জীবনানন্দের চিঠি তাঁর আত্মজীবনীর খসড়া

দ্বিজাতিতত্ত্ব কিংবা আরও পরিস্কার করে বললে ধর্ম, তথা মুসলান ও হিন্দুত্ববাদের ওপর ভর করে উনিশশো সাতচল্লিশে দেশ ভাগের বছর খানেক আগে ১৯৪৬ সালের ২ জুলাই বরিশালের সর্বানন্দ ভবন থেকে সুহৃদ প্রভাকর সেনকে ব্রজমোহন কলেজের তৎকালীন অধ্যাপক, কবি জীবনানন্দ দাশ যে নাতিদীর্ঘ চিঠি লেখেন, সেটিকে এ যাবত উদ্ধার হওয়া তাঁর চিঠিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করা যায়। কেননা, এই চিঠিখানা তাঁর ছোটখাট আত্মজীবনী—যেখানে তৎকালীন পূর্ববঙ্গের একটি মফস্বল শহরের একজন ইংরেজির অধ্যাপকের জন্ম-পরিচয় বয়ানের পাশাপাশি লেখক হিসেবে নিজের ব্যর্থতা, সীমাবদ্ধতা ও হতাশা স্পষ্ট। যদিও জীবনানন্দের জন্ম সাল ও তারিখ নিয়ে আজও যে কিছুটা বিভ্রান্তি রয়েছে, এই চিঠি সেই বিভ্রান্তি বা ধোঁয়াশা আরও বাড়িয়েছে।
প্রভাকর সেনকে লেখা এই চিঠিতে নিজের জন্মপরিচয়ে জীবনানন্দ লিখেছেন, 'আমার জন্ম হয়েছিল বরিশালে ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দে ফাল্গুন মাসে। পড়েছিলাম বিএম স্কুল ও বিএম কলেজ, প্রেসিডেন্সি কলেজ, ইউনিভার্সিটি ও কলেজে। শেষ পর্যন্ত আইন পরীক্ষা দেওয়া হয়নি। অধ্যাপনা করেছি কলকাতার সিটি কলেজ, দিল্লির এক কলেজ, বরিশাল বিএম কলেজে। আরও ২/৪ রকম কাজ করেছি ফাঁকে ফাঁকে। এখনও অধ্যাপনাই করতে হচ্ছে। কিন্তু মনে হয় এ পথে আর বেশিদিন থাকা ভালো না।'
এই চিঠি লেখার মাস দুই-তিন পরে পাকাপাকিভাবে কলকাতায় গিয়ে জীবনানন্দ প্রথমে যে চাকরিটা নেন, সেটি শিক্ষকতা ছিল না। বরং তিনি চাকরি নেন স্বরাজ নামে একটি পত্রিকার রবিবাসরীয় বা সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে। যদিও চাকরিটা বেশিদিন করতে পারেননি। ঘুরেফিরে আবার তাকে শিক্ষকতায়ই ফিরতে হয় এবং আমৃত্যু এই পেশাতেই ছিলেন। যদিও শিক্ষকতার প্রতি তার একধরনের বিরক্তি বা খেদও যে ছিল, তা প্রভাকর সেনকে লেখা ওই চিঠিতে স্পষ্ট। তার ভাষায়, 'যে জিনিস যাদের যেভাবে শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে সবই অসাড়তার নামান্তর নয় কি?' ফলে তিনি এই 'অসাড়তা' থেকে মুক্তি চেয়েছিলেন। কিন্তু মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাকে এই 'অসাড়তা'র ভারই বহন করতে হয়েছে। যে কারণেই হয়তো 'সৃষ্টির তীরে' কবিতায় লিখেছিলেন, 'মানুষের হাতে আজ মানুষ হতেছে নাজেহাল, পৃথিবীতে নেই কোনো বিশুদ্ধ চাকরি।'
জীবনানন্দের জন্মতারিখ নিয়ে কিছুটা বিভ্রান্তি এখনও রয়ে গেছে। বিশেষ করে তার জন্মতারিখটা ১৭ নাকি ১৮ ফেব্রুয়ারি—এ নিয়ে। প্রথম দিকে তার জীবনীকার ও গবেষকরা ১৮ ফেব্রুয়ারি উল্লেখ করলেও পরবর্তীকালে ১৭ ফেব্রুয়ারি মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। ১৮৯৯ নাকি ১৮৯৮—এ নিয়ে বিভ্রান্তি থাকলেও ১৮৯৯ সালের ব্যাপারে গবেষকরা পরবর্তীতে ঐক্যমতে পৌঁছান। এই বিভ্রান্তি এড়ানো যেতো, যদি জীবনানন্দ নিজে প্রভাকর সেনকে লেখা এই চিঠিতে তারিখটি উল্লেখ করতেন। তিনি লিখেছেন, ১৮৯৯ সালের ফাল্গুন মাসে। অর্থাৎ সাল লিখেছেন ইংরেজিতে, কিন্তু মাস বাংলায়। যদিও ইংরেজি তারিখটি নিয়ে বিভ্রান্তি বা ভিন্নমত থাকলেও বাংলা তারিখের ব্যাপারে সবাই একমত, সেটি হলো ৬ ফাল্গুন ১৩০৫। সুতরাং জীবনানন্দের জন্ম তারিখের ক্ষেত্রে বাংলা সন ও তারিখ ব্যবহার করাই শ্রেয়।

২.
বিখ্যাত লেখকদের ডায়েরি ও চিঠির প্রতি পাঠকের আলাদা আকর্ষণের বড় কারণ, এইসব ডায়েরি ও চিঠির মধ্য দিয়ে লেখকের ব্যক্তিসত্ত্বা, ব্যক্তিজীবন, ব্যক্তিগত আলাপচারিতা, জীবনবোধ ও ভাবনা—যেগুলো অনেক সময় তার কবিতা-গল্প-উপন্যাসে নাও আসতে পারে বা এলেও সেখানে বিমূর্ততা স্বাভাবিক, সেইসব বিষয় উঠে আসে। জীবনানন্দের চিঠিগুলোও আসলে তার আত্মজীবনীর খসড়া। এর মধ্য দিয়ে লেখক হিসেবে তার ভাবনা এবং ব্যক্তিজীবনের টানাপড়েনসমূহ জানা সম্ভব হয়।
এ যাবৎকাল তার যতগুলো চিঠি আবিষ্কৃত বা উদ্ধার হয়েছে, সংখ্যার বিচারে তা খুব বেশি নয়। আবার অনেককে চিঠি লেখার যে ফ্রিকোয়েন্সি, তাতে মনে হয় তিনি প্রচুর চিঠি লিখতেন। ফলে এ ব্যাপারে এখন এই উপসংহারে পৌঁছানোই সঙ্গত যে, আবিষ্কৃত চিঠির বাইরেও আরও অজস্র চিঠি হারিয়ে গেছে। হয়তো জীবনানন্দ নিজে সংরক্ষণ করেননি। আবার যাদেরকে লিখেছেন তাদেরও অনেকে হারিয়েছেন। অনেকে হয়তো সংরক্ষণের প্রয়োজনই বোধ করেননি। কারণ জীবিতকালে জীবনানন্দ খুব বেশি খ্যাতিমান ছিলেন না।
জীবনানন্দের অন্যতম জীবনীকার প্রভাতকুমার দাস এ পর্যন্ত ১৩১টি চিঠি উদ্ধার করতে পেরেছেন, যার মধ্যে ১১৭টি জীবনানন্দ লিখেছেন এবং বাকি ১৪টি জীবনান্দকে লেখা। তবে পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর জেলার খড়্গপুর কলেজে অধ্যাপনাকালীন কলেজের অধ্যক্ষ হিমাংশুভূষণ সরকার এবং সহকর্মী পুলিনবিহারী পালকে লেখা যে ৬টি পাওয়া গেছে, তার সবগুলো প্রভাতকুমারের বইয়ে (পত্রালাপ জীবনানন্দ দাশ, প্রকাশ: জানুয়ারি ২০১৭, এবং মুশায়েরা, কলকাতা) গ্রন্থভুক্ত হয়নি।
জীবনানন্দের পত্রপ্রাপকদের মধ্যে আছেন তাঁর মা কুসুমকুমারি দাশ, মেয়ে মঞ্জুশ্রী দাশ, বোন সুচরিতা দাশ, ভাই অশোকানন্দের স্ত্রী নলিনী চক্রবর্তী, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জীবনানন্দের আবিষ্কারক বুদ্ধদেব বসু, সুহৃদ সঞ্জয় ভট্টাচার্য, দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় প্রমূখ। মাকে লেখা মাত্র দুটি চিঠির হদিস পাওয়া যায়। যেগুলো লিখেছিলেন কলকাতার হার্ডিঞ্জ হোস্টেলে থাকার সময়। অর্থাৎ যখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন পড়তেন।
কলকাতা সিটি কলেজে শিক্ষকতার সময় এই কলেজের কাছেই ১৮/২/এ বেচ্যু চ্যাটার্জি স্ট্রিটের যে বাড়িতে কিছুদিন ভাড়া ছিলেন, সেখানে বসে লেখা একটি চিঠির সন্ধান পাওয়া যায়, যেটি লিখেছিলেন সুহৃদ অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তকে, ১৯২৬ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি। এই চিঠিতে অচিন্ত্যকে 'আপনি' বলে সম্বোধন করলেও পরবর্তীকালে সম্বোধনটি 'তুমি'তে নেমে আসে।
কবিতার মতো চিঠি লেখার ব্যাপারেও তিনি খুব সাবধানী বা খুঁতখুতে ছিলেন। যে কারণে ছোট বড় সব চিঠিরই খসড়া করে নিতেন। পরে ফাইনাল করে পাঠাতেন। উদ্ধারকৃত বা আবিষ্কৃত চিঠিগুলোর বেশ কয়েকটা এরকম খসড়া। অর্থাৎ শেষতক জীবনানন্দ হয়তো চিঠিগুলো পোস্ট করেননি।
বেশির ভাগ চিঠি তিনি লিখতেন সংক্ষিপ্ত, পোস্টকার্ডে, এবং সাধারণত প্রাপ্ত পত্রের উত্তর হিসেবে। আবার সেসব চিঠির ভেতরে নিজের মানসিক পরিস্থিতি, কর্মহীন বেকার জীবনের গ্লানি, নতুন কাজের সন্ধানে প্রিয়জনের কাছে বুদ্ধিপরামর্শ চাওয়া, কখনো মান-অভিমানের প্রসঙ্গও ছিল।
'ময়ূখ' জীবনানন্দ স্মৃতি সংখ্যায় সঞ্জয় ভট্টাচার্য লিখেছেন, 'চিঠিপত্রে অত্যন্ত অন্তরঙ্গ ছিলেন তিনি (জীবনানন্দ দাশ)। তাঁর চিঠি পেলে মনে হত, সব সময় তিনি কবিতার কথা ভাবেন। এমন তো কেউ ভাবে না—রবীন্দ্রনাথেরও অন্যান্য ভাবনা আছে—কিন্তু কবিতার দুর্ভাবনা ছাড়া কি এই ব্যক্তিটির (জীবনানন্দ) ভাববার মতো আর কিছু নেই। ভাবতাম, জীবনানন্দের চিঠি পড়তে পড়তে। কাব্যময় চিঠি নয়—কবিতা বস্তুটির জন্যে চিন্তা আর উৎকণ্ঠা থাকত তাঁরই চিঠিতে।' ফয়জুল লতিফ চৌধুরীর ভাষায় (জীবনানন্দ দাশের চিঠিপত্র, ফেব্রুয়ারি ২০১৫, অন্যপ্রকাশ), 'জীবনানন্দের চিঠিগুলিতে একজন আত্মবিশ্বাসী, সৌজনস্যসুন্দর এবং অকপট ব্যক্তিত্বের পরিচয় পাওয়া যায়, যিনি মানবিক সম্পর্কের ব্যাপারে আন্তরিক, যার সংযম ও পরিমিতিবোধ অগাধ, যার বিনয় অবিচল।'
৩.
এসব চিঠিতে জীবনানন্দের জন্মশহর বরিশাল সম্পর্কে তার আবেগ এবং কখনো কখনো কিছুটা বিরক্তির কথাও ফুটে ওঠে। ১৯৩৭ সালের ২ জুলাই প্রমথ চৌধুরীকে লেখা চিঠিতে বলছেন, 'কলকাতায় থাকলে পাঁচ মিনিটে যে জিনিস পাওয়া যেত এখানে (বরিশাল) তা পেতে এক সপ্তাহেরও বেশি লেগে গেল। মফস্বলের এই শহরগুলো এখনও নানা দিক দিয়ে Intellectually backward হয়ে আছে। এখানে Culture জিনিসটা একরকম নেই বল্লেই হয়। সাহিত্যসৃষ্টি তো দূরের কথা, সাহিত্যচর্চাও খুব কম লোকই করে। সেই জন্যেই কলকাতায় কোনো কাজ নিয়ে চলে যেতে ইচ্ছে করে, এই আবহাওয়ার ভিতর মন আর টিকে থাকতেই চায় না।'

তিনি বিশ্বাস করতেন, কলকাতার অলিগলি মানুষের শ্বাসরোধ করে বটে, কিন্তু কলকাতার ব্যবহারিক জীবনে একটা প্রান্তরের মত মুক্তি পাওয়া যায়; এখন যখন জীবনে কর্মবহুলতার ঢের প্রয়োজন, কলকাতার এই স্বচ্ছন্দ পটভূমির থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা চলে না আর।
চাকরি-বাকরি বিশেষ করে শিক্ষকতা নিয়েও তার যে অসন্তুষ্টি ছিল, সেটিও ফুটে ওঠে তার কোনো কোনো চিঠিতে। বরিশাল থেকে ১৯৪২ সালের ৩১ অক্টোবর নলিনী চক্রবর্তীকে লেখা চিঠিতে তিনি লিখছেন, 'অধ্যাপনা জিনিষটা কোনো দিনই আমার তেমন ভালো লাগেনি। যে সব জিনিষ যাদের কাছে যে রকমভাবে শিক্ষা দেয়া হচ্ছে, তাতে আমার বিশেষ আস্থা নেই। এই কাজে মন তেমন লাগে না, তবু সময় বিশেষে অন্য কোনো কোনো প্রেরণার চেয়ে বেশী জাগে তা স্বীকার করি।'
তবে শুধু ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখের গল্পই নয়, এসব চিঠিতে কখনো কখনো নিজের জীবনবোধ ও সাহিত্যসম্পর্কিত আলোচনাও তিনি করেছেন। বরিশালের সর্বানন্দ ভবন থেকে ১৯৪৩ সালের ৩০ অক্টোবর সিগনেট প্রেসের মালিক দিলীপকুমার গুপ্তকে লেখা চিঠিতে বলছেন, 'আমাদের এই পৃথিবীর ভিতরেই আরো অনেক পৃথিবী রয়েছে যেন; সাধারণ চোখ দিয়ে স্বভাবত তা খুঁজে পাওয়া যাবে এমন নয়; থাকে তা সৃষ্টিপরায়ণ মানসের ভিতর; এরাই আমাদের দেখান।'
কবিতা সম্পর্কেও নিজের ভাবনা ফুটে ওঠে ১৯৪৫ সালের ২৬ ডিসেম্বর প্রভাকর সেনকে লেখা এক চিঠিতে—'ভালো কবিতা লেখা অল্প কয়েক মুহূর্তের ব্যাপার নয়; কবিতাটিকে প্রকৃতিস্থ করে তুলতে সময় লাগে। কোনো কোনো সময় কাঠামোটি, এমন কি প্রায় সম্পূর্ণ কবিতাটিও খুব তাড়াতাড়ি সৃষ্টিলোকী হয়ে ওঠে। কিন্তু তারপর—প্রথম লিখবার সময় যেমন ছিল তার চেয়ে বেশি স্পষ্টভাবে—চারদিককার প্রতিবেশচেতনা নিয়ে শুদ্ধ তর্কের আবির্ভাবে কবিতাটি আরো সত্য হয়ে উঠতে চায়।'
একসময় নানা কারণে জন্মস্থান বরিশাল ছাড়ার জন্য ব্যাকুল হলেও শেষদিকে এসে সেই প্রিয় মাতৃভূমিতে ফেরার তাড়নাও যে তার মধ্যে তীব্র হয়, সেটিও বিভিন্ন চিঠিপত্রে স্পষ্ট। তিনি যখন (১৯৪৬) শেষবারের মতো বরিশাল ছেড়ে কলকাতায় যান, তখন পর্যন্ত দেশভাগ হয়নি। ফলে পাসপোর্ট ভিসারও প্রয়োজন হয়নি। কিন্তু ১৯৪৭-এ দেশভাগের পরে তিনি আর তৎকালীন পূর্ববাংলায় ফিরে আসেননি। এ প্রসঙ্গে মৃত্যুর আগের বছর ১৯৫৩ সালের ২৩ এপ্রিল কায়সুল হককে লেখা এক চিঠিতে নিজের সেই ব্যাকুলতার কথা জানান—'আমি বড্ড অলস, শরীরও অসুস্থ, মনও নানা কারণে ভেঙে পড়ছে। পূর্ব পাকিস্থান নিজের জন্মস্থান; সেখানে যেতে আমি অনেকদিন থেকেই ব্যাকুল; কিন্তু পাসপোর্ট ইত্যাদি কবে যোগাড় করে উঠতে পারব বলতে পারছি না।'

৪.
খড়্গপুর কলেজে অধ্যাপনার পাঁচ মাস সময়কালে কলেজের অধ্যক্ষ হিমাংশুভূষণ সরকারকে ইংরেজিতে পাঁচটি এবং সহকর্মী পুলিনবিহারী পালকে লেখা জীবনানন্দের ছয়টি চিঠি উদ্ধার করা গেছে। এই কাজে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন খড়্গপুর নিবাসী জীবনানন্দ গবেষক কামরুজ্জামান। খড়্গপুরে তার সাথে আমার সাক্ষাৎ হয় ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে। তার গবেষণা বলছে, কলেজে যোগদানের আগে জীবনানন্দ সচক্ষে এখানের পরিবেশ দেখা এবং সহকর্মীদের সাথে পরিচত হতে আসেন। এ সময় অধ্যক্ষ হিমাংশুভূষণ অন্য সহকর্মীদের সাথে জীবনানন্দকে পরিচয় করিয়ে দেন। শুধু তাই নয়, কলকাতায় ফেরার পথে কবিকে স্টেশন পর্যন্ত এগিয়ে দেন স্বয়ং অধ্যক্ষ। স্টেশন থেকে কলেজ পর্যন্ত যেতে রেলের কর্মশালা, চারপাশে লাল মাটির ওপর দাঁড়িয়ে থাকা রুক্ষ সবুজ বনানী দেখে কবি মুগ্ধ হয়েছিলেন।

জীবনানন্দ দাশ খড়্গপুর কলেজের অধ্যক্ষকে প্রথম চিঠি লেখেন ১৯৫০ সালের ৪ আগস্ট কলেজে যোগদানের সম্মতি জানিয়ে। এর ২০ দিন পর বিস্তারিতভাবে আরেকটি চিঠি লেখেন অধ্যক্ষকে। তৃতীয় চিঠিটি লিখেছিলেন ওই বছরের ৫ ডিসেম্বর। কলকাতায় ছুটিতে গিয়ে স্ত্রীর অসুস্থতার খবর জানিয়ে যেখানে লিখেছেন, চিকিৎসক পরামর্শ দিয়েছেন এই শীতে যেন তাকে (স্ত্রী) নিয়ে কোথাও না যান। কেননা এতে হাঁপানি আরও বেড়ে যেতে পারে। ফলে আগামী বসন্ত অথবা গ্রীষ্মের আগে পরিবার নিয়ে খড়্গপুরে আসার সম্ভাবনাও তিনি বাতিল করে দেন। পরিবারসহ থাকার জন্য খড়্গপুরে যে বাসাটি দেখেছিলেন, সেটি প্রয়োজন নেই বলেও অধ্যক্ষকে জানান। ১৯৫১ সালের ১৩ জানুয়ারি অধ্যক্ষকে লেখা আরেকটি চিঠিতে নিজের অসুস্থতা ও চিকিৎসার কথা জানিয়ে আরও কিছুদিন ছুটিতে থাকার আবেদন করেন।
অধ্যক্ষকে লেখা পঞ্চম চিঠিটি বেশ দীর্ঘ এবং সেখানে ব্যক্তিগত নানা প্রসঙ্গ এসেছে। ১৯৫১ সালের ১১ মার্চ ১৮৩ ল্যান্সডাউন রোডের ঠিকানা থেকে লেখা ওই চিঠিতে জীবনানন্দ নিজের শারীরিক অসুস্থতার বিবরণ দেন এবং এই অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির জন্য দুঃখপ্রকাশ করেন। তবে এই অসুস্থতার কারণে যাতে ক্লাস ও পরীক্ষা ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে বিষয়ে নিজের পরিকল্পনার কথাও উল্লেখ করেন।

এই চিঠির অর্ধ মাস পরে জীবনানন্দ চিঠি লেখেন খড়্গপুরের সহকর্মী পুলিনবিহারী পালকে, কলেজের চাকরি চলে যাওয়ার দুদিন আগেই যেখানে তার আর্থিক দুরবস্থা ও মানসিক বিপর্যয়ের বিস্তারিত তুলে ধরেন। ১৯৫১ সালের ৩১ মার্চ লেখা ওই চিঠিতে তিনি জানান, খড়্গপুর কলেজ থেকে ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে মাত্র তিরিশ টাকা পেয়েছিলেন। কিন্তু ফেব্রুয়ারি মাসে যে কাজ করলেন, সেই টাকা এখনও পাননি। ফলে বিগত দিনের পাওনাটা না পেলে এই দুর্দিনে টিকে থাকা মুশকিল। আগস্ট মাসে দিল্লি কলেজের পাকা কাজ ও কলকাতার নানা সুযোগ সম্ভাবনা ছেড়ে দিয়ে খড়্গপুর কলেজের চাকরি ভালো ও স্থায়ী—এই পূর্ণ বিশ্বাসে তিনি যে এখানে যোগ দিয়েছিলেন, সে কথাও মনে করিয়ে দেন পুলিন বিহারীকে। কলেজের বোর্ডিংয়ে নিজের লেপ, তোষক, জামা-কাপড়, বই ইত্যাদি ঘরে বন্ধ করে রেখে এসেছেন উল্লেখ করে জানতে চান, সব ঠিক আছে কি না? গ্রীষ্মের ছুটি কবে আরম্ভ হবে সে কথাও জানতে চান। সবশেষে অবিলম্বে এই চিঠির জবাব পাওয়ার প্রত্যাশার কথাও উল্লেখ করেন।
কিন্তু এই চিঠি লেখার দুদিন পরেই ২ এপ্রিল কলেজ পরিচালন সমিতির সভা হয় যেখানে মূল আলোচ্য বিষয় ছিল জীবনানন্দের দীর্ঘ অনুপস্থিতি। সভায় ১৯৫০ সালের সেপ্টেম্বরে যোগদানের পর থেকে পরের বছর ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তিনি যেসব ছুটি নিয়েছেন তা নিয়ে আলোচনা হয়। এই ছুটির ফলে ক্লাসে ব্যাঘাত, কলেজের অর্থনৈতিক সংকট এবং শর্তসাপেক্ষে ইস্তফার বিষয়ে কবির চিঠিটিও বিবেচনায় নেয়া হয়। সব মিলিয়ে সভায় সর্বসম্মতভাবে জীবনানন্দের দীর্ঘ ছুটির আবেদনটি অগ্রাহ্য হয় এবং ইংরেজি বিভাগের দ্বিতীয় পদটি বিলুপ্ত করা হয়। এরপর জীবনানন্দকে জানিয়ে দেয়া হয়-Your service is no longer required…এপ্রিল মাসের কোনো এক সময়ে তিনি শেষবারের মতো খড়্গপুরে আসেন এবং রুমের ভেতরে থাকা বিছানা, বইপত্র নিয়ে নিঃশব্দে চলে যান।
৫.
জীবনানন্দ বেঁচেছিলেন বাংলা সাহিত্যের দুই দিকপাল রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সময়ে। নজরুলের সঙ্গে তাঁর একবার কল্লোলের অফিসে দেখা হলেও রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কোনোদিনই দেখা হয়নি বা জীবনানন্দ একই শহরে থাকলেও রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতে যাননি। তাঁর ভাষায়, 'নিজের জীবনের তুচ্ছতা' ও রবীন্দ্রনাথের 'বিরাট প্রদীপ্তি' দুজনের মধ্যে যে ব্যবধান রেখে গেছে—তিনি (জীবনানন্দ) তা লঙ্ঘন করতে পারেননি।

জীবনানন্দের যেসব চিঠি আবিষ্কৃত হয়েছে, তার মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে লেখা এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা চিঠিগুলো বিশেষভাবে উল্লেখ্য। বাংলা ১৩৩৫ সালের ৩ পৌষ ৬৬ হ্যারিসন রোডে বসে রবীন্দ্রনাথকে লেখা একটি চিঠি জীবনানন্দের মৃত্যুর পরে বেশ আলোচনার জন্ম দেয়। কেননা চিঠিটি আবিষ্কৃত হলেও এটি রবীন্দ্রভবন সংগ্রহশালায় নেই। ফলে প্রভাতকুমার দাস ধারণা করছেন, ভুলে হয়তো চিঠিটি তিনি (জীবনানন্দ) ডাকে দেননি। তাছাড়া চিঠির পরিপাটি চেহারা দেখলে এই মন্তব্য বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়।
প্রথম কাব্যগ্রন্থ ঝরাপালকের একটি কপি জীবনানন্দ পাঠিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথকে। সেই বই পড়ে তিনি জীবনানন্দকে একটি ছোট চিঠি লিখেছিলেন। বাংলা ১৩৩৫ সালে লেখা ওই চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লেখেন—'তোমার কবিত্বশক্তি আছে তাতে সন্দেহ মাত্র নেই। কিন্তু ভাষা প্রভৃতি নিয়ে এত জবরদস্তি কর কেন বুঝতে পারি নে। কাব্যের মুদ্রাদোষটা ওস্তাদীকে পরিহাসিত করে।' এরপর ধূসর পাণ্ডুলিপি পড়ে রবীন্দ্রনাথ আরেকটি চিঠি দেন মাত্র দুই লাইনে। শান্তিনিকেতন থেকে লেখা ওই চিঠিতে কবিগুরু লেখেন—'তোমার কবিতা পড়ে খুশি হয়েছি। তোমার লেখায় রস আছে, স্বকীয়তা আছে এবং তাকিয়ে দেখার আনন্দ আছে।'
প্রথম চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ ভাষা নিয়ে জবরদস্তির যে অভিযোগ করেন, সে বিষয়ে জীবনানন্দ নিজের একটি ব্যাখ্যা দেয়ার প্রয়োজনবোধ করেন। তিনি লেখেন, 'কবি কখনো আকাশের সপ্তর্ষিকে আলিঙ্গন করবার জন্য উৎসাহে উন্মুখ হয়ে ওঠেন, পাতালের অন্ধকারে বিষজর্জর হয়ে কখনো তিনি ঘুরতে থাকেন। বীঠোফেনের কোনো কোনো সিম্ফনি বা সোনাটা ভেতর অশান্তি রয়েছে, আগুন ছড়িয়ে পড়ছে, কিন্তু আজও তা টিকে আছে। চিরকালই থাকবে তাতে সত্যিকার সৃষ্টির প্রেরণা ও মর্যাদা ছিল বলে।'