ট্রাম্প ও ১৫ মার্কিন রাষ্ট্রপতির রোমান্স কাহিনী
নীলছবির নায়িকা স্টর্মি ড্যানিয়েলস দাবী করেছিলেন যে তার সাথে ডোনাল্ড ট্রাম্পের অবৈধ সম্পর্ক ছিল; তার এই দাবী যেকোন দেশের রাষ্ট্রপতিদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগসমূহের মাঝে সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর।
মার্কিন পর্নোগ্রাফি শিল্পের প্রতিথযশা নায়িকা ড্যানিয়েলসের আসল নাম স্টেফানি ক্লিফোর্ড। তিনি দাবী করেছেন যে লেক টাহোতে ২০০৬ সালে, তারকাদের জন্য আয়োজিত গলফ প্রতিযোগিতা চলাকালীন সময়ে তিনি ট্রাম্প এর সাথে যৌন সম্পর্কে জড়ান। সাবেক প্লেবয় প্লেমেইট ক্যারেন ম্যাকডুগালও ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অনুরুপ অভিযোগ এনেছেলিন। অভিষিক্ত হবার আগেই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বিরুদ্ধে প্রায় এক ডজনেরও বেশি মহিলা যৌন হয়রানির অভিযোগ এনেছিলেন। ট্রাম্প তার বিরুদ্ধে আনা এ ধরণের সব অভিযোগকে অবশ্যই জোরালোভাবেই অস্বীকার করেছেন।
তবে ট্রাম্প যতই অস্বীকার করুন এসব অভিযোগ মিডিয়াতে যথেষ্ট প্রচার পেয়েছে, এবং ট্রাম্পকে এই কেলেঙ্কারী ছায়ার মত তাড়া করে বেরিয়েছে তার শাসনের পুরো পাঁচ বছরই। তবে ওভাল অফিসের বাসিন্দাদের জন্য এধরণের অভিযোগ মোকাবেলা করা নতুন কিছু নয়। ট্রাম্প যেমন এসব অভিযোগে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন, তেমনি মার্কিন প্রেসিডেন্টের পদটির সাথেও অনেক আগে থেকেই "যৌন হয়রানি"র অভিযোগ ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে, ঐতিহাসিকভাবেই।
মার্কিন রাষ্ট্রপতিদের এক তৃতীয়াংশই অভিযুক্ত হয়েছেন বিবিধ যৌন হয়রানী, অবৈধ সম্পর্কও এবং বিবাহবর্হিভূত সন্তান জন্মদানের অভিযোগে।তাদের মধ্যে কেউ কেউ আবার বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের ব্যাপারে গর্ব করতেও দ্বিধা করেননি।
মার্কিন রাষ্ট্রপতিদের নারী কেলেংকারীর তালিকা বেশ দীর্ঘ:
জর্জ ওয়াশিংটন
দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠে ভেনাস নামের এক দাসীর গর্ভে অবৈধ সন্তান জন্ম দেয়ার। ভেনাস, ভার্জিনিয়াতে জর্জের পারিবারিক এস্টেটেই কাজ করতেন। নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক রিপোর্টে জানা যায় যে, ১৯৯৯ সালে ভেনাসের বংশধরেরা ডিএনএ টেস্ট এর মাধ্যমে প্রমাণ করতে চেয়েছিল যে তারা জর্জ ওয়াশিংটনের পরিবারের অংশ। তবে বিভিন্ন জটিলতার কারণে সেই ডিএনএ টেস্ট করা আর সম্ভব হয়নি, ফলে এই রহস্য অমীমাংসিতই রয়ে গিয়েছে।
টমাস জেফারসন
ওয়াশিংটনের মত, জেফারসনও স্যালি হেমিংস নামের একজন দাসীর গর্ভে অবৈধ সন্তান জন্ম দেয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছিলেন তার প্রথম মেয়াদে। জেফারসন ভাইস প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন সময়ে তার স্ত্রী মৃত্যুবরণ করেন। জর্জ ওয়াশিংটনের মত তারও ভার্জিনিয়াতে বড় জমিদারী ছিল। জর্জ ওয়াশিংটনের বেলায় ভেনাসের বংশধরেরা ডিএনএ টেস্ট করতে ব্যর্থ হলেও ১৯৯৮ সালে ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ হয় স্যালি হেমিংসের সন্তানের পিতা জেফারসনই ছিলেন।
অ্যান্ড্রু জ্যাকসন
প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড্রু জ্যাকসন ব্যাপকভাবে সমালোচিত হন র্যাচেল ডোনেলসন রোবার্ডসকে বিয়ে করার কারণে। আইনগতভাবে আগের স্বামীর কাছ থেকে বিবাহ বিচ্ছেদ না নিয়েই র্যাচেল, অ্যান্ড্রু জ্যাকসনকে বিয়ে করে বসেন, যা কেউই ভাল চোখে দেখেননি।
উইলিয়াম হেনরী হ্যারিসন
মার্কিন ইতিহাসের সবচেয়ে অল্প সময় ধরে রাষ্ট্রপতির পদে থাকা হ্যারিসনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসে তার এক দাসী ডেলসিয়ার সাথে সম্পর্কে জড়ানোর। ডেলসিয়ার বংশধরেরা দাবী করেন যে হ্যারিসনের সাথে সম্পর্কের ফলস্বরুপ তিনি ছয়টি সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন। মাত্র ৩২ দিন দেশ চালানোর পর হ্যারিসন মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছিলেন অসুস্থতাজনিত কারনে।
জন টাইলার
হ্যারিসনের মৃত্যুর পর সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে ভাইস প্রেসিডেন্ট টাইলার ক্ষমতায় এসেছিলেন। ওয়াশিংটন পোস্টের রিপোর্ট অনুযায়ী, তিনিও একজন ভার্জিনিয়া নিবাসী দাসীর গর্ভে সন্তান জন্ম দিয়েছিলেন।
জেমস গারফিল্ড
গারফিল্ড, আরেকজন স্বল্প সময় ধরে দায়িত্ব পালন করা প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ১৮৬২ সালের গৃহযুদ্ধের সময়, জেনারেল পদে আসীন থাকা অবস্থায় তার বিরুদ্ধে বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কে জড়ানোর অভিযোগ ওঠে।
গ্লোভার ক্লিভল্যান্ড
ক্লিভল্যান্ড হচ্ছে একমাত্র প্রেসিডেন্ট, যিনি দুই মেয়াদে ওভাল অফিসের দায়িত্বে ছিলেন; কিন্তু তিনি পরপর প্রেসিডেন্ট ছিলেন না—মাঝের সময়টায় ক্ষমতায় ছিলেন বেঞ্জামিন হ্যারিসন।
প্রথম মেয়াদের নির্বাচনী প্রচারণা চালানোর সময়ে তার বিরুদ্ধে বেশ চাঞ্চল্যকর একটি রিপোর্ট ছাপা হয় বাফেলো ইভেনিং টেলিগ্রাফ পত্রিকায়। তাদের ভাষ্যমতে, প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচণ করার ঠিক ১০ বছর আগে তিনি মারিয়া হ্যালপিন নামক এক মহিলার গর্ভে সন্তান জন্ম দিয়েছিলেন। তিনি মারিয়ার দায়িত্ব না নিয়ে তাকে মানসিক হাসপাতালে পাঠিয়ে দেন। পরে অন্য একটি পরিবার শিশু সন্তানটিকে দত্তক নেন।
হ্যালপিন দাবী করেন যে ক্লিভল্যান্ড তার সাথে জোরপূর্বক সম্পর্ক স্থাপন করেন। এমনকি, তিনি তার বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগও এনেছিলেন। তবে ক্লিভল্যান্ড সন্তানকে পুরোপুরি অস্বীকার করেননি, তিনি বলেন হলে হতেও পারে, সেবার এই অভিযোগ সত্ত্বেও নির্বাচণে জিতেও যান। তিনি নির্বাচণী প্রচারণায় দাবী করেন যে অবিবাহিত অবস্থায় হ্যালপিনের সাথে তিনি সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন।
ভাইস পত্রিকার রিপোর্টে প্রকাশিত হয় যে ক্লিভল্যান্ড ঝামেলা এড়ানোর জন্য অন্যায়ভাবে হ্যালপিনকে মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছিলেন। প্রকৃত কোন কারণ না থাকায় তিনি হাসপাতাল কতৃপক্ষকে জানিয়েছিলেন যে "হ্যালপিন মানসিক ভারসাম্যহীন, কেননা সে অনিয়ন্ত্রিতভাবে বিভিন্ন বিবাহিত পুরুষদের সাথে যৌনসংগম করে বেড়ায়"।
ওয়ারেন হার্ডিং
হার্ডিং ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ২৯তম রাষ্ট্রপতি, যাকে নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গুজব রটেছে যে তিনি একটি অবৈধ সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন। ন্যান ব্রিটন নামক একজন সেক্রেটারির সঙ্গে তার অন্তরঙ্গতার কথা প্রকাশ পেয়েছিল।
হার্ডিং রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন সময়েই মৃত্যুবরণ করেন, যার কারণে এ ব্যাপারটির কোন সুরাহা হয়নি। তবে সম্প্রতি ডিএনএ টেস্ট থেকে প্রমাণিত হয়েছে যে ব্রিটনের গর্ভের সন্তানটির পিতা তিনিই ছিলেন। কেউ কেউ এমনটাও মনে করেন যে তার স্ত্রী ফ্লোরেন্স নিজ হাতে তাকে বিষ প্রয়োগ করে হত্যা করের্রচন, ১৯২৩ সালে।
ফ্র্যাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্ট
রুজভেল্ট তার স্ত্রী এলেনরের সেক্রেটারী লুসি মার্সারের সাথে দীর্ঘদিন ধরে অবৈধ সম্পর্কে লিপ্ত ছিলেন। বাজফিডের রিপোর্ট অনুযায়ী, এই সম্পর্কের শুরু ১৯১৬ সালে। রুজভেল্টের স্যুটকেসে মার্সারের লেখা প্রেমপত্র খুঁজে পেয়ে এলেনর তাকে ডিভোর্স নেয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন; তবে শেষ পর্যন্ত তারা বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটাননি।
ডুইট ডি আইজেনহাওয়ার
আইজেনহাওয়ার তার গাড়ীর ড্রাইভার সামার্সবির সাথে দীর্ঘ প্রণয়ে জড়িয়ে পড়েছিলেন। আইজেনহাওয়ারের মৃত্যুর পরে সামার্সবি তাদের এই সম্পর্কের ব্যাপারে মুখ খোলেন, এবং বিস্তারিত জানান। সাবেক রাষ্ট্রপতি হ্যারি ট্রুম্যান একবার একজন লেখককে জানিয়েছিলেন যে ১৯৪৫ সালে আইজেনহাওয়ার তার জেনারেলের কাছে অনুমতি চেয়েছিলেন স্ত্রীর সাথে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটানোর ব্যাপারে, যাতে তিনি সামার্সবিকে বিয়ে করতে পারেন।
জন এফ কেনেডি
প্রেসিডেন্ট কেনেডির বিভিন্ন প্রেমিকাদের নিয়ে মুখরোচক গুজব প্রচলিত ছিল, যার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ছিলেন হলিউডের নায়িকা ম্যারিলিন মনরো।
লিন্ডন বি জনসন
বিভিন্ন রিপোর্টের বরাত দিয়ে বলা যায়, যে জনসনের একাধিক অবৈধ সম্পর্ক ছিল, যার মধ্যে বেশিদিন ছিল ম্যাডেলিন ব্রাউনের সাথে, ২১ বছরের সম্পর্ক। জনসনের একজন জীবনী লেখক বলেছিলেন যে "যখনই মানুষ কেনেডির বিভিন্ন সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করতেন, তখনই রেগে গিয়ে জনসন টেবিল চাপড়াতেন, এবং বলতেন যে "কেনেডি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে যত নারীর সাথে সজ্ঞানে মিশেছেন, তার চেয়েও বেশী নারীদের সাথে ভুলবশত যৌন সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন''
জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ (বুশ সিনিয়র)
জর্জ বুশ সিনিয়রের নামে অভিযোগ আসে দুই নারীকে নিয়ে—একজন ছিলেন হোয়াইট হাউজের কর্মী, যিনি তার প্রশাসনের একজন সদস্য ছিলেন। অপর অভিযোগটি ছিল ১৯৬০ সালের একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে। বুশ দু'টি অভিযোগই সম্পূর্ণরুপে অস্বীকার করেছেন।
বিল ক্লিনটন
ট্রাম্পের আগে, ক্লিনটনের বিভিন্ন যৌন অভিসারের গল্প এবং তার বিরুদ্ধে আনিত অসাদাচরণের অভিযোগগুলোই সবচেয়ে বেশি কেলেংকারীর জন্ম দিয়েছিল মার্কিন প্রশাসনে।
সবচেয়ে বেশি চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী ঘটনাটির কেন্দ্রে ছিলেন মনিকা লিউনিস্কি, তবে মনিকা ছাড়াও পলা জোন্স, জেনিফার ফ্লাওয়ার্স, ক্যাথলিন ওয়াইলি, এলিজাবেথ ওয়ার গ্রেচেন, জুয়ানিতা ব্রোডরিক— এদের সবাই বিভিন্ন পর্যায়ে ক্লিটনের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানীর অভিযোগ এনেছেন।
জর্জ ডব্লিউ বুশ
বুশের বিরুদ্ধে সবচেয়ে গুরুতর অভিযোগ আসে একজন টেক্সাস নিবাসী মহিলার উপর যৌন নির্যাতনের। এই ঘটনার কারণে মহিলাটি পরে আত্মহননের পথ বেছে নেন। বুশের বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ উঠে আসে ১৮ মাস ধরে একজন সাবেক পতিতার সাথে সম্পর্কে জড়ানোর।
মূলত বিল ক্লিনটনের যুগ থেকেই মার্কিন রাষ্ট্রপতিদের ব্যক্তিগত স্বেচ্ছাচারিতার খবর মিডিয়ায় আসতে শুরু করে, যার সর্বশেষ উদাহরণটি আমরা দেখতে পেয়েছি বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্ষেত্রেও। তবে বাকি সব রাষ্ট্রপতিরাও যে স্বচ্ছ ছিলেন না তা বলাই বাহুল্য।