দ্য ফিলিং অভ পাওয়ার
দেনেবের সাথে পৃথিবীর যুদ্ধ চলছে, সে বহুদিন। এখানকার আসল ক্ষমতাধরদের সাথে অনায়াস ওঠবসে অভ্যস্ত জেহান শুমান। বেসামরিক নাগরিক তিনি। কিন্তু তাতে কি, তার তৈরি বিভিন্ন প্রগ্রামিং প্যাটার্নের সুবাদেই আজ সবসেরা পর্যায়ের স্বনিয়ন্ত্রিত ওয়ার কম্পিউটার তৈরি সম্ভব হয়েছে। জেনারেলরা সেজন্যেই ওর কথা কানে তোলেন। বিভিন্ন সংসদীয় কমিটির হর্তাকর্তারাও তাই।
নিউ পেন্টাগনের স্পেশাল লাউঞ্জে এই দু দলেরই একজন করে প্রতিনিধি রয়েছেন। মহাশূন্যের অভিজ্ঞতায় পোড় খাওয়া মানুষ জেনারেল ওয়েইডার। ওর ছোট মুখটা কুঁকড়ে প্রায় শূন্যের চেহারা পেয়েছে। কংগ্রেসম্যান ব্রান্টের গাল মসৃণ, তার দৃষ্টি পরিষ্কার। দেশপ্রেমের কারণে নাম ছড়িয়ে পড়েছে তার, বিশেষ ঢঙে দেনেবিয় টোব্যাকো টানেন, এমনি স্বাধীনতা আবশ্য তাকে দেওয়া যায়।
পয়লা কাতারের প্রগ্রামার শুমান। দীর্ঘদেহী, টনটনে আত্মসম্মান জ্ঞান ওর। নির্ভয়ে মুখোমুখি হয়েছেন ওদের।
'এই ভদ্রলোকের নাম লিদিসলাস আউব,' বললেন তিনি।
'হঠাৎ দারুণ মেধাবী যে লোকটির দেখা পেয়েছেন আপনি,' প্রশান্ত কণ্ঠে বললেন কংগ্রেসম্যান ব্রান্ট। 'আচ্ছা।' আন্তরিক আগ্রহে ডিমের মতো টেকো মাথার বেঁটেখাটো মানুষটাকে জরিপ করলেন তিনি।
জবাবে ছোটখাটো মানুষটা হাতের আঙুল মোচড়াতে লাগল, উদ্বিগ্ন। এর আগে কখনও এমনি ডাঁকসাইটে লোকজনের ধারেকাছেও ভেড়েনি সে। স্রেফ নিচু পদের একজন প্রবীণ টেকনিশিয়ান সে, বহুদিন আগে মানুষজাতির ভেতর থেকে মেধাবীদের ছেঁকে বের করার সমস্ত পরীক্ষায় ব্যর্থ হয়ে অদক্ষ শ্রমিকের কাতারে থিতু হয়েছে। আসলে মহান প্রগ্রামার ওর শখের কথা জেনে ফেলে এখন সেটা নিয়ে ভয়ঙ্কর হৈচৈ শুরু করেছেন।
'আমার কাছে এই ঢাকঢাক গুরগুর অবস্থা ছেলেমানুষি ঠেকছে,' বললেন জেনারেল ওয়েইডার।
'একটু বাদে আর ঠেকবে না,' বললেন শুমান। 'এটা হুট করে ফাঁস করার ব্যাপার নয়--আউব!' এক শব্দের নামটা উচ্চারণে হুকুমের সুর ছিল, অবশ্য মহান প্রগ্রামার তো স্রেফ একজন টেকনিশিয়ানের সাথে কথা বলছেন। 'আউব! সাত নয়ে কত বলো?'
এক পলক দ্বিধায় ভুগল আউব, তারপরই দুর্বল উদ্বেগে ঝিলিক খেলল ওর ফাঁকা চোখজোড়ায়। 'তেষট্টি,' বলল সে।
ভুরু নাচালেন কংগ্রেসম্যান ব্রান্ট। 'ঠিক হয়েছে?'
'নিজেই যাচাই করে দেখুন, কংগ্রেসম্যান।'
পকেট কম্পিউটার বের করে দুবার ভাঙা প্রান্তগুলো ঝাঁকালেন তিনি, হাতের তালুতে রেখে পর্দার দিকে তাকালেন। তারপর আবার রেখে দিলেন। 'এই প্রতিভা দেখাতে ওকে এখানে নিয়ে এসেছেন? একজন জাদুকর?' জানতে চাইলেন তিনি।
'তারচেয়ে বেশি কিছু, স্যার। অল্প কিছু অপারেশন মুখস্থ করে এখন সেগুলো দিয়ে কাগজে হিসাব কষতে পারে আউব।'
'তারমানে কাগুজে কম্পিউটার?' বললেন জেনারেল। মনে হলো হতাশ হয়েছেন তিনি।
'না, স্যার,' সধৈর্যে বললেন শুমান। 'আদৌ কাগুজে কম্পিউটার নয়। স্রেফ এক তা কাগজ। জেনারেল, দয়া করে একটা সংখ্যা বলবেন?'
'সতেরো,' বললেন জেনারেল।
'আর, কংগ্রেসম্যান, আপনি?'
'তেইশ।'
'গুড! আউব, সংখ্যাগুলো গুণ করো, তারপর কাজটা কিভাবে করলে এই ভদ্রলোকদের বুঝিয়ে দাও।'
'জ্বি, প্রগ্রামার,' মাথা নুইয়ে বলল আউব। শার্টের পকেট থেকে একটা ছোট প্যাড এবং আরেক পকেট থেকে শিল্পীর সূক্ষ্ম স্টাইলাস বের করল ও। কপাল কুঁচকে কাগজের বুকে কষ্টকর চিহ্ন আঁকল সে।
তীক্ষ্ণ কণ্ঠে ওকে বাধা দিলেন জেনারেল ওয়েইডার। 'আমাকে দেখতে দাও।'
কাগজটা ওর হাতে তুলে দিল আউব।
'বেশ,' ওয়েইডার বললেন, 'দেখে তো সতেরোর মতোই লাগছে।'
মাথা দোলালেন কংগ্রেসম্যান ব্রান্ট। 'তাই বটে,' বললেন তিনি, 'কিন্তু আমার ধারণা যেকেউ কম্পিউটার থেকে সংখ্যা নকল করতে পারে। আমার তো মনে হয়, আমিও এমনকি মখশ ছাড়াই চলনসই সতেরো লিখতে পারবো।'
'আউবকে কাজ চালিয়ে যেতে দিলে ভালো হতো, জেন্টলমেন' নিরুত্তাপ কণ্ঠে বললেন শুমান।
মৃদু কম্পিত হাতে কাজ চালিয়ে গেল আউব। অবশেষে ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, 'উত্তর হলো তিন শো একানব্বই।'
দ্বিতীয় দফা কম্পিউটার বের করে ঝাঁকি দিলেন কংগ্রেসম্যান ব্রান্ট। 'হায় খোদা, ঠিকই আছে। আঁচ করল কিভাবে?'
'আঁচ অনুমান নয়, কংগ্রেসম্যান,' বললেন শুমান। 'কাগজের বুকেহিসাব কষেই ফল বের করেছে ও।'
'ভুয়া,' অধৈর্যের সাথে বললেন জেনারেল। 'কম্পিউটার এক জিনিস আর কাগজের বুকে কতগুলো আঁকিবুকি আঁকা সম্পূর্ণ অন্য ব্যাপার।'
'খোলাসা করো, আউব,' বলল শুমান।
'জ্বি, প্রগ্রামার--মানে, জেন্টলমেন, আমি সতেরো লিখে ওটার নিচেই তেইশ লিখেছি। তারপর মনে মনে বলেছি: তিন সাতে--'
'কিন্তু, আউব,' মসৃণ কণ্ঠে বাদ সাধলেন কংগ্রেসম্যান। 'সমস্যাটা তো সতেরো গুণন তেইশের।'
'জ্বি, জানি,' সবিনয়ে বলল বেঁটে টেকনিশিয়ান, 'কিন্তু তিন সাতে বলে শুরু করার কারণ কাজটা এভাবেই হয়। তো এখন, তিন সাতে একুশ।'
'কিভাবে জানছো?' জিজ্ঞেস করলেন কংগ্রেসম্যান।
'স্রেফ আমার মনে আছে। কম্পিউটারের সবসময় একুশই আসে। অনেকবার পরখ করেছি।'
'তাই বলে সবসময় আসবে তাতো না, নাকি?' বললেন কংগ্রেসম্যান।
'হয়তো না,' আমতা আমতা করল আউব। 'আমি অঙ্কবিদ নই। কিন্তু, বুঝতেই পারছেন, সবসময় শুদ্ধ উত্তরই পেয়েছি।'
'বলে যাও।'
'তিন সাতে একুশ, তো একুশ লিখলাম আমি। তারপর তিন একে তিন। তো একুশের দুইয়ের নিচে এক লিখলাম।'
'দুইয়ের নিচে কেন?' চট করে জানতে চাইলেন কংগ্রেসম্যান ব্রান্ট।
'কারণ--' সমর্থনের আাশায় অসহায়ের মতো বড়কর্তার দিকে তাকাল আউব। 'এটা ব্যাখ্যা করা কঠিন।'
'আপাতত আপনারা ওর কাজ মেনে নিলে বিশদ ব্যাপারগুলো আমরা গণিতবিদদের হাতে ছেড়ে দিতে পারব,' বললেন শুমান।
মেনে নিলেন ব্রান্ট।
'দেখতেই পাচ্ছেন,' খেই ধরল আউব, 'তিন যোগ দুই হলো পাঁচ, ফলে একুশ হয়ে যাচ্ছে একান্ন। এখন কিছুক্ষণের জন্যে এভাবে রেখে নতুন করে শুরু করুন। সাতকে দুই দিয়ে গুণ করলে আসছে চৌদ্দ; আর দ্ইু একে দুই। এখন, এভাবে বসিয়ে যোগ করলে দাঁড়াচ্ছে চৌত্রিশ। এখন চৌত্রিশকে এভাবে একান্নর নিচে বসিয়ে যোগ করলে পাচ্ছেন তিন শো একানব্বই। এটাই উত্তর।'
মুহূর্তের জন্যে নীরবতা নেমে এলো। তারপর জেনারেল ওয়েইডার বললেন, 'বিশ্বাস করি না। এমনি প্যাঁচানো কায়দায় বিভিন্ন সংখ্যা বানিয়ে এভাবে-ওভাবে গুণ আর যোগ করেছে সে। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি না। এটা জটিল জালিয়াতি না হয়ে যায় না।'
'ওহ, না, স্যার,' ঘর্মাক্ত কলেবরে বলে উঠল আউব। 'আসলে আপনারা অভ্যস্ত নন বলেই জটিল লাগছে। আসলে, নিয়মগুলো একদম সহজ, যেকোনও সংখ্যার বেলায় কাজ করবে।'
'যেকোনও সংখ্যা, অ্যাঁ?' জানতে চাইলেন জেনারেল। 'দেখা যাক তবে।' নিজের কম্পিউটার (জমকালো স্টাইলের জিআই মডেলের) বের করে উল্টাপাল্টা সংখ্যা টিপলেন তিনি। 'কাগজে পাঁচ, সাত, তিন আর আট লিখ। তাহলে দাঁড়াচ্ছে পাঁচ হাজার সাত শো আটত্রিশ।'
'জ্বি, স্যার,' নতুন এক তা কাগজ নিয়ে বলল আউব।
'এবার,' (আরও কয়েক দফা কম্পিউটারে পাঞ্চ করে), 'সাত দুই তিন নয়। সাত হাজার দুই শো উনচল্লিশ।'
'জ্বি, স্যার।'
'এবার এদুটো গুণ করো।'
'একটু সময় লাগবে,' কাঁপা কণ্ঠে বলল আউব।
'সময় নাও,' বললেন জেনারেল।
'শুরু করো,' আউব,' বললেন শুমান।
উবু হয়ে বসে কাজ শুরু করল আউব। আরেক টুকরো কাগজ নিল সে, আরেকটা। শেষমেশ ঘড়ি বের করে ওটার দিকে তাকিয়ে রইলেন জেনারেল। 'তোমার জাদু সংখ্যা লেখা শেষ হয়েছে, টেকনিশিয়ান?'
'প্রায় শেষ, স্যার। এই যে, একচল্লিশ মিলিয়ন, পাঁচ শো সাঁইত্রিশ হাজার তিন শো বিরাশি।' ফল লেখা সংখ্যাটা দেখাল সে।
তেতো হাসি দিলেন জেনারেল ওয়েইডার। নিজের কম্পিউটারের গুণনের কন্ট্যাক্ট টিপে সংখ্যাগুলাকে ঘূর্ণী খেয়ে অবশেষে স্থির হতে দিলেন তিনি। এক মুহূর্ত অপলক
দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে শেষে সবিস্ময়ে ক্ষীণ কণ্ঠে বলে উঠলেন, 'হায় খোদা, লোকটা তো ঠিকই বলেছে।'
*
টেরেস্ট্রিয়াল ফেডারেশনের প্রেসিডেন্টের অফিস। সামরিক বরাদ্দ সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ কমিটির প্রধান কংগ্রেসম্যান ব্রান্ট প্রেসিডেন্টের সাথে কথা বলছিলেন। বিপুল আন্দোলন এবং বিরাট জনপ্রিয়তার পর দেনেবিয় যুদ্ধ এখন মহড়া-পাল্টা মহড়ার নোংরা বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। পৃথিবীতে ক্রমেই অসন্তোষ বেড়ে উঠছে। সম্ভবত দেনেবেও সমানভাবেই বাড়ছে সেটা।
'বিনা কম্পিউটারে হিসাব কষা,' অধৈর্যের সাথে বললেন প্রেসিডেন্ট, 'কথাটা ঠিক খাপ খায় না।'
'হিসাব,' বললেন কংগ্রেসম্যান, 'ডেটা সামলানোর একটা কায়দামাত্র। সেটা যেমন মেশিন করতে পারে, আবার মানুষের মগজও করতে পারে। একটা উদাহরণ দিই।' সদ্য রপ্ত করা নতুন বিদ্যা কাজে লাগিয়ে গুন আর ভাগ করতে লাগলেন তিনি। শেষমেশ অনিচ্ছাসত্ত্বেও কৌতূহলী হয়ে উঠলেন প্রেসিডেন্ট।
'বরাবর কাজ হয় এভাবে?'
'প্রত্যেকবার, মিস্টার প্রেসিডেন্ট। কোনও ফাঁক নেই।'
'শেখা কঠিন নাকি?'
'মোটামুটি ধারণা পেতে আমার সপ্তাহ খানেক লেগেছে। আমার মনে হয় আপনার আরও কম সময় লাগবে।'
'বেশ,' চিন্তিত সুরে বললেন প্রেসিডেন্ট, 'মানলাম, এটা একটা মজার পার্লার গেম, কিন্তু কি কাজে আসবে?'
'সদ্যজাত শিশু কি কাজে লাগে, মিস্টার প্রেসিডেন্ট? আপাতত কোনও কাজে লাগছে না। কিন্তু, আপনি কি বুঝতে পারছেন না, মেশিন থেকে মুক্তির একটা উপায়ের ইঙ্গিত দিচ্ছে এটা? ভেবে দেখুন, মিস্টার প্রেসিডেন্ট,' উঠে দাঁড়ালেন কংগ্রেসম্যান, আপনাআপনি বক্তৃতার সুর ধরল তার ভরাট কণ্ঠস্বর। 'দেনেবিয় যুদ্ধটা কম্পিউটারের বিরুদ্ধে কম্পিউটারের যুদ্ধ ছিল। ওদের কম্পিউটারগুলো আমাদের মিসাইলের বিরুদ্ধে কাউন্টার-মিসাইলের দুর্ভেদ্য বর্ম তৈরি করেছে, আবার আমাদের কম্পিউটারগুলোও ওদের বিরুদ্ধে একই কাজ করেছে। আমরা আমাদের কম্পিউটারের দক্ষতা বাড়ালে ওরাও তাই করছে, ফলে পাঁচ বছর ধরে একটা নজুক এবং অনাবশ্যক ভারসাম্য টিকে আছে।
'এখন কম্পিউটারকে ছাড়িয়ে যাওয়ার, টপকে যাওয়ার, ওটার মাধ্যমে সামনে এগোনোর মতো একটা কায়দা রয়েছে আমাদের হাতে। আমরা কম্পিউটেশনের মেকানিক্সের সাথে মানুষের চিন্তাকে মেলাবো। বুদ্ধিমান কম্পিউটারের মতো একটা কিছু পাবো আমরা; কয়েক বিলিয়ন। ফলটা কি দাঁড়াবে এখনই তার বিশদ ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারছি না, তবে সেটা হিসাবের বাইরে। এবং আমাদের আগেই দেনেব জেনে ফেললে ওরা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে।'
চিন্তিত কণ্ঠে প্রেসিডেন্ট বললেন, 'আমাকে কি করতে বলেন?'
'হিউম্যান কম্পিউটেশনের উপর একটা প্রকল্পের পেছনে প্রশাসনের শক্তি প্রয়োগ করুন। চাইলে এর নাম দিতে পারেন প্রজেক্ট নাম্বার। আমার কমিটির পক্ষ থেকে নিশ্চয়তা দিতে পারি, কিন্তু পেছনে প্রশাসনকে লাগবে আমার।'
'কিন্তু মানবীয় হিসাবনিকাশ কতদূর যেতে পারবে?'
'তার কোনও সীমাপরিসীমা নেই। প্রগ্রামার শুমানের হিসাবে, ওই আমাকে প্রথম এই আবিষ্কারের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন--'
'অবশ্যই শুমানের কথা শুনেছি।'
'হ্যাঁ। বেশ, ডক্টর শুমান বলেছেন, তাত্ত্বিক দিক থেকে এমন কিছু নেই যা কম্পিউটার করতে পারে কিন্তু মানুষের মন পারে না। কম্পিউটার স্রেফ সীমিত পরিমাণ ডেটা নিয়ে সেগুলো নিয়ে সীমিত পরিমাণে হিসাব কষে। মানুষের মনও এই প্রক্রিয়া অনুকরণ করতে পারে।'
কথাটা নিয়ে কঞ্চিৎ ভাবলেন প্রেসিডেন্ট। 'শুমান একথা বলে থাকলে, আমি ওর কথা বিশ্বাস করতে রাজি--তাত্ত্বিকভাবে। কিন্তু বাস্তবে কম্পিউটার কিভাবে কাজ করে কিভাবে জানছে কেউ?'
আন্তরিক হাসলেন ব্রান্ট। 'বেশ, মিস্টার প্রেসিডেন্ট। একই প্রশ্ন আমিও করেছি। একটা সময়ে সরাসরি মানুষের হাতেই কম্পিউটারগুলোর নকশা তৈরি হয়েছিল বলে মনে হয়। সহজ কম্পিউটার ছিল সেসব। সেটা অবশ্য আরও অগ্রসর কম্পিউটারের পরিকল্পনার লক্ষ্যে কম্পিউটারের যৌক্তিক প্রয়োগের বেশ আগের কথা।'
'হ্যাঁ, হ্যাঁ। বলে যান।'
'দৃশ্যত টেকনিশিয়ান আউব শখ হিসাবে এইসব প্রাচীন কায়দার কিছু নতুন করে আবিষ্কার করে বসেছে। কাজটা করতে গিয়ে সেসবের প্রক্রিয়ার বিস্তারিত পর্যবেক্ষণের সময় ওসব অনুকরণ করতে পারার কথা জেনেছে সে। এইমাত্র আপনাকে যে গুন করে দেখালাম, সেটা কম্পিউটারেরই কাজের একটা অনুকরণ।'
'বিস্ময়কর!'
ভদ্রতার হাসি দিলেন কংগ্রেসম্যান, 'আরেকটা কথা যদি বলতে দেন, মিস্টার প্রেসিডেন্ট--আমরা একে যতবেশি উন্নত করে তুলতে পারব ততই কম্পিউটার তৈরি ও রক্ষণাবেক্ষণে আমাদের ফেডারেল প্রয়াস ভিন্ন দিকে নিয়ে যেতে পারব। মানুষের মস্তিস্ক দায়িত্ব তুলে নেওয়ায় আমরা আরও বেশি করে শান্তির সময়ের কর্মকাণ্ডে আমাদের শক্তি নিয়োগ করতে পারবো। সাধারণ মানুষের উপর যুদ্ধের ধাক্কা কমবে। ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে এটা অবশ্যই বিরাট সুবিধাজনক অবস্থা হবে।'
'আচ্ছা,' বললেন প্রেসিডেন্ট, 'আপনার কথা বুঝতে পারছি। বেশ, বসুন, কংগ্রেসম্যান, বসুন। ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে একটু সময় লাগবে আমার।--কিন্তু এই অবসরে গুণের কায়দাটা আর একবার দেখান দেখি। দেখি ব্যাপারটা ধরতে পারি কিনা।'
*
প্রগ্রামার শুমান তাড়াহুড়া করতে যাননি। লিওসের রক্ষণশীল, বড়ই রক্ষণশীল, বাপ-দাদার কায়দায় কম্পিউটারের সাথে কাজ করতে পছন্দ করেন। তবু ওয়েস্ট ইউরোপিয়ান কম্পিউটার কম্বাইন নিয়ন্ত্রণ করছেন তিনি। তো তাকে পূর্ণ উদ্যমে প্রজেক্ট নাম্বারে যোগ দিতে রাজি করানো গেলে অনেক কিছু হাসিল করা যেতো। যাবে।
কিন্তু রাজি হচ্ছেন না লিওসের। 'কম্পিউটারের উপর থেকে নিয়ন্ত্রণ শিথিল করার ধারণা পছন্দ হচ্ছে কিনা নিশ্চিত নই,' বললেন তিনি। 'মানুষের মন খামখেয়ালে চলে। কম্পিউটার সবসময় যে কোনও সমস্যার একটা সমাধানই দেবে। মানুষের মনও যে তাই করবে, তার কি নিশ্চয়তা আছে?'
'মানুষের মন, কম্পিউটার, লিওসের, কেবল বাস্তবতাকে নিয়েই কাজ করে। সেটা মানুষের মন নাকি মেশিন করছে, কিছু এসে যায় না। ওরা স্রেফ উপায়।'
'হ্যাঁ, হ্যাঁ। মনের কম্পিউটারের কাজ অনুকরণের দুর্দান্ত প্রদর্শনী দেখেছি, কিন্তু আমার কাছে কিঞ্চিৎ ভাসাভাসা ঠেকছে। তত্ত্ব হয়তো মেনে নিতে পারি, কিন্তু তত্ত্বকে বাস্তবে রূপায়িত করা যাবে ভাববার মতো কি কারণ আছে?'
'আমার ধারণা কারণ আছে, স্যার। হাজার হোক, কম্পিউটার তো আর বরাবর ছিল না। যুদ্ধজাহাজ, পাথুরে কুড়োল আর রেলরোডঅলা গুহাবাসীদের কম্পিউটার ছিল না।'
'ওরা সম্ভবত হিসাব-নিকাশও করত না।'
'আপনি ঢের বেশি জানেন। এমনকি রেলরোড কিংবা যিগুরাত (মন্দির) বানাতেও কিছু পরিমাণ হিসাব-নিকাশের দরকার ছিল। সেটা নিশ্চয়ই আমাদের চেনা কম্পিউটার ছাড়াই হয়েছিল।'
'বলতে চাইছেন, ওরা আপনার দেখানো কৌশলেই হিসাব করেছে?'
'হয়তো না। হাজার হোক, এই পদ্ধতি--ও হ্যাঁ, প্রাচীন ইউরোপিয় শব্দ 'গ্রাফো' মানে 'লেখা' থেকে আমরা একে 'গ্রাফিটিক্স' বলছি-খোদ কম্পিউটার থেকেই বের করা হয়েছে। তো এটা সেগুলোর আগের সময়ের হতে পারে না। তবু, গুহাবাসীদের নিশ্চয়ই কোনও একটা কায়দা ছিল, তাই না?'
'হারানো শিল্পকর্ম! আপনি হারানো শিল্পকর্মের কথা তুললে--'
'না, না। মোটেই হারানো শিল্পকর্মের অনুরাগী নই আমি। যদিও বলছি না যে, তেমন কিছু ছিল না। হাজার হোক, হাইড্রোপনিক্সের আগেও মানুষ শস্য খেত, নিশ্চয়ই মাটিতেই সেসব ফলাত ওরা। এছাড়া আর কি করতে পারত?'
'আমি জানি না। তবে কাউকে জমিনে কিছু ফলাতে দেখলে তবেই মাটিতে ফসল ফলানোর কথা বিশ্বাস করব। আর নিজের চোখে দেখলেই কেবল দুটো পাথরে ঘষে আগুন জ্বালানোর কথা মানব।'
ওকে শান্ত করার প্রয়াস পেলেন শুমান। 'বেশ, আসুন গ্রাফিাটিক্সেই থাকা যাক। এখন সরাসরি মাস-ট্রান্সফারেন্স বিশাল যন্ত্রপাতির সাহায্যে পরিবহনের জায়গা দখল করছে। যোগাযোগের যন্ত্রগুলো অনেক ছোটো এবং ক্রমাগত দক্ষ হয়ে উঠছে। সত্যি বলতে আপনার পকেট কম্পিউটারের সাথে হাজার বছর আগের বিপুল কর্মকা-ের তুলনা করুন। তাহলে কম্পিউটার বিদায় করার শেষ পদক্ষেপ নেওয়া নয় কেন? শুনুন, স্যার, প্রজেক্ট নাম্বার একটি চলমান উদ্যোগ। ইতিমধ্যে অনেকখানি অগ্রগতি দেখা গেছে। কিন্তু আমরা আপনার সাহায্য চাই। দেশপ্রেম আপনাকে চালিত না করলে বুদ্ধিবৃত্তিক অ্যাডভেঞ্চারের কথাই না হয় ভাবুন।'
'কিসের অগ্রগতি?' সসংশয়ে বললেন লিওসের। 'গুণ বাদে আর কি করতে পারেন?'
'সময়মতো সব হবে। যথাসময়ে। এই তো ভাগ করা শিখেছি আমি-- নির্ভুল নিঃশেষে ভাগ এবং দশমিকের ভাগ করতে পারি।'
'দশমিকের ভাগ? কয় ঘর পর্যন্ত?'
গলার স্বর স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলেন প্রগ্রামার শুমান। 'যেকোনও ঘর!'
নিচের চোয়াল ঝুলে পড়ল লিওসেরের। 'বিনা কম্পিউটারে?'
'আমাকে একটা সমস্যা দিন?'
'সাতশোকে তেরো দিয়ে ভাগ করুন? ছয় ঘর পর্যন্ত যান।'
পাঁচ মিনিট বাদে শুমান বললেন, 'দুই দশশিক শূন্য, সাত, ছয়, নয়, দুই, তিন।'
পরখ করলেন লিওসের। 'বেশ, অবাক কা- তো। গুণ আমাকে তেমন মুগ্ধ করেনি, কারণ হাজার হোক এখানে ভাগের ব্যাপার আছে, ভেবেছিলাম গুণের জারিজুরি দিয়ে এটা হতেও পারে। কিন্তু দশমিক--'
'এই শেষ নয়। এখন টপ সিক্রেট একটা ব্যাপারও ঘটেছে, যেটা সত্যি বলতে কি এখন না বলাই ভালো। তবু--আমরা হয়তো বা বর্গমূলের বেলায়ও এক ধরনের সাফল্য পেয়ে গেছি।'
'বর্গমূল?'
'এখানে কিছু ঝামেলা আছে। এখনও সামলে উঠতে পারিনি। তবে টেকনিশিয়ান আউব, যে মানুষটা এই বিজ্ঞান আবিষ্কার করেছে এবং এ ব্যাপাওে যার বিস্ময়কর ধারণা রয়েছে, বলছে সমস্যা মোটামুটি সমাধান করে ফেলেছে। স্রেফ একজন টেকনিশিয়ান সে। আপনার মতো একজন মানুষের, প্রশিক্ষিত ও মেধাবী গণিতবিদেও কোনও সমস্যাই হওয়ার কথা না।'
'বর্গমূল,' আগ্রহী হয়ে বিড়বিড় করলেন লিওসের।
'হনমুলও। আপনি কি আমাদেও সাথে থাকছেন?'
সহসা সামনে এগিয়ে এলো লিওসেরের হাত। 'ধামিও আছি।'
*
কামরার মাথায় জোর কদমে আগুপিছু করার সময় অবাধ্য একদল ছাত্রের মুখোমুখি জাঁদরেল শিক্ষকের মতো শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে কথা বলে চলেছেন জেনারেল ওয়েইডার। ওরা প্রজেক্ট নাম্বারের প্রধান বেসামরিক নাগরিক হলেও কিছুই এসে যায় না। জেনারেল সামগ্রিকভাবে প্রধান। প্রতি মুহূর্তে নিজেকে তাই ভাবছেন তিনি।
'এখন বর্গমূল খুবই ভালো,' বললেন তিনি। 'আমি নিজে পারি না, কায়দাও বুঝি না, তবে খুবই ভালো। তবু, এই প্রজেক্টকে আপনাদের কেউ কেউ যেমন বলেন, পাশ কাটানো চলবে না। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর গ্রাফিটিক্স নিয়ে আপনাদের যেমন খুশি খেলতে পারেন, তবে এই মুহূর্তে আমাদের হাতে সুনির্দিষ্ট এবং খুবই বাস্তব সমস্যা মীমাংসার অপেক্ষায় রয়েছে।'
দূরের কোণ থেকে কষ্টকর মনোযোগের সাথে শুনছিল টেকনিশিয়ান আউব। দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পেয়ে গালভরা নামের পদবী আর মোটা অঙ্কের বেতনে প্রজেক্টে বদলি হয়েছে সে। এখন আর টেকনিশিয়ান না হলেও সামাজিক ফারাকটা রয়েই গেছে। উচ্চ পদস্থ বৈজ্ঞানিক নেতারা কিছুতেই ওকে সমান মর্যাদা দেওয়ার ব্যাপারটা মানতে পারেননি। ও-ও তেমন কিছু চায়নি। ওরা যেমন ওকে নিয়ে অস্বস্তিতে বোধ করেন, তেমনি সেও ওদের বেলায় অস্বস্তি পোহায়।
জেনারেল বলছিলেন, 'আমাদের উদ্দেশ্য খুবই সহজ, জেন্টলমেন। কম্পিউটারের প্রতিস্থাপন। কম্পিউটার সমেত মহাকাশযানের তুলনায় পাঁচ ভাগের এক সময় এবং দশ ভাগের এক ভাগ খরচে কম্পিউটার ছাড়া মহাশূন্যে চলার মতো একটা মহাশূন্যযান বানানো সম্ভব। আমরা কম্পিউটারকে বাদ দিতে পারলে দেনেবের চেয়ে পাঁচগুন-দশগুন বড় বহর তৈরি করতে পারব।
'এবং এরচেয়ে আরও দূরে দেখতে পাচ্ছি আমি। এখন হয়তো কল্পনা হতে পারে; ¯্রফে একটা স্বপ্ন। কিন্তু ভবিষ্যতে মানুষ চালিত মিসাইল দেখতে পাচ্ছি!'
শ্রোতাদের ভেতর চকিত গুঞ্জন উঠল।
'এই মুহূর্তে আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো বুদ্ধিমত্তার বিচারে মিসাইলগুলোর ক্ষমতা সীমিত,' বলে চললেন জেনারেল। 'অল্প কিছু মিসাইল, যদি থাকে, লক্ষ্য ভেদ করতে পারে। সৌভাগ্যক্রমে শত্রুপক্ষের মতো আমাদের জন্যেও মিসাইলের লড়াই চূড়ান্ত পরিণতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
'অন্যদিকে, গ্রাফিটিক্স দিয়ে একজন কিংবা দুজন মানুষ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা গেলে মিসাইল ঢের হালকা, গতিশীল এবং অনেক বুদ্ধিমান হবে। আমাদের বিজয়ী করার মতো সুবিধা এনে দেবে। তাছাড়া, জেন্টলমেন, যুদ্ধের জরুরিত্ব আমাদের একটা জিনিস মনে রাখতে বাধ্য করছে। একজন মানুষ কম্পিউটারের চেয়ে ঢের বেশি খরচযোগ্য। কম্পিউটার চালিত মিসাইলের ক্ষেত্রে কাজ করতে গিয়ে যেকোনও ভালো জেনারেলই উদ্বেগ বোধ করবেন, কিন্তু মানুষঅলা মিসাইল যেকোনও সংখ্যা এবং অবস্থায় ছোঁড়া সম্ভব--', তিনি অনেক কিছু বললেও টেকনিশিয়ান আউব অপেক্ষা করেনি।
*
নিজের ঘরের একান্ত পরিবেশে রেখে যাওয়া চিরকুটের পেছনে প্রচুর শ্রম ঝরিয়েছে টেকনিশিয়ান আউব। শেষপর্যন্ত সেটার চেহরা হয়েছে এরকম:
'গ্রাফিটিক্স নামে পরিচিত কৌশল নিয়ে গবেষণা শুরুর সময় এটা শখের চেয়ে বেশি কিছু ছিল না। একে মজার বিনোদন, মনের একধরনের খেলা ছাড়া কিছু ভাবিনি।
'প্রজেক্ট নাম্বার শুরুর পর ভেবেছি অন্যরা আমার চেয়ে বিজ্ঞ। হয়তো গ্রাফিটিক্সকে মানুষের কল্যাণে কাজে লাগানো হবে। হয়তো বা সত্যিকার অর্থে মাস ট্রান্সফারেন্সের মতো যন্ত্রপাতি উদ্ভাবনে কাজে প্রয়োগ করা হবে। কিন্তু এখন দেখতে পাচ্ছি কেবল মৃত্যুর কাজেই একে ব্যবহার করা হবে।
'গ্রাফিটিক্স আবিষ্কারের দায় নিতে পারব না আমি।'
এরপর স্বেচ্ছায় একটা প্রোটিন-ডিপোলারাইজারের ফোকাস নিজের দিকে স্থির করে নিমেষে যন্ত্রণাহীন মৃত্যুতে ঢলে পড়েছে সে।
*
ছোটখাটো টেকনিশিয়ানের আবিষ্কারের মহিমার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে তার কবরের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন ওরা।
বাকি সবার সাথে প্রগ্রামার শুমানও মাথা নিচু করে আছেন, কিন্তু অবিচল তিনি। হাজার হোক, টেকনিশিয়ান তার দায়িত্ব পালন করেছে, এখন আর তার প্রয়োজন নেই। গ্রাফিটিক্স সে শুরু করে থাকতে পারে, কিন্তু শুরু হয়ে যাওয়ায় মানুষ চালিত মিসাইল তৈরির পাশাপাশি না জানি আরও কতকিছু উদ্ভাবনের দিকে বিপুল বিজয়ীর মতো এগিয়ে যাবে এটা।
সাত-নয়, গভীর সন্তোষের সাথে ভাবলেন শুমান, তেষট্টি। এটা জানতে কম্পিউটার লাগে না। আমার মাথার ভেতরেই কম্পিউটার আছে।
এ থেকে পাওয়া ক্ষমতার অনুভূতিটুকু বিস্ময়কর।