চন্দনের সুবাসিত সাবান
চন্দনকাঠ সেই প্রাচীনকাল থেকেইভারতীয় সংস্কৃতির এক অপরিহার্য অংশ। হিন্দু ধর্মগ্রন্থে এর বহুল উল্লেখ রয়েছে। আয়ুর্বেদ থেকে জানা যায়, প্রাচীনকাল থেকে এটি ধূপ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, মহীশুরের বিখ্যাত চন্দনের সুগন্ধি ভারতের প্রায় প্রতিটি বাড়িতে সাবান রূপে জায়গা করে নিয়েছিল। পরবর্তীতে সে সাবানই হয়ে উঠেছিল ভারতীয় পরিচয়ের প্রতীক। এর নাম ছিলমহীশুর স্যান্ডাল সোপ।
'ত্বককে মসৃণ ও মখমলের মতো কোমল' করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সাবানটি বেঙ্গালুরুর কারাখানা থেকে প্রথম বাজারে আসে আজ থেক ঠিক একশো বছর আগে।তবে মহীশুর স্যান্ডাল সাবানের শুরুর গল্পটার শেকড় তৎকালীন মহীশুর রাজ্যে। ভারতের সিংহভাগ চন্দনকাঠের গাছই জন্মায় এ রাজ্যে।
ভারতেরসর্বত্রই চন্দন পাওয়া যায়। কর্ণাটক ও তামিলনাড়ুর ৯০ শতাংশেরও বেশি এলাকায় (৮,৩০০ বর্গকিলোমিটার) পাওয়া যায় এটি। কর্ণাটকের দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চলে ৫,০০০ বর্গকিলোমিটারেরও বেশি জায়গা জুড়ে প্রাকৃতিকভাবে জন্মায় এ গাছ। তামিলনাড়ুতে ৩,০০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে জন্মায় চন্দন।
পূর্বে চন্দনকাঠের একচেটিয়া ব্যবসা ছিল তৎকালীন মহীশুর রাজ্যের দখলে। ১৭৯৯ সালের আগে চন্দন ছিল রাজ্যটির রাজস্ব সংগ্রহের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খাত। 'স্যান্ডাল কোটি' নামে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন চন্দনকাঠের গুদাম ছিল। ১৭৯৯ সালের আগে মহীশুরের চন্দনকাঠের অন্যতম প্রধান ক্রেতা ছিল চীন। চীনের মিং ও কিং রাজবংশে এ জিনিসের খুব কদর ছিল। অভিজাত পরিবার ও রাজসভার কর্মকর্তারা সম্রাটকে খুশি করার জন্য চন্দনকাঠ উপহার দিত। নিষিদ্ধ নগরীর প্রায় সমস্ত আসবাবই চন্দনকাঠের তৈরি।
তবে ১৭৯৯ সালের পর ধীরে ধীরে জার্মানি এ কাঠের অন্যতম প্রধান ক্রেতা হয়েওঠে। ভারতে তখনও চন্দনকাঠের তেল চোলাই করা হতো আদিম পদ্ধতিতে। সেজন্য জার্মানরা সরাসরি কাঠ কিনে নিয়ে নিজেরাই তেল চোলাই করে নিত।
সেকালে মহীশুরে বেড়াতেআসা সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের চন্দনের তৈরি সুগন্ধি উপহার দেওয়ার প্রথা প্রচলিত ছিল। উনিশ শতকের প্রখ্যাত পর্যটক ও ব্রিটিশ অভিজাত লর্ড ভ্যালেনসিয়া ভারতে ঘুরতে এসেছিলেন (১৮০২-০৬)। ১৮০৪ সালে তিনি মহীশুর সফর করেন।ঐতিহাসিক দলিল থেকে জানা যায়, সে সময় মহারাজা মুম্মাদি কৃষ্ণ রাজা ওয়াড়িয়ার অন্যান্য উপহারের সাথে দুটো চন্দন তেলের বোতলও উপহার দেন তাকে। ১৮৬১ সালে রানি ভিক্টোরিয়াকে বহু দামি উপহার পাঠান মহারাজা মুম্মাদি কৃষ্ণ রাজা ওয়াড়িয়ার।একটা চন্দনকাঠের তৈরি হাঁটার ছড়ি এবংপাখাও ছিল সেসবের মধ্যে।
বার্ষিক কর প্রদানে ব্যর্থতার মিথ্যা অজুহাতে ১৮৩১ সালে মহীশুর প্রশাসনের দায়িত্ব নিজেদের হাতে তুলে নেয় ব্রিটিশরা। সে সময় 'স্যান্ডাল কোঠি'গুলোতে বিপুল পরিমাণ চন্দনকাঠ মজুত ছিল। সবচেয়ে কম কাঠ ছিল যে গুদামে, সেসবের দামও ছিল ৭ লাখ রুপির বেশি। এ কারণে 'স্যান্ডাল কাচেরি' নামে একটা সরকারি বিভাগই খুলে বসে ব্রিটিশরা।চন্দনকাঠের চাহিদা এত বেশি ছিল যে, এটি রাজস্ব খাতের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি উৎসে পরিণত হয়।
১৮৮১ সালে ব্রিটিশরা মহীশুর রাজ্যকে ওয়াড়িয়ার রাজবংশের কাছে ফিরিয়ে দেয়। সে সময় চন্দনকাঠের বিরাট বাজার তৈরি হয়েছিল। তখন বন দফতর নিষ্কাশিত সমস্ত চন্দন প্রতি বছর নিলামে তুলে বিক্রি করত। ১৮৮০-৮১ সালে প্রতি টন চন্দনের দাম ছিল ৩৮৭ রুপি, ১৯১১-১২ সালে সেদাম বেড়ে ৫৩৪ রুপিতে গিয়ে ঠেকে। পরের দুই বছরে প্রতি টন চন্দনের দাম গিয়ে দাঁড়ায় ১০৫১ রুপিতে। সে সময় এ ছিল বিপুল পরিমাণ টাকা।
বিশ্বজুড়ে চন্দনকাঠের এমনই চাহিদা ছিল যে, এই নিলামগুলোতে ভলকার্টস ওঅ্যান্টয়েন চিরিস-এর মতো শীর্ষস্থানীয় পারফিউম উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান অংশ নিত। ৩-৪ মাস সমুদ্রযাত্রা করে, তারপর টানা কয়েক দিন গরুর গাড়িতে চেপে হুঁসুর তীর্থহলি, সাগর ও সেরিংগাপট্টমের মতো প্রতন্ত অঞ্চলেরচন্দন গুদামে হাজির হতো এসব প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা।
জার্মান রসায়নবিদরা ততদিনে চন্দনকাঠ চোলাই করার পদ্ধতি শিখে এ ব্যাপারে রীতিমতো দক্ষ হয়ে উঠেছিলেন। ওষুধ প্রস্তুতের সমস্ত নিয়ম-কানুন মেনে উৎকৃষ্ট মানের তেল উৎপাদন করতে পারতেন তারা। এর ফলে চন্দনকাঠের নতুন বাজার তৈরি হয়, কারণ ১৯৩০ সালের আগ পর্যন্ত এই তেলই ছিল যৌনরোগের একমাত্র ওষুধ। উনিশ শতকের গোড়ার দিকে টোকিও ও প্যারিসে জেলাটিন পিল উৎপাদনের হার বেড়ে যায়। এ ক্যাপসুলে চন্দন তেল থাকত। তেলটি যৌনরোগের সংক্রমণ ঠেকাতে সক্ষম বলে বিশ্বাস করা হতো।
কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর জার্মানিতে চন্দন রফতানি বন্ধ হয়ে যায়। ফলে চন্দন নিলামের প্রথাও গেল বন্ধ হয়ে। যুদ্ধের কারণে অন্যান্য দেশে চন্দনকাঠ পাঠানোও কঠিন হয়ে গেল। কিন্তু মহীশুরের মহারাজা বুঝতে পেরেছিলেন, স্থানীয়ভাবেআন্তর্জাতিক মানদণ্ড বজায় রেখে চন্দন তেল নিষ্কাশন করতে পারলে কাঠের পরিবর্তে তেলই রফতানি করা যাবে। এর ফলে বাণিজ্য শুল্কও খুব কম দিতে হবে।
বুদ্ধিটা দারুণ ছিল। আলফ্রেড চ্যাটারটনকে রাজ্যের শিল্প-পরিচালক নিযুক্ত করলেন তিনি। চ্যাটারটন ছিলেন প্রচণ্ড মেধাবী মানুষ। মাদ্রাজের প্রকৌশল কলেজের অধ্যক্ষ থাকার সময় তিনি নিত্যদিনের কাজকর্মে অ্যালুমিনিয়াম ব্যবহার বৃদ্ধির আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। মাদ্রাজ সরকারের শিল্প-পরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা ছিল তার।
মহীশুরে পৌঁছেই কাজে নেমে পড়লেন চ্যাটারটন। ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স, ব্যাঙ্গালোর-এর দুজন রসায়নের অধ্যাপক, জে জে সাডবোরো ও এইচ ই ওয়াটসনকে সাথে নিয়ে ল্যাবরেটরিতে চন্দন তেল নিষ্কাশন শুরু করলেন। ভারতে তারাই প্রথম ল্যাবরেটরিতে এ তেল নিষ্কাশন করেন। ব্যাপক পরীক্ষানিরীক্ষার পর তারা ওষুধ কোম্পানির মানের চন্দন তেল উৎপাদন করার রহস্য আবিষ্কার করলেন। এ তেল ইউরোপীয় ক্রেতাদের কাছে সমাদৃত হয়।
তেল নিষ্কাশনের পদ্ধতিটি আরও নিখুঁত করে অচিরেই মহীশুরে একটি কারখানা স্থাপন করা হলো। কারখানাটির মাসিক উৎপাদনক্ষমতাছিল ২,০০০ পাউন্ড। মহীশুর স্যান্ডালউড অয়েল ফ্যাক্টরি নামের কারখানাটির দায়িত্বে ছিলেন চ্যাটারটন নিজে। ১৯১৬ সালের আগস্টের মধ্যে উৎকৃষ্ট মানের চন্দন তেল উৎপন্ন করে লন্ডনে পাঠানো শুরু হয়।
সে বছরই চন্দন তেল নিষ্কাশন করার জন্য বেঙ্গালুরুতে আরেকটি কারখানা স্থাপন করা হয়। কদিন পরই মহীশুরে আগের দুটোর চেয়েও অনেক বড় আরেকটি কারখানা খোলা হয়।
প্রায় ৬ বছর মহীশুর স্যান্ডালউড অয়েল ফ্যাক্টরির পরিচালক ছিলেন চ্যাটারটন।বিশ্বের বৃহত্তম চন্দন নিষ্কাশন কারখানায় পরিণত হয় এটি। কারখানাটিতে চ্যাটারটন যে মানদণ্ড বজায় রেখে কাজ করাতেন, পরবর্তীকালে তা একে তেল ব্যবসায় সবচেয়ে সফল বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর একটিতে পরিণত করে।
এক দশকেরও বেশি সময় ধরে আন্তর্জাতিক চন্দন তেলের বাজারের নিয়ন্ত্রণ ছিল মহীশুরের হাতে। তারপর ১৯২৯-৩০ সালে হঠাৎ অস্ট্রেলীয় চন্দন তেলের সাথে তীব্র প্রতিযোগিতায় নামতে হয় তাদের। অস্ট্রেলিয়ান নির্যাসটি ভিন্ন প্রজাতির কাঠ থেকে উৎপন্ন হতো, ওটার শারীরিক ও রাসায়নিক বৈশিষ্ট্যও অনেকটাই অন্যরকম ছিল। তবু তেলটি মহীশুরের একচেটিয়া বাজারে তীব্র প্রতিযোগিতা গড়ে তোলে। বলা হয়, ফরাসি রসায়নবিদ ও ফার্মাসিস্টরা পয়সা, তুমুল প্রচারণা ও প্রোপাগান্ডার মোহে পড়ে গিয়েছিলেন।
অবশ্য শিগগিরই চন্দনকাঠের ব্যবসার নেতৃত্ব আবার মহীশুরের হাতে ফিরে আসে। ১৯১৮ সালে একজন বিদেশি অতিথি মহীশুরের মহারাজা, চতুর্থ কৃষ্ণ রাজা ওয়াড়িয়ারকে মহীশুরে উৎপাদিত চন্দন তেল দিয়ে তৈরি এক প্যাকেট সাবান উপহার দেন। উপহারটি দেখেনতুন বুদ্ধি আসে মহারাজের মাথায়। তিনি স্থির করেন, মহীশুরেই প্রাকৃতিক চন্দন তেল ব্যবহার করে সাবান তৈরি করবেন।
দক্ষ শিল্প-রসায়নবিদ এসজি শাস্ত্রিকেলন্ডন পাঠালেন তিনি সাবান ও সুগন্ধি প্রযুক্তির ওপর উন্নততর প্রশিক্ষণ নিতে। তার এই পদক্ষেপ ছিল এক নতুন যুগের সূচনা। কারণ লন্ডন থেকে শাস্ত্রির ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গে জন্ম নেয় ভারতের প্রথম চন্দন সাবান।
মহীশুর স্যান্ডাল সোপ নামে একে বাজারে ছাড়া হয়। সাবানটি এমনই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে, গোটা ভারতবর্ষের ঘরে ঘরে ব্যবহার হতে থাকে এটি। একসময় রফতানিতেও শীর্ষ পণ্যগুলোর তালিকায় ঠাঁই করে নিয়েছিল এ সাবান।
বিশ্বের একমাত্র প্রাকৃতিক চন্দন তেল সমৃদ্ধ সাবান হিসেবে এটি বিপণন করা হয়।
ব্যাঙ্গালোরের কাবন পার্কের কাছে সরকারি সাবান কারখানা স্থাপন করেছিলেন মহীশুরের মহারাজা। ১৯৫৭ সালে রাজাজি নগর নামের নতুন শিল্পনগর প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর সাবান কারখানাটি বর্তমান জায়গায় উঠে আসে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীনকারখানাটির বর্তমান নাম কর্ণাটক সোপস অ্যান্ড ডিটারজেন্টস লিমিটেড।
রমরমা অতীত পেছনে ফেলে এলেও, এই কারখানাগুলো এখনও চন্দন তেলের সাবান তৈরি করে। গৌরবমণ্ডিত অতীতের গন্ধ আজও বাতাসে ভেসে বেড়ায় এ সাবানের সুগন্ধের সঙ্গে।