জীবনকর্ম: ডিন কুন্টজের সাক্ষাৎকার
ডিন কুন্টজের নামে সুনাম আছে যে, উনি প্রচুর লিখতে পারেন। তাঁর প্রায় ১২০টি বই বেস্ট সেলার লিস্টের উপরের সারিতে ছিল। শৈশবে কষ্টের সময় বই ছিল তাঁর একমাত্র আশ্রয়স্থল। সেই জন্য তিনি সপ্তাহে ৬দিন সকাল সাড়ে ছয়টা থেকে রাতে খাবারের সময় পর্যন্ত বই আর লেখালেখি নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। তিনি বিভিন্ন ধরণের চরিত্র ও আলাদা জগৎ তৈরি করেছেন তাঁর পাঠকদের জন্য।সাক্ষাতকারটি প্রকাশিত হয়েছে হার্বাড বিজনেস রিভিউতে, মার্চ-এপ্রিল ২০২০ সংখ্যায়।
আপনি এত স্ট্যামিনা আর সৃজনশীল শক্তি কোথা থেকে পান?
ডিন কুন্টজ: ছোটবেলায় কোন বইগুলো আমার কাছে অর্থবহ ছিল সেইসব কথাই স্মরণ করিয়ে দেয় আপনার প্রশ্নটি। আমি খুব গরীব পরিবারের সন্তান। বাবা ছিলেন ভয়ংকর রকমের মদ্যপ। বই ছিল আমার কাছে বাঁচার একমাত্র রাস্তা। অন্যদের জীবনযাপন যে আলাদা তা আমি বই পড়েই শিখেছি। বিশ্ব তাদের সাফল্যের যে স্থানে নিয়েছে তা আমি স্বচক্ষে দেখেছি। এবং এইগুলোই আমার ভাগ্য পরিবর্তনের চাবিকাঠি। আমি মনে করি, আপনি যা চান সেই অনুযায়ী কাজ করলে তা পাবেনই, এবং মনে হয় না, এইভাবে ভাবা কোনোদিন বন্ধ করে দিব। বই এবং বইয়ের সম্ভাবনা নিয়ে উৎসাহিত হওয়া কখনো বোধহয় বন্ধ করতে পারব না।
তাহলে কখনো এমন সময় আসে নি, যখন আপনি ভেবেছেন, আমার দ্বারা এইসব আর সম্ভব নয়?
ডিন কুন্টজ: যদি আমি সব সময় একই টাইপের বই লিখতাম, মূলত প্রকাশকরা যা চায় আরকি, তাহলে নিশ্চিতভাবেই সবাই কিছুদিন বাদে আমাকে নিয়ে উপহাস করত। ব্যবসাটা আসলে একটি সূত্রের মাধ্যমে পরিচালিত হয়- আপনি যদি একটি বই রাজমিস্ত্রী নিয়ে লেখেন, তারাও আপনাকে আরো ১০০০ বই রাজমিস্ত্রী নিয়েই লিখতে বলবে- কিন্তু আমি প্রতিনিয়ত লেখার বিষয় পরিবর্তন করেছি। এমনটাই যে করতে হবে আমার পরামর্শ কিন্তু এটা নয়, এমনকি বিভিন্ন ধারায় লিখতে হবে তাও নয়, বিভিন্ন ধরণের গল্প বলতে হবে তাও না। আসলে আমি যে ব্যাপারটা ধরতে পেরেছিলাম তাহল, আগের যে বইটি সবাই হুড়মুড়িয়ে কিনেছে এবং পাঠ-আনন্দ পেয়েছে, আবারও সেই একই ধরনের বই বাজারজাত করা আরও কঠিন। অন্যদিকে, একটানা যেকোনো কাজ করলেই একঘেয়েমি চলে আসতে পারে, তাই কাজে পরিবর্তন আনতে হবে, এমন কিছু করতে হবে যা আগে কখনও করেন নি, হয়তো এতে আপনি আতঙ্কিত হয়ে পড়তে পারেন, ভাবতে পারেন এ কাজটায় সফলতা হবেন না। আমি কিন্তু এসব ভেবেই একই জিনিস করা থেকে বিরত থাকি। যখন একটা আইডিয়া মাথায় আসে, মনে হয় লেখাটা আমার জন্য জটিল হয়ে যাবে এবং পাঠকদের বোঝানোও দুষ্কর হবে, সেই সময়ে আমি আরো বেশি উৎসাহী হয়ে লিখি। একঘেয়েমির বিরুদ্ধে এটা হল আমার কাছে ওষুধ। মূলত এটা টিকা নেওয়ার মত কাজ করে।
সৃজনশীল ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষেত্রে সঠিক মূল্যায়ন কীভাবে করেন?
ডিন কুন্টজ: বহু বছর আগে দ্য ব্যাড প্লেস নামে একটি বই লিখেছিলাম, সেখানে টমাস নামে একটি চরিত্র ছিল, চরিত্রটার ছিল ডাউন সিনড্রম। আমার এজেন্ট পাণ্ডুলিপি পড়ে আমাকে ডেকে বলল, 'টমাস চরিত্রটা সত্যিকার জিনিয়াস। আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না তুমি এইরকম একটা চরিত্র নিয়ে কাজ করেছে।' এবং আমি তখন বললাম, 'আপনি জানেন, আমি যেকোনো চরিত্রের ভিতরে ঢুকে কাজ করতে স্বচ্ছন্দবোধ করি। ডাউন সিনড্রম আছে এমন চরিত্র নিয়ে সম্পূর্ণ একটা উপন্যাস লেখার ইচ্ছা আমার আগে থেকেই ছিল।' সে আধা মিনিট চুপ করে থেকে তারপরে বলল, 'আসলেই এই ব্যাপারটা খুবই চাঞ্চল্যকর।' কিন্তু আমি মনে করি, আপনি যেকোনো কিছুই করতে পারবেন যদি আপনি চান। ভাষা খুব সাবলীল এবং সুশ্রী রাখাও লেখকদের একটি টেকনিক।
আপনি তো শুরুতে ছদ্মনামেই লিখতেন। কখন বুঝলেন এবার আসল নামে লেখার সময় হয়েছে?
ডিন কুন্টজ: প্রথমদিকে, আমি চাইতাম একটু আলাদা কিছু করতে, বেশির ভাগ সময় তাই করতাম, তখন এজেন্ট এবং প্রকাশকরা বলেছিল, 'আপনার উচিত ছদ্মনামে লেখা।' আমি কিছুটা সরল ছিলাম, তো, তাই করলাম। তারপরে ধীরে ধীরে দেখলাম যে, আমার নিজের নামে লেখা বইগুলোর চারপাশে কি হচ্ছে। যদিও আমি বেস্টসেলার লেখক ছিলাম না, কিন্তু সপ্তাহে আমার নামে ৩০ বা ৪০টি চিঠি আসত। সেইজন্য ৭০ দশকের শেষে এবং ৮০ দশকের শুরুর দিকে আমি এবং আমার স্ত্রী চিন্তা করলাম ছদ্মনামে যেগুলো লিখেছিলাম সেগুলো নিজের নামে কিনে নেব। আমি সেগুলোর ব্যাপারে বিস্তারিত সবাইকে বলতে লাগলাম, তখন অন্যান্য লেখকেরা ভাবল আমি পাগল হয়ে গেছি। প্রকাশকরা তো সেগুলো আমাকে বিক্রি করতই, কিন্তু সমস্যা হচ্ছে তারা তো আগেও আমাকে সম্মানী দিয়েছিল, তাহলে দাঁড়াল যে, বইগুলোতে আমার তেমন অধিকার নেই। কিন্তু দুইটি কারণে আমরা ওই কাজগুলো করেছিলাম।
প্রথমত, আমি অনেকগুলো সায়েন্স ফিকশন উপন্যাস লিখেছিলাম, এবং আমরা জানি সেগুলো যদি প্রিন্ট হতেই থাকে, তাহলে সমালোচকদের কাছে আমি শুধু সায়েন্স ফিকশন লেখক হিসেবেই থাকব। একবার যদি তারা আপনাকে কোনো ব্যাপারে ট্যাগ দিয়ে দেয়, তাহলে সেটা অতিক্রম করতে আপনার বহু সময় লাগবে। তাই অন্য টাইটেলগুলো নিজের করার জন্য বইগুলো কিনে নেই এবং সমালোচকদের ভয়টাও মন থেকে সরে যায়।
দ্বিতীয়ত, আমরা চিন্তা করছিলাম যে, অন্যান্য বইগুলোর মূল্যও বেড়ে যাবে, যদি আমি বেস্টসেলার লেখক হিসেবে স্বীকৃতি পাই। আমার এই মুহূর্তে একটি ঘটনার কথা মনে পড়ছে, আমরা এক প্রকাশকের কাছে যাই, যার কাছে আমার চারটি বই আছে। সেগুলোও আমি ছদ্মনামেই লিখেছিলাম। তাকে বলি বইগুলো কিনে নেব। তারই দুর্ভাগ্য কিনা জানি না সে সেদিন নীচু মনের পরিচয় দিয়েছিল, কিন্তু আবার বলেছিল, 'নিয়ে যান, এইগুলো আপনার কোনো কাজেই লাগবে না। রদ্দি জিনিস।' এভাবে আমাদের খানিকটা অপমানই করল। আমরা তখন তাকে ধন্যবাদ দিয়ে চলে আসি। এবং বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, সেখানকার প্রথম বইটি আমার নিজের নামে প্রকাশ করি এবং অবিশ্বাস্য সাফল্য পাই। নিউইউর্ক টাইমস বেস্টসেলার লিস্টে প্রথম ছয় সপ্তাহ এক নাম্বারে অবস্থান করেছিল। তখনই মনে হল আমি ঠিক আছি। আমার প্রবল আগ্রহের কারণেই এমনটা সম্ভব হল। এটা কোনো ভুল ছিল না। তারপরে ধীরে ধীরে আমার বইয়ের বিক্রি বাড়তেই লাগল এবং সমালোচকরাও আমার প্রতি মুগ্ধতা দেখাতে শুরু করল।
যখন আপনার একটি বই পাঠকপ্রিয় হয়, তখন কি আবারও বেস্টসেলার হওয়ার কোনো চাপ থাকে?
ডিন কুন্টজ: হার্ডকভারে প্রকাশিত বই মিডনাইট, এই বইটিই বেস্টসেলার লিস্টের নাম্বার ওয়ানে ছিল অনেকদিন। এবং এটিই আমার প্রথম বই, যা নাকি হার্ডকভারে প্রকাশ হওয়ার পরেও বেস্টসেলার হয়। আমার প্রকাশক একদিন ফোন দিয়ে বলে, 'আপনার জন্য দারুণ খবর আছে।' কিন্তু আমি 'হুররে' বলার আগেই সে আবার বলে, 'এটা নিশ্চয় আপনি বুঝতে পেরেছেন যে: আপনি এমন কোনো বই আর লিখতে পারবেন না যে ওই বই আবারও বেস্টসেলার লিস্টের নাম্বার ওয়ানে থাকবে, কাজেই এরকম ঘটনা আর ঘটবে না।' বেস্টসেলার হওয়ার খবরে প্রথমে যেটুকু খুশি হয়েছিলাম এক নিমিষে তা বেলুনের মত চুপসে গেল। তবে কি, এরপরে পরপর চারটি বই-ই নাম্বার ওয়ান হল এবং প্রকাশক ফোন দিয়ে প্রত্যেকবার একই কথা বলেন। কাজেই, আমি তখন আর চাপ নিয়ে লিখিনি, নিজের মত করে লেখে গেছি। বরং বলতে পারেন নিজেকে বারবার সফল হিসেবে প্রমাণ করে গিয়েছি। শেষে এটা বলতে চাই, 'আমি আসলে এমন জায়গায় যেতে চেয়েছি যে, যাতে তারা মনে করে আমি একই ঘটনা বারবার ঘটাব।'
সম্পাদকের সাথে কাজের ক্ষেত্রে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কোনো ঝামেলা?
ডিন কুন্টজ: একসাথে ভাল কাজ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রকাশক এবং সম্পাদকের ব্যাপারে খুব উচ্ছ্বসিত ছিলাম, কিন্তু পরে দেখলাম আমি সম্পাদকীয় কমিটি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। সেখানকার পরিস্থিতিটাই সব সময়ই অন্যরকম। সব ধরণের মন্তব্য নিয়েই তারা একে-অন্যের সঙ্গে বিরোধিতা করে। তবে সম্পাদকের সাথে আমার সম্পর্কটা ভালই ছিল, আমি ভাগ্যবান। এবং তাকে আমি শ্রদ্ধা করতাম। আমি এটাও জানি এমন কিছু লেখক আছেন যারা অন্যের দিকনির্দেশনা নিতে চান না। আমিও আমার নিজেরটা করতেই ভালবাসি, আমি প্রতি পৃষ্ঠা ২০ থেকে ৩০ বার রিরাইট করি।
তাহলে বুঝতেই পারছেন, আমি একটি পরিচ্ছন্ন পাণ্ডুলিপি বানাতে চাই। আমি জানি একজন ভাল সম্পাদক সব সময়ই আমার ভুলগুলো শুধরানোর চেষ্টা করে। আমার চিন্তাগুলোকে আরো গোছালো করতে সাহায্য করে। মুক্তমন নিয়ে কেউ কথা বললে, তার কথা না শুনে থাকা যায় না। 'হ্যাঁ, এটা আমি পারব।' অথবা 'না, আমি পারব না।' আপনি একটি কাজ কেন করছেন, তার ব্যাখ্যা করতে আপনি তার কাছে বাধ্য। আপনি যদি তার সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন, তাহলে এটাই পরিষ্কার হবে যে, আপনি কাজটি সঠিক ভাবেই করেছেন। এখন, আমার স্ত্রীই আমার সবচেয়ে কঠোর সমালোচক। যখন সে কিছু পড়ে এবং তার কাছে সমস্যা মনে হয় সেটাকে তখনই আমি গুরুত্বের সাথে দেখি। যদি তার পড়ে কোনো সমস্যা না হয়, তাহলে আমি আত্মবিশ্বাসী বোধ করি।
আপনার স্ত্রী তো আপনার পেশাগত জীবনে বিরাট ভূমিকা পালন করেছেন। একসাথে থাকা এবং কাজ করা একটু কঠিন?
ডিন কুন্টজ: আমি এমন অনেক লোকদেরকে চিনি যারা মনে করেন বিবাববিচ্ছেদই একমাত্র রাস্তা। কিন্তু দেখেন, বাড়িতে আমাদের অফিস একেবারে পাশাপাশি, সুতরাং চব্বিশ ঘন্টাই এক বাড়িতে। এরকম ছাড়া, আমি অন্যকিছু কল্পনাও করতে পারি না্। আমাদের বিয়েটা খুব ভালভাবে টিকে যাওয়ার কারণ হল, আমরা দুইজনের একই রকম রসবোধ সম্পন্ন।
আমরা দুজনেই জানি জীবনে প্রায় কিছুই নেই। আগেও ছিল না। দেখেন, আমার কাজ থেকে ওর কাজ সম্পূর্ণ আলাদা। তাই আমরা একটি গোলকধাঁধার ভিতরে অটোমেটিক ফিট হয়ে গেছি। আমি সম্ভবত গত এক বছরে একটিও চেক লিখিনি। গত ৫০ বছরেও খুব বেশি না। কখনও কখনও চেকবুকের ভারসাম্যই রাখতে পারি না। তাই সেগুলো আমার থেকে দূরে থাকে। অন্যকিছুতে মনোযোগ দেওয়ার চাইতে নিজের কাজে মনোযোগ দেওয়াই গুরুত্বপূর্ণ মনে করি।
আপনার বইগুলো দিনকে দিন সাহিত্য হিসেবে বেশি মূল্যায়িত হচ্ছে, কিন্তু সেগুলো ইতিমধ্যে সাহিত্যগুণ সম্পন্নই।
ডিন কুন্টজ: আমি তো প্রথমে পেপারব্যাক দিয়ে শুরু করেছিলাম। আর এই বাজারটার মূল ব্যাপারই হচ্ছে বিনোদন দেওয়া। কিন্তু আমি চিন্তা করেছিলাম এটার অন্য কোনো পথও আছে। ডিকেন্সের লেখায় পাঠক নিশ্চয় বিনোদিত হয়, একই সাথে তিনি আবার লিটারেরি। আমি সব সময় ভাষাকে বেশি ভালবাসতাম, কিন্তু দিনকে দিন এই ভালবাসাটা আরো বেড়ে গেল এবং আমার বইগুলোও পরিবর্তন হতে থাকল। আমাকে বহুবার বলা হয়েছে কম শব্দ দিয়ে লিখে ফেলতে, তারা চেয়েছিল আমি পাঠকদের আবদ্ধ রাখি। কিন্তু আমি বুক সাইনিং এর সময় যেসব চিঠিপত্র পেয়েছি, আমি দেখেছি আমার পাঠকেরা আমার ভাষায় ঠিকই ঢুকতে পেরেছে। তাই, আমি জানি আমি কাদের জন্য লিখছি।
যখন আমি তরুণ লেখক ছিলাম, তখন চিন্তা করতাম লেখার হয়তো কিছু কৌশল আছে এবং আপনি যখন সেগুলো জেনে যাবেন বই লেখাও আপনার জন্য সহজ হয়ে যাবে। কৌশলের কোনো শেষ নেই। কিন্তু বইগুলো জটিল হয়ে যায় তখনই যখন ওই কৌশল ঠিক মতো প্রয়োগ হয় না। একটা কৌশলও যদি আপনি না জানেন তাহলে লেখা আরও কঠিন হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে ভাষাকে নমনীয় রাখা উচিত। এটাকে নিয়ে আপনি যেভাবে খুশি খেলতে পারবেন, কিন্তু আপনি যখন বুঝবেন যে জিনিসটা পার্ফেক্ট হচ্ছে না তখন আপনি হতাশ হবেন। আপনার মাথায় যখন কোনো আইডিয়া আসবে, আপনি উত্তেজনা বোধ করবেন, কিন্তু সত্যি বলতে কি এটা আপনি যতক্ষণ না ঠিকঠাক লিখতে পারবেন ততক্ষণ পর্যন্ত আসলে কিছু ঘটেনি।
একটা গল্প বা চরিত্র প্রাথমিক ধারণা থেকে কিভাবে এগিয়ে যায়, সেই ব্যাপারে কিছু বলেন?
ডিন কুন্টজ: আমি আউটলাইন তৈরি করে লিখি। কিন্তু যখন আমি স্ট্রেঞ্জারসবইটি লিখি, যেটি শেষ হয়েছিল অনেকগুলো চরিত্র নিয়ে এবং প্রায় আধা মিলিয়ন শব্দ লিখেছিলাম, সেটাতে আমি আগে থেকে কোনো আউটলাইন করে লিখিনি, চেয়েছিলাম প্রথম লাইন দিয়ে শুরু করব এবং কয়েক জোড়া চরিত্র নির্মাণ করব। সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম ব্যাপারটা ছেড়ে দেব, এবং এই সিদ্ধান্তটা ছিল সঠিক। তারপর থেকে আমি আর কোনোদিন আউটলাইন করে লিখিনি।
আমি প্রথমে ছোট কোনো আইডিয়া থেকে কাজ শুরু করি, একটি মূল থিম থাকে, পরিষ্কার থাকে, এবং তারপরে সেটা নিয়ে ভাবতে শুরু করি- সপ্তাহ বা মাস নয়, কয়েকদিন বলতে পারেন এবং তারপরেই মূল লেখা শুরু করি। যদি প্রথম বিশ পেইজে প্রধান চরিত্রটা ফুটিয়ে তুলতে না পারেন, তাহলে ওই লেখাটা বন্ধ করে দেওয়াই উচিত। যদি চরিত্রটা বেঁচে যায়, তাহলে চরিত্রটিকে আমি ইচ্ছামত চলতে দেই। এটা তরুণ লেখকদের জন্য খুবই জটিল একটি কাজ। আপনি নিজেকেই বলেন চরিত্রটা আসলে কে এবং চেষ্টা করেন চরিত্রটাকে বুঝতে। যদি আপনি চরিত্রটিকে মুক্ত করে দেন, তাহলে চরিত্রটি আরো রিচ হবে, স্তরপূর্ণ হবে এবং আরো বেশি ইন্টারেস্টিং হয়ে উঠবে। এটা কিছুটা অদ্ভূত, কিন্তু এটাই সত্য। চরিত্রই সবকিছু নিজের হাতে নিয়ে নেবে, তারা আরো ভাল জায়গায় আপনাকে নিয়ে যাবে, তারা যেদিকে যাবে, সেদিকেই আপনাকে যেতে হবে। আমি মাঝে মধ্যে প্লটটার সমাপ্তি বা কেন্দ্রস্থল বা এলোমেলোভাবে কিছু কিছু জানি, তবে আমি আসলে খুব বেশি জানি না।
আমার মনে আছে, ফেইস নামে একটি বই নিয়ে কাজ করছিলাম, তখন কাজের মাঝামাঝি সময়ে মাথায় একটি লাইন এলো: 'আমার নাম অড টমাস। আমি একটি অস্বাভাবিক জীবনযাপন করি।' মনে হচ্ছিল কারো কথা শুনে আমি এই কাজটি করছিলাম, তখন এটিকে আমি গল্পের সূচনা হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিলাম। বিভিন্ন তথ্যউপাত্ত টুকে রাখার জন্য আমি একটি হলুদ রেখাযুক্ত নোটপ্যাড রাখি এবং সেইখানেই আমি লাইনটি লেখেছিলাম। যদিও কোনোকিছুই আমি দীর্ঘক্ষণ লিখি না, কিন্তু তখন নিজেকে লেখায় ব্যস্ত দেখলাম এবং কয়েক ঘন্টা টানা লেখার পর থামলাম, আমার কাছে অড টমাস বইয়ের প্রথম অধ্যায় ছিল। আমি জানতাম যে, এটি সিরিজ হবে, যদিও এর আগে কখনও সিরিজ লিখিনি। এবং আমি দীর্ঘ সময় বসে ভেবেছি, 'এই চরিত্রটা কই থেকে এসেছে?' আজ অবধি আমি তা জানি না। কিন্তু আমি টমাসকে নিয়ে আটটি বই লেখা হয়ে গেছে।
একটি আদর্শ কর্মমুখর সপ্তাহ আপনার কাছে কেমন?
ডিন কুন্টজ: আমি সাধারণত ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠি। দিনের জন্য প্রস্তুতি নেই। কুকুরটিকে হাঁটাই। ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল পড়ি। সাড়ে ছয়টায় আমি ডেস্কে বসি এবং একটানা রাতের খাবারের আগ পর্যন্ত কাজ করে যাই। খুব কমই দুপুরে খাবার খাই। কারণ যদি আমি খাই, তাহলে আমার মনোনিবেশ ঠিক থাকে না। আমি সপ্তাহে ছয়দিনই এভাবেই কাজ করি, আর যদি কোনো বইয়ের শেষ পর্যায়ে থাকি তাহলে সাতদিনই লিখি। আবার এটি যদি কোনো বইয়ের শেষ চতুর্থাংশ হয়, তাহলে আমার গতি আরো বেড়ে যায়, আমি তখন সপ্তাহে ১০০ ঘন্টা কাজ করি। এটা আমার জন্য খুবই সাধারণ ব্যাপার, কারণ যখন ১০ ঘন্টা বা তারও বেশি সময় ধরে স্ক্রিনের সামনে বসে থাকি তখন দুনিয়া থেকে আমি বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই, এবং সম্পূর্ণ উপন্যাস একটানে পড়ে শেষ করার চেষ্টা করি। আবার কখনও কখনও আমি এমন কোনো দৃশ্যে থাকি দেখা যায় নিজ থেকে হাসি, অশ্রুতে সঞ্চারিত হই। আমার অফিসের দরজা কাছ দিয়ে হেঁটে যাওয়া লোকজন ভাবে আমি পাগল হয়ে গেলাম নাতো।
পারফেকশনিস্ট হিসেবে আপনি প্রতিনিয়তই সংশোধন করতে থাকেন, আসলে আপনি কিভাবে নিশ্চিত হন যে আরো উন্নতি করার সুযোগ রয়েছে?
ডিন কুন্টজ: আমি জানি না, ব্যাপারটা অন্য কারো ক্ষেত্রে কিভাবে কি হয়? প্রত্যেকবার যখন আপনি কোনো পৃষ্ঠার মধ্য দিয়ে যাবেন, আপনি খেয়াল করবেন আপনার মাথায় এই ভাবনা কাজ করবে, কিভাবে আরো স্পষ্ট করে বক্তব্য ছবির মতো উপস্থাপন করা যায়। এবং প্রত্যেকবারই নতুন কিছু বলার সুযোগ পাচ্ছেন। এবং এটির গতিও মাথায় থাকছে। প্রতিদিন ১০ পৃষ্ঠা গল্প না লিখে, বরং ওটার মান বাড়াতে সম্পাদন করুন। মূলত এই ব্যাপারটা আপনাকে কিছুটা ধীর করে দিলেও আপনি ৩০ বা ৪০ পেইজে গিয়ে কোনো না কোনো সমস্যা পেয়েই যাবেন। গতি নিয়ে যদিও বেশি সমস্যা নেই, তবে আমি যখন ওই মুহূর্তে পৌছে যাই, তখন এটিকে সমাধান করার জন্যও আমার কাছে দুটি বা তিনটি উপায়ও পেয়ে যাই, এবং সেগুলো নিয়ে তেমন আমি চিন্তিত হবা না। অন্যান্য লেখকরা কিন্তু এইভাবে করে না। কিন্তু তারাও কোনো না কোনো সমস্যার বিরুদ্ধে দাঁড়ায়, তাদের পদ্ধতি নিশ্চয়ই আলাদা। অনেকেই আবার রাইটারস ব্লকে পড়েন। আমি কখনই ওইসবের ধারেকাছে যাই না। আমি মনে করি, দুনিয়ার সব কাজ কোনো না কোনো পদ্ধতির মধ্য দিয়ে করা উচিত।
প্রকাশনার বড় পরিবর্তন হয়েছে আপনি সফলভাবে এ পরিবর্তনে সাড়া দিয়েছেন।
ডিন কুন্টজ: আমি এমন কিছু ঘটনা দেখেছি যা প্রকাশকরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না আবার এমন কিছু ঘটনা দেখেছি যা তারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। তবে আমি প্রকাশকদের প্রয়োজনের কথা ভেবে কখনও লিখিনি।
এক সময় পেপারব্যাকগুলির ৫০০টি বিতরণকারী ছিল, কিন্তু এখন চার বা পাঁচটিতে নেমে এসেছে। প্রচুর প্রকাশক কখনই ইবুকের উত্থানকে ভাল চোখে দেখে নি। গত বছর, আমার এজেন্টরা যুক্তি দিয়েছিল যে আমি অন্য কারো চেয়ে আমাজনে বেশি বই বিক্রি করতে পারব। এবং মূলে ছিল বিপণন। আমরা আটজন প্রকাশকের কাছে গিয়েছিলাম, তাদের মধ্যে কয়েকজন মাত্র এক পৃষ্ঠার একটা বিপণন পরিকল্পনা নিয়ে এসেছিল। কয়েকজন আট কিংবা দশ। কিন্তু অ্যামাজন পরিকল্পনা দিল ৩০টির মতো। সবই চিত্তাকর্ষক এবং চিন্তাশীল। সুতরাং আমি আমার পাঁচটা বইয়ের জন্য একটা চুক্তি কিন্তু অনেকেই, এমনকি স্বাধীন বই বিক্রয়কারীরাও আমাকে জানিয়েছে, এটা দুর্দান্ত একটা কাজ হয়েছে।
আপনি নিজে নিজে অনেক কিছু রপ্ত করেছেন, ব্যাপারটা আসলে কি ছিল?
ডিন কুন্টজ: হাই স্কুল এমনকি কলেজগুলিতেও আমি কুড়ে ছিলাম না। আমি সব বিষয়ই নিয়েই পড়তে চেয়েছি, পড়েছিও। তবে শিক্ষকরা যেসব কাজ দিতেন আমি সেসব না করে তার চেয়েও গুরুত্ব দিয়ে অন্যান্য বিষয়ের বই পড়তাম। আমি প্রায়ই নকল রিপোর্ট জমা দিতাম। সংশ্লিষ্ট বই তো পড়তাম না, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শুধু শিরোনামগুলো গ্রন্থণা করতাম। এবং আমি কখনও ধরা খাই নি। যখন সায়েন্স ফিকশন এবং ফ্যান্টাসি লিখেছি তখন আমার সায়েন্সের ব্যাপারে প্রাথমিক কিছু বিষয়ে বৈজ্ঞানিক জ্ঞান থাকতে হয়েছিল, তবে আমি বেশির ভাগই নিজে থেকে বানাতাম। সমসাময়িক কথাসাহিত্যে আপনি এইরকম কিছু পেয়েছেন কিনা আমি জানি না। আমি পাঠকদের কাছ থেকে কোনো চিঠি পেতে চাই নি। লিকতে গিয়ে প্রায়ই আমি গবেষণা শুরু করে দিয়েছি, এবং বিস্ময়ের সাথে দেখতাম যে, নতুন কিছু শিখে এবং সেটাকে গল্পের অংশ করতে পারাটা দারুণ খুশির ব্যাপার। আমি কোয়ান্টাম মেকানিক্সের মতো বেশ কিছু জটিল বিষয়ে আগ্রহী হয়েছিলাম এবং দেখলাম আমি যতবেশি জেনেছি, আমি তত বেশি গল্পের নতুন নতুন আইডিয়া পেয়েছি।
আমি এক জায়গায় পড়েছি যে, আপনি কিছু গবেষক রেখেছেন, কারণ আপনি কখনো লেখায় বিরতি পড়তে দিতে চান না। এটা কি সত্যি?
ডিন কুন্টজ: অফিসে লেখার সময়ে আমি অনলাইনে যাই না। যদি ঢুকি, তাহলে পাঁচ ঘন্টা কাজের পরে। আর খুব অল্প সাইটে ঢুকি। তবে আমার সহায়করা অনলাইনে রয়েছে, তাদেরকে আমি বলি এটা খুঁজে দেন, ওটা খুঁজে দেন। তারা খুঁজে বের করে প্রিন্টআউট আমার কাছে দিয়ে যায়। অথবা আমি তাদের সাথে গিয়েও বসি কখনও কখনও। তবে মূল গবেষণাটা আমি নিজেই করি।
কখনও লেখালেখি ছেড়ে অবসর নেওয়ার চিন্তা করেছেন?
ডিন কুন্টজ: লেখালেখি ছাড়া আমি কি করব, জানি না। এটাই কাজ, এটাই আমি। এটা আমি ভালবাসি। আমার আধ্যাত্মিক দিক আছে। আমি মনে করে এই ট্যালেন্টটা অনুগ্রহ, একটি অসাধারণ উপহার।
অনুবাদ: হুমায়ূন শফিক