ধনকুবের শেষ নিজাম ও প্রিন্সেস আয়েশা হেলেন সিমনস
হায়দারাবাদের নিজামের বিত্ত বৈভব ঐশ্বর্যের কথা সবাই জানেন, কিন্তু বর্তমান নিজামের নাম কি জিজ্ঞেস করলে নিশ্চিত অনেকেই মাথা চুলকাতে শুরু করবেন। তার নাম মোটেও নিজাম নয়। নিজাম হচ্ছে পদবী। নিজাম-উল মুলক, সাথে খেতাব আসফ ঝা। প্রথম নিজাম পীর কামার-উদ-দীন খান ৩১ জুলাই ১৭২৪ থেকে ১ জুন ১৭৪৮ মৃত্যুর দিন পর্যন্ত হায়দারাবাদের আনুষ্ঠানিক প্রধান শাসক। দশম নিজাম মীর ওসমান আলী খান ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৭ মৃত্যুবরণ করার পর একাদশ নিজাম মুকাররম ঝার বয়স যখন ৮৭ বছর। তার মৃত্যুর পর যিনি গদিনসিন হবেন তিনি দারুন আকর্ষণীয় এক ব্যক্তিত্ব, তিনি প্রিন্স আজমেত শাহ, তিনিই স্টিভেন স্পিলবার্গ ও রিচার্ড অ্যাটেনবরার বিশেষ প্রজেক্ট ফটোগ্রাফার। তিনি মুকাররম ঝার প্রথম পুত্র, জন্ম ১৯৬২ সালে। এক সময়কার হায়দারাবাদ রাজ্য এখনকার হায়দেরাবাদ, তেলেঙ্গানা ও কর্ণাটক জুড়ে। পুরোনো হায়দারাবাদ ইংল্যান্ড ও স্কটল্যান্ড একত্র করলে যা হবে তার চেয়েও বড়। এবার হেলেন সিমনসের কথা। কে তিনি?
বাবা মার দিক দিয়ে তার নাম আইরিস আর স্কটিশ। অস্ট্রেলিয়ার পার্থ অভিবাসী। হেলেনের জন্ম অস্ট্রেলিয়াতেই, ১৯৭১ সালে তার বয়স ২৯ বছর। কাহিনিটা রোমান্টিক ফিকশনও বলা যায়। ক'বছর পর পার্থ শহরে অনেকটা ইচ্ছের বিরুদ্ধে স্পেয়ার গার্ল হয়ে একটি ডিনার অংশ নেন হেলেন। সেখানে একজন আগন্তকের সাথে দেখা হল তার, প্রথম দেখাতেই যাকে তার বেশ আকর্ষণীয় মনে হল। এবং রহস্যময়ও। তিনি নিজের পরিচয় দিলেন 'মিস্টার ঝ'। তার সঙ্গে ফোন নম্বর অদলবদল হল। পরদিন সকালেই হেলেনের বাড়িতে ফুল পৌঁছে গেল, ফোন এলো একটু পরই, আলাপে একসাথে খাবার দাওয়াতে এলো অপর প্রান্ত থেকে। সম্মতি পাওয়ার পর গাড়িও চলে এলো। যেতে যেতে হেলেনের জানা হল এই মানুষটি হচ্ছেন, হিজ হাইনেস প্রিন্স মুকাররম ঝা, হায়দেরাবাদের নিজাম।
হায়দেরাবাদ কোথায় এবং নিজাম ব্যাপারটা কি এ সম্পর্কে তার সামান্য ধারনাও নেই। এমনকি ভারত সম্পর্কেও তার জ্ঞান অতি সামান্য। তাদের সাক্ষাৎ ঘটেছিল ব্যবসায়ী ইয়োম গোর্ল্ডবার্গের নিমন্ত্রণে। তারপর যা ঘটতে থাকে তা পুরোটা হেলেনের বেলায় প্রেমের রাসায়নিক প্রতিক্রিয়া ছাড়া আর কিছু নয়। মুকাররমের চোখ তার কাছে মনে হয় অতল বাদামি আর মানুষটিকে লাগে দারুণ কেয়ারিং; আর মুকাররমের ভালো লাগে হেলেনের সজীবতা, রসিকতা এবং উন্নাসিকতাহীনতা। দ্রুতই সম্পর্কটা বিয়ের দিকে গড়াতে থাকে তাদের। হেলেনের একটু আশঙ্কা ছিল -- এতো টাকা পয়সার মালিক। দু'এক যুগের পর আবার না তাকে উপেক্ষা করতে শুরু করেন। তবে সেরকম হয়নি। পার্থে একটি সিভিল সিরিমনিতে প্রিন্স মুকাররমের সাথে তার বিয়ে অনুষ্ঠিত হল। তখন থেকে হেলেন হায়দেরাবাদের বেগম হলেন। বিয়েতে তিনি পরেছিলেন নীল জার্সি স্যুট। প্রিন্সের নিজের বাড়ি হ্যাভলক স্ট্রিট পশ্চিম পার্থে। বিয়ের রিসেপশন সেখানেই হল। সেদিন হেলেনের পরনে ছিল ফুলেল শিফন গাউন। ৪৫ বছর বয়স্ক এই প্রিন্স তাকে বিয়ে করেছিলেন তুর্কি বংশোদ্ভূত প্রিন্সেস এমরার সঙ্গে ১৯৮৯র জানুয়ারিতে তালাক পর্বটা সেরে। এখন ৩১ বছর বয়সী হেলেনই তার সব। হেলেন প্রথমেই সন্তানের স্বপ্ন দেখেছেন। হলেনও। তবে প্রিন্স আলেকজান্ডার আজম যার বয়স যখন ১ বছর হবে তখন তাকে সিংহাসনের জন্য মোকাবেলা করতে হবে প্রিন্সেস এমরার দুই সন্তানের সাথে। সে জন্য আজম জন্মগ্রহণ করার আগেই তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেন। তার নাম রাখা হলো আয়েশা। সিভিল ম্যারেজটা সেড়েই ইসলামি কায়দায়ও আনুষ্ঠাকিতা সারা হলো।
ব্যাপারটা হেলেনের জন্য হল এক মজুবত বন্ধন আর মুকাররমের জন্য 'লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইটকে আপন করে পাওয়া। হেলেনের চেয়ে বয়সে বেশ খানিকটা বড় হলেও এমন যত্নশীল একজন পুরুষের কাছ থেকে একদিনের জন্যও সরে যাবার কথা মনে এলো না। হেলেনের গর্ভে যখন ছেলের জন্ম হলো, আনন্দে প্রিন্স হায়দেরাবাদে টেলিগ্রাম করে জানিয়ে দিলেন, তার অধিনস্ত সবার জন্য তিনি একদিনের গণ ছুটি মঞ্জুর করেছেন। হেলেনসহ তিন বোনের একজন রনডাকে নিজাম তার একান্ত সচিব করে নিলেন। এর আগে রনডা লন্ডনে একটি বিজ্ঞাপন সংস্থায় এবং বিবিসি নাট্য বিভাগে কাজ করতেন। আর হেলেন কাজ করতেন পার্থে ইয়োমে গোল্ডবার্গের অফিসে।
এই নিজামের সাথে অস্ট্রেলিয়ার সম্পর্ক ১৯৭২ থেকে। উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া ছয়টি রাজ প্রাসাদ, শহরে একটি ম্যানসন, অলঙ্কার ও মনিমুক্তার স্তূপ এবং ব্যবসাও পেয়েছেন। মুকাররম ঝা অস্ট্রেলিয়া এসে পার্থ শহরে একটি ম্যানসন কেনেন বড় অঙ্কের আয় উঠে আসবে বলে।
হেলেনের ভাষ্য, নিজামের রুচিটা একজন ধনী মানুষের মতোই ছিল। তার জন্ম প্যারিসে, শৈশব থেকেই দু'হাতে টাকা উড়িয়ে আসছেন, আবার মজা দেখুন খাবার জন্য আমাকে নিয়ে ঢুকছেন রাস্তার পাশের ছোট ক্যাফেতে।
আমার কাছে অনেক টাকার অর্থ কি? অনেক ভেবে দেখেছি। ইসলামি নীতি মেনে আমাদের বিয়ের সময় অনেক বড় একটি ডায়মন্ড দেওয়া হয়েছিল আমাকে। পরে একবার পার্থের একটি দোকানে গেলাম। দোকানদার ডায়মন্ডটা নেড়েচেড়ে দেখে বলল, এটা ভুয়া, হীরা এত বড় হতে পারে না।
তারপর আমি এটা ব্যাঙ্কের লকারে রেখে দিলাম। দু'এক মাস পর আমি জানলাম আমাদের টাকার কোনো অভাব নাই। ১৯৩০-এর দশকেই অর্থের হিসেবে এই টাকার পরিমাণ ছিল ৭০০ মিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে কিছু অলঙ্কার বিক্রি করতে বোম্বেতে নিলামের আয়োজন করা হল। ১৬ মিলিয়ন পাউন্ড নিলাম ডাক উঠল অলঙ্কারের। আর নিজাম এখনও তার অধীনস্তের কাছ থেকে একুশবার তোপধ্বনি পান, ঐতিহ্যবাহী আরব বডিগার্ড নিয়ে চলেন।
মুকাররম সুশিক্ষিত, ক্যামব্রিজের হ্যারো আর স্যান্ডহার্স্ট কলেজে পড়াশোনা করেছেন। পার্থে তার জন্য হালকা উড়োজাহাজের বন্দোবস্ত আছে। নিজাম তার সম্মান ও অবস্থান সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন।
১৯৮৩ সালে এই দম্পতির দ্বিতীয় পুত্র ওমর জন্মগ্রহণ করে। হেলেনের হায়দেরাবাদ ভালো লাগার দিন ফুরিয়ে আসে। এতো শত নফরের রাজত্বে তার প্রাইভেসি বিলুপ্ত হয়ে যায়। এদিকে নিজামের ম্যানেজারদের অর্থ আত্মসাতের কারণে এটা ওটা নিলাম উঠতে শুরু করে। হেলেনের মনে হতে শুরু করে ক্রিস্টাল ঝাড়বাতির মধ্যে নিজামের প্রাসাদ একটি শ্বাসরুদ্ধকর জঙ্গল। এখান থেকে তার মুক্তি চাই -- শুরুতে তিনি যে জীবন প্রিন্সের সঙ্গে যাপন করছেন, রাজপ্রাসাদে সেই জীবন বিষিয়ে উঠেছে। মূল প্রাসাদের বাইরেও নিজামের রয়েছে গোলাকান্দা প্রাসাদ, হিমায়েতবাগ প্রাসাদ, আহমেদবাগ প্রাসাদ এবং অসাধারণ সৌন্দর্যের চৌমহল্লা প্রাসাদ। তারপরও মুকাররম ঝা তাকে প্রাসাদ থেকে ইউরোপে নিয়ে এলেন। ওখান থেকে হেলেন চলে এলেন নিজ দেশে, অস্ট্রেলিয়ায়। পার্থের হ্যাটরক হাউস এবং পার্থের শিপস্টেশনে (ভেড়া প্রতিপালন ভূমি) এসে মুকাররম ঝাওয়েরও ভালো লাগল। এখানে অন্তত: তার পেছনে গোয়েন্দা, আয়কর বিভাগের লোক আর সুবিধাবাদী মানুষ সর্বক্ষণ অনুসরণ করছে না।
কিন্তু হেলেনে সুস্থির থাকতে পারলেন না। ১৯৮৩ সালে পার্থে মিলিয়নিয়ার কোর স্টোকসের একটি চ্যারিটি পার্টিতে কাজিন পিটার ফোর্টসের দেখা পেলেন। এই পিটার ফোর্টস হেলেনকে আকৃষ্ট করলেন ভালোভাবেই। দ্রুতই তাদের মধ্রে সখ্য গড়ে উঠল। পিটার বিত্তহীন চালচুলোহীন। ধনীদের মনোরঞ্জন করে তাদের অর্থেই টিকে থাকেন তিনি। তাতে হেলেনের কোনো অসুবিধা নাই।
বরং হেলেন নিজামদের সঞ্চিত টাকা ইচ্ছেমতো উড়াতে শুরু করেন। মুকাররম ঝাকে বাধ্য করলেন পিটারকে তার গাড়ির শোফার এবং এসকর্ট হিসেবে নিয়োগ দিতে। হেলেন পুরনো গাড়ি বদলে ফেললেন, নতুন স্পোর্টস কার কিনে তাতে ঘুরে বেড়াতে শুরু করলেন, স্টিয়ারিংয়ে পিটার। অস্ট্রেলিয়ার সমাজে অন্যজন কি করছে এ নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। সেই পার্থেই নিঃস্ব পিটার ফোর্টস আর হেলেন সিমনস আলোচনায় উঠে এলেন। হেলেন-পিটার স্ক্যান্ডাল মুকাররম ঝার জন্য ভীষণ রকম অস্বস্থিকর হয়ে উঠল।
১৯৮৩তে হেলেন পার্থের সুপারমার্কেটে এলে শপের ফ্যাশন প্যারেডে অংশ নিয়ে সংবাদপত্রের খবর হন। তার হোটেল ভর্তি বন্ধু ,রাত করে ফেরা, 'গা ভরা অলঙ্কার -- কে এই প্রিন্সেস?' এই খবরে ছাপা নিজাম ক্ষুব্ধ হলেন। এই ঘটনা ক্রমাগত গঠতে খাকল, আর প্রতিবারই তার অরুচিকর অলঙ্কারের বাহুল্যের প্রসঙ্গটি উঠে আসতে শুরু করল। নিজামের পরিবর্তে পিটার 'ধনী নারীর সুখী যুবক' পরিচিতি লাভ করল।
১৯৮৬ পর্যন্ত মুকাররম ঝার সঙ্গে হেলেনের সম্পর্ক বজায় ছিল। এই সময়ে পার্থের হাই সোসাইটি হেলেনকে টাকার জন্য ইচ্ছেমতো ব্যবহার করল। যাকে খুশি টাকা দেওয়া, আর পিটার ফোর্টসওে সম্পর্কের কয়েক সপ্তাহের বাড়ি কিনে দেওয়া--এসব হেলেন গোপন রাখার চেষ্টা করলেন। কিন্তু তার ক্রমবর্ধমান বন্ধুর সংখ্যা এক সময় পিটারকেও বিচলিত করে তুলল এবং শেষ পর্যন্ত পিটারের আশঙ্কাই সত্যি হয়। নতুন নতুন পুরুষের বদলে পিটার নিজে থেকেই সরে পড়তে বাধ্য হন। পিটার প্রেমিক থেকে খারিজ হয়েছেন এ খবরও ছাপা হয়।
১৯৮৬-র শেষের দিকে এসে হেলেন গলায় প্রায়ই যন্ত্রণা অনুভব করতে থাকেন। তার গ্রন্থিগুলোয় প্রদাহ সৃষ্টি হয়। ১৯৮৭-র ফেব্রুয়ারিতে প্রিন্সেস আয়েশা ওরফে হেলেন সিমনস এইচআইভি পজেটিভ 'সনাক্ত হন, তবে সংবাদটি গোপন রাখা হয়। এ সংবাদে ভেঙ্গে পড়েন হেলেন। এ সময়ে পিটার তার সাথে নতুন করে যোগাযোগ শুরু করেন। ১৯৮৭-র জুনে পিটার ফোর্টস অসুস্থ হয়ে পড়লে পরীক্ষায় তাকেও এইচআইভি পজেটিভ সনাক্ত করা হয়। পিটার এই ঘাতক রোগে আক্রান্ত হওয়ার জন্য হেলেনকেই দায়ি করেন, কারণ তিনি পরিস্কার করে বলেন: হেলেনের সাথে পুনঃসম্পর্ক হওয়ার পর তিনি অন্য কোনো নারীর শয্যাসঙ্গী হননি। সংবাদটি দ্রুত পার্থের হাই সোসাইটিতে ছড়িয়ে পড়ে। যারা প্রিন্সেসের নিবিড় সান্নিধ্যে এসেছেন তারা আতঙ্কিত হয়ে নিজেদের শারীরিক অবস্থা পরীক্ষা করাতে কেউ প্রকাশ্যে কেউ গোপনে প্যাথলজিক্যাল ক্লিনিকে ছুটে যান। পিটার তার ৪০তম জন্ম দিবন বেশ জাকজমকপূর্ণভাবে পালন করেন। এটাই ছিল তার জীবনের শেষ জন্মোৎসব। ১৯৮৮-র ফেব্রুয়ারিতে তার মৃত্যু হয়।
হেলেন এইডস আক্রান্ত হওয়ার পরও শান্ত হননি। বরং তিনি মুকাররম ঝাকে তালাকের জন্য চাপ দিতে শুরু করেন। অন্য দিকে নিজাম দূরত্ব চাচ্ছিলেন, তালাক চাচ্ছিলেন না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি বাধ্য হন। প্রায় পাঁচশ মিলিয়ন ডলারে তাদের তালাক চূড়ান্ত হয়।
তবে তালাকের মাধ্যমে বিপুল অর্থের মালিক হলেও হেলেনের অবস্থা ক্রমেই খারাপ হতে থাকে। তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। নিজাম ভাবতে পারতেন অনাচার আর বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি হেলেন পাচ্ছে। কিন্তু দেখা গেল প্রতিদিন সন্ধ্যায় একজন ভিজিটর তাকে দেখতে আসছেন, তাকে প্রবোধ দিচ্ছেন। এই ভিজিটর একাদশ নিজাম মুকাররম ঝা। ১৯৮৯-র মে মাসের প্রথম দিকে শারীরিক অবস্থার আরও অবনতি হয়।
সিডনি মর্নিং হেরাল্ডের সাথে এক সাক্ষাৎকারে নিজাম বললেন, যদিও আমরা স্বামী স্ত্রী হিসেবে সম্পর্কিত ছিলাম না, কিন্তু প্রতি সন্ধ্যায় আমরা অনেক কথা বলতাম। তার ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়াটা ছিল খুব যন্ত্রণাদায়ক অভিজ্ঞতা। রয়াল পার্থ হসপিটালে হেলেনের মৃত্যু হয়।
হেলেনের মৃত্যুর পরপর অস্ট্রেলিয় গণমাধ্যম খানিকটা সদয়ই হয়েছিল। তীর্যক শিরোনমের মধ্যে ছিল: 'পার্টিগোয়ার প্রিন্সেস ডাইড অ্যাট ফর্টি ওয়ান আফটার এ লং ইলনেস'-- দীর্ঘ ভোগান্তির পর পার্টিমুখী রাজকন্যার মৃত্যু।
কিন্তু ক'দিন পরই সংবাদ হলো এই ডাইনি পার্থের হাই সোসাইটিতে এইডস ছড়িয়েছে। যারা তার নামে পাগল ছিল, যারা তার সম্পদ লুটেপুটে খেয়েছে তারা আক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু এক সময় যারা তার সার্বক্ষণিক সঙ্গী ছিল, তাদের আচরণে এমন দাঁড়িয়েছিল যে কেউ যেন তার নামও শোনেনি।
হেলেনের মৃত্যুকালীন ইচ্ছে অনুযায়ী তার দুই ছেলের লালন পালনের ভার গ্রহণ করলেন তার বোন রনডা। হেলেন মনে করতেন নিজাম বোহেমিয়ান এবং উদার ধরনের মানুষ। হেলেনের ছোট বোন জুলি একটি চিঠিতে হেলেনের পক্ষে কিছু কথা লিখলছিলেন:
হেলেনের প্রকৃত মৃত্যুর আগেই সে মারা গেছে বলে আমাদের বিশ্বাস। আমরা যে হেলেনকে চিনতাম এটা সেই হেলেন না। পিটার ফোর্টসের মৃত্যুর পরই হেলেনেরও শারীরিক অবস্থা খারাপ হতে থাকে। অদ্ভুত শোনালেও সত্য যে পিটার হেলেনকেই দোষারোপ করেছে। পিটারকে ভালোবাসার আগে হেলেন ভাবার কোনো সুযোগ পায়নি -- কেবল হেলেন তার আবেগ ও অনুভূতিকে অনুসরণ করে গেছে।
মুকাররম ঝা মানতেন যে তিনি দীর্ঘদিন প্রিন্সেস আয়েশার শয্যাসঙ্গী হননি, কাজেই তার মধ্যে এইচআইভি এইডস সংক্রমণ ঘটেনি, ঘটার কথাও না। কিন্তু তারপরও গুঞ্জন নিজাম-উল-মূলক মুকাররম ঝা এইডস আক্রান্ত হয়েছেন।
নিজাম-উল-মুলক মুকাররম ঝা সুইজারল্যান্ডের এক বড় হাসপাতালে রক্ত পরীক্ষা করতে দিলেন। রিপোর্ট এলো এইচআইভি নেগেটিভ। এটি বেশ আলোচনার মতো খবর হলো। নিজাম তো তাই চাচ্ছিলেন।
ইস্তাম্বুলের বসফরাসের তীরে এক কাবাবের রেস্তোরায় সাবেক মিস টার্কি ম্যানোলিয়া অনুর সাথে তার সাক্ষাৎ ঘটল -- আবারও প্রেমের সমীকরণ। দুজনের প্রেমের পরিণতি, ১৯৯০ সালে বিয়ে। ম্যানোলিয়া গর্ভবতী হন এবং ১৯৯৩ সালে এক প্রিন্সেসের জন্ম দেন। সেই কন্যা, প্রিন্সেস নিলুফার নামেই পরিচিত। কিন্তু কিছুকাল পর ম্যানোলিয়া অনুর আবিষ্কার করলেন জামিলা বোলারাস নামে মুকাররম ঝার এক উপপত্নীও রয়েছে। পলে এই জামিলাকে কেন্দ্র করেই তাদের বিয়েটা ভেঙ্গে গেল। ২০১৭ সালে ম্যানোলিয়ার মৃত্যু হয়। তারপর মুকাররম ঝা জামিলা ও অপর এক প্রিন্সেস আয়েসাকে বিয়ে করেন। হিজ হাইনেস সাহেবজাদা মীর বরকত আলী খান সিদ্দিকী মুকাররম ঝা বা আসফ ঝা ৮৭ বছর বয়সে এখনও ভালোই আছেন।
পাদটীকা : মুকাররম ঝার বাবা মীর ওসমান আলী খান আসফ ঝা ১৯৩৭ সালে পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি হিসেবে টাইম ম্যাগাজিনে চিত্রায়িত হন। তার ছেলে আজম ঝা যখন অটোমান সুলতান দ্বিতীয় আবদুল মজিদের কন্যা দুরু শেভারকে বিয়ে করেন তখন তার নানি প্রার্থী ছিলেন ইরানের রাজকুমার রোজা শাহ পাহলভি পরে শাহানশাহ) এবং মিশরের রক্তে প্রথম ফুয়াদের পুত্র ফারুক (যিনি পরে রাজা হন এবং জামাল আবদেল নাসের তাকে উৎখাত করেন)।
মীর ওসমান আলী খান তার ছেলে আজম ঝাকে ডিঙ্গিয়ে দৌহিক মুকাররম ঝাকে উত্তরসুরী নিয়োগ করে যান। মুকাররম ঝার প্রথম স্ত্রী বেগম এসরা বৈবাহিক সূত্রে প্রিন্সেস।