকের বই তাদের কাছে নেই। সত্তরের দশকে বইটির দাম ছিল ১২ টাকা।
দ্বিতীয়বার ঢাকার পথে ফাদার টিম
ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার পাট চুকাতে হল কারণ তার ভিজিটিং প্রফেসরশিপ শেষ হয়ে গেছে। তিনি জীববিজ্ঞানের নেমাটোলজি বিশেষজ্ঞ হিসেবে পড়িয়েছেন। ফাদার টিম ইউরোপ হয়ে ঢাকায় ফিরবেন মনস্থির করলেন।
যুক্তরাষ্ট্রে থাকতেই তার পাকিস্তানি ভিসার মেয়াদ ফুরিয়ে যাওয়ার কাছাকাছি, তিনি কয়েক মাস আগেই ভিসার আবেদন করলেন কিন্তু পেলেন না। ঠিক হলো সানফ্রান্সিসকো থেকে তার ভিসার অনুমোদন রোম দূতাবাসে পাঠানো হবে। তিনি রোম পৌঁছলেন, কিন্তু ভিসার জন্য কতোদিন তাকে অপেক্ষা করতে হবে কোনো ধারনা না পেয়ে স্পোকেন ইতালিয়ান শিখতে শুরু করলেন। ভাগ্য ভালো, এক সপ্তাহ পর ভিসা পেলেন এবং ২০ অক্টোবর ১৯৭০ ঢাকায় এসে পৌঁছলেন। ঢাকায় নেমেই শুনলেন তাকে নটর ডেম কলেজের প্রিন্সিপাল করা হয়েছে। কোনো কালক্ষেপন না করে তাকে যোগ দিতে হবে। ক'দিনের মধ্যেই তিনি হাউস সুপিরিয়র নির্বাচিত হলেন। তারপর আইনি সীমাবদ্ধতার তোয়াক্কা না করে তাকে চারবার হাউস সুপারিয়র নিয়োগ করা হয়। সত্তরের জলোচ্ছাসের পর তিনি চলে গেলেন উপকূলীয় জেলায়, সেখানকার বর্ণনা তার কাছ থেকেই শোনা যাক:
উপকূলীয় এলাকায় ১৯৭০-এর নভেম্বর যে ভয়ঙ্কর সাইক্লোন জলোচ্ছ্বাস হয়ে গেল তার আগে ২৩ অক্টোবর ঢাকায় একটি ঘূর্ণিঝড় হয়ে গেল। এতে ক্ষতি হলো সামান্যই, কিন্তু পরেরটার ক্ষতি অভাবনীয়। রেডিও সাইক্লোনের শতর্ক বার্তা দিয়ে যাচ্ছে, নভেম্বর সন্ধ্যায় আমি নিজেই তা শুনছি। ঘূর্ণিঝড়ের বিপদের সংকেত দিয়ে রেডিও জানাচ্ছে সতর্ক সংকেত ৬ চলছে। তারপর হঠাৎ কতো নম্বর সতর্ক সংকেত চলছে তা বলা বন্ধ হয়ে গেল। শুধু বলা হচ্ছে ভয়ঙ্কর বিপদ। আমার সাথে আরো একজন ফাদার রেডিও শুনছিলেন, আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, এই কথার মানে কি? সংকেত কি ৬ ছাড়িয়ে গেছে? এ প্রশ্নের উত্তর কেউ জানে না। পরে উপকূলীয় মানুষের সাক্ষ্য থেকে জানা গেল তারাও বুঝতে পারেননি এর মানে। তারা হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছিলেন। পরদিনের সংবাদপত্রের ছাপা হলো ঘন্টায ১২০ মাইল বেগে ঘূর্ণিঝড় বয়ে গেছে এর ২০ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাস উপকূল ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। কিন্তু কী ট্র্র্যাজেডি যে ঘটে গেছে তার ন্যূনতম ধারনাও ছিল ন। এটা অবিশ্বাস্য যে অভাবনীয় সংখ্যক মৃত্যু ও ক্ষয়ক্ষতির প্রথম ধারনাটি এসেছে তিনদিন পরের বিবিসি সংবাদ থেকে। তারা ধারনা করছে আনুমানিক ৫০ হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটেছে। তখনই সাইক্লোন এলাকায় যাবার জন্য হুড়োহুড়ি শুরু হয়ে গেল।
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সাইক্লোনের পর চীন থেকে ফিরছিলেন, তিনি ঢাকায় বিরতি দিলেন, কিন্তু সাইক্লোন দুর্গত এলাকা সফরে গেলেন না। তার এই নিস্পৃহতা পূর্ব পাকিস্তানে ভয়ঙ্কর প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করল, তিনি ফিরে এলেন, তার উপকূলীয় এলাকা ঘুরে আসার কথা। সংবাদপত্রে যে ছবি প্রকাশিত হল তাতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে উড়োজাহাজের নিচে উঁচু-নিচু পার্বত্য ভূমি--কিন্তু বলা হলো তিনি দুর্গত এলাকার উপর দিয়ে ঘুরে এসেছেন। এয়ারপোর্টে কর্মরত একজন আমাকে জানিয়েছেন প্রেসিডেন্টের উড়োজাহাজ এক ঘন্টার মধ্যেই ফিরে এসেছে। এই ভয়ঙ্কর দুর্যোগেও ইয়াহিয়া খান তার সরকারের ভয়ঙ্কর নিস্পৃহতা এবং ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের ১৭দিন পর দুর্গত এলাকায় সেনাবাহিনীর ত্রাণ সহায়তার জন্য উপস্থিতি, পূর্ব-পাকিস্তানের জনগণের বিদ্রোহের আগুনে 'সৎ ভগ্নিসুলভ' আচরণে তেল ঢেলে দেয়।
২৭ নভেম্বর ১৯৭০ পোপ ষষ্ঠ পল ম্যানিলা যাবার পথে ঢাকা বিমান বন্দর স্পর্শ করলেন। ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পুনর্বাসনের জন্য তিনি পাকিস্তান সরকারকে এক লক্ষ ডলার এবং সমপরিমাণ অর্থ চার্চকে দিলেন। তেমন ক্ষতিগ্রস্ত না হলেও নোয়াখালির ক্যাথলিকরা মিশন স্কুলে বেতন দেওয়া বন্ধ করলেন। তাদের ব্যাখ্যা : পোপ আমাদের দেখভালের দায়িত্ব নিয়েছেন।
খ্রিষ্টীয়ান অর্গানাইজেশন যার রিলিফ অ্যান্ড রিহেবিলিটেশন- 'কর' শুরু থেকেই জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার জন্য তিনটি দুর্গত এলাকায় ত্রাণ কাজ শুরু করল, এটা ছিল বাংলাদেশের জন্য একটি বৈপ্লবিক ধারনা। এতোদিন সবাই যার যার ধর্মমতের মানুষের সেবার কথা ভেবে এসেছে। মুসলমান ক্যাথলিন ও সরকারকে বোঝাতে কর (পরে এর নামাকরণ হয় কারিতাস),অনেকটা সময় ব্যয় করতে হয়, তবে শেষ পর্যন্ত বোঝাতে সমর্ম হয় যে, তারা শুধু কেবল সুনির্দিষ্টভাবে আলাদা করে ক্যাথলিকদের জন্য নয়, সমাজের মুসলমান হিন্দু সবার জন্যই ত্রাণ পরিচালণা করছে।
তখন নটর ডেম কলেজে রমজানের ছুটি চলছিল। একদল ছাত্র ছুটির সময় বিশেষ বিশেষ ক্লাস করছিল--তারা ঘূর্ণিঝড় দুর্গত এলাকা সফরের প্রস্তাব দেয়। ফাদার পিশোতো পরবর্তীকালে কলেজের প্রিন্সিপাল, কিভাবে আগ্রহী ছাত্রদের ত্রাণকাজে সম্পৃক্ত করা যায় তা জানতে পুনর্বাসন সচিবের সাথে যোগাযোগ করেন। এর আগে ১৯৬১-এর ঘূর্ণিঝড়ের পর ডেমরায় ত্রাণকাজের জন্য ছাত্রদের দল তিনিই গঠন করেছেন। সরকারের ত্রাণ ও পুনর্বাসন সচিব জানালেন যেহেতু ছাত্ররা সরকারি কর্মকর্তা নয় তাই তাদের দিয়ে সংগৃহীত ও প্রাপ্ত সামগ্রী বিতরণ করানো যাবে না। তিনি পরামর্শ দিলেন তারা নিজেরা ত্রাণ সংগ্রহ করে দুর্গত এলাকায় চলে যেতে পারে।
ফাদার পিশোতো তারপর হেল্প (হার্টল্যান্ড ইমার্জেন্সি লাইফ সেভিং প্রজেক্টে) এর সাথে যোগাযোগ করলেন : কজন আমেরিকান ডাক্তার (সিয়াটো ল্যাবরেটরিতে কর্মরত--পরে এর নাম হয়েছে আইসিডিডিআরবি) ও তাদের স্ত্রীরা আরো কিছু স্থানীয় অধিবাসীদের নিয়ে দুর্গতদের সহায়তার জন্য উদ্যোগী হয়। হাতিয়ায় দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন সেনাকর্মকর্তার সুপারিশে হেল্প কর্মক্ষেত্র হিসেবে মনপুরা দ্বীপ বেছে নেয়। জলোচ্ছ্বাসে তলিয়া যাওয়া সবচেয়ে দুর্গত ও দুর্গম এলাকার নাম মনপুরা। সিয়াটোর একজন ডাক্তার হাতিয়া দ্বীপ থেকে ছোট মোটরবোট ভর্তি খাবার ও কাপড় নিয়ে মনপুরা আসেন, এবং এই দ্বীপের উত্তরাংশের একটি দোতলা প্রাইমারি স্কুল ভবনে অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করেন। তবে তাদের আগেই ঢাকা মেডিকেল কলেজের চতুর্থ বর্ষের চারজন ছাত্র, তাদের মধ্যে দু'জন নটর ডেম কলেজের প্রাক্তন শিক্ষার্থী বেচে যাওয়া মানুষগুলোকে টাইফয়েড ও কলেরার ইনজেকশন দিয়ে যাচ্ছিলেন।
ফাদার পিশোতো ও আমি ছয়জন ছাত্র ও একজন শিক্ষকের একটি দলের সাথে উল্কা ট্রেনে ২৪ নভেম্বর চট্টগ্রাম পৌঁছি। হেল্প তখনকার চট্টগ্রাম শেল অফিসের ব্যবস্থাপক ফজলে হাসান আবেদের (গ্রন্থ রচনার সময় ব্র্যাকের ডিরেক্টর, প্রয়াত স্যার ফজলে হাসান আবেদ) সাথে যোগাযোগ করে তাদের রেস্ট হাউসে আমাদের রাতে কাটানোর ব্যবস্থা করে দিল।
আমাদের চট্টগ্রাম কেন্দ্রের দায়িত্বে ছিলেন লিন ব্রিকলে। ক'বছর পর তিনি ডাক্তার হন। আমরা পৌঁছার তিনদিন আগে থেকেই কাজ শুরু হয়েছিল। হালকা উড়োজাহাজে উপর থেকে ফেলার মতো করে প্লাস্টিকের ব্যাগে খাবার ভরা হলো--ব্যাগে দেওয়া হলো মুড়ি, একটা সেদ্ধ ডিম, এক চাকা গুড়। একসাথে অনেক ব্যাগ চটের বস্তায় ভরা হলো, বস্তাগুলোকেই উপর থেকে ছাড়া হবে।
হাতিয়া কেন্দ্রে আট নয় বছরের একটি বালক, হাতিয়ার উত্তর প্রান্তে তার বাড়ি, ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে সে বেঁচে গেছে বটে, কিন্তু তাকে এতিম করে দিয়ে গেছে। তার হাসিখুশি অবয়ব, জ্ঞান আর উচ্ছাস আমাদের সবার ছিল অশেষ প্রেরণার উৎস। আমার হাতিয়া সফরে বহুবার তার সাথে দেখা হয়েছে, আমরা কী করছি এ নিয়ে তার কৌতুহলের শেষ ছিল না।
পরদিন উপকূলীয় স্টিমারে পনের ঘন্টার ক্লান্তিকর ভ্রমণের পর হাতিয়া দ্বীপে পৌঁছলাম। আমরা থাকলাম আইডব্লিউটিএর টার্মিনালে। এমনিতেই তা লোকারন্য হয়ে আছে। দ্বীপগুলোর মধ্যে এখানে আসাই তুলনামূলকভাবে সহজ বলে সবাই এখানে আসছে। আমাদের দলের ছেলেদের কেউ কেউ সিঁড়ির নিচে মালামাল নিয়ে ঘুমাল। স্টেশন মাষ্টারের অফিস রুমে কংক্রিটের বাঙ্ককেই বলা হলো বেড--যদিও তা মর্গে লাশ রাখার স্ল্যাবেরই চেয়ে বেশি কিছু নয়। পরদিন সকালে পদার্থ বিজ্ঞানের শিক্ষক মিত্র ও আমি ঢাকায় আমেরিকান স্কুলের বব মার্ফি স্পিডবোটে মনপুরার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম, অন্যরা দেশি নৌকায়। ফাদার পিশোতো কোনোভাবে সেনাবাহিনীর বোটে ঠাই করে নিতে পেরেছেন।
ভাটার সময় বোট চালানোর ঝক্কি টের পেতে আমাদের বেশি সময় লাগল না। আমরা বারবার বালির স্তরে আটকা পড়ে যাচ্ছি। সেখান থেকে আবার গভীর প্রণালী খুঁজে বের করে নিতে হচ্ছে। মনপুরা উপকূলের দৃশ্য ভয়ঙ্কর। চারদিকে ফুলে উঠা মৃত মানুষের দেহ এবং মৃত গবাদি পশু ভাসছে এখানে ওখানে। ভাটার টানে কোনো কোনো লাশ বালিতে আটকা পড়ছে। আমরা উত্তর ক্যাম্পে পৌঁছে দেখি শত শত মানুষ খাবার বিতরণের অপেক্ষায় ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছে--পাকিস্তান এয়ার ফোর্সের কার্গো প্লেন থেকে চাল, কম্বল ও কাপড়ের বস্তা ফেলা হচ্ছে। একটি জার্মান হেলিকপ্টারও খাবার দাবার ও প্রয়োজনীয় দ্রব্য নিক্ষেপ করছে।
মনপুরা ৪৮ বর্গমাইলের একটি এলাকা, তাতে মূল ভূখন্ডের পাশাপাশি দুটি চর রয়েছে-- দক্ষিণে ফৈজুদ্দিন ছোট চর এবং বড় দ্বীপ সাকুচিয়া-- গভীর সমুদ্র প্রণালী মূল ভূখন্ড থেকে একে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। দুটো দ্বীপই শক্তিশালী মেঘনা নদীর মুখে--মেঘনা-পদ্মা-যমুনা নতুন ব্রহ্মপুত্র মিলে আবারও মেঘনা নাম নিয়ে প্রবাহিত। গঙ্গা ব্রহ্মপুত্র মোহনায় লক্ষ কিউসেক পানি প্রবাহিত হয়--অর্থাৎ প্রতি সেকেন্ডে ৭ লক্ষ কিউবিক ফিট পানি। আমাজন, নাইজার এবং ইয়াংজির পরে চতুর্থ অবস্থানে এই নদী। বদ্বীপের দ্বীপগুলোর মধ্যে সবচেয়ে পুরোনো মনপুরা এবং সন্দ্বীপ। ১৬৬৪ সালে পর্তুগীজরা যখন মনপুরা অধিকার করে নেয়, ভোলা এবং হাতিয়ার কোনো অস্তিত্ব ছিল না। তখন এই দ্বীপকে বলা হতো সাগর দ্বীপ। কিন্তু মোগল সাম্রাজ্যের পূর্বাঞ্চলীয় শাসক শায়েস্তা খান পর্তুগিজদের হঠানোর জন্য মনা গাজীকে পাঠান। তিনি সাফল্যের সাথে তার মিশন শেষ করেন। সাগরদ্বীপের নাম বদলে রাখা হয় মনপুরা। পর্তুগিজরা ছেড়ে যাবার সময় তাদের কিছু কুকুর রেখে যায়, এদের বংশধরই বিখ্যাত মনপুরার কুকুর। কিন্তু জলোচ্ছ্বাসে প্রায় সবই ভেসে গেছে। মনপুরার ষোলটি ওয়ার্ড। ইউনিয়ন কাউন্সিলের ওয়ার্ড মেম্বারদের জীবিতদের তালিকা তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয়। জলোচ্ছ্বাসের আগে অধিবাসী ছিল ৩০ হাজার, আর এখন ওয়ার্ড মেম্বারদের তালিকায় পাওয়া গেল প্রায় ১৩ হাজার। জলোচ্ছ্বাসে অধিকাংশই শিশু, বৃদ্ধ এবং মহিলা সবচেয়ে বেশি ভেসে গেছে। তারপরও যারা বেঁচে আছে তারা গাছের ডালে আটকে বেঁচেছে। আমরা মানুষের বেঁচে থাকার বিস্মযকর এক খবর পেলাম। নর্থ ক্যাম্পে এক দম্পতি যারা হাতিয়া থেকে ঘরের চালে দশ মাইল ভেসে আসার পর মনপুরাতে পৌঁছেছে। আর ৮০ ফুট লম্বা এক জাহাজ কুতুবদিয়া নিয়ন্ত্রন হারিয়ে মনপুরার পশ্চিম তীরে স্থলভাগের ১০০ মিটার ভেতরে ছিটকে পড়ে এসে পড়েছে, জাহাজে ১০ জন মানুষও ছিল।
উত্তর মনপুরা প্রাইমারি স্কুলের পাকা ভবনে আমরা ক্যাম্প বসালাম। জলোচ্ছ্বাস দরজা জানালা সব নিয়ে গেলেও ভবনটাকে তুলে নিতে পারেনি, নিচতলার সিমেন্টবালু সরে গেছে, তবে উপরতলাটা ত্রাণ সামগ্রীর গুদাম হিসেবে ভালোই কাজে লাগল। স্কুলের সামনে তাবু খাটিয়ে ডাক্তারদের নিয়ে রাত কাটানোর আয়োজন করলাম।
সেই ভয়ঙ্কর রাতের কাহিনী শুনতে থাকি। অনেকে বলেছে তারা দক্ষিণ দিক থেকে একটি উঁচু পানির দেয়াল আসতে দেখেছে, কেউ বলেছে পানির উচ্চতা ধীরে ধীরে বেড়েছে, এক হাতে গাছের ডাল আকড়ে অন্য হাতে একটা বা দুটো সন্তান ধরে রাখার চেষ্টা করেছে কেউ কেউ। অনেকেই সে সুযোগ পায়নি। একটি পরিবারের ১২ জন শিশুকে অথৈ সাগরে ঠেলে দিয়েছে ঢেউ। মূল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে উপড়ে পড়া একটি গাছ একটি পরিবারের সবার মৃত্যুর সাক্ষী হয়ে আছে। আশাপ্রদ গল্পও শুনেছি, নব্বই বছরের বুড়োর অলৌকিক বেঁচে থাকার পাশাপাশি একটি গাছের গুড়িতে আশ্রয় নিয়ে সেখানেই সন্তান প্রসব করা নারী, ছয় থেকে আট ঘন্টার জলোচ্ছ্বাসে কাটিয়ে বেঁচে গেছে।
পরে ফাদার টিম ছিন্নমূল মানুষের সেবায় পুরো বছর কাটিয়ে দিলেন মনপুরায়, সে জন্য এই মনপুরা ফাদার টিমের মনপুরা, কিংবা তিনি এ মনপুরার ফাদার টিম। সেই জলোচ্ছাসে মৃত্যুর সংখ্যা সম্ভবত পাচ লক্ষ।
বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের মানুষ
বাংলাদেশে আমার অবস্থানকালে এখানকার মানুষের মধ্যে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার অনুপস্থিতির খুব প্রশংসা করেছি। আমার প্রতি কারো কোনো বিরূপ পূর্ব ধারনাও ছিল না। যখন আমি প্রথম এলাম, দিনের বেলা যখন আমাদের সাদা আলখেল্লা পরে বেরোতাম, ছোট ছেলে মেয়েরা আমাদের দেখলে সাধারণত মেম সাহেব কিংবা লাল বান্দর রেড মাঙ্কি বলে চেচিয়ে উঠত। বড়রা যখন শুনতেন ছেলেমেয়েদের বকাঝকাও করতেন। ছেলে মেয়েরা যা করতো পুরোটা মজা করার জন্য। ধর্মীয় কোনো অবমাননার জন্য তারা অবশ্যই তা করত না। মনে করা হয়ে থাকে সকল মানুষ ভাই ভাই মুসলমানদের এই বিশ্বাসটি কার্যত শুধু মুসলমানদের বেলাতেই প্রযোজ্য হয়ে থাকে। কিন্তু আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি এই ভ্রাতৃত্ব যে কেবল বন্ধুদের কাছ থেকে পেয়েছি এমন নয়, একেবারে অচেনা মানুষের কাছ থেকেও পেয়েছি। সাদা বিদেশি খ্রিষ্টান হিসেবে আমাকে সবসময় অনেকটা বহিরাগতের মতোই থাকার কথা। কিন্তু অনেক দিক থেকেই আমি নিজদেশের চেয়েও বেশি আপন হয়ে থাকতে পেরেছি। ভিন্ন ধর্মের যাজক হিসেবে বাংলাদেশ আমাকে অনেক আপন করেই গ্রহণ করেছিল। আমার নিজ দেশ আমেরিকাও প্রথম দিকে আমাকে এভাবে নেয়নি। সৌভাগ্যবশত আধুনিক যোগাযোগ সবত্রই পূর্ব ধারনা ও অপছন্দের সব বাধা ভেঙ্গে দিচ্ছে। যে দিন সব জায়গাতেই বর্ণ, জাতি, ধর্ম ও লিঙ্গ পরিচয় বৈষম্যের কারণ হবে না, আমি খুব আনন্দ পাব।
বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমার কাজ ও যোগাযোগের কারণে বাংলার বিশিষ্ট মানুষের সাথে আমার দেখা সাক্ষাৎ হয়েছে, তারা জাতীয় রাজনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন। সবার আগে ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দি, তিনি নাচ উপভোগ করতেন বলে আমেরিকান পার্টিগুলোতে আসতেন, মহিলাদের অভিযোগ ছিল তিনি নাচে দক্ষ ছিলেন না, অনেক সময় পা মাড়িয়ে দিতেন। নটর ডেম কলেজে এলে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের সাথে দেখা হয়েছে, তার ছেলে তখন এ কলেজের ছাত্র, পাঞ্জাবি গভর্নর আজম খানের সাথে দেখা হয়েছে, কিছু বাংলা শব্দ লিখে তিনি বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছেন। তার শব্দগুলোর মধ্যে ছিল চাষী ভাই জেলে ভাই। তার বিপরীত চরিত্রের জেনারেল আইয়ুব খান দীর্ঘ ১২ বছর শাসন করেছে, প্রথমে সামরিক আইন প্রধান ও পরে প্রেসিডেন্ট হিসেবে, তিনি একটি বাংলা শব্দও শেখেননি। তার সাথে আমার দুবার দেখা হয়েছে, ১৯৬৫ সালে গভর্নর'স হাউসে এখনকার বঙ্গভবন এবং লাহোরে বিজ্ঞান সম্মেলনে। আমরা দু'জন একই শাররিকভাবে উচ্চতার মানুষ হলেও তিনি কখনো আমার দিকে তাকাননি, তবে আমাকে ডিঙ্গিয়েই ডানে ও বায়ে তাকিয়েছেন। এই জেনারেল বাঙ্গালিদের যেমন মুগ্ধ করেছে, একই ভাবে আমাকেও। যে সব অনুষ্ঠানে জিয়াউর রহমানের সাথে আমার সাক্ষাৎ হয়েছে দক্ষতা নিয়ে একটি নৈর্ব্যক্তিক অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছেন। তবে শেখ মুজিবুর রহমান ও জেনারেল এইচ এম এরশাদ অনেক খোলামেলা এবং আন্তরিক, বিশেষ করে শেখ সাহেব।
দর্শনার্থীরা আমাকে বরাবর দুটো প্রশ্ন করেন : ১৯৫২ সালে আপনি যখন পূর্ব পাকিস্তানে এসেছিলেন তখনকার দেশ আর এখনকার বাংলাদেশের (ফাদার টিমের স্মৃতিকথা ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত। পান্ডুলিপি হয়ত আরো আগে প্রণীত) মধ্যে কিভাবে তুলনা করবেন? আর দ্বিতীয় প্রশ্নটি হচ্ছে আপনি ভবিষ্যতের বাংলাদেশকে কীভাবে দেখছেন?
প্রশ্ন দুটোর বিস্তৃত উত্তর এড়াতে গিয়ে আরো কিছু প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছি। পুরোনো দিনের স্মৃতিতে আসে অনেক কম মানুষ-- পোশাকে দৈন্যদশা, রাস্তায় বুড়োমানুষের দেখা পাওয়া দুর্লভ, শিশুরা শুকনো, কেউ কেউ হাড় জিরজিরে--তুলনামূলকভাবে রাস্তায় অনেক বেশি ভিক্ষুক তারপরও এখন বহুগুণ বেশি বস্তিবাসী, তাদের অবস্থা তখনকার বস্তিবাসীর চেয়ে খারাপ। এখন সারা দেশে ভোগ্যপণ্যের ছড়াছড়ি: বিলাসিতার দ্রব্য এবং সাধারণ প্রয়োজনমোটর সাইকেল, রেডিও ক্যামেরা, টিভি ইত্যাদি।
তারপরও আমার অবস্থানকালে বাংলাদেশে শিক্ষার হার তেমন বাড়েনি, তবে জনসচেতনতা অনেক বেড়েছে। সে আমলে কোথাও বেরোলে পানি খাবার সময় জিজ্ঞেস করতে হতো পানিটা কোথাকার, পরে আর জিজ্ঞেস করতে হয়নি কারণ আমি নিশ্চিত পানিটা টিউবওয়েলের। আমি যখন প্রথম এলাম মানুষ ইনজেকশনকে ভীষণ ভয় পেতো আর এখন চিকিৎসা সেবার অংশ হিসেবে ইনজেকশন না পেলে প্রতারিত বোধ করে। আগে কেবল বাজারে বিক্রি করার জন্য সবজি উৎপন্ন করত, এখন নিজেরা খাবার জন্যই হরেক রকম শাক-সবজি চাষ করে থাকে। চরম দরিদ্র থেকে বাংলাদেশের মানুষের মোটামুটিভাবে বেরিয়ে আসার অন্যতম সাক্ষী ফাদার টিম। এই খ্রিষ্টিয় ফাদার জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাংলাদেশের মানুষকে ভালোবেসেছিলেন।