পাচার হওয়া প্রাচীন সম্পদ!
আজ হয়তো আপনার বসার ঘরের দেয়ালে ঝুলে থাকা ছবিটি খুব একটা আলাদাভাবে চোখে পড়ছে না। তবে আজ থেকে বহু বহু বছর পর এই সাধারণ চিত্রকর্মটিই সবার কাছে হয়ে উঠতে পারে অসাধারণ কিছু!
আর এই সবকিছুই সময়ের ফলাফল! সময়ের ফেরে বহুমূল্যবান দ্রব্য যেমন মূল্য হারিয়ে ফেলে, তেমনি সাধারণ কিছুকেও করে তোলে অনন্য। আর প্রাচীন এই ছবি, ঘরোয়া জিনিস, লেখা, আসবাব, মুদ্রা বা অ্যান্টিক দ্রব্যগুলোই হয়ে ওঠে পাচারের শিকার!
টাকার লোভে পৃথিবীজুড়ে অ্যান্টিক ট্রাফিকিং বা প্রাচীন দুষ্প্রাপ্য দ্রব্য পাচারের নজির খুব একটা কম নয়। লাভও তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। অবৈধ অস্ত্র এবং মাদকের পর অ্যান্টিক পাচারই একমাত্র অবৈধ পাচার ক্ষেত্র, যেখানে প্রতি বছর বিলিয়ন ডলার বিনিময় হয়।
অনেকসময় মূল্যবান এই দ্রব্যগুলো বহুকাল আগে যুদ্ধক্ষেত্রে হারিয়ে যাওয়া জাতির নিদর্শন, যেটি দীর্ঘসময় যাবত নির্দিষ্ট দেশকে ফেরত দেওয়া হয় না এবং ফলাফল হিসেবে পাচারকারীর হাতে পড়ে যায়। বহুকাল ধরে এই পাচার পরিচালিত হলেও ইসলামিক স্টেট অব ইরাক এন্ড দ্য লেভান্টের হাতে সিরিয়া ও ইরাকের ঐতিহাসিক স্থানগুলো ধ্বংস হওয়ার পর বিশ্বের নজরে ব্যাপারটি এ বিষয়টি আরো বড় আকারে উঠে আসে।
দেশ থেকে দেশে অ্যান্টিক পাচার করার এই ঘটনাটি ঘটেছে বৃহৎ ভারতবর্ষেও। কলোনিগুলো থেকে নিজেদের শাসনামলে বহ মূল্যবান দ্রব্য নিজেদের দেশে পাচার করেছে পশ্চিমা শাসকেরা। কূটনীতি এবং অর্থনৈতিক চুক্তির মাধ্যমে এসব দ্রব্যের কিছু নিজ দেশে ফেরত আনা গেলেও বেশিরভাগই রয়ে গিয়েছে ভিন্ন দেশে।
অ্যান্টিক পাচার, ফ্রান্স-চায়না রেষারেষি
২০০৯ সালের কথা। ফ্রান্সের প্যারিসে সেবার ১৮ শতকের ব্রোঞ্জ নির্মিত একটি ইঁদুরের মাথা ও একটি খরগোশের মাথা নিলামে তোলা হয়। মূর্তি দুটির মালিকানা তখন ছিলো ফ্রেঞ্চ ফ্যাশন ডিজাইনার ইভ সেইন্ট লরেন এবং শিল্পপতি পিয়েরে বার্জের। চীন দাবি জানায় যে মূর্তি দুইটি চীনের। কথাটা মিথ্যে ছিলো না। ১৮৬০ সালে আফিম যুদ্ধের সময় ফ্রেঞ্চ ও ব্রিটিশ সৈনিকেরা চীনে আসলে আরো অনেক কিছুর সাথে এই মূর্তিও তুলে নিয়ে যায়। নিলামে মূর্তি বিক্রি হলেও পরবর্তীতে নিলাম বাতিল হয় এবং ২০১৩ সালে মূর্তিটি চীনকে উপহার হিসেবে দিয়ে দেন এর মালিকেরা। প্রতিদানে চীন তাদেরকে ব্যবসায়িক সুবিধা দেয় নিজ দেশে। মূর্তি পাচার ও এর দেশে ফিরে যাওয়ার অনেক নজিরের মধ্যে এটি ছিলো অন্যতম একটি!
জাদুঘর: পাচার হওয়া মূর্তির ঠিকানা
সুযোগ পেলেই কোন দেশের অ্যান্টিক, সাংস্কৃতিক নিদর্শন ও অন্যান্য নানাবিধ সম্পদ বেমালুম নিজের মনে করে ভিন্ন দেশে তুলে নিয়ে আসাটা নতুন ঘটনা নয়। আর এসব প্রাচীন অ্যান্টিকের স্থান, বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুলোতে, হয়ে থাকে ভিনদেশের জাদুঘরে। পরবর্তীতে অনেক দেশই তাদের এই পাচার হওয়া সম্পদ ফেরত চায়। কখনো তারা সেটা পায়, কখনো পায় না।
এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতেই ১৯৭০ সালে ইউনেস্কো অবৈধভাবে পাচার হওয়া এসব সম্পদগুলোকে নিজ দেশের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার নির্দেশনা প্রদান করে। ব্যক্তিগত শখের বসে সংগ্রহকারী এবং জাদুঘরের প্রতি এই চাপটা প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। জাদুঘরগুলো নিজেদের সংগ্রহে থাকা সম্পদগুলো বৈধ কিনা তা খতিয়ে দেখার জন্য আইন বিশেষজ্ঞও নিয়োগ দিয়ে থাকে। তবে তা স্বত্ত্বেও কিছু ঝামেলা রয়েই যায়।
এই যেমন- বার্লিনের পারগ্যামন জাদুঘরের কথাই ধরা যায়। জাদুঘরটি ইউনেস্কো'র নির্দেশনা প্রদানের ৪০ বছর পূর্বে, ১৯৩০ সালেই নতুন কোন অ্যান্টিক গ্রহণ করা বন্ধ করে দেয়। এর সংগ্রহে থাকা ৫০০,০০০ সম্পদের মধ্যে প্রত্যেকটি সম্পর্কেই যথাযথ জ্ঞান রাখে তারা এবং এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞও নিয়োজিত রয়েছেন জাদুঘরটিতে। তবে এত কিছুর পরেও তুরস্কের গাজিনটেপ শহরের বাসিন্দারা কিন্তু এই দাবী একদম মানতে রাজি নয়। তাদের দাবী অনুসারে, এই জাদুঘর এবং লন্ডনের ব্রিটিশ জাদুঘরসহ বিশ্বব্যাপী কয়েকটি জাদুঘরে প্রায় ২০টির বেশি চুরি হওয়া তুরস্কের সম্পদ রয়েছে। ১৯৭০ সালের আগে পাচার হওয়া এই সম্পদগুলো ফেরত চান বাসিন্দারা। চীন বা ইতালির মতো তুরস্কের জন্যও হারানো প্রাচীন সম্পদ ফিরিয়ে আনা রাজনৈতিক লক্ষ্যের অন্তর্গত। এখন পর্যন্ত এভাবে দেশটি ৪,০০০টির বেশি অ্যান্টিক ফিরিয়ে এনেছে।
ব্যাক্তিগত সংগ্রাহক: ভিন্ন ধরণ, ভিন্ন নিয়ম
একটি দেশ অন্য দেশের কাছ থেকে নিজেদের সম্পদ ফেরত চাইতেই পারে। কিন্তু এই নিয়মটা কিন্তু ব্যান্তিগত সংগ্রহকারীদের বেলায় খাটে না। মার্কেট এখানে সবচাইতে বড় ভূমিকা পালন করে। ১৯৯৫ সালে অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল ইন্সটিটিউট ফর দ্যা ইউনিফিকেশন অফ প্রাইভেট ল' কনভেনশন অনুযায়ী, কোন ব্যক্তি অ্যান্টিক বা প্রাচীন শিল্প বিক্রি করতে গেলে তাকে প্রথমে সেই সম্পদের বৈধতা এবং ইতিহাস প্রমাণ করতে হবে। দুঃখের ব্যাপার হলো ইউনেস্কোর নির্দেশনা ১৩০টি দেশ মানলেও উপররে আইনটি মানতে রাজী হয়েছে মাত্র ৩৭টি দেশ।
এছাড়াও আছে করমুক্ত ইকোনমিক জোনের ব্যবস্থা। ফ্রি-পোর্ট ওয়ারহাউজগুলোতে চুরি হওয়া ছবি ও অন্যান্য সম্পদ বছরের পর বছর লুকিয়ে রাখেন অনেকেই। জেনেভার ফ্রি-পোর্টে এমন প্রায় লক্ষাধিক সম্পদ পড়ে আছে। ল্যুভেও এই সংখ্যা একেবারে কম নয়!
আরো অনেকের মতো অবৈধ ও পাচার হওয়া সম্পদের জন্য পৃথিবীর অন্যতম আর্ট ডিলার আলি অ্যাবাউটামের ফিনিক্স অ্যানসিয়েন্ট আর্ট গ্যালারিও ফ্রি-পোর্ট ব্যবহার করে। ২০১০ সালে সেখানে দ্বিতীয় শতকের একটি রোমান অ্যান্টিক পাওয়ার পর থেকে জেনেভাতে থাকা এই গ্যালারির ফ্রি-পোর্ট নিয়ে আইনগত কার্যক্রম চলছে! ব্যক্তিগত মালিকানাধীন সম্পদের ক্ষেত্রে তাই দেশের তুলনায় জল ঘোলাটা একটু বেশিই হয়ে থাকে!
অ্যান্টিক পাচারে আইএসআইএল এর সম্পৃক্ততা
প্রশ্ন আসতেই পারে যে, আইএসআইএল কিভাবে এবং কেন অ্যান্টিক পাচারের সাথে জড়িত? মূলত এই যোদ্ধাদের কার্যক্রমই সবার মনে এই প্রশ্ন তুলে ধরে। বর্তমান বিশ্বে ইন্টারনেট ক্রেতা ও বিক্রেতাকে কোনরকম বাড়তি ঝামেলা ছাড়াই প্রাচীন সম্পদ কেনা-বেচার সুযোগ করে দেয়। আইন সংক্রান্ত কাগজাদিরও দরকার সেভাবে পড়ে না। আর আইএসআইএল ঠিক এই সুযোগটাই নিয়ে থাকে বলে অনেকের ধারণা।
বিশেষ করে ইরাক ও সিরিয়াতে তাদের আক্রমণের পর এ ব্যাপারে সবাই আরো গভীরভাবে ভাবতে শুরু করেন। আইএসআইএল সবসময় কেন ঐতিহাসিক স্থাপনা ও স্থানগুলোতেই আঘাত করছে এবং সেগুলোকে ধ্বংস করে দিচ্ছে? এই প্রশ্নের উত্তর হিসেবে অ্যান্টিক পাচারের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের আর্থিক সরবরাহ অব্যাহত রাখাকেই ভাবেন বিশেষজ্ঞরা। তবে অনেকে এই ধারণাকে ভুল বলেও মনে করেন। তাদের মতে, আইএসআইএল-এর মতো কারো পক্ষে এতো নিখুঁতভাবে সম্পদ পাচার করাটা সম্ভব নয়।
২০০ বছরে বয়সী গ্রিক পার্থেনন মার্বেল হোক, কিংবা ভারতবর্ষের কোহিনূর, যুগে যুগে এক দেশ থেকে অন্য দেশে সম্পদ পাচার হয়ে এসেছে। তাদের কিছু নিজের জন্মভূমিতে ফিরে এসেছে, বেশিরভাগই আসেনি। তবে এ নিয়ে কাজ যে কম হচ্ছে তা নয়। রাজনৈতিক সম্পর্ক যেখানে মুখ্য, টিকে থাকার জন্য কূটনীতি যেখানে প্রয়োজন, সে বিশ্বব্যবস্থায় হাতে থাকা অন্য দেশের অ্যান্টিক তো ফিরিয়ে দেওয়াই যায়, তাই না?