গ্রিক ও রোমান এবং অধুনান্তিক কালের অতিমারী
ব্যাধি, মারী ও মড়কের সাথে মানুষের লড়াই আজকের নয়। বরং বহু শতাব্দী প্রাচীন। আজ এই কোভিড-১৯-এর প্রেক্ষিতে বাংলার লোকধর্মের শীতলা দেবীর কথা আমাদের মনে পড়তেই পারে। এই লোক দেবী ভারত উপমহাদেশে উত্তর ভারত, পশ্চিমবঙ্গ, নেপাল, বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানে ব্যাধি আরোগ্যের দেবী হিসেবে স্বীকৃত। আদ্যাশক্তি দেবী দুর্গার অবতার হিসাবে, তিনি পক্স, ঘা, ব্রণ, প্রভৃতি রোগ নিরাময় করেন। দোলযাত্রা থেকে আট দিন পরে দেবী শীতলার আরাধনা করা হয়। হিন্দু ধর্মের বিশ্বাসানুসারে এই দেবীর প্রভাবেই মানুষ বসন্ত প্রভৃতি চর্মরোগাক্রান্ত হয়। এই কারণেই গ্রামবাংলায় বসন্ত রোগ 'মায়ের দয়া' নামে অভিহিত । মাঘ মাসের ৬ষ্ঠ দিনে দেবী শীতলার পূজা করা হয়। শীতলা দেবীর বাহন গাধা বা গর্ধব। প্রচলিত মূর্তিতে শীতলা দেবীর এক হাতে জলের কলস ও অন্য হাতে ঝাড়– দেখতে পাওয়া যায়। ভক্তদের বিশ্বাস কলস থেকে তিনি আরোগ্য সুধা দান করেন এবং ঝাড়– দ্বারা রোগাক্রান্তদের কষ্ট লাঘব করেন।
আবার হিন্দু আর এক লৌকিক দেবী ওলাইচন্ডীকে মুসলমানরা বলে ওলা বিবি। জহির রায়হানের 'হাজার বছর ধরে' উপন্যাসে সেই ওলা বিবির হঠাৎ আগমনে একটি গ্রামের জীবনযাত্রা কীভাবে পালটে যায়, তা-ই দেখতে পাই আমরা। জহিরের উপন্যাসে গ্রামীণ মুসলিম নারী সমাজে এই তিন ব্যাধির দেবী বা ভগ্নীত্রয় সম্পর্কে এভাবে গল্প বলা হয়, 'ওলা বিবি, বসন্ত বিবি আর যক্ষ্মা বিবি ওরা ছিলো তিন বোন এক প্রাণ। যেখানে যেত এক সঙ্গে যেতো ওরা। কাউকে ফেলে কেউ বেরুতো না বাইরে। একদিন যখন খুব সুন্দর করে সেজেগুজে ওরা রাস্তায় হাওয়া খেতে বেরিয়েছিলো, তখন হঠাৎ হজরত আলীর সঙ্গে দেখা হয়ে গেলো ওদের। রঙ্গিন শাড়ি পরে বেরুলে কি হবে, ওদের চিনতে এক মুহূর্তও বিলম্ব হলো না হযরত আলীর। তিনি বুঝতে পারলেন এরা একজন কলেরা, একজন বসন্ত, আর একজন যক্ষ্মা বিবি। মানুষের সর্বনাশ করে বেড়ায় এরা। আর তখনি এক কান্ড কইরা বইসলেন তিনি। খপ কইরা মা ওলা বিবির একখানা হাত ধইরা দিলেন জোরে এক আছার। আছাড় খাইয়া একখানা পা ভাইঙ্গা গেলো ওলা বিবির। আহা সব খোদার কুদরত।'
'পুতুল নাচের ইতিকথা'র ঐ দৃশ্যটি এত সজীব আর সুন্দর যে আসলেই ভোলা কঠিন। না- শশী ও কুসুম নয়, শশী ও মতির সহোদর সহোদরাপ্রতিম সম্পর্কের একটি দৃশ্য যেখানে সূক্ষভাবে মড়কের কথা আসছে। পুকুর ঘাটে বন্ধুর বোন তথা কিশোরী মতিকে যুবক ডাক্তার শশী জিজ্ঞাসা করছে যে সে কলেরার টিকা নিয়েছে কিনা? উত্তরে মতি সহজ ভাবে জানায় যে কলেরার টিকা লাগবে কেন? মা শীতলার দয়া থাকলেই সে বেঁচে যাবে। উত্তরে শশী স্বভাবতই বিক্ষুব্ধ হয়।
কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য ত' বহু আগেই তাঁর 'বোধন' কবিতায় বলে গেছেন 'মারী ও মড়ক মন্বন্তর, ঘন ঘন বন্যার/আঘাতে আঘাতে ছিন্ন ভিন্ন/ভাঙ্গা নৌকার পাল/এখানে দারুণ দু:খে কেটেছে সর্বনাশের কাল'-এর কথা। বঙ্কিম চন্দ্রের 'আনন্দমঠ-এ ১৭৭৬-এর মন্বন্তর এবং মন্বন্তরের সঙ্গী হিসেবেই মারী বা মড়কের বিবরণ আসছে উপন্যাসের শুরুতেই।
মুসলিম বিদ্বেষী বক্তব্যের জন্য 'আনন্দমঠ' (রচনা: ১৮৮২) অবশ্যই সমালোচনার যোগ্য, তবে ১৭৫৭ সালে বাংলায় বৃটিশ শাসনের সূচনার অল্প কিছু বছরের ভেতরেই বা ১৭৭৬ নাগাদ কিভাবে এক মহা দুর্ভিক্ষ নেমে আসে এবং ক্রমে দুর্ভিক্ষের প্রভাব পড়ে জনস্বাস্থ্যেও, সেবিষয়ে 'আনন্দমঠ' আজো বিশ্বস্ত রেফারেন্স হতে পারে। ১৭৭৬-এর দুর্ভিক্ষের একশ' বছর পরে উইলিয়াম হান্টারের 'দ্য এনালস্ অব রুরাল বেঙ্গল' (১৮৬৮) থেকে জানা যায়: '১৭৭০ সালের মে মাসের পূর্বেই বাংলার 'এক-তৃতীয়াংশ জনসংখ্যা সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ীই নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।' বঙ্কিম তাঁর উপন্যাস রচনায় হান্টারের বইটি থেকে প্রচুর তথ্যগত সাহায্য নিয়েছেন। বাংলায় দুর্ভিক্ষের বিস্তার নিয়ে 'আনন্দমঠ'-এর সূচনার কিছু পংক্তি এখানে উদ্ধৃত করছি:
'১১৭৬ সালে গ্রীষ্মকালে একদিন পদচিহ্ন গ্রামে রৌদ্রের উত্তাপ বড় প্রবল। গ্রামখানি গৃহময়, কিন্তু লোক দেখি না। বাজারে সারি সারি দোকান, হাটে সারি সারি চালা, পল্লীতে পল্লীতে শত শত মৃন্ময় গৃহ। মধ্যে মধ্যে উচ্চ নীচ অট্টালিকা। আজ সব নীরব। বাজারে দোকান বন্ধ, দোকানদার কোথায় পালাইয়াছে ঠিকানা নাই। আজ হাটবার, হাটে হাট লাগে নাই। ভিক্ষার দিন, ভিক্ষুকেরা বাহির হয় নাই। তন্তুবায় তাঁত বন্ধ করিয়া গৃহপ্রান্তে পড়িয়া কাঁদিতেছে। ব্যবসায়ী ব্যবসা ভুলিয়া শিশু ক্রোড়ে করিয়া কাঁদিতেছে। দাতারা দান বন্ধ করিয়াছে। অধ্যাপকে টোল বন্ধ করিয়াছে; শিশুও বুঝি আর সাহস করিয়া কাঁদে না। রাজপথে লোক দেখি না, সরোবরে স্নাতক দেখি না, গৃহদ্বারে মনুষ্য দেখি না। বৃক্ষে পক্ষী দেখি না। গোচারণে গরু দেখি না। কেবল শ্মশানে শৃগাল-কুকুর।'
এরপরই দুর্ভিক্ষ কিভাবে ছোঁয়াচে রোগের বিস্তার ঘটাচ্ছে সে প্রসঙ্গে লিখছেন যে কিভাবে বাংলার মানুষ 'খাদ্যাভাবে গাছের পাতা খাইতে লাগিল, ঘাস খাইতে আরম্ভ করিল, আগাছা খাইতে লাগিল। ইতর ও বন্যেরা কুক্কুর, ইন্দুর, বিড়াল খাইতে লাগিল। অনেকে পলাইল, যাহারা পলাইল, তাহারা বিদেশে গিয়া অনাহারে মরিল। যাহারা পলাইল না, তাহারা অখাদ্য খাইয়া, না খাইয়া রোগে পড়িয়া প্রাণত্যাগ করিতে লাগিল। রোগ সমর পাইল, জ্বর, ওলাওঠা, ক্ষয়, বসন্ত। বিশেষত: বসন্তের প্রাদুর্ভাব হইল। গৃহে গৃহে বসন্তে মরিতে লাগিল। কে কাহাকে জল দেয়, কে কাহাকে স্পর্শ করে। কেহ কাহার চিকিৎসা করে না; কেহ কাহাকে দেখে না, মরিলেও কেহ ফেলে না।'
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের 'শ্রীকান্ত' উপন্যাসে বার্মায় জাহাজঘাটায় নেমেই নায়ক শ্রীকান্ত জানতে পারে যে রেঙ্গুনে মড়ক ছড়িয়েছে এবং সেজন্য জাহাজঘাটায় জাহাজের বিশেষত: দরিদ্র ও শ্রমিক শ্রেণির নারী-পুরুষের দশ দিনের কোয়ারেন্টাইনের বিবরণ পাওয়া যাচ্ছে: 'পরদিন বেলা এগার-বারটার মধ্যে জাহাজ রেঙ্গুন পৌঁছিবে; কিন্তু ভোর না হইতেই সমস্ত লোকের মুখচোখে একটা ভয় ও চাঞ্চল্যের চিহ্ন দেখা দিল। চারিদিক হইতে একটা অস্ফুট শব্দ কানে আসিতে লাগিল, কেরেন্টিন। '
শুধু 'শ্রীকান্ত' নয়, শরৎচন্দ্রের একাধিক উপন্যাসে বারবার মহামারী বা মড়কের প্রসঙ্গ আসছে। 'গৃহদাহ' নামে লেখকের যে উপন্যাস টলস্টয়ের 'আন্না কারেনিনা'দ্বারা প্রভাবিত বলে অনেক সমালোচক মনে করেন এবং বন্ধু মহিমের প্রথমে দয়িতা ও পরে আইনগত স্ত্রী অচলার প্রতি ডাক্তার সুরেশের অবোধ্য ভয়ানক আকর্ষণ সুরেশকে দিয়ে যে প্রবল অনৈতিক সব কাজ করিয়ে নেয়, ছলে-বলে-কৌশলে কোন না কোনভাবে অচলাকে জয় করার তার মরীয়া চেষ্টার এই আখ্যানেও মহামারী মাঝে মাঝেই উপন্যাসের ক্যানভাস হিসেবে আসছে। উপন্যাসের শেষে সুরেশ যেন তার যাবতীয় অন্যায়ের প্রায়শ্চিত্ত করতেই কঠোর প্লেগের মাঝে রোগীদের সেবা করতে গিয়ে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখেই নিজেকে ঠেলে দেয়। শরৎচন্দ্রের 'বিরাজ বৌ' উপন্যাসে কলেরা বা ভেদবমির সংক্রমণের কথা জানা যাচ্ছে। গোটা আঠারো ও উনিশ শতক থেকে বিশ শতকের শুরু অবধি বাংলা কথাসাহিত্য প্রায়ই নিমোনিয়া, কলেরা, ইনফ্লুয়েঞ্জা ও সেসব এড়াতে সম্পন্ন মধ্যবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর 'হাওয়া বদলে' পশ্চিম বা বিহার ও উত্তর ভারতে যাত্রার বিবরণে পরিপূর্ণ।
'চতুরঙ্গ-এ প্লেগে তো জ্যাঠামশাইয়ের মৃত্যুর কথাও লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ। 'গোরা' উপন্যাসে পালক পিতা-মাতার ঘরে কট্টর হিন্দু হিসেবে বড় হওয়া আইরিশ যুবক গৌরচাঁদ বা গোরা মড়কের সময় গ্রামে গ্রামে ঘুরে দেখতে পায় ও কষ্ট হলেও নিজের মনের কাছে স্বীকার করতে বাধ্য হয় যে দূর্যোগ দূর্বিপাক বা মড়কের সময় বাংলার গ্রামে মুসলিম সমাজ যেমন তাদের ধর্মীয় শিক্ষাতেই একতাবদ্ধ, হিন্দু সমাজ জাতিভেদ প্রথার কারণে ঠিক ততটাই অনৈক্যে ভরা ও পরষ্পরের প্রতি অসংবেদী। একই ভাবনা শরৎচন্দ্রের 'পল্লীসমাজ' উপন্যাসে নায়ক রমেশেরও। তারাশঙ্করের 'ধাত্রীদেবতা'উপন্যাসের নায়ক শিবনাথও কলেরার সময় গ্রামে গ্রামে আর্ত ও পীড়িতের মাঝে সেবাব্রত গ্রহণ করে।
আধুনিক বাংলা সাহিত্যের উন্মেষের আগেই মধ্যযুগের লোকজ বাংলা কাব্যে শীতলা দেবী, ওলাই চন্ডী বা ওলা বিবির ব্রত-মানতসহ নানা স্ত্রী আচারের বিবরণ পাওয়া যায় যা হিন্দু-মুসলিমের যৌথ সাংস্কৃতিক ও নৃ-তাত্ত্বিক উত্তারাধিকার।
বাংলা অঞ্চল ও বাংলা সাহিত্যের কথা তো বলা হল পশ্চিমা সাহিত্যের দিকে মুখ ফেরানো যাক:
'মড়ক কেমন?'এমন প্রশ্নের জবাবে রোমক দার্শনিক ও কবি লুক্রেতিয়াস লিখছেন,
মড়কের বীজাণু পতিত হয়
জল অথবা শস্য ক্ষেতের উপর,
পরিপুষ্ট পশু ও মানবদেহে পতিত হয়,
অথবা বাতাসে ঝুলে থাকে,
আর নি:শ্বাসে বাতাস নেবার সময়
আমরা শ্বাসনালী হয়ে টেনে নিই সকল বীজাণু
দেহের অভ্যন্তরে।
মড়কের সময়ে স্বাভাবিক ভাবেই মানুষের মুখ বিষাদগ্রস্থ হয়, আতঙ্ক ও হতাশা ভর করে সবার ভেতরে। 'বৃক্ষরাজির প্রকৃতি (অন দ্য নেচার অফ থিংস)'-এ লুক্রেতিয়াস পেলেপনেশীয় যুদ্ধের সময় এথেন্সে ছড়িয়ে পড়া এক ভয়ানক প্রাণ সংহারী মড়কের মর্মভেদী বিবরণ দেন। কবিতাটি এমন এক কালো সুরে হুট করে শেষ হয় যে অনেক পন্ডিতই মনে করেন যে কবিতাটি অসমাপ্ত রেখেই লুক্রেতিয়াস মারা গেছেন। এমন কিংবদন্তীও প্রচলিত আছে যে তার স্ত্রী ভালবেসে তাঁকে একটি শুশ্রুষাকারী ভেষজ নির্যাস খেতে দিলে সেটি খেয়ে উল্টো তিনি মারা যান।
আবার কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ধ্রুপদী সাহিত্যের বিশ্লেষক মেরি বেয়ার্ড আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন যে 'ইলিয়াড' শুরুই হচ্ছে ট্রয়ে গ্রিক শিবিরে মড়কের উপক্রমণ দিয়ে। আর কেন গ্রিক শিবিরে মড়ক লেগেছে? যেহেতু আগামেমনন ক্রিসেইসকে অন্যায় দাসত্বে বন্দি করেছেন, তার শাস্তি বা অভিশাপ হিসেবে এই মড়কের সূচনা। মার্কিনী গবেষক ড্যানিয়েল আর ব্লিকম্যানের মতে 'ইলিয়াড'-এ আগামেমনন ও একিলিসের তর্ক 'যেন আমাদের ভুলে যেতে না দেয় যে কিভাবে মড়ক সামনের অনাগত সময়ের চারিত্র্য বা মেজাজ কেমন হবে সেটা ঠিক করে দেয়। আরো যেটা গুরুত্বপূর্ণ যে এই আখ্যানের হৃদয়ের কাছাকাছি যে নৈতিক বিন্যাস আছে সেটিও নির্দিষ্ট করে দেয় দু:সহ এই মহামারী।' ঘুরিয়ে বললে, 'ইলিয়াড' এই আখ্যানের সব চরিত্রের দ্বারা সাধিত যত মন্দ আচরণ থেকে উদ্ভুত মহামারীর এক কাঠামোবদ্ধ বিবরণ পাঠককে উপহার দেয়। মড়ক সময়ের আখ্যান আমরা খুঁজে পাই 'অয়দিপাউস রেক্স' বা রাজা অয়দিপাউস থেকে 'এ্যাঞ্জেলস ইন আমেরিকা' অবধি বিশ্ব সাহিত্যের বিপুল গ্রন্থ সম্ভারের ধারাক্রমে। 'তুমি নিজেই মড়ক,' এক অন্ধ ব্যক্তি বলেন রাজা ইদিপাউসকে।
মধ্যযুগের ইউরোপে কালো মৃত্যুর প্রেক্ষাপটে লেখা জিওভান্নি বোক্কাচ্চিওর 'ডেকামেরন (১৩৩৫)' মড়কের সময়ে গল্প বলার সবল ভূমিকাকে উন্মোচন করে। কালো মৃত্যু বা মহামড়কের সময়ে দশজন ব্যক্তি ফ্লোরেন্সের বাইরে একটি ভিলায় দুই সপ্তাহের জন্য নির্জনাবাসে থাকছে। স্বেচ্ছা-অন্তরীণ দশার এই সময় কাটাতেই তারা নৈতিকতা, প্রেম, যৌনতার রাজনীতি, বাণিজ্য ও ক্ষমতার নানা গল্প বলে। দশটি নভেলা বা উপন্যাসিকার এই সংগ্রহে রেনেসাঁর আদিতম দিনগুলোর সময়ে সামাজিক নানা কাঠামো ও মিথষ্ক্রিয়ার পদ্ধতি হিসেবে গল্প বয়ানকে একটি পদ্ধতি হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। এই গল্পগুলো শ্রোতাদের (এবং বোক্কাচ্চিওর পাঠকদেরও) তাদের প্রতিদিনকার 'স্বাভাবিক' জীবন যাপনকে পুনর্গঠিত হবার পথ যোগায়, যা কিনা মড়কের কারণে স্তব্ধ ও নিশ্চল হয়ে আছে।
মেরি শেলীর ভবিষ্যদ্বানীমূলক উপন্যাস 'দ্য লাস্ট ম্যান (১৮২৬)'-ও কিন্তু প্রতিদিনের জীবনের স্বাভাবিকতাকে তার কেন্দ্রবিন্দু করেছে। ২০৭০ থেকে ২১০০ সালের বৃটেনে প্রোথিত এই ভবিষ্যতদ্বানীমূলখ উপন্যাস- যা কিনা ২০০৮ সালে চলচ্চিত্রায়িত হয়- লিওনেল ভার্নি নামে এক ব্যক্তির জীবনকে কেন্দ্র করে আবর্তিত যিনি বিশ্ব জুড়ে এক প্রবল মড়কের পর পৃথিবীর 'শেষ মানবে' পরিণত হন। শেলীর উপন্যাস বন্ধুত্বের মূল্যকে গুরুত্ব দেয়। উপন্যাসটি শেষ হয় যেখানে ভার্ণি একটি ভেড়া কুকুরের সাথে একাকী ঘুরে বেড়াচ্ছে এমন এক দৃশ্যে। এমন দৃশ্য মনে করিয়ে দেয় যে পালিত প্রাণীরা কিভাবে সঙ্কটের সময়ে স্বস্তি এবং স্থিরতার প্রতীক হতে পারে। মড়কের প্রাতিষ্ঠানিক প্রস্তুতি বিষয়ে উপন্যাসটি বেশ কঠোর। বৈপ্লবিক কল্পস্বর্গবাদ ও মড়কের পর বেঁচে যাওয়া মানবগোষ্ঠিগুলোর ভেতর যে তীব্র অন্তর্দ্বন্দ ও লড়াই শুরু হয়, তাকেও তিনি বিদ্রুপ করেছেন। পরে অবশ্য তারাও মারা যায়।
এডগার এ্যালান পো'র ছোট গল্প 'লাল মৃত্যুর মুখোশ (১৮৪২)'-ও মহামড়কে যথোপযুক্ত ও মানবিক সাড়া দিতে কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। লাল মৃত্যু যখন দেখা দিল, তখন দেহের ছিদ্র থেকে প্রবল রক্তপাতে মানুষ মরতে শুরু করলো। উত্তরে রাজপুত্র প্রসপেরো তাঁর এক হাজার বিত্তশালী অমাত্যকে নিয়ে একটি নির্জন তবে বিলাসবহুল প্রাসাদে জড়ো করেন, কঠোরভাবে দ্বার রুদ্ধ করে দেন এবং সময় কাটাতে অভিজাত শ্রেণির সবাইকে নিয়ে একটি মুখোশ পরা বল নাচের আসরও আয়োজন করেন। বাইরের পৃথিবী ত' তার নিজের দায়িত্ব নিজেই নিতে সক্ষম: রাজপুত্র প্রসপেরো অভিজাত নর-নারীদের মন খারাপ করতে বা দুশ্চিন্তা করতেও নিষেধ করলেন। রাজপুত্র তাদের আমোদ-আহ্লাদ করার সব ব্যবস্থাও করে দিলেন।
পো সেই বিলাসবহুল বল নাচের আয়োজনের খুঁটি-নাটি বর্ণনা দিয়েছেন। এই আখ্যানের শেষ হয় মানুষের বেশে স্বয়ং লোহিত বর্ণ মৃত্যুরও অপ্রাকৃত আগমনের ভেতর দিয়ে। মড়ক নিজেই সেই রাজপুত্র ও তাঁর অমাত্যবর্গের জীবন কেড়ে নেন। বিলাস-আনন্দে মত্ত অভিজাতেরা একের পর এক হলঘরে লুটিয়ে পড়তে থাকে- রক্তভেজা, হতাশ দেহভঙ্গিমায়।
ড্যানিয়েল ডিফোর 'মড়কের বছরের জার্ণাল (আ জার্ণাল অফ দ্য প্লেগ ইয়ার') বইটিতে লেখক তেমন একটা ইতিহাসই রচনা করেছেন যা কিনা তিনি ১৭২২ সালে 'মড়কের জন্য যথাযথ প্রস্তুতি' নামক একটি পরামর্শ ম্যানুয়ালের সহায়তায় লেখেন। তখন সাধারণ মানুষ আশঙ্কা করছিল যে এই মহামারী আবার ইংলিশ চ্যানেল পার হয়ে আসতে পারে। মধ্যপ্রাচ্য থেকে যাত্রা শুরু করে মার্সেই হয়ে এবং উত্তর সমুদ্রে বাণিজ্যতরীগুলোর মাধ্যমে এই রোগ হানা দিতে পারে বৃটেনে- এমন ভয়ই ছড়িয়ে পড়ছিল। ডিফো এমনটাও আশা করছিলেন যে এই বই 'আমাদের এবং ভবিষ্যত বংশধরদের কাজে আসবে, যদিও এই তিক্ত পেয়ালার পানীয়ের অংশ থেকে আমাদের পরিত্রাণ পাওয়া উচিত।' সেই তিক্ত পেয়ালা অবশ্য ততক্ষণে আসবাবপত্র রাখার তাক থেকে বের হয়ে পড়েছে।
১৬৬৫ সালে মড়ক সর্বব্যপ্ত হবার পর এতদিন যারা গড়িমসি করছিল, তারাও স্থাণ ত্যাগের জন্য অস্থির হয়ে উঠলো এবং আগেই কেন এলাকা ছাড়েনি এটা নিয়েও মন খারাপ করতে শুরু করে, 'গোটা শহরে একটি ঘোড়া পাওয়া যাচ্ছিল না যা কেনা যায় বা ভাড়া নেয়া যায়,' ডিফো পরে স্মৃতিচারণা করেন। ইতোমধ্যে শহরের প্রধান দরজাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয় এবং অধিবাসীরা সবাই আটকা পড়ে। আটকা পড়া অধিবাসীরা প্রায় প্রত্যেকেই মন্দ নানা আচরণ করে এবং এদের ভেতর বিত্তশালীরাই সবচেয়ে মন্দ আচরণ করে: আগেই যখন খাবার-দাবার মজুদ রাখতে বলা হয়েছিল সেটা ত' তারা শোনেনি। আর অবরুদ্ধ অবস্থায় তারা তাদের দরিদ্র চাকর-বাকরদের পাঠালো খাবার-দাবার সংগ্রহ করতে, 'এই যে খাবার-দাবার কিনতে ঘরের বাইরে আমাদের যেতে হয়েছিল, এটাই পরে গোটা শহরের জন্য ভয়ানক বিপর্যয় ডেকে আনে,' ডিফো লিখলেন।
লন্ডন শহরের প্রতি পাঁচজনে একজন অধিবাসী মারা গেলেন; ব্যবসায়ীদের আগাম কিছু সতর্কতাও তাদের বাঁচাতে পারেনি। কসাইরা রাঁধুনীদের এক টুকরো মাংস দিতেও অস্বীকৃতি জানালো। রাঁধুনীকে নিজেই সেই মাংস ঝুলিয়ে রাখা তাক থেকে নিতে হয়েছে। এবং কসাই রাঁধুনীর হাত থেকে সরাসরি টাকা নিতেও অস্বীকৃতি জানালে রাঁধুনীকে মুদ্রাগুলো ফেলতে হয়েছে এক বালতি ভিনেগারের ভেতর। আজ যখন আপনার হ্যান্ড স্যানিটাইজার ফুরিয়ে যাচ্ছে, তখন অতীতের এই কথা মনে করতে পারেন।
'দু:খ এবং যন্ত্রণা যেন প্রতিটি মুখে গেঁথে গেছিল,' ডিফো লিখেছিলেন। জনমনে ভীতি ছড়ায় এমন বই মুদ্রণে সরকারের নিষেধাজ্ঞাও কাজে আসছিল না। পথে বের হলেই ত' আতঙ্ক। প্রতি সপ্তাহে কত মানুষ মারা যাচ্ছে তার সাপ্তাহিক খতিয়ান পথে টাঙ্গানো অথবা গলিতে গলিতে মৃত শবদেহের সারি। শহরের মেয়রের নির্দেশনামাগুলোও পাঠ করা যেত অতি সহজেই: 'যদি কোন ব্যক্তি এমন কোন মানুষকে দেখতে যায় প্লেগ হয়েছে অথবা জেনে-শুনে, স্বেচ্ছায় বা সজ্ঞানে কেউ যদি কোন মড়কে সংক্রমিত বাড়িতে সরকারের নিষেধ সত্ত্বেও ঢোকে, তবে যে বাড়িতে এই ব্যক্তির বসবাস, সেই বাড়ি বন্ধ করে দেয়া হবে।' এবং এই মড়কে সংক্রমিত বাড়িগুলোর উপরে সাঁটা চিহ্নগুলো সহজেই দেখতে পাওয়া যেত, দারোয়ানরা বাড়িগুলো পাহারা দিত, প্রতিটি দরজাতেই এক ফুট লম্বা লাল রঙের ক্রুশ চিহ্ন আঁকা আর যার উপর বড় বড় অক্ষরে লেখা থাকতো, 'হে প্রভু, আমাদের করুণা করো!' দূর থেকেই এমন লেখা পড়া যেত।
আধুনিক ও সাম্প্রতিক সাহিত্য
বিশ শতকে, আলবেয়ার কাম্যুর 'দ্য প্লেগ (১৯৪২)' এবং স্টিফেন কিংয়ের 'দ্য স্ট্যান্ড (১৯৭৮)' প্লেগের মত মহামারীর সামাজিক নানা প্রভাব বা নিহিতার্থের প্রতি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বিশেষত: মড়কের কারণে সৃষ্ট নির্জনাবাস ও রোগ নিরসন বা জনতার ভেতর ছড়িয়ে পড়তে থাকা আতঙ্ক হ্রাসে রাষ্ট্রের ব্যর্থতাও এই দুই উপন্যাসের উপজীব্য। কাম্যুর উপন্যাসে মড়কে দংশিত আলজেরীয় শহর ওরানের অধিবাসীদের মানবীয় আচরণ ও সম্পর্কের মূল্য বিষয়ে এক উদ্বিগ্ন পাঠ। ভবিষ্যতে আমাদের জন্য কি আছে সে বিষয়ে এই কঠোর ও চাঁচা-ছোলা অজ্ঞানতা এবং নিকট ভবিষ্যতের ভয়াবহতা যা কিনা একইসাথে এত কাছে ও এত দূরে- তার উপস্থিতির নীরবতা আমাদের সারাদিন অস্থির করে রাখে।
মড়ক বিষয়ে কাম্যুর পর্যবেক্ষণই যেন জোজে সারামাগোর 'অন্ধত্ব (১৯৯৫)' উপন্যাসে মেধাবী ও ধ্বংসাত্মক ভাবে পুনর্চিত্রায়িত হয়েছে। এই উপন্যাসে ডিফোর মত একজন ডাক্তার হলেন মূলত চক্ষু বিশেষজ্ঞ এবং তিনি দেখছেন যে একটি রোগ ছড়িয়ে পড়ছে, যা মানুষের দেখার ক্ষমতা লুপ্ত করে তাকে প্রাণীর স্তরে নামিয়ে আনছে। ঐতিহাসিক রূপক কাহিনী হিসেবে 'ব্লাইন্ডনেস' কুড়ি শতকের কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রকে ইঙ্গিত করে: অসহায়ের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ, সামরিক শাসকদের নির্দয়তা। এই রোগ যখন ছড়িয়ে পড়ে, সরকার তখন সব অন্ধদের পাকড়াও করে এবং তাদের মানসিক সংশোধনাগারে নিয়ে যায় যেখানে অন্ধরা পরষ্পরের বিরুদ্ধে লড়াই করে। তারা চুরি করে, ধর্ষণ করে। 'অন্ধরা সবসময়ই যুদ্ধরত, সবসময়ই তারা যুদ্ধে লিপ্ত ছিল,' সারামাগো লেখেন, উপন্যাসের কালোতম পর্যবেক্ষণ এটাই।
তবে 'ব্লাইন্ডনেস' ইতিহাসের যে কোন শিক্ষার চেয়ে আরো অনেক কালো। সারামাগোর জন্য, অন্ধত্ব কোন অসুস্থতা নয়: এটা একটি মানবীয় অবস্থা। গোটা উপন্যাসে একজন মানুষেরই শুধু দৃষ্টি অক্ষত থেকে যায়। সেই নারীটি অন্ধদের পড়ে শোনায় যা তাদের সাথে একইসাথে স্বর্গসুখ আবার ক্রোধের কারণ: 'আমরা ত' আর কোন কাজে লাগি না শুধু শোনা ছাড়া- যখন কেউ আমাদের আগে এই মানব প্রজাতি কেমন ছিল সেটা পড়ে শোনায়।' এবং আধুনিক মড়কের উপন্যাসে এটাই পৃথিবী ধ্বংস করে দেয়া শেষ আতঙ্কের গল্প যখন জ্ঞানের হারিয়ে যাওয়ার ওষুধ হলো একমাত্র পাঠ। যেন বা এই উপলব্ধি থেকেই সারামাগোর চক্ষু বিশেষজ্ঞ, অসুখটি সবার কাছে বিদিত হবার আগেই, নিজের দৃষ্টিশক্তি হারান: যদিও তিনি বুঝেছিলেন জীবনের মহার্ঘতা, রূপ ও জ্ঞানের নশ্বরতা। দৃষ্টিশক্তি হারানোর আগেই চক্ষু বিশেষজ্ঞের কাছে যখন হুট করে এবং অস্বাভাবিক ভাবে অন্ধ হয়ে যাওয়া এক রোগী তাঁর কাছে আসে- যে কিনা কোন কিছু কালো নয় বরং সব কিছু দুধের মত সাদা দেখতে পায়- রোগীর কাছ থেকে এমন অভিজ্ঞতা শুনে বিচলিত ডাক্তার বাড়ি ফিরে রাতের খাবারের পর পাঠাগারের বইয়ে এ বিষয়ে পড়তে যান। 'সেই রাতে, যে বই তিনি পড়ছিলেন, তার পাশেই শুয়ে পড়ে তিনি তাঁর ক্লান্ত চোখ জোড়া ঘষলেন এবং চেয়ারে হেলান দিলেন,' সারামাগো লেখেন। ডাক্তার অবশেষে বিছানায় যাবার সিদ্ধান্ত নেন। 'এর এক মিনিট পরেই ঘটনাটা ঘটে যখন তিনি বইগুলো বুক শেলফে রাখতে যাচ্ছিলেন। প্রথমে তিনি লক্ষ্য করলেন যে নিজেই নিজের হাত জোড়া দেখতে পাচ্ছেন না এবং তারপর তিনি বুঝলেন যে তিনি অন্ধ হয়ে গেছেন।"
সব কিছু সাদা হয়ে গেছে। একটি শূণ্য পৃষ্ঠার মত সাদা।
কিংয়ের 'দ্য স্ট্যান্ড' উপন্যাসে একটি মার্কিনী সামরিক ঘাঁটি থেকে জৈব প্রযুক্তিগত কৌশলে সৃষ্ট একটি সুপার ফ্লু ভাইরাস 'প্রজেক্ট ব্লু' একটি ছিদ্রপথে নির্গত হয়। এরপরই দেখা দেয় মহামারী। কিং সম্প্রতি ট্যুইটারে বলেছেন যে কোভিড-১৯ তাঁর ফিকশনের মহামারীর মত অত ভয়ানক অবশ্যই নয় আর জনগণকে তিনি সাবধান থাকার পরামর্শ দিয়েছেন।
একইভাবে ২০১৬ সালে প্রকাশিত উপন্যাস 'ফিভার'-এ দক্ষিণ এশীয় লেখক দিওন মেয়ের জৈবপ্রযুক্তিগত কৌশলে সৃষ্ট ও সমরাস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত এক ভাইরাসের ছড়িয়ে পড়ার পর মহাদূর্যোগের প্রেক্ষাপটে বেঁচে যাওয়া মানুষেরা সামান্য রসদের জন্য পরষ্পর যে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয় তার বিবরণ এঁকেছেন।
'সেভেরেন্স (২০১৮)' সালের উপন্যাসেও লিং মা তাঁর উপন্যাস 'শেন ফিভার'-এ সাধারণ মানুষকে মৃত্যুর আগ অবধি স্বয়ংক্রিয় চালক শক্তি যোগানোর কথা লিখেছেন- লিখেছেন তাঁর বোধশক্তি ভোঁতা করে দেয়া রচনায়। খানিকটা রূপকের রহস্যে মোড়া এই উপন্যাসে নায়িকা ক্যান্ডেস ভবিষ্যতের নিউইয়র্ক যা কিনা ধীরে ধীরে ধ্বসে পড়ছে, সেখানে প্রতিদিনই তার কাজের জায়গায় যায়। অবশেষে সে বেঁচে থাকার জন্য একটি বৃত্তে যোগ দেয় এবং বৃত্তের অন্য সদস্যরা জোম্বিদের প্রতি যে ভয়াবহ মনোভাব পোষন করে, তাদের সাথে সাংস্কৃতিক ও নৈতিক ভাবে সে খাপ খাইয়ে নেয়। 'হাড়ে-মজ্জায় উলঙ্গ হয়ে যাওয়া উত্তর-পুঁজিবাদী মানব সমাজের অণুতে পরমাণুতে বিভাজিত রূপ এভাবেই এই উপন্যাসে বিধৃত,' বলে উল্লেখ করেছেন বইটির আলোচক জিয়াইয়াং ফাং।
সম্প্রতি 'দ্য গার্ডিয়ান' পত্রিকায় এ্যান্ড্রু ডিকসন তাঁর 'শেক্সপীয়র ইন লকডাউন' প্রবন্ধে জানাচ্ছেন যে মহাকবি ও নাট্যকার উইলিয়াম শেক্সপীয়রের সময়ও কিন্তু প্লেগ বা মহামারীর সংক্রমণ হয়েছিল এবং তিনি মহামারীর কারণে নির্জনবাস বা স্বেচ্ছা-অন্তরীণ থাকার সময়ে 'কিং লীয়ার' বা 'রাজা লীয়ার' রচনা করেছেন। ইংরেজি ভাষার এই মহাকবি সম্ভবত: প্লেগের কারণে তিনি যে থিয়েটার কোম্পানিতে কাজ করতেন সেই 'গ্লোব' কোম্পানি দীর্ঘদিনের জন্য ছুটি হবার সময়টি ভালই কাজে লাগিয়েছেন। 'ম্যাকবেথ' এবং 'এ্যান্টনীও ক্লিওপেট্রা' শেষ করার সাথে সাথে সমাপ্ত করছেন 'কিং লীয়ার' বা 'রাজা লীয়ার'-ও।
গোটা 'কিং লীয়ার' নাটকের মূল সুর বা ভাবটি দেখুন কেমন ভয়ানক- পরিত্যক্ত সব রাস্তা আর বন্ধ হয়ে যাওয়া দোকানপাট, কুকুরগুলো দৌড়ে বেড়াচ্ছে, নগর পরিষেবা দানকারীরা তিন ফুট লম্বা বোর্ড লাল রঙে এঁকে, সাথে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে যাতে করে সবাই দূরত্ব রাখে, গির্জায় নিরন্তর ঘন্টাধ্বনি বেজেই যাচ্ছে শোককৃত্যের আহ্বানে- 'কিং লীয়ারে'র অসম্ভব ধূসর ও বিরাণ খাঁ খাঁ নাট্যভূমি যেন সেই মড়কের সময়েরই প্রতিচ্ছবি।
এই নাটকের গোটা টেক্সটই যেন মৃত্যু, বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্য ও হতাশার নানা চিত্রকল্পে পরিপূর্ণ, যেন সবাই বোধ করতে পারে হাড়ে কাঁটা দেয়া হিম অনুভূতি। নাটকের একটি জায়গায় গ্লুচেস্টার যেমন বিষন্ন মুখে বলছে: 'প্রেম শীতল হয়ে আসে, বন্ধুত্বের পতন হয়, ভাইয়েরা বিভক্ত হয়; প্রাসাদে, ষড়যন্ত্র; এবং পিতা ও পুত্রের মাঝেও বন্ধনে ফাটল ধরে...আমরা দেখেছি আমাদের শ্রেষ্ঠ সময়।' আমরা অবশ্য নিশ্চিত করে বলতে পারিনা যে 'কিং লীয়ার' মড়ক নিয়েই রচনা- ঠিক যতটা প্রত্যক্ষভাবে বেন জনসনের 'দ্য আলকেমিস্ট' বা থমাস ডেক্কেরের কৌতুকোদ্দীপক সংবাদধর্মী প্রচারপত্র 'দ্য ওয়ান্ডারফুল ইয়ার' ১৬০৩ সালের ভয়ানক সব ঘটনাক্রমকে প্রচার করেছে, 'কিং লীয়ার' তত প্রত্যক্ষভাবে মড়কের কাহিনীকে উপস্থাপন করে না। তবে মড়কের খাঁ খাঁ সময়ের এক সূক্ষ উপস্থিতি গোটা নাটকেই টের পাওয়া যায়।
আবার শুধু 'কিং লীয়ারে'ই নয়, শেক্সপীয়রের আরো কিছু নাটকেও প্লেগের বিবরণ পাওয়া যায়। যেন বা তাঁর একাধিক নাটকে মড়ক ফ্রেমের বা চালচিত্রের প্রান্ত হয়ে আসে- তা' যতটা দেখা যায়, তার চেয়ে বেশি অনুভব করা যায়। কখনো কখনো মড়ককে শেক্সপীয়র প্লটের বিবরণে একটি কৌশল হিসেবেও ব্যবহার করেছেন। যেমন, 'রোমিও এবং জুলিয়েট'-এ ফ্রায়ার লরেন্স দ্বারা প্রেরিত বার্তাবাহক মড়কে অসুস্ত হয়ে পড়েন। ফলে এই বার্তাবাহক নির্জনবাস অবলম্বনে বাধ্য হন। কাজেই বার্তাবাহকের কাছে যে চিঠিটিতে বলা হয়েছিল যে জুলিয়েট আসলে মারা যায়নি, সেই খবর রোমিওর কাছে আর পৌঁছয় না। এর আগেই নাটকের শুরুতে 'তৃতীয় অঙ্কে' মার্ক্যুশিওর সংলাপ দেখুন: 'তোমাদের দু'জনের গৃহেই এক মড়ক দেখা দিয়েছে!' এমন সংলাপে 'মড়ক' বলতে 'প্রেম' বুঝে দর্শক মন্ডলীতে মৃদু হাস্যের সূচনা হলেও নাটকে সেসময়ের এক মড়ক বা দূর্যোগ গুটি বসন্তের কথাও বলা হতে পারে। কিন্তু ১৬০৩ সালের সেই আতঙ্কজনক মহামারীর পর যখন কিনা রাজা জেমস প্রথমের রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠানও পিছিয়ে দেয়া হলো, শেক্সপীয়রের নাটকগুলোয় রোগের নানা অনুষঙ্গ ব্যবহৃত হতেই থাকে। তাঁর অপেক্ষাকৃত কম মঞ্চায়িত নাটক 'টিমোন অফ এথেন্স'-এ টিমোন এক স্বেচ্ছা-নির্বাসিত ব্যক্তি হয়ে ওঠেন যেখানে তাঁর ঠোঁটে কিনা এমন সংলাপও উচ্চারিত হয়: 'মড়ক...তোমার সবল, সংক্রামক জ্বর স্তুপীকৃত হচ্ছে/ এথেন্সের উপর!' 'মড়কের মুকুটে সজ্জিত'...'তাদের কাছে ফিরিয়ে দাও মহামারী/যদি আমি তাদের জন্য এটা ধরতে পারতাম' ইত্যাদি নানা সংলাপ লক্ষ্য করা যায়। আবার শেক্সপীয়রের আর একটি নাটক 'মেজার ফর মেজার'-এ লক্ষ্য করা যায় যে কিভাবে নাট্যকার তাঁর সময়ের লন্ডন নগরীকে বর্ণনা করছেন যেখানে কিনা গণিকালয় ও পানশালাগুলো এক স্বেচ্ছাচারী সরকারের সিদ্ধান্তেই বুঝি হুট করে বন্ধ হয়ে গেল। এমনটা তখন প্রায়ই হতো।
ম্যাকবেথ, ১৬০৬ সালের মড়কের সময়েই রচিত বলে অনুমান করা হয়, এক সংক্ষিপ্ত কিন্ত জটিল বক্তব্য দিয়ে সূচীত হয় যা বহু দর্শকের মনেই ভীতি সঞ্চার করে থাকবে: 'মরণোন্মুখের আর্ত গোঙ্গানী/কোথাও কি জিজ্ঞাসা করা হয়েছে যে কে এবং যত ভাল মানুষের জীবন/তাদের টুপির ফুল ঝরে পড়ার আগেই নির্বাপিত/হয় মরছে অথবা অসুস্থ বড়।' শাপিরোর মতে, 'যদিও চার পংক্তির বেশি নয়, তবু এটুকুতেই মড়কের ভীতি ও দূর্বিপাকের এর চেয়ে ভাল বিবরণ আর হয় না।' আর 'কিং লীয়ার' ত' আরো বেশি প্রত্যক্ষ। লীয়ারের ডান হাত যে অনুচর কেন্ট, সে ভৃত্য অসওয়াল্ডকে চেঁচিয়ে বলছে, 'তোমার ফেনা গাঁজানো মুখে মড়কের সংক্রমণ!' লীয়ার আরো বলছেন 'মড়ক যা কিনা ঝুলছে দোদুল্যমান বাতাসে' আর এভাবেই মড়ক বায়ুবাহিত রোগ এই মুখে মুখে প্রচারিত তত্ত্বটি বলা হচ্ছে নাটকে। নাটকের নানা জায়গায় লীয়ারের মুখের দীর্ঘ বক্তব্যগুলোর একটিতে রাজা কন্যা গনেরিলকে এই বলে ডাকছেন, 'যেন একটি মড়কের ক্ষত, যেন বা সূচীছিদ্র শোভিত বিষ্ফোটক/জেগে আছে আমার দূষিত রক্তে'- সেই সময়ের মড়কে মানবদেহের লিম্ফনোড বা লসিকা গ্রন্থি ফুলে ওঠার কথা এসেছে এই সংলাপে। আরো একটি লক্ষ্যনীয় বিষয় হলো যে ১৫৯২ সালের জুনে যখন আর একটি প্রবল মড়ক দেখা দিয়েছিল তখন থিয়েটারগুলো প্রায় ছয় মাস বন্ধ থাকে। শেক্সপীয়র এসময় ঝুঁকে যান কবিতায়: তাঁর দীর্ঘ কবিতা 'ভেনাস ও এ্যাডোনিস' বা 'দ্য রেপ অফ লুক্রেশে' দু'টোই এসময় রচিত হয়েছিল। যেহেতু তরুণ কবির দরকার ছিল কিছু আয়ের ব্যবস্থা করা। প্রেক্ষাগৃহগুলো সারাটা সময় বন্ধ থাকলে শেষপর্যন্ত তাঁর 'কিং লীয়ার' অথবা 'রোমিও এবং জুলিয়েট,' 'হ্যামলেট,' 'ম্যাকবেথ,' 'এ্যান্টনী এ্যান্ড ক্লিওপেট্রা' অথবা তাঁর অন্য কোন সেরা কাজই আত্মপ্রকাশ করতে পারত না।