গগনেন্দ্রনাথের প্রহসন আর ক্যারিকেচার
১৯১৫ সালে প্রতিষ্ঠিত বিচিত্রা ক্লাবের অন্যতম উদ্যোক্তা ও সংগঠক ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাইপো গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর। শুধু তা-ই নয়, অভিনেতা ও মঞ্চ ডিজাইনার হিসেবেও ক্লাবের থিয়েটার এবং মঞ্চের কর্মকাণ্ডেও তার সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল। সেইসাথে তিনি একজন চিত্রশিল্পীও ছিলেন। তার আঁকাআঁকির শুরু ব্যঙ্গচিত্র দিয়ে। সমসাময়িক বাঙালি সমাজই উঠে এসেছে গগনেন্দ্রনাথের ক্যারিক্যাচারগুলোতে। এই ব্যঙ্গচিত্রগুলো ছিল মূলত সে সময়ের বাঙালি সমাজ সম্পর্কে তার নিজস্ব ধারণার বহিঃপ্রকাশ।
গগনেন্দ্রনাথের ব্যঙ্গচিত্রগুলোর সাথে সবচেয়ে বেশি খাপ খায় প্রহসন নাটকগুলো। তেমনই একটা নাটক জ্যোতিন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'এমন কর্ম আর করব না' (পরে এর নাম বদলে হয়ে যায় 'অলীক বাবু')। নাটকটি সফলভাবে মঞ্চস্থ হয়েছিল। উনিশ শতকের গোড়ার দিকে গিরিশ ঘোষ লিখিত ও পরিচালিত (১৮৪৪-১৯১১) নাটকগুলো গগনেন্দ্রনাথকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। সমসাময়িক ভারতীয় থিয়েটারে গিরিশ ঘোষের অবদানের ব্যাপারে উৎপল দত্ত অত্যন্ত উচ্চধারণা পোষণ করতেন। ব্যঙ্গচিত্রের মাধ্যমে গগনেন্দ্রনাথের সমালোচনার ধরন ছিল অন্যান্য ইউরোপীয় ভাবধারার হিন্দু সংস্কারকদের থেকে একেবারেই আলাদা।
গগনেন্দ্রনাথের ব্যঙ্গচিত্র সম্পর্কে বিবেকানন্দের একটি উক্তি খুব মানানসই। যেসব উচ্চশিক্ষিত বাঙালি বাবুর একমাত্র লক্ষ্যই ছিল ইংরেজ সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে একটা সরকারি চাকরি জুটিয়ে নেওয়া, তারা ছিলেন বিবেকানন্দের চোখের বিষ। তাদের সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন: 'নিজেদের তোমরা উচ্চশিক্ষিত মনে করো। কী সব আজেবাজে জিনিস শিখেছ তোমরা? অন্যের চিন্তাভাবনা বিদেশি ভাষায় মুখস্থ করে, সেসব দিয়ে মগজ ভরিয়ে রেখে এবং কয়েকটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি নিয়েই নিজেকে শিক্ষিত ভেবে ফেলছ? ধিক্কার তোমাদের! এই কি শিক্ষা? তোমাদের শিক্ষার লক্ষ্য কী? হয় কেরানি, নয়তো দুর্নীতিবাজ উকিল, কিংবা বড়জোর ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হবে। এই সবই তো কেরানিগিরিরই অন্য রূপ।'
গগনেন্দ্রনাথ তার ব্যঙ্গচিত্র সংকলন 'বিরূপ বজ্র'-র ভূমিকায় বলেছেন, 'বিকৃতি যখন লাগামহীনভাবে বেড়ে যায়, অন্ধ অভ্যাসের দ্বারা লালিত হয়, তখন এসব বিকৃতি যে কুৎসিত, কুরুচিপূর্ণ এবং অস্বাভাবিক তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া শিল্পীর কর্তব্য হয়ে পড়ে।'
ঘনিষ্ঠজন হওয়া সত্ত্বেও গগনেন্দ্রনাথের পেন্সিল থেকে রেহাই পাননি বিশিষ্ট বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু। নিজেকে নিয়ে আঁকা কার্টুনটি দেখে তিনি মন্তব্য করেছিলেন, গগনেন্দ্রনাথের কার্টুনগুলো স্রেফ ব্যঙ্গচিত্র নয়, শিল্পীর সংক্ষুব্ধ আত্মার প্রতিচ্ছবি।
'বিরূপ বজ্র' প্রকাশিত হওয়ার পর 'ভারতী' পত্রিকায় লেখা হয়:
'বিশ্ববিদ্যালয়ের সিংহদ্বার খোলা; দলে-দলে বলিষ্ঠ ও স্বাস্থ্যসুন্দর যুবক ছাত্র ভিতরে ঢুকিতেছে—তাহারাই বঙ্গের ভবিষ্যৎ আশা ভরসা। ভিতরে বিদ্যার বিরাট কারখানা—উপরে কর্তৃপক্ষ পাহারায় নিযুক্ত। চিমনি দিয়া ধূম বাহির হইতেছে। প্রকাণ্ড গ্রন্থ-যন্ত্র পুরাদমে চলিতেছে এবং তাহারই কঠোর চাপে আষ্টেপৃষ্ঠে থেৎলাইয়া বাঙ্গালার ভবিষ্যৎ শিবরাত্রির সলতেরা যখন বাহির হইয়া আসিতেছে, তখন তাহাদের আর সেই জোরালো গড়ন ও সুশ্রী চেহারা নাই; তাহাদের কাহারও দেহে ধুতি-চাদর—বোধহয় কেরানি; কাহারও পরনে চোগা-চাপকান-সামলা—নিশ্চয়ই উকিল; কেহ হাত-পা ছড়াইয়া পপাত ধরণীতলে—সম্ভবত পঞ্চত্বপ্রাপ্ত।'
গগনেন্দ্রনাথের আগে ব্যঙ্গচিত্রের অবস্থা কী ছিল?
তার আগেই কালীঘাট শিল্পীদের হাত ধরে সামাজিক ব্যঙ্গচিত্র পরিচিত হয়ে উঠেছিল। গোড়ার দিকে তাদের আঁকাআঁকি ধর্মীয় বিষয়বস্তুতে সীমাবদ্ধ থাকলেও, পরবর্তীতে তৎকালীন সমাজের সাধারণ মানুষের জীবনাচার উঠে আসতে থাকে তাদের চিত্রে। কিন্তু তাদের চিত্রে 'ব্যঙ্গ' জিনিসটা ঠিকঠাক প্রাণ পেত না।
গগনেন্দ্র ও সমসাময়িক অন্যান্য বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা সম্ভবত জার্মানির সাপ্তাহিক ব্যঙ্গ ম্যাগাজিন 'SIMPLICISSIMUS'-এর সাথে পরিচিত ছিলেন। জার্নালটি ১৮৯৬ থেকে ১৯২৬ পর্যন্ত নিয়মিত প্রকাশ হতো। নানা ধরনের সিরিয়াস ব্যঙ্গচিত্র নিয়মিত ছাপা হতো এ পত্রিকায়। সাংবাদিকতার ইতিহাসে সবচেয়ে প্রভাবশালী সচিত্র ম্যাগাজিনগুলোর একটি হিসেবে সম্মান দেওয়া হয় একে।
গগনেন্দ্রনাথের আঁকা অনেকটাই রুডলফ উইল্কের মতো। উইল্কের ছবিগুলো ১৯০০ থেকে ১৯০৮ সালের মধ্যে প্রকাশিত হয়। জর্জ গ্রোজের চিত্রগুলো ১৯১৬ সালের পর প্রকাশিত হয়। দুজনে সমসাময়িক শিল্পী হলেও, তার আঁকাআঁকির সাথে গগনবাবু এতটা পরিচিত ছিলেন না। গগনেন্দ্রের তুলনা দেওয়া যায় ১৯ শতকের রাজনৈতিক ক্যারিকেচারশিল্পীদের অগ্রদূত ফরাসি চিত্রশিল্পী ডমিয়ের-এর সাথে। দুজনই প্রায় একই কায়দায় ছবি আঁকতেন।
'বিরূপ বজ্র' ও 'অদ্ভুত লোক' এই দুটো ক্যারিকেচার সংকলনই ১৯১৭ সালে প্রকাশিত হয়। এ দুটো গগনেন্দ্রের প্রথম দিকের ক্যারিকেচার। ভালো করে লক্ষ্য করলে এই সংকলন দুটোতে গগনেন্দ্রের পরিশীলিত স্টাইল দেখা যাবে। বোঝা যাবে এই সংকলন দুটো গগনেন্দ্রের চৈতন্য সিরিজের সাথে সম্পর্কিত। চৈতন্য সিরিজের বেশিরভাগ ছবিই ১৯১৪ সালের মধ্যে আঁকা হয়ে গিয়েছিল। কাগজের ওপর পেন্সিলের পাতলা সরু টান গগগেন্দ্রের সংবেদনশীল মনের পরিচায়ক। সেইসাথে বড় কালো রঙের ছোপগুলো এ-ও জানান দেয় যে, ছবিগুলোকে তিনি অবারি বিয়ার্ডস্লি-র বিখ্যাত ছবিগুলোর মতো করে আঁকতে চেয়েছেন।
'বাবু' শব্দটি দিয়ে যে শুধু ব্রিটিশ প্রশাসকদের সংজ্ঞানুসারে মধ্যবিত্ত বাঙালিদের বোঝায়, ব্যাপারটি এমন নয়। কিংবা এ শব্দ দিয়ে স্রেফ পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজকেও বোঝায় না। গগনেন্দ্রনাথের ক্যারিকেচারগুলোতে 'বাবু' সমাজের সমালোচনার মাধ্যমে মধ্যবিত্ত সমাজের আত্মসমালোচনার চেষ্টাও করা হয়েছে। বাবুদের 'গোরা' বা 'সাদা সাহেব' সাজার প্রচেষ্টাকে গগনেন্দ্রনাথ বেশ কয়েকটি সরস ছবি এঁকে ব্যঙ্গ করেছেন।
বাঙালি ভদ্রলোক
এ ছবিতে বর্ধমানের রাজাকে চিরাচরিত ধনী বাঙালির রূপে এঁকেছেন গগনেন্দ্র। একটি বেদির ওপর দাঁড়ানো রাজার স্বাভাবিক ভুঁড়িকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে যে দেখতে হাস্যকর লাগে। সাহায্যের আশায় অভাবী মানুষের হাত বাড়ানো তার সামনে। সেই হাতগুলোকে একটা লাঠি দিয়ে সরিয়ে দিচ্ছেন তিনি। পেছনে তার সম্পদের স্তূপ—রাশি রাশি মুদ্রা। সেসব টাকাপয়সা খরচ হয় অপ্রয়োজনীয় উৎসব, বারবনিতা (নারীর হাত দিয়ে বোঝানো হয়েছে) এবং চাটুকারদের (উড়ন্ত শকুনের দল) পেছনে।
পিয়ারের মিঞা
এ ছবিতে গগনেন্দ্র এঁকেছেন এক স্বামীর মাতলামি ও স্ত্রীর সাথে তার দুর্ব্যবহার। স্ত্রী এখনও তাকে 'পিয়ারে মিঞা' বা 'প্রিয় স্বামী' বলে ডাকে। এ ছবিতে গগনেন্দ্র অতি যত্নের সাথে লাল রং ব্যবহার করে স্ত্রীর কপাল কেটে গিয়ে রক্ত বেরোনোর ছবি এঁকেছেন। ছবিটির মাধ্যমে তিনি শুধু নারীদের প্রতি মধ্যবিত্ত বাবু সমাজের মানসিকতাই ফুটিয়ে তোলেননি, নারীদের দুরবস্থার প্রতি নিজের সমবেদনারও প্রকাশ ঘটিয়েছেন।
বিয়ে
তীব্র সামাজিক সংবেদনশীলতা নিয়ে বিয়ের প্রতি বাঙালি দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণের ওপর একটি জটিল ব্যঙ্গচিত্র এঁকেছিলেন গগনেন্দ্রনাথ। এ ছবিতে দেখা যায় বর এক রোমান্টিক লোক—তার হাতে 'রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট'। অন্যদিকে তার বাবা মৃত পুত্রবধূর সৎকারের আয়োজন করছে। তার কফিনের কাপড়ের ওপর আঁকা প্রজাপতিটি বিয়ের দেবতা প্রজাপতির প্রতিনিধিত্ব করছে।
দ্য ড্যান্স বা বল রুম ড্যান্স-এর (Waltzing Mahila নামেও পরিচিত) অনেকগুলো সংস্করণ রয়েছে। এগুলোর মধ্যে বোঁচা নাকওয়ালা চাপা রঙের পুরুষের ছবিটি বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। গায়ের রং ও বোঁচা নাক তাকে ভারতীয় বৈশিষ্ট্য দিয়েছে। লোকটির পরনে ঝুলওয়ালা কোট। এটি তার পাশ্চাত্যকরণের চিহ্ন। তার সঙ্গিনীর পরনের কাপড়টি শাড়ি ও স্কার্টের সংমিশ্রণ। সঙ্গীর দিকে সে প্রশংসার দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তাদের এই নাচ দুই সংস্কৃতির মিলন ঘটানোর ব্যর্থ চেষ্টার প্রতীক। ছবিটিকে 'কালার স্ক্রিম' নামেও ডাকা হয়। 'কালার' এখানে বর্ণবাদ কুসংস্কারের প্রতিনিধিত্ব করছে।
এই ক্যারিকেচারগুলোতে চিত্রসংবলিত রূপক ব্যবহার করা হয়েছে। তাই ব্যাখ্যামূলক দৃষ্টিকোণ থেকে ক্যারিকেচারগুলো অত্যন্ত আকর্ষণীয়। গগনেন্দ্রনাথ পাশ্চাত্য নাচের এই অন্তরঙ্গ দৃশ্যটি দক্ষতার সাথে এঁকেছেন।
কিছু কিছু নারীবাদীর ভাষ্যে এ ছবিতে বাঙালি রমণীর ঘরের চারদেয়াল ডিঙিয়ে বাইরের পৃথিবীর সাথে পরিচিত হওয়া চিত্রিত হয়েছে। ছবির মহিলার পরনের পোশাকটি বাঙালি নারীর বন্ধনমুক্তির প্রতীক। পোশাকটি রবীন্দ্রনাথের বড় ভাই সত্যেন্দ্রনাথের স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর অবদানের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। অন্দরমহলের খাঁচা থেকে বাইরে বেরিয়ে আসা প্রথম নারীদের একজন ছিলেন তিনি।
গগনেন্দ্রনাথ ১৯২১ সালে প্রকাশ করেন 'রিফর্ম স্ক্রিমস' (নব হুল্লোড়)। এই ব্যঙ্গচিত্র সংকলন ছিল তার জাতীয়তাবাদের বহিঃপ্রকাশ। সংকলনটি তখনকার স্বাধীনতা সংগ্রামের সচিত্র দলিল। ১৯১৯ থেকে ১৯২১ সাল পর্যন্ত সংঘটিত যেসব রাজনৈতিক ঘটনা গগনেন্দ্র চাক্ষুষ করেছিলেন, সেগুলোই ছবি আকারে স্থান পেয়েছে 'নব হুল্লোড়ে'।
বাংলার রাষ্ট্রীয় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া
১৯১৯ সালে অ্যাক্ট অফ রিফর্ম বাস্তবায়ন করার পরপরই বাংলার আইন পরিষদ ভেঙে দেওয়া হয়। এই ঘটনাটি চিত্রবন্দি করেন গগনেন্দ্রনাথ। ছবিটিতে দেখা যায় পশ্চিমা কায়দায় রাষ্ট্রের সৎকার হচ্ছে। ছবিতে মৃতদেহ দেখানো না হলেও, ভারতীয় ও ব্রিটিশ উচ্চপদস্থদের দেখা গেছে শোকের পোশাক পরিহিত অবস্থায়।
ভুয়া দেশপ্রেম ও স্বয়ংক্রিয় বক্তৃতা যন্ত্র
প্রজ্ঞার অভাব ও ধীশক্তি কাজে না লাগানোর জন্যে ১৯১৭ সালে 'বিরূপ বজ্রে' বাংলার জমিদার, মহারাজা ও কাউন্সিলরদের ব্যঙ্গচিত্রে বিদ্ধ করেছিলেন গগনেন্দ্রনাথ। জনসভায় স্বয়ংক্রিয় মেশিনের মতো অন্যের লিখে দেওয়া বক্তৃতা পড়ে যেতেন তারা।
আমার দেশপ্রেম আমার সমান
মিথ্যে দেশপ্রেমকে ব্যঙ্গ করে আঁকা কার্টুন 'মাই লাভ অফ মাই কান্ট্রি ইজ অ্যাজ বিগ অ্যাজ আই অ্যাম'। এ কার্টুনে গগনেন্দ্র নিজেকে এঁকেছেন এক কোনায় বসে থাকা সাধারণ বাঙালি শ্রোতা হিসেবে। ছবিতে তার পরনে চিরাচরিত দেশি পোশাক, হাতে হুঁকা। ছবির বেশিরভাগ জায়গা দখল করে রাখা পেটমোটা মানুষটির বড় বড় বোলচাল শুনে ভারি আমোদ পাচ্ছে কার্টুনের গগনেন্দ্র। পশ্চিমা পোশাক পরা পেটমোটা বক্তাটি বাঁ হাতে চুরুট নিয়ে কর্তৃত্বপরায়ণ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। ক্যারিকেচারটি বর্ধমানের মহারাজা বিজয়চাঁদের।
রাসায়নিক চিৎকার
'কেমিক্যাল স্ক্রিম'-এ দেখা যায়, বিখ্যাত রসায়ন অধ্যাপক পি. সি. রায় 'ভারতীয় কালি' দিয়ে যে স্বদেশপ্রেম বোঝানো হয় তা মুছে ফেলার চেষ্টা করছেন। স্বদেশী আন্দোলনের সময় ভারতীয় বিজ্ঞানীরা যেসব নতুন নতুন আবিষ্কার করেছিলেন, সেগুলোকে খোঁচা মেরে আঁকা হয়েছিল ছবিটা। কেননা সিংহভাগ আবিষ্কারই ব্যর্থ হয়েছিল—ওসবের সাহায্যে দেশি জিনিস উৎপাদন করা সম্ভব হয়নি।
রাজনৈতিক চিৎকার
কবির সর্বশেষ উড়ান, প্রশ্ন: এটি সহযোগিতা নাকি অসহযোগ?
গগনেন্দ্রনাথ তাঁর কাকা রবীন্দ্রনাথকেও নিস্তার দেননি। বাংলা পত্র-পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের ব্যঙ্গচিত্র খুব বেশি চোখে পড়ে না। ধারণা করা হয়, ১৯২১ সালের ১৬ এপ্রিল বিশ্বকবির প্রথম বিমানে চড়া উপলক্ষে গগনেন্দ্রনাথই প্রথম তাকে কার্টুনে আঁকেন। এ ছবিতে দেখা যায় রবীন্দ্রনাথ ইজিচেয়ারে বসে আকাশে উড়ে যাচ্ছেন, তার ডান হাতে একতারা। তার রিডিং গ্লাস (প্যান্সনেজ চশমা) ও খাতা-পেন্সিল সব শূন্যে উড়ছে—তিনি সেসবের দিকে চেয়ে আছেন দুচোখ ভরা বিস্ময় নিয়ে। 'স্বপ্নে উড়ান'—অর্থাৎ আকাশে উড়ে বেড়ানোর ধারণাটি গগনেন্দ্র নিয়েছেন দীনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা 'স্বপ্ন প্রয়াণ' থেকে।
গগনেন্দ্রের আঁকা অন্ধকার আকাশের কমপক্ষে দুটো ছবি আছে। কোনও ছবিতেই তারিখ দেওয়া নেই। একটায় আকাশভর্তি অজস্র তারা আর অর্ধচন্দ্র। অন্যটিতে আকাশ সাদা মেঘে ঢাকা।
রবীন্দ্রনাথ ও মহাত্মা গান্ধীর মধ্যে আদান-প্রদানকৃত চিঠি থেকে জানা গেছে, অসহযোগ আন্দোলনের ব্যাপারে গান্ধীর সঙ্গে একমত ছিলেন না বিশ্বকবি। এমনকি মহাত্মা গান্ধী সশরীরে দেখা করেও রবীন্দ্রনাথের সক্রিয় সমর্থন আদায় করতে পারেননি। এ কারণেই গগনেন্দ্রনাথ তাঁর ক্যারিকেচারের শিরোনামে প্রশ্ন আকারে একটি অতিরিক্ত বাক্যাংশ জুড়ে দেন: 'এটি সহযোগিতা নাকি অসহযোগ?' বিশ্বকবির বিমানযোগে এই লন্ডন সফরের মূল উদ্দেশ্য ছিল শান্তিনিকেতনে আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য তহবিল সংগ্রহ করা। তাই 'অসহযোগ আন্দোলনে' গান্ধীকে অসহযোগিতা করে ব্রিটিশ শাসনকে সহযোগিতা করেন তিনি। পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের জবাবে (১৯১৯) ব্রিটিশ শাসকদের দেওয়া নাইটহুড উপাধি ফিরিয়ে দেওয়ার পরই এই বিভ্রান্তিকর কাজটি করেন রবীন্দ্রনাথ। পাঞ্জাবের মর্মান্তিক এ ঘটনার কারণে গগনেন্দ্রনাথ যে অন্তর্দাহে পুড়ছিলেন তা তিনি চিত্রায়িত করেন 'Peace Reigns in the Punjab' নামক ব্যঙ্গচিত্রে।
বিশ শতকের প্রথম দুই দশকে বাংলায় প্রধানত দুই ঘরানার ছবি আঁকা হতো। একটি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার চাপিয়ে দেওয়া অ্যাকাডেমিক ঘরানা। অন্যটি এর প্রতিবাদে গড়ে ওঠা ঐতিহ্যগত ভারতীয় আত্মপরিচয়ের সন্ধান। একে বলা হয় নব্য-বঙ্গীয় (বেঙ্গল স্কুল) ঘরানা। কিন্তু গগনেন্দ্রনাথের ছবি ছিল বেঙ্গল স্কুল ঘরানারও বাইরের। গগনেন্দ্রনাথই প্রথম শিল্পী যিনি একাধারে জাপানি ঐতিহ্য ও পাশ্চাত্য আধুনিকতার উদ্ভাবনকে বাংলার ঐতিহ্যগত রূপরীতির সঙ্গে মিলিয়ে চিত্রকলায় নতুন উজ্জীবন এনেছিলেন। বাংলার আধুনিকতার অন্বেষণকে তিনি আন্তর্জাতিকতায় অভিষিক্ত করেছিলেন। ভারতের চিত্রকলার আধুনিকতায় এটিই তাঁর সবচেয়ে বড় অবদান।
গগনেন্দ্রনাথের তার ব্যঙ্গচিত্রের অনেকগুলোই লিথোগ্রাফ হিসেবে এঁকেছিলেন। তার কার্টুনগুলো লিথোগ্রাফি প্রেসে ছেপেছিলেন একজন মুসলিম কারিগর। গগনেন্দ্রনাথের চিত্র সম্পর্কে ভালো করে জানতে হলে তিনি নিজের ছবিগুলোকে কীভাবে লিথো পাথরে স্থানান্তর করেছিলেন, এগুলোকে কীভাবে সুন্দর চিত্রকলায় পরিণত করা হয়েছিল এবং লিথোগ্রাফে রঙের ভূমিকা কী—এই ব্যাপারগুলো জানা জরুরি।
Reference
1) Dr. Sukumar Sen, A History of Bengali Literature, Sahitya Akademi, New Delhi, 1992.
2) Quoted in Mulk Raj Anand, Gaganendranath Tagore's Realm of the Absurd, JISOA, Birth Centenary Number of Gaganendranath Tagore, Pulin Bihari Sen (ed.), 1972.
3) SIMIPLICISSIMUS, 108 Satirical Drawings from the famous German Weekly, Text by Stanley Appelbaum, New York, 1975.
4) Honore Daumier, 240 Lithographsi, Introductionby Wilhelm Waltmann,Abbey Art Series, London (undated).
5) R.A. Walker, The Best of Beardsley, London (undated).
6) For the description of babu, see NAARI (Magazine), Tilotama Thoru (ed.), Ladies Study Group, Calcutta, 1990.
7) For adaptation of a suitable dress for an emancipated Bengali woman and the role played by Jnanadanandini Devi, see NAARI, ibid.
8) O.C. Gangoly, The Humorous Art o Gaganendranath Tagore, Calcutta, (undated).
9) Sant Nihal Singh, An Evening with Rabindranath Tagore, The Modern Review, July, 1921.
10) Krishna Dutta and Andrew Robinson(editors/ translators), Selected Letters of Rabindranath Tagores, Cambridge University Press,Delhi,1997.