ট্যাগোর @ ইয়াহু.কম : চিঠির অতীত ও ভবিষ্যৎ
১৯১৮। ট্যাগোর বছরের প্রথম দিনটাই এক ধরনের কাঙালিপনা দিয়ে শুরু করলেন। তিনি ঐ গানটা লিখলেন : আমি যখন তার দুয়ারে ভিক্ষা নিতে যাই/তখন যাহা পাই/ সে যে আমি হারাই বারে বারে। ঠাকুর বাড়ির বিশাল জমিদারি যার দখলে তাকে কী ভিক্ষে মানায়?
কাঙালিপনা কাটিয়ে এ মাসে আরো লিখলেন: জাগরনে যায় বিভাবরী, ওহে সুন্দর মরি মরি।
ফেব্রুয়ারিতে আবার লিখলেন, আমার সকল দুঃখের প্রদীপ/ জ্বেলে দিবস গেলে করব নিবেদন/ আমার ব্যথার পূজা হবে সমাপন।
এপ্রিলে আমেরিকা যাবেন ঠিক করলেন, এক লাখ টাকা কর্জও নিলেন, কিন্তু মহাযুদ্ধের কারণে যাওয়া হলো না।
মে মাসের ১৬ তারিখে কন্য মাধুরীলতা যক্ষায় ভুগে মৃত্যুবরণ করল। মন ভীষণ খারাপ। কিন্তু ১১ বছর বয়সী রাণু একটি চিঠি লিখে মনভাঙ্গা ঠাকুরকে আবার জাগিয়ে দিল:
প্রিয় রবিবাবু।
আমি আপনার গল্পগুচ্ছের সব গল্পগুলো পড়েছি আর বুঝতে পেরেছি। কেবল ক্ষুধিত পাষানটা বুঝতে পারিনি। আচ্ছা জয়পরাজয় গল্পটার শেষে শেখরের সঙ্গে রাজকন্যার বিয়ে হল! না? কিন্তু আমার দিদিরা বলে শেখর মরে গেল। আপনি লিখে দেবেন যে, শেখর বেঁচে গেল আর রাজকন্যার সঙ্গে তার বিয়ে হল। কেমন? সত্যিই যদি শেখর মরে গিয়ে থাকে তবে আমার বড় দুঃখ হবে। আমার সব গল্পগুলোর মধ্যে মাষ্টারমশায় গল্পটা ভালো লাগে। আমি আপনার গোরা, নৌকাডুবি, জীবনস্মৃতি, ছিন্নপত্র, রাজর্ষি, বৌঠাকুরানীর হাট, গল্পসপ্তক সব পড়েছি। আপনার কথা ও ছুটির পড়া থেকে আমি আর আমার ছোট বোন কবিতা মুখস্ত করি। চতুরঙ্গ, ফাল্গুণী ও শান্তিনিকেতন শুরু করেছিলাম কিন্তু বুঝতে পারলাম না। ডাকঘর, অচলায়তন, রাজা শারদোৎসব এসবও পড়েছি। আমার আপনাকে দেখতে খু-উ-উ-উ-উ-উ-উব ইচ্ছে করে।
এই হচ্ছে রাণুর প্রথম চিঠি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জুলাই মাসে জবাব দিলেন, খুব বেদনার সময় তুমি যখন তোমার সরল এবং সরস জীবনীটি নিয়ে খুব সহজে আমার কাছে এলে এবং এক মুহূর্তে আমার স্নেহ অধিকার করলে তখন আমার জীবন আপন কাজে বল পেল--আমি প্রসন্ন চিত্রে আমার ঠাকুরের সেবায় লেগে গেলুম। কিন্তু তোমার প্রতি এই স্নেহ যদি আমাকে বল না দিয়ে দুর্বল করত, আমাকে মুক্ত না করে বন্ধ করত তাহলে আমার প্রভুর কাছে আমি কী জবাব দিতুম? তোমাকে আমার কাছে পাঠিয়ে আমার ঠাকুর আমাকে আরও বেশি বল দিয়েছেন। তুমিও তেমনি বল পাও আমি কেবল এই কামনা করছি।
তোমার ভালবাসা তোমার চারদিকে সুন্দর হয়ে বাধামুক্ত হয়ে ছড়িয়ে থাক--তোমার মন ফুলের মতো মাধুর্যে পবিত্রতায় পূর্ণ বিকশিত হয়ে তোমার চতুর্দিকে আনন্দিত করে তুলুন। ... আমি তোমাকে যখন পারব চিঠি লিখব--কিন্তু যদি চিঠি লিখতে দেরি হয়, লিখতে যদি নাও পারি তাতেই বা এমন কী দুঃখ! তোমাকে যখন স্নেহ করি তখন চিঠির চেয়েও আমার মন তোমার ঢের বেশি কাছে আছে।
একালের রানু হলে কী লিখত?
'বাবু খাইসো? দাড়ি কাটার দরকার নেই। মিস ইউ।
'উম্মা।'
ঠাকুর কী জবাব দিতেন?
পোস্টকার্ডে মাকে লেখা সত্যজিৎ রায়ের চিঠি
আমরা তো ভাবতে থাকি এবং স্বীকার করে নেই যে আমরা যা চিঠি বলে ভাবতাম পোস্ট কার্ডে, কিংবা খামে কিংবা এরোগ্রামে, প্রাপকের নাম ঠিকানা লিখে চিঠির ওজন বুঝে ডাকটিকেট লাগিয়ে চিঠির লাল বাক্সে ফেলতাম সেই চিঠির মৃত্যু হয়েছে। আপনি শেষ চিঠি কবে লিখেছেন? আমি শেষ চিঠি কবে লিখেছি মনে নেই; নতুন সহস্রাব্দে অর্থাৎ ২০০০ সাল থেকে এ পর্যন্ত কুড়ি বছরের অধিক সময়ে প্রিয়জন কিংবা অপ্রিয়জন কারো কাছেই একটিও যে লিখিনি এটা নিশ্চিত। সম্ভবত চিঠি না লিখার এই পাপবোধ থেকেই একটি উপন্যাস লিখেছি 'এসএমএস যুগের আগে,' কিন্তু খুব আগে নয়; খুকু তার শিক্ষক প্রেমিককে লিখছে:
পুরোনো দিনের চিঠিতে ওয়াইফ তার কলিকাতাবাসী হাজব্যান্ডকে সম্বোধন করছে 'ওগো পূজনীয় পতিধন' আর ইতিতে লিখেছে 'আপনার পদতলে আশ্রিতা।' এসব লিখতে আমার বয়েই গেছে।
এ ধরনের চিঠি আমি লিখি না। আপনি যত বড় বাহাদুরই হোন না কেন পূজনীয়, পতিধন জাতীয় শব্দ আমার পক্ষে ব্যবহার করা অসম্ভব, আর পদতলে আশ্রিতা তো কখনোই নয়। আপনি যদি এ ধরনের চিঠি আমার কাছ থেকে আশা করে থাকেন তা হলে লিখে রাখতে পারেন আপনার সে আশায় গুড়ে বালি। .... চিঠির ইতিতে ভিক্ষুকের মতো বলা আপনারস্নেহের কাঙ্গালিনী--কাঙ্গালিনী না কচু! আমি কারো স্নেহ কিংবা আমিষ কিংবা শর্করার কাঙালিনী নই।' খুকু এবং তার শিক্ষক যে কটা চিঠি লেখালেখি করেছে তার অর্ধেকই পোস্ট করা হয়নি। বইয়ের মলাটের ভেতর লুকোনোই রয়ে গেছে।
স্কুল জীবনে 'টাকা চাহিয়া পিতার নিকট পত্র লিখা, 'গ্রীষ্মের ছুটির কিভাবে কাটাইয়াছ জানাইয়া বন্ধুর নিকট পত্র লিখা' শিখেছিলাম। বাস্তব জীবনে পিতার ভবনেই বসবাস করতাম বলে তাকে চিঠি লিখতে হয়নি। গ্রীষ্মের ছুটি কাটাবার কাহিনী নিয়ে বন্ধুকেও না। স্কুলে যা শেখায়নি, বাস্তব জীবনের একটি পর্যায়ে কিছুটা সময় প্রেমপত্র লিখতে হয়েছে। প্রেমটা বিয়েতে গড়িয়ে যাওয়ায় প্রেমপত্র লেখক হিসেবে আমার খ্যাতিমান হবার সম্ভাবনাও তলিয়ে গেছে।
মনে পড়ছে আবার ট্যাগোরের কথা।
৩ আগষ্ট ১৯৩৫
ঢাকা থেকে শ্রী প্রমোদ মুখার্জি রবীন্দ্রনাথকে লিখলেন:
হে কবি, আপনি কবিগুরু আপনাকে নমস্কার। কবি আপনি বিশ্বের বরেণ্য, আমারও বরেণ্য। আপনাকে বুঝাইতে পারি এমন কোন ভাষা আমার নাই। তবে আমিও একজন বাণী জননীর দীন সেবক। আপনার দয়া ব্যতিরেকে কোন গ্রন্থকারই এদেশে দাঁড়াইতে পারে নাই। আপনার দয়া পাইতে পারি এমন কোন বিশেষ গুণ যে আছে এমন নহে, তবে আমি একজন জিনিয়াস। আমার সমন্ধে বিভিন্ন পত্রিকাতে আলোচনা হইয়াছে। আপনার দয়া ব্যতিরেকে আমার গত্যন্তর নাই। এদেশের লোকেরা এবং বিশেষ করিয়া সম্পাদকমন্ডলী আমার সমন্ধে একেবারে উদাসীন। এমনকি বুঝাইয়া লিখিলেও কান দিবে না। জিনিয়াস কথাটায় ব্যাপক অর্থ, আমার সমন্ধে প্রমাণ ও ইনডিকেশন স্বরূপ শ্রদ্ধেয় মৃণালকান্তি ঘোষ মহাশয়ের নিকট লিখিয়াছি।ইতি বিনয়াবত, শ্রী প্রমোদ মুখার্জি
ঢাকা ৩রা আগস্ট ১৯৩৫
ঢাকার প্রমোদ মুখার্জির এই চিঠিটি রবীন্দ্রনাথের পাগলা ফাইল থেকে তুলে এনেছেন অমিতাভ দাসগুপ্ত। রবীন্দ্রনাথের পাগলা ফাইলে কাকে লিখা এমন অনেক চিঠি রয়েছে, নাথ সম্বোধন করে এক নারী স্ত্রী অভিমান করে লিখেছেন, এতোদিন পর পর আমার কথা মনে পড়ল! এতোদিন স্ত্রী ও সন্তানের খোঁজ না নেওয়ার অপবাদ দিয়ে
একালে চিঠি লেখার সংস্কৃতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এমনকি সুইসাইড নোটও টেক্সট মেসেজ আকারে দিলেই চলে।
'বাবু খাইসো'- অনেক অর্থবহ। মেসেজ প্রাপক বাবু এর একশতটা মানে বের করতে পারবে। অন্ততঃ মেয়েটি যে কেয়ারিং (যত্নবান বললে সবটা বলা হয় না) তাতে তো কোনো সন্দেহ নেই।
চিঠি দিও প্রতিদিন, চিঠি দিও--সত্তরের দশকের এই গান এখন ভিন্নভাবে গাইতে হচ্ছে। এই গানের এমন একটি পঙক্তি ছিল: চিঠিগুলো অনেক বড় হবে/পড়তে পড়তে সকাল দুপুর আর রাত্রি চলে যাবে। চিঠি বড় হলে বেশি সময় লাগবে এটাই স্বাভাবিক। একালে সম্ভবত গাইতে হবে: এসএমএস দিও প্রতিদিন। এসএমএস-এর কাছে ভয়ঙ্কর মার খেয়ে গেল পত্রসংস্কৃতি ও পত্রসভ্যতা। দাপ্তরিক কিছু আনুষ্ঠানিক চিঠিপত্র ছাড়া আর সব চিঠি এখন 'এনডেনজারড' বিপন্ন সংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠেছে।
চিঠির বারটা বাজাতে, ডাক হরকরাকে বেকার বানাতে, চিঠির বাক্সে জং ধরাতে সহিংস কোনো আক্রমণ পরিচালনা করতে হয়নি; আক্রমণের শুরুটা হাসতে হাসতে দুটি মধুর শব্দ দিয়ে 'মেরি ক্রিসমাস'। ৩ ডিসেম্বর ১৯৯২ ভোডাফোন কোম্পানির ব্রিটিশ প্রকৌশলী নিল প্যাপওয়ার্থ তার ডেস্কটপে কম্পিউটারে বসে টাইপ করলেন পৃথিবীর প্রথম সংক্ষিপ্ত বার্তা 'মেরি ক্রিসমাস' আর তা ভেসে উঠল ভোডাফোন ডিরেক্টর রিচার্ড জার্ভিস-এর সেলফোনে। এই বার্তা পেয়ে রিচার্ড জার্ভিসকে নিল জ্যাপওয়ার্থকে পাল্টা মেরি ক্রিসমাস বলেছিলেন?
দেখা হলে নিশ্চয়ই বলেছেন, কিন্তু ৩ ডিসেম্বর ১৯৯২ তার পক্ষে ফিরতি বার্তা প্রদানের কোনো সুযোগই ছিল না--কারণ তখন ওয়ানওয়ে ট্রাফিক কেবল খোলা হয়েছে। ফিরতি বার্তার 'অপশন' তখনও আবিষ্কৃত হয়নি।
চিঠির সর্বনাশের শুরুটা আরো আগে থেকেই। ১৯৭১ সালেই রে টমলিমসন প্রথম ই-মেইল পাঠালেন। বার্তাটি পেল একই কক্ষে অপর একটি কম্পিউটার। তখন এ ধরনের বার্তা প্রেরণের প্রক্রিয়াকে ইলেকট্রনিক মেইল বা ই-মেইল বলা হয়নি, আরো ছ'সাত বছর পর ই-মেইল কথাটা মানুষ মুখে তুলে নেয়।
লেখালেখি আবিষ্কার আর চিঠি লেখালেখি শুরু কাছাকাছি সময়েই হয়ত হবে। প্রাচীন ভারত, প্রাচীন মিশর প্রাচীন গ্রিস- প্রাচীন রোম, সুমের, এবং চীনে চিঠির অস্তিত্ব আবিষ্কৃত হয়েছে। হোমারের ইলিয়াড-এ চিঠি আছে; হেরোডটাস, থুসিডিসিস চিঠির কথা তাদের লেখায় উল্লেখ করেছেন কাজেই তারাও চিঠি লিখেছেন, বলাই যায়।
চিঠি আন্তরিকভাবে হাতে কলমে লিখা হতো। যন্ত্র, বিশেষে করে টাইপরাইটার চিঠির প্রকৃতি বদলে দিয়েছে।
মহামারীর সময় রোগ সংক্রমিত হবার ভয়ে মানুষের ছোঁয়া লাগা চিঠি কেউ খুলেন না। ছোঁয়া না লাগা চিঠি হচ্ছে ইলেকট্রনিক মেইল। ই-মেইল রোগ ছড়াতে পারে না। এমন নয় যে করোনাকালে চিঠি আদান প্রদান কমেছে, কমেছে আরো অনেক আগে। এমনিতেই দীর্ঘচিঠির রেওয়াজ মানুষের ব্যস্ততা ও অস্থিরতার কারণে কমে এসেছিল। ই-মেইল এসে চিঠি হঠাতে শুরু করে। চিঠির কতোগুলো অন্তর্নিহিত সুবিধে ছিল--কোনো যন্ত্রপাতি লাগত না। কাগজ কলম আর ঠিকানা, তারপর ডাকঘরে গিয়ে নামমাত্র মূল্যের ডাক টিকেট লাগিয়ে দিলেই হলো। বাকীটা বুঝবে ডাক বিভাগ।
চিঠিতে ব্যক্তির ছোঁয়া থাকে (ভাইরাসেরও)! পত্রপ্রাপক পত্র লেখকের আবেগটা উপলব্ধি করে, কিন্তু ই-মেইল কি নৈর্ব্যক্তিক মনে হয় না! ই-মেইল যুগে যাদের জন্ম, যারা চিঠি মানেই ই-মেইল মনে করে তাদের পক্ষে এটা অনুধাবন করা সম্ভব হবে না।
একটি ই-মেইল হয়তো প্রাপকের মনোযোগের অগোচরে অন্যসব ই-মেইল ও স্প্যামের আড়ালে হয়ত অপঠিতই থেকে যেতে পারে। কিন্তু চিঠির বেলায় তা ঘটত না। প্রেমের চিঠিতে গোলাপের দুটো বাস্তব পাপড়িও জুড়ে দেওয়া যেত, ই-মেইলেও সম্ভব, অ্যাটাচমেন্ট হিসেবে আস্ত বাগানের ছবি, দু'চারটে পাপড়ি এমন বেশি কিছু নয়। চিঠি কখনো মেলাওয়ার, কম্পিউটার ভাইরাস ছড়াত না, ই-মেইল রেহাই দেয় না। ই-মেইল মাঝপথে বাধাপ্রাপ্ত হতে পারে--হ্যাকড হয়ে যেতে পারে, গোপনীয় তথ্যাবলী ফাঁস হয়ে যেতে পারে। চিঠি অন্ততঃ গোপনীয়তার প্রশ্নে অত্যন্ত নিরাপদ ছিল।
রবীন্দ্রনাথের বিয়ের নেমন্তন্ন
চিঠি লেখালেখি মানুষকে লেখক করে তুলে, শুধু চিঠি হিসেবে বিবেচনা করলেও প্রতিদিন বিশ্বজুড়ে কত পত্রসাহিত্য রচিত হতো। যদি চিঠি নাই থাকত জগন্ময় মিত্রের পাওয়া সেই অমর গান কেমন করে সৃষ্টি হতো:
বলেছিলে তাই চিঠি লিখে যাই কথা আর সুরে সুরে
মন বলে তুমি রয়েছ কাছে আখি বলে কত দূরে।
তুমি আজ কত দূরে
আখির আড়ালে চলে গেছ তবু রয়েছ হৃদয় জুড়ে
যাবার বেলায় হাত দুটি ধরে বলেছিলে চিঠি দিও মোরে
দূর থেকে তাই গানের লিপিকা লিখে যাই সুরে সুরে
ই-মেইল একটি চিঠির জন্য দিনের পর দিন প্রতীক্ষায় থাকার যাতনা লাঘব করেছে। মেইল কম্পোজ করা হওয়া মাত্র এক ক্লিকে এমনকি ভিন্ন গোলার্ধের প্রাপকের কাছে পৌঁছে যায়। এক ক্লিকে শত প্রাপকের কাছে পৌঁছে। ভীষণ পরিবেশ বান্ধব ই-মেইল; সহস্র ই-মেইল পত্রের জন্য একটি বৃক্ষের ডালও কাটতে হয় না। কিন্তু কাগজ জানে কাগজ কতোটা বৃক্ষ খেকো।
সংশোধন, সংযোজন, বিয়োজন ই-মেইলে খুবই সহজ, চিঠিতে নয়। স্পেল চেকার, ও অন্যান্য ডিভাইস ব্যবহার করে চমৎকার মেইল পাঠিয়ে তাক লাগিয়ে দেওয়া যায়, চিঠিতে অজ্ঞতা সহজে ধরা পড়ে।
চিঠিতে ডাক খরচ তো লাগবেই, এসএমএসও ফ্রি নয়, যৎকিঞ্চিত খরচ হয় এই যা। অবশ্য চ্যাট হিসেবে বিভিন্ন অ্যাপস বিনে পয়সায় বার্তা আনা নেওয়া করে। হাজার ই-মেইল রাখার জন্য টেবিলে বা শেলফে বাড়তি এতটুকু পরিসরেরও প্রয়োজন হয় না, কিন্তু চিঠি তো জায়গা দখল করবেই।
ভেলাইয়াপ্সা শিবা আয়াদুরাই, এমআইটির বিজ্ঞানী এবং ই-মেইল আবিষ্কারের দাবিদার, মনে করেন ই-মেইল আসলে চিঠিই, কিন্তু এসএমএস এবং চ্যাট পুরোনো চর্চার চিঠি ও ই-মেইল উভয়কেই হত্যা করেছে। বার্তা চলে গেছে বিনে পয়সায় ভোগ্য হোয়াইটসঅ্যাপ-এর দখলে। প্রতিদিন দুই বিলিয়ন হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহারকারী প্রতিমিনিটে ৬৯ মিলিয়ন বার্তা চালাচালি করে থাকে। তার মানে প্রতি সেকেন্ডে ১১ লক্ষ ৫০ হাজারটি বার্তা! যদি কথা বলা ও চেহারা দেখিয়ে কথা বলার অন্যান্য অপশন না থাকত, তাহলে এই সংখ্যা আরো বেড়ে যেত, ২০১৭ সালের হিসেবে প্রতিদিন ৫৫ মিলিয়ন হোয়াটসঅ্যাপ কল প্রক্রিয়াকরণ হয়েছে এবং ব্যবহারকারী এতে মোট ৩৪০ মিলিয়ন মিনিট সময় ব্যয় করেছে।
এতো কেবল হোয়াটসঅ্যাপ! তালিকায় কিন্তু এর উপরেই ফেইসবুক, আরো বেশি জনপ্রিয় ফেইসবুক মেসেঞ্জার। আরও আছে উইচ্যাট, কিউ কিউ, কিউ জোন, টাম্বলার, ইনস্টাগ্রাম, টুইটার, বাইদু টিবা, স্কাইপ, ভাইবার, সিনা উইবো, লাইন, স্ন্যাপচ্যাট, ওয়াইওয়াই, ভিকোনতাকতে, পিনটারেস্ট, লিঙ্কেডইন টেলিগ্রাম, সিগন্যাল, রেডি, তারিঙ্গ, ফোরস্কোয়ার, রেনরেন, ট্যাগড বাদু, মাইস্পেস, মিক্স, দ্যা ডটস, কিউইবক্স, স্কাইরক, ডেলিশাস, স্ন্যাপফিশ, ওপেন ডায়েরি, ফিল্মএফিনিটি, কোচসার্ফিং, ইমগুরু, জিফি, ইল্লো, ভিমিও, কাইয়ুশি, রিভার্বনেশন, ফ্লিক্সস্টার, কেয়ার টু, কাফেমাম, রেইভার্লি, নেক্সটডোর, ওয়েন, সেলুফুন, ইউটিউব, আপস্ট্রিম, ক্লাসমেটস, মাই হেরিটেজ, ভায়াডিও, জিঙ্ক, জাঙ্গা, লাভি জার্নাল, ফ্রেন্ডস্টার, ফানি অর ডাই, গায়া অনলাইন, উইহার্টইট, বাজনেট, ডেভিয়ান আর্ট, ফ্লিকার, মিটমি, মিটআপ, টউট, মিক্সি, ডিসকর্ড, ভেরো, কোরা, স্প্রিলি, ডব্লিউটি সোশাল, ট্রিলার, এলফা, ইউবো পপবেইজ, পিনাট, ভ্যালেন্স, ফ্লিপ, হাউসপার্টি, ক্যাফেইন, স্টিমিট, টুইট, ওয়াটপ্যাড, কেয়ারিংব্রিজ, ক্রাঞ্চিরোল, সাউন্ডক্লাউড, মকোস্পেস, ইতালকি- এখানেই শেষ নয়, অন্তত সচল ১০০টার নাম লেখা যাবে। তাহলে চিঠি লেখার কি দরকার? মাত্র এক দশক আগেও গ্রাম থেকে আসা ছেলেটি যখন মেয়েটির কাছে ঠিকানা চাইল, মেয়েটি কথা শুনে হতভম্ব ছেলেটি বিড়বিড় করল:
আমি বুঝি না শহুরে রকমসকম
ঠিকানা চাইতেই বললে
নভেরা অ্যাট ইয়াহু ডটকম।
এখন ছেলেটি আর অবাক হয় না, প্রযুক্তির মহাসড়কে লিপফ্রগ দিয়ে এখন তার হাতেও স্মার্টফোন। তারও আছে একাধিক ভার্চুয়াল ঠিকানা। ভার্চুয়াল ঠিকানা আপনার মেইল চেক করুন। ট্যাগোর অ্যাট ইয়াহু ডট কম থেকে মেইল এসেছে :
প্রিয়...
আগামী রবিবার ২৪শে অগ্রহায়ন তারিখে শুভ দিনে, শুভ লগ্নে আমার পরমাত্মীয় শ্রীমান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শুভ বিবাহ হইবে। আপনি তদুপলক্ষে বৈকালে উক্ত দিবসে ৬নং জোড়াসাকোস্থ মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের ভবনে উপস্থিত থাকিয়া বিবাহাদি সন্ধর্শন করিয়া আমাকে এবং আত্মীয়বর্গকে বাধিত করিবেন। ইতি-
অনুগত
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
এমন চিঠি পাবার সম্ভাবনা নেই, মেইলেও না। চিঠি ও মেইল উভয়েই সঙ্কটে আছে। চিঠি মহাসঙ্কটে। হঠাৎ প্রাচীন পাথরের স্ল্যাবে লিখা কিছু পেলে এ কালের প্রত্নবিদ যেমন উল্লসিত হয়ে ওঠেন, আগামী সহস্রাব্দে কলম দিয়ে কাগজে লিখা এবং ডাকযোগে পাঠানো কোনো চিঠির একটি বা দুটি পাতা পেলে আগামী দিনের গবেষক বিষ্মিত হয়ে বলবেন, ওই মাই গড। এত বড় চিঠি! চিঠিতে এতো কী কথা! কী কথা তাহার সাথে!
একালের নাজিম হিকমত জেলখানা থেকে স্ত্রীকে আর চিঠিও লিখবেন না। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের অনুবাদে নাজিম হিকমতের জেলখানার চিঠিকে মনে হবে মহাকাব্য:
১.
প্রিয়তমা আমার,
তোমার শেষ চিঠিতে
তুমি লিখেছো:
মাথা আমার ব্যথায় টনটন করছে,
দিশেহারা আমার হৃদয়।
তুমি লিখেছো:
যদি ওরা তোমাকে ফাঁসি দেয়
তোমাকে যদি হারাই,
আমি বাঁচবো না।
তুমি বেঁচে থাকবে প্রিয়তমা বধূ আমার
আমার স্মৃতি কালো ধোঁয়ার মতো হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে
তুমি বেঁচে থাকবে, আমার হৃদয়ের রক্তকেশী ভগিনী,
বিংশ শতাব্দীতে,
মানুষের শোকের আয়ু
বড়জোর এক বছর।
মৃত্যু ...
দড়ির একপ্রান্তে দোদুল্যমান শবদেহ
আমার কাম্য নয়, সেই মৃত্যু।
কিন্তু প্রিয়তমা আমার, তুমি জেনো
জল্লাদের লোমশ হাত
যদি আমার গলায়
ফাঁসির দড়ি পরায়
নাজিমের নীল চোখে ওরা বৃথাই খুঁজে ফিরবে ভয়।
অন্তিম ঊষার অস্ফুট আলোয়
আমি দেখব, আমার বন্ধুদের, তোমাকে দেখব।
আমার সঙ্গে কবরে যাবে
শুধু আমার
এক অসমাপ্ত গানের বেদনা।
...
কাল রাতে তোমাকে আমি স্বপ্ন দেখলাম
মাথা উঁচু করে
ধূসর চোখ মেলে তুমি আবছা আমার দিকে তাকিয়ে
তোমার আর্দ্র ওষ্ঠাধর কম্পমান
কিন্তু তোমার কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম না।
কৃষ্ণপক্ষ রাত্রে কোথাও আনন্দ সংবাদের মতো ঘড়ির টিক্ টিক্ আওয়াজ
বাতাসে গুন্ গুন্ করছে মহাকাল
আমার ক্যানারীর লাল খাঁচায়
গানের একটি কলি
লাঙ্গল চষা ভূঁইতে
মাটির বুকফুঁড়ে উদগত অঙ্কুরের দুরন্ত কলরব
আর এক মহিমান্বিত জনতার বজ্রকণ্ঠে উচ্চারিত ন্যায্য অধিকার
তোমার আর্দ্র ওষ্ঠাধর কম্পমান
কিন্তু তোমার কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম না।
আশাভঙ্গের অভিশাপ নিয়ে জেগে উঠলাম।
ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বইতে মুখ রেখে
অতগুলো কণ্ঠস্বরের মধ্যে
তোমার স্বরও কি আমি শুনতে পাইনি?
কী আশ্চর্য মহামতি গ্যোটের কথাও মিথ্যে হয়ে যাবে: Letters are among the most significant memorial a person can leave behind them.
মিথ্যে হয়ে যাবে লরেন্স ডারেলের সেই নারীবিদ্বেষী উদ্ধৃতি:
A woman's best love letters are always written to the man she is betraying.
দুর্ভাগ্য আমাদের, আমাদের হাতেই চিঠি সমাহিত হলো। চিঠির আর ভবিষ্যৎ নেই। রেস্ট ইন পিস।