পরিচয়
লোকটাকে প্রথম দেখায় আমার চেনা চেনা লাগে। কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারি না কোথায় দেখেছি। আজকাল এমন হচ্ছে আমার। সহজ জিনিস মনে পড়ে না।
রাত প্রায় দশটা। এই ব্যস্ত রেস্তোরাঁর টেবিলগুলো প্রায় ফাঁকা। মাত্র কয়েকটা টেবিল। তবু লোকটা বেছে বেছে আমারই টেবিলের উল্টোপাশে এসে বসল। শুক্র, শনিবার ছাড়া প্রায় রাতেই আসি এখানে। সাড়ে নয়টার দিকে ভীড় কমে আসে। অফিসের ব্যস্ততা আর অন্যান্য কাজ শেষে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকি। হালকা কোনো খাবার কিংবা এক কাপ কফি খেয়ে তারপর উঠি। এ সময়টা আমার নিজের। তাই অহেতুক উপদ্রবে একটু ভ্রূ কুঁচকে গেল। টেবিলটা ছোট। দু'পাশে কেবল দু'টা লাল রেক্সিন মোড়ানো চেয়ার।
আশেপাশে আর কোনো ফাঁকা টেবিল নেই। থাকলে সেখানে গিয়ে বসতাম। এই ভাবতে ভাবতে ওপাশে বসা লোকটির দিকে নজর পড়ল। কেমন যেন চেনা চেনা চেহারাটা। ত্রিশের ঘরে বয়স। মুখে হালকা দাড়ি, চোখে কালো মোটা ফ্রেমের চশমা। লম্বাটে গাল। চোখে চোখ পড়তেই লোকটা আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসল। রেস্তোরাঁতে এমন সাধারণত হয় না। যা-ই হোক, লাল জামা পরা ওয়েটারকে ইশারায় ডাক দিলাম। আহামরি ভীড় নেই, তবু তার মধ্যে খুব ব্যস্ত ভাব।
পাশের টেবিলে ছোট বাচ্চাসহ একটা পরিবার। বাচ্চাটা থেকে থেকে হঠাৎ জোরে একটা চিৎকার দিচ্ছে। বাবা-মা ব্যতিব্যস্ত। এর মধ্যে ওপাশের লোকটি একটু নড়েচড়ে বসল। তারপর বলল, 'যা গরম পড়েছে!' আমি মনে মনে বেশ বিরক্ত হলাম, এ লোক তো দেখি গায়ে পড়ে কথা বলতে চায়। দু' ঢোঁক পানি খেয়ে নিয়ে আমি একটু মাথা ঝাঁকালাম। এখনই কিছুর অর্ডার দেব না। রেস্তোরাঁর ভীড় পাতলা হয়ে আসছে। আর এরা আমাকে চেনে। ওপাশের লোকটাও চুপ করে রইল। কিছুই অর্ডার দেওয়ার চেষ্টা করল না।
তারপর হঠাৎ সোজাসুজি আমার দিকে তাকিয়ে লোকটা বলল, 'লেখালেখি করেন?' আমি অবাক। কে এ? আগে তো দেখা হয়নি। যদিও প্রথম চেনা চেনা লাগছিল। সামান্য লেখালেখি করতাম এক সময়। এমন জনপ্রিয় নই যে হঠাৎ রেস্তোরাঁয় অচেনা লোকজন আমাকে চিনে ফেলবে। আমার ভ্রু আপনাতেই আরও একটু কুঁচকে এলো। তার চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম, 'কেন বলুন তো!' লোকটা একটুও উদ্যম না হারিয়ে বলতে শুরু করল, 'এই জন্যই আপনাকে চেনা চেনা লাগছিল।' আশ্চর্য! আমিও কিন্তু ভাবছিলাম, লোকটাকে চেনা চেনা লাগছে। অবশ্য অনেক লোকের চেহারাতেই একটা চেনা চেনা ভাব থাকে। কিছু বলার আগেই লোকটা আবার বলল, 'লাহিড়িপাড়া কলেজ কোয়ার্টার। আবিদুলের ঘুম আসে না। সিলিংয়ের উপর এসে পড়া আলো আর ছায়ার খেলা...।'
'জানেন, আবিদুলের চরিত্রটা নাড়া দিয়েছিল খুব। পুরনো বইয়ের বাতিক আছে আমার। কয়েক সপ্তাহ আগে ফুটপাত থেকে বইটা কিনেছি। তবে বইয়ে ছবিটায় আপনাকে বেশ তরুণ দেখায়'।
এ দেখছি সত্যি আমার বই পড়েছে। দুর্লভ ঘটনা। ভেতরে ভেতরে একটু অবাক হলেও বুঝতে দিই না। নিজের লেখক পরিচয়টা ভুলেই যাচ্ছিলাম। লোকটা বলতে শুরু করে, 'আমি আরও দুয়েক দিন আপনাকে এখানে আসতে দেখেছি। আপনি খুব অন্যমনস্ক থাকেন। নিশ্চয়ই নতুন কোনো লেখা নিয়ে।' লোকটা জানে না, যে বইটা সে পড়েছে ওটাই আমার সর্বশেষ লেখা। কমপক্ষে সাড়ে চার বছর আগের। এরপর নতুন কোনো লেখায় আর হাত দেওয়া হয়নি।
কী বলা উচিত বুঝতে না পেরে বললাম, 'আচ্ছা!' সে বলল, 'আমি কলাপাড়ায় থাকি। একটা বেসরকারি ব্যাংকে আছি। ছাত্র বয়সে প্রচুর বই পড়তাম। একটু আধটু লেখালেখির অভ্যাস ছিল।' লোকটা কী চায়? লেখা প্রকাশে সাহায্য চায় না তো? আমার কোনো প্রশ্ন কিংবা কৌত'হল প্রকাশ ছাড়াই লোকটা আরও কথা বলে যেতে থাকে। হয়তো অনেক দিন কথা বলার মত কাউকে পায়নি সে। আমার উৎসাহ কমে আসে। আমাদের দেশের লোকগুলো প্রাইভেসি এবং অন্যের সময়ের দাম বোঝে না। আমি হঠাৎ বিদায় নেওয়ার ভঙ্গিতে বলি, 'আচ্ছা, আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে ভাল লাগল।'
লোকটা একেবারে অবাক হয়ে যায়। একটু লজ্জাই পেয়ে যাই। শুরুতে যখন সে আমার বই পড়েছে বলেছিল, বেশ খুশি হয়েছিলাম। কিন্তু এখন যে-ই নিজের প্রসঙ্গে বলতে শুরু করেছে, অমনি আমার আগ্রহ কমে গেছে। লোকটা বলে, 'আমার নামই আপনাকে বলা হয়নি। আমার নাম রেদোয়ান আহমেদ।' একটু হেসে বলি, 'আমার নাম তো জানেনই।' লোকটা হেসে বলে, 'জি, জি। আপনার নাম মনে আছে।' লোকটার কথা বলার অকৃত্রিম আগ্রহ দেখে হঠাৎ সিদ্ধান্ত বদলে ওয়েটারকে আমাদের জন্য দুটো কফি দিতে বলি।
প্রশ্রয়টুকু পেয়েই সে আরও দ্রুত কথা বলতে শুরু করল। একসময় মানুষকে খুব আগ্রহ নিয়ে লক্ষ্য করতাম। নিশা চলে যাওয়ার পর থেকে এই আগ্রহ মরে গিয়েছিল। সবকিছুতেই। অনেক দিন পর আজ এই লোকটার প্রতি সেই আগ্রহ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করলাম।
কথা বলতে বলতে গতি কমিয়ে হঠাৎ একটু ধীরলয়ে লোকটা বলল, 'আপনাকে একটা কথা বলতে চাই।' আমি তাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, 'আচ্ছা, একটা কথা বলুন তো। আপনার সঙ্গে আমার আগে কি কোথাও দেখা হয়েছে?' সে একটু থেমে গিয়ে বলল, 'না! ...আমার মনে পড়ছে না।'
এরপর আরও অনেকগুলো কথা বলল। ধীরেসুস্থে। তার মধ্যে আমি অবশ্য সবটুকু ভালভাবে শুনতে পেলাম না। নিজের চিন্তায় হারিয়ে যেতে লাগলাম মাঝে মাঝেই। তবে লোকটা যা বলতে চাইল, তা বুঝতে পারলাম। কথার সারমর্ম হলো তার ইদানিং আত্মহত্যা করতে ইচ্ছা করে। অকারণে। আজকাল ঢাকা শহরের চাকরিজীবি সব লোককেই আমার মানসিক রোগী মনে হয়। তবু লোকটা এসব আমাকে বলছে দেখে বিস্মিত না হয়ে পারলাম না, 'কিছু মনে করবেন না, আমাকে এই কথাগুলো বলবার কারণ কী?' লোকটা পাত্তা না দিয়ে বলে চলল, 'ঘটনাটা প্রথম ঘটে আমার অফিসে। তেমন কিছুই না। সামান্য একটু কথা কাটাকাটি ...'
ব্যাপারটা আমি আগেও লক্ষ্য করেছি। কারও দুয়েকটা লেখা পড়লে, লোকে তাকে খুব আপন মনে করে। আমার উপন্যাস পড়ে সে সময় দু'জন চিঠি লিখেছিল, কয়েকজন যোগাযোগ করেছিল। এর মধ্যে একজন এমন একান্ত কথা লিখেছিল, যা স্বাভাবিকভাবে সে অদেখা কাউকে বলত না। হয়তো তার মনে হয়েছিল আমি খুব কাছের কেউ যে তাকে বুঝতে পারবে। এদের মধ্যে একটা চিঠি ছিল নিশা নামের একজন তরুণীর। যাক! আমি বর্তমানে ফিরে আসি। লোকটা কথা বলেই যাচ্ছে।
বললাম, 'আপনার এমন মনে হওয়ার কারণ কী?'
সে একটু অধৈর্য্য হয়ে বলল, 'সেটাই তো আপনাকে এতক্ষণ ধরে বলছি। ইদানিং হঠাৎ হঠাৎ এই চিন্তা আসছে আমার। তারপর আরেকদিন দাড়ি কাটার সময় হঠাৎ জোরে ব্লেডের পোচ মেরে দিলাম। অনেকখানি কেটে গেল। রক্ত পড়ল প্রচুর।' এটুকু বলে শার্টের কলার সরিয়ে দেখাল। সত্যিই একটা লম্বা দাগ সেখানে। বলল, 'পরে যখন সেন্স ফেরত আসল, নিজেই অবাক হলাম। কী করছি? একটু আগেই তো সব ঠিক ছিল।'
আমি বললাম, 'কোনো কিছু নিয়ে খুব স্ট্রেসড আছেন? অফিস, ফ্যামিলি?' রেদোয়ান অসহায় স্বরে বলল, 'না, না। কোথাও কোনো সমস্যা নেই। স্ত্রী আর ছেলেটাকে নিয়ে ভালোই আছি। অফিসেও কোনো সমস্যা নেই। যেটুকু ঝামেলা, সেটুকু সবজায়গাতেই থাকে।' আমার অবশ্য বিশ্বাস হল না। লোকটা প্রচন্ড মানসিক চাপে আছে। কিন্তু নিজেই তা স্বীকার করছে না। মাঝে মাঝেই হাসছে, যেন ভুলে থাকতে চাইছে। আমার মত সম্পূর্ণ অপরিচিতের কাছে পরিচিত ভঙ্গিতে কঠিন সমস্যা নিয়ে কথা বলছে। যেন এটা মোটেই অস্বাভাবিক নয়।
আমি একটা শ্বাস ফেলে বললাম, 'যদি কোথাও কোনো সমস্যা না থেকে থাকে, তাহলে ছুটি নিয়ে কোথাও কয়েক দিন ঘুরে আসুন।' তিনি একটু অধৈর্য্য হয়ে বললেন, 'সেটাও করেছি। ফ্যামিলি নিয়ে সতেরো তারিখে বান্দরবান থেকে ঘুরে এলাম।' ভারী রাগ লাগে আমার। তার সমস্যার সমাধান কি আমার দেওয়ার কথা! ফুটপাত থেকে কেনা একটা বই পড়ে সে আমাকে চিনেছে। তলস্তয় পড়লে কি সে তলস্তয়ের কাছে যেত নিজের সমস্যা নিয়ে? লোকটা তখনও বলে যাচ্ছে। তাকিয়ে থাকতে থাকতে পুরো ব্যাপারটা খুব অ্যাবসার্ড লাগে আমার। এভাবে এই রেস্তোরাঁয় রাত সাড়ে দশটায় সদ্যপরিচিত এক যুবকের আত্মহত্যার ইচ্ছার কথা শুনে যাচ্ছি... ব্যাপারটাই খাপছাড়া।
আমি একটু জোরেই বলে ফেললাম, 'আপনি একজন সাইকিয়াট্রিস্ট দেখান!' পাশের টেবিলের লোকদুটো মাথা ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকালো। স্বর নামিয়ে বললাম, 'এখন অনেক ভালো ভালো সাইকায়াট্রিস্ট আছেন। ইমতিয়াজ আহমেদ, আলী আসগর, রুবী চৌধুরি। নেটে সার্চ দিলেই ডিটেইলস পেয়ে যাবেন। কাউকে কিছু জানাতেও হবে না।' লোকটা ফিসফিস করে বলতে লাগল, 'আমার এক বন্ধু, সাইকোলজির স্টুডেন্ট ছিল। তার সঙ্গে কথা বলেছি। অবশ্য নিজের কথা বলিনি। আমার এক আত্মীয়ের সমস্যা বলে সমাধান চেয়েছি। কিন্তু...'
প্রসঙ্গ ঘুরানোর জন্য বললাম, 'আপনার ছেলের নাম কি?' লোকটার মুখের পেশি নরম হয়ে আসে, 'তুরাগ।' তারপর বিরতি না দিয়েই বলে যায়, '...তুরাগ নদের পাড়ে প্রথম ওর কাছে জেনেছিলাম বাবা হতে যাচ্ছি। ব্যাপারটা স্মরণীয় করে রাখতে আমরা এই নাম রেখেছিলাম।' এরকম একটা ঘটনা আমিও জানি। সম্ভবত অফিসে আমার এক কলিগও ছেলের নাম রেখেছিলেন তুরাগ। আজকাল সবাই কি তুরাগতীরে বেড়াতে গিয়ে সারপ্রাইজ দেয় নাকি!
আমি একটু গলা খাকারি দিয়ে রেদোয়ানকে বললাম, 'শুনুন, চাপ নেবেন না। জীবনটা এত জটিল না। হাসিখুশি থাকুন। তারপরও সমস্যার সমাধান না হলে ভালো একজন সাইকায়াট্রিস্ট দেখান। কারও অ্যাপয়ন্টমেন্টের দরকার হলে আমাকে ফোন দিতে পারেন। এই যে আমার কার্ড।' মনে হলো, কার্ডটা দিয়ে একটা ভুল করলাম। সে চুপ করে শুনল। তারপর হঠাৎ করে জরুরি কিছু মনে পড়েছে এমন ভঙ্গিতে চট করে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, 'আজ উঠি। আপনার সঙ্গে আরেকটু কথা বলতে পারলে ভাল হত। কিন্তু ক'দিন ধরেই বেশি রাত হচ্ছে ফিরতে। যাই।' আমি ভেতরে ভেতরে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। সে বলল, 'আমার নাম্বারটাও রাখুন।' তার নাম্বার রাখার কোনো ইচ্ছা আমার নেই, কারণ অফিসের বাইরের ফোন আমি মর্জি মোতাবেক ধরি। তবু বললাম, 'বলুন'। মোবাইল হাতে নিলাম ঠিকই। সেভ করলাম না। এসব অনাকাঙিক্ষত সমস্যা বয়ে বেড়াবার ইচ্ছা নেই। লোকটা বিদায় নিল।
তার চলে যাওয়া দেখতে দেখতে এবার একটু হাত-পা ছেড়ে বসলাম। নিশার কথা ভাবছিলাম। ইদানিং ওর মুখ আমার স্পষ্ট মনে পড়ে না। ও ভাবত, আমাকে ছাড়া বাঁচবে না। মানুষ কত ভুল ভাবে! রেস্তোরাঁর পাশের ফুটপাত দিয়ে অনেকেই ঘরে ফিরছে। আমার ফেরার কোনো তাড়া নেই।
তবু একসময় ভারী পায়ে উঠে দাঁড়াই। খুবই ক্লান্ত লাগে। বিল দিতে দিতে আমার রক্তে হঠাৎ একটা শিহরণ কাজ করে। কারণ রেদোয়ানকে আগে কোথায় দেখেছি মনে পড়ে যায়। বছর পাঁচ-ছয় আগে আমি একটা গল্প লিখেছিলাম 'বিপন্ন বিস্ময়'। বছর চৌত্রিশের একজন যুবককে নিয়ে, তার নাম 'রেদোয়ান'। স্ত্রী তরু ও সন্তান তুরাগকে নিয়ে স্বচ্ছল, স্বাভাবিক জীবন। কিন্তু এক রাতে ঘুম ভেঙে হঠাৎ রেদোয়ানের মরে যেতে ইচ্ছা করে। তারপর থেকে ইচ্ছাটা তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। দু'বার চেষ্টা করার পর তৃতীয়বার সে সফল হয়। জীবনানন্দের 'আট বছর আগের একদিন' কবিতা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে গল্পটা লিখেছিলাম। মনে করার চেষ্টা করি, রেস্তোরাঁয় আসা রেদোয়ান ক'বার আত্মহত্যর চেষ্টার কথা বলেছিল। দু'বার কি? তার মানে, তার মানে...। মাথায় দ্রুত একটা হিসেব চলতে থাকে। ওয়েটারকে টাকা দিয়ে দ্রুত দৌড়ে যাই বাইরে। মোবাইলে তার ফোন নাম্বারটা খুঁজতে থাকি। একসময় মনে পড়ে বিরক্ত হয়ে নাম্বারটা সেভ করেছিলাম না। একটা আতঙ্ক নিয়ে ফুটপাতে চলাচল করা অসংখ্য পথচারীর মধ্যে অন্ধকারে নিস্ফলভাবে রেদোয়ানকে খুঁজতে থাকি।