প্রতিবাদ: ডিম্বাঘাত, পাদুকাঘাত ও চপেটাঘাত...
ডিম্বাঘাতও আছে, প্রক্রিয়াটি বহুল ব্যবহৃত বলে এর গুরুত্ব অনেক কমে গেছে। তবে এতো বেশি ব্যবহৃত যে ডিম নিজেই ইংরেজির ক্রিয়া হয়ে ইংরেজের অভিধানে ঢুকে পড়েছে। শব্দটি হচ্ছে এগিং (এগ মানে অবশ্যই ডিম, মূল শব্দ)। অভিধানগত অর্থ হচ্ছে মানুষ কিংবা কোনো সম্পদের উপর ডিম ছুঁড়ে মারা।
সাধারণত কাঁচা ডিম মারা হয়ে থাকে। খরচ কমাতে এবং কর্মসূচি (নিক্ষেপকারীর) অধিকতর সফল করতে পঁচা ডিম নিক্ষেপ করাটাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। কড়া সিদ্ধ শক্ত ডিমেরও চাহিদা আছে। এতে টার্গেট যথেষ্ট আঘাত পায়। অবশ্য ডিম ছোঁড়ার দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য আন্তর্জাতিক ডিম নিক্ষেপ প্রতিযোগিতাও শুরু হয়ে গেছে।
১৮ জুন ১৯৭০ যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী হ্যারল্ড উইলসন যখন নির্বাচন প্রচারণা চালাচ্ছিলেন সে সময় তরুণ রক্ষণশীলদের একজনের ছোঁড়া কাচা ডিম তার মুখে আঘাত করে এবং ডিমটি ভেঙ্গে যায়। হ্যারল্ড উইলসন বলেছেন, রাজনৈতিক মতানৈক্য থাকলে এমনটা ঘটতেই পারে। এটাকে সিরিয়াসলি নেবার কোনো কারণ নেই।
তবে দক্ষিণ এশিয়ার কোনো কোনো অংশে এটা ঘটলে ডিমকে আনবিক বোমা বিবেচনা করে নিক্ষেপকারীকে ঘটনাস্থলেই মেরে ফেলা হতো। কোনোভাবে বেঁচে থাকলেও মৃত্যুদণ্ড হবার মতো দন্ডবিধির ধারা জুড়ে দিয়ে তাকে নির্ঘাত কারাগারে পাঠানো হতো। ২০০৪ সালে তুলনামূলকভাবে কম সভ্য দেশ ইউক্রেনে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পদপ্রার্থী ভিক্টর ইয়ানুকোভিচের মাথায় ছুঁড়ে দেওয়া ডিম ভেঙ্গে যাবার পর তার মাথা ঢেকে দ্রুত তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় এবং আক্রমণটিকে বড় করে দেখাতে বিবৃতি দেওয়া হয় যে তার মাথায় ইট নিক্ষেপ করে হত্যার চেষ্টা হয়েছে। এ নিয়ে প্রত্যক্ষদর্শীরা হাসাহাসি করে নির্মল আনন্দ উপভোগ করার একটি সুযোগ পায়।
১৯১৯ এর মার্চে ব্রাজিলের সাবেক প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও দ্য সিলভা ব্রাজিলের দক্ষিণাঞ্চলে সফরে গেলে তার গাড়িতে অবিরাম ডিম নিক্ষেপ করা হয়। পরে বোঝা যায় এগুলো শুধু ডিম ছিল না- সাথে কিছু পাথরও ছিল। ২০১৭-র জুলাইয়ে পানামার স্বাস্থ্য মন্ত্রী রিকার্ডো ব্যারোসের কন্যার বিয়ের পরপরই যখন বর ও কণে চার্চ থেকে বেরোচ্ছিল তাদের গায়ে ডিম নিক্ষেপ করা হয়। অবশ্য কেউ কেউ বলেছেন, ডিমের দাম ফুলের দামের চেয়ে মোটেও কম নয়। সম্মান জানাতেই তা করা হয়েছে।
সম্প্রতি যারা ডিম্বাক্রান্ত হয়েছেন তাদের মধ্যে বেশ কজন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ রয়েছেন ডেভিড ক্যামেরন, নিকোলাস সারকোজি, র্যাফায়েল কোরিয়া, লুই ফরচুনো, ডেভিড ব্রেইন, হেলমুট কোহল, জন প্রেসকট, আর্নল্ড শোয়ার্জনেগার।
নিউজিল্যান্ডের বিরোধী দলীয় একজন নেতা ফ্র্যাজার এনিংকে যে তরুণ ডিম নিক্ষেপ করে, সাথে সাথে তাকে ধরাও হয় কিন্তু তার বিরুদ্ধে কোনো চার্জ না এনে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। অস্ট্রেলিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী জুলিয়া গিলার্ড ডিম এবং আাধখানা স্যান্ডউইচ পেয়েছেন, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন শুধু ডিম। রাজনীতিবিদদের বিশেষ করে ক্ষমতাসীন রাজনীতিবিদদের পঁচা ডিম নিক্ষেপের সংস্কৃতি সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের ছিল। ডিম্বাঘাতের চর্চা এখন নেই বললেই চলে।
ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নর এবং খ্যাতিমান অভিনেতা আর্নল্ড শোয়ার্জনেগারের হলুদ কোটে নিক্ষিপ্ত ডিম লেগে ফেটে যায়। এটি আমলেই নেননি তিনি। ভাষণ দিতে উঠে ডিম নিক্ষেপকারীকে উদ্দেশ্য করে বললেন, কেবল ডিম দিলে? আমার বেকন কোথায়? প্রতিবেশি ভারতে পঁচা ডিম রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বেশি ব্যবহৃত হয় আর বাংলাদেশে পঁচা ডিমের ব্যবহার বেশি দামি কেক এবং পুডিং বানাতেই।
ফুলের ঘায়ে মুর্ছা যাবার ব্যাপারটি যেমন বাস্তবিকই দুর্লভ, ডিমের ঘায়ে বা ডিম্বাঘাতে কোনো রাজনীতিবিদের মৃত্যু হয়েছে এমন শোনা যায়নি।
কোনো কারণে ক্ষোভ ঝাড়ার জন্য আসল মানুষটিকে পাওয়া না গেলে অগত্যা ছবিই হতে পারে ডিম্ববর্ণের লক্ষ্য। হংকংয়ের প্রতিবাদীকারীরা শি জিনপিং-এর ছবির উপর ঠিক এ কাজটিই করেছে। ২০১৭ সালে ওয়ারউইক রেলষ্টেশনে অস্ট্রেলিয়ান প্রধানমন্ত্রী বিলি হিউজেস এর ডিম পাবার ঘটনার শতবর্ষ পালিত হয়েছে। এ নিয়ে একটি
চপেটাঘাত না পাদুকাঘাত? যদি প্রাপ্য হয় এবং যদি অপশন দেওয়া হয় চপেটাঘাত না পাদুকাঘাত তাহলে কোনটা নেবেন?
আপনার সামনে দুটো মডেল আছে। একটি ফরাসি প্রধানমন্ত্রী ইমানুয়েল মাখোর চড় খাওয়া, অন্যটি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশকে জুতো ছুড়ে মারা।
পাশাপাশি দুটো মডেল নিয়ে গবেষণা করলে বরং চপেটাঘাতের চেয়ে পাদুকাঘাতেরই বেশি সমর্থন পাবার কথা। কারণ চড়টা লেগে পাঁচ আঙ্গুল বসে যাবার সম্ভাবনাই সবচেয়ে বেশি। আর পাদুকাঘাতের সময় জর্জ বুশের মতো ঝানু রাজনীতিবিদ হলে সময় মতো মাথা সরিয়ে নিয়ে নিক্ষেপকারীকেই 'ডজ' দিয়ে দিতে পারেন।
জর্জ বুশ এবিসি টেলিভিশনের মার্থা রাদাজকে স্পষ্ট বলে দিয়েছেন, জুতো মেরেছে তাতে কি? এতে অপমানিত হবার কোনো কারণ নেই, তিনি অপমানিত হনও নি। তিনি বলেছেন, তার জীবনে অনেক উদ্ভট ঘটনা ঘটেছে, এটাও একটা। সন্ধানী চোখে তিনি দেখেছেন নিক্ষিপ্ত জুতো জোড়ার সাইজ দশ নম্বর। সেটা সাক্ষাৎকারের সময় বলেও দিয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে গ্রাম বাংলার সেই গল্পটাই মনে পড়ার কথা। থানার দারোগা যে ধরে নিয়ে কান ধরে উঠবস করিয়েছে তাতে সমস্যা নেই। দারোগা তারপর যে চড় থাপ্পড় মেরেছে, তাতেও সমস্যা নেই। তারপর যে জুতোপেটা করেছে তাতেও তেমন সমস্যা নেই। এখন ভাবছি কোনদিন না আবার অপমান করে বসে।
জর্জ বুশদের নিয়ে এটাই সুবিধে। পাদুকাঘাতেও অপমানিত হন না।
বুশকে পাদুকাঘাত করুন এই নামের বেশ কটি ভিডিও গেইম বুশ যদ্দিন প্রেসিডেন্ট ছিলেন বাজারে খুব ভালো চলেছে। একই নামের একাধিক ভিডিও গ্যাম্বলিংও চালু হয়েছিল।
একটা সত্যি স্বীকার করতেই হবে পাদুকা নিক্ষেপকারীরা মোটেও ভাল টার্গেট শুটার নন। তাদের নিক্ষিপ্ত কম জুতোই টার্গেট স্পর্শ করে। এটাও অবশ্যই মানতে হবে তাদের তুলনায় ডিম নিক্ষেপকারীদের হাত অনেক পাকা। অনেকে নিক্ষেপকারী টার্গেটের মাথায়, কপালে, নাকে এবং মুখে ডিম ভাঙতে সক্ষম হয়েছে।
পাদুকা পুরান
পাদুকা ছুড়ে সেলেব্রিটি হতে হলে নিক্ষিপ্ত পাদুকা যেনতেন মানুষকে আঘাত করলে হবে না। এমনকি পোলান্ডের মতো ছোট দেশের হলেও অন্তত প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী তো হওয়া চাই। এদিক দিয়ে খুব নাম কামিয়েছেন মুনতাজার আল জাইদি।
১৪ ডিসেম্বর ২০০৮ বাগদাদ প্রধানমন্ত্রীর প্রাসাদে প্রধানমন্ত্রী নুরি আল মালিকিকে নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করছিলেন তখনকার মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ। সঙ্গত কারণেই পৃথিবীখ্যাত অনেকগুলো টিভি চ্যানেল তা লাইভ দেখিয়ে যাচ্ছিল। এই সময় একটি জুতো প্রেসিডেন্ট বুশের দিকে ছুটে এলো, প্রেসিডেন্ট মাথা সরিয়ে নিয়ে জুতো নিক্ষেপকারীকে ডজ দিলেন। জুতোর সাথে আরবি যে চিৎকারটি শোনা গেল তার বাংলা করলে দাঁড়ায়, 'তোর মতো কুত্তার জন্য এটাই ইরাকি জনগণের শেষ চুম্বন। ততোক্ষণে নিক্ষিপ্ত দ্বিতীয় জুতোকেও ডজ দিতে সক্ষম হলেন পৃথিবীকে বারবার ডজ দেওয়া প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ। প্রধানমন্ত্রী নুরি আল-মালিকি হাত দিয়ে জুতোটা ধরে ফেলার চেষ্টা করলেন। সে সময় যে চিৎকারটি শোনা গেল তা হচ্ছে 'এই জুতোটি ইরাকের বিধবা, এতিম ও নিহতদের পক্ষ থেকে।'
প্রধানমন্ত্রী গার্ড রেজিমেন্ট তখনই এই জুতো নিক্ষেপকারি মুনতাজার আল জাইদিকে ধরে ফেলল, তাকে পিটিয়ে বিধ্বস্ত অবস্থায় ইরাকি সেনাবাহিনীর বাগদাদ কমান্ডের কাছে হস্তান্তর করল। তারপর আদালতে। ১২ মার্চ ২০০৯ তাকে তিন বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হলো। ৭ এপ্রিল দণ্ড হ্রাস করে এক বছরের কারাবাস ধার্য করা হলো। সদাচারনের জন্য তাকে ৯ মাস কারাবাসের পরই মুক্তি দেওয়া হয়। তবে জেলখানায় তার উপর ভয়ঙ্কর নির্যাতন করা হয়েছে। পাদুকা গ্রহীতা হিসেবে জর্জ বুশ ব্যাপারটাকে কিভাবে নিলেন? তার সহজ উত্তর: জুতোটা দশ নম্বর ছিল। দৃষ্টি আকর্ষণ করার লক্ষ্যে এ কাজটা করেছে। এতে আমি নিজেকে এতোটুকুও হুমকিগ্রস্ত বলে মনে করি না। স্বাধীন সমাজে প্রতিবাদের অনেক ভাষা আছে। জুতো নিক্ষেপও একটি ভাষা।
১৯৭৭ সালে জন্মগ্রহণকারী জাইদি মূলত: টেলিভিশন সাংবাদিক। এর আগে একবার সরকারি বাহিনী তাকে অপহরণ করেছিল। জাইদির জুতোজোড়া এফবিআই ধ্বংস করে ফেলেছে।
ডিসেম্বর ২০০৯ প্যারিসে বক্তৃতা দেবার সময় জাইদির উপরও পাদুকা ছুঁড়ে মারা হয়েছিল, তিনি বললেন এটা নতুন কিছু নয়, আমারই টেকনিক। পাদুকা ছুঁড়েছে অপর একজন দেশছাড়া ইরাকি সাংবাদিক।
করাচির এক আইনজীবী খুব বড় ধরনের একটি কৃতিত্ব দাবি করে বসলেন। ২৯ মার্চ ২০১৩ পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফ এসেছিলেন কিন্তু হাইকোর্টে। তার বিরুদ্ধে অনেক মামলা। বে'শ কটাতে তিনি এন্টিসিপেটরি বেইল- আগাম জামিন নিয়ে রেখেছেন। কোর্টে তার আর্জি ছিলো জামিনের মেয়াদ আরো বাড়ানো হোক। আইনজীবী তাজাম্মুল লোধি এবং পাকিস্তান পিপলস পার্টির অনুসারী আরো অনেকেই ছিলেন জামিন বিরোধী। তারা মনে করেন বেনজির ভুট্টোকে নিরাপত্তা দিতে পারভেজ মোশাররফের ব্যর্থতার কারণেই তিনি খুন হন। সেদিন হাইকোর্ট জামিনের মেয়াদ বাড়িয়ে দিলো। খুশি মনে পারভেজ মোশাররফ তার সমর্থকদের নিয়ে যখন বের হচ্ছিলেন তাজাম্মুল লোধি নিজের পা থেকে এক পাটি পাম্পশু খুলে তাকে লক্ষ্য করে ছুঁড়ে মারলেন।
তাজাম্মুল দাবি করলেন জুতোটা পারভেজ মোশাররফের ঠিক নাকে গিয়ে লেগেছে। জুতো মারার কারণ তিনি মনে করেন পারভেজ গণতন্ত্রের হত্যাকারী।
সে রাতে সিএনএন পারভেজ মোশাররফকে জিজ্ঞেস করল, জুতোটা ঠিক কোথায় লেগেছে?
তিনি বললেন, তিনি বললেন, কিছুই লাগেনি, আমি দেখিওনি আর আমার সমর্থকদের কাছে শুনলাম কেউ একজন কিছু একটা ছুঁড়ে মেরেছিল। তিনি জুতো কথাটা মুখেই আনলেন না।
জাস্টিন বিভার এই প্রজন্মের ক্রেইজ। তার বেলাতে শুধু ফুল আর চুম্বন নয়, জুতোও জোটে। ৪ জুন ২০১৭ সুইডেনের স্টকহোমে সামার ফেস্টিভালে গান গাচ্ছিলেন। একজন ভক্ত পরের গানটি স্প্যানিশ সিঙ্গেল: জেসপাসিতো গাইবার জন্য অনুরোধ করলেন। জাস্টিন বিভার ভুলে গেছেন গানের কথা। চেষ্টা করেও যখন মনে করতে পারলেন না এবং এই গানটি গাইবেন না বলে জানালেন অমনি ক্ষিপ্ত ভক্ত ছুঁড়ে মারল তার জুতো। জুতো শেষ নয়, তারপর পানির বোতল। জেসপাসিতো কিন্তু তারই গাওয়া সুপারহিট গান।
১০ এপ্রিল ২০১৪ সাল ভেগাস স্ক্র্যাপ মেটাল ওয়েস্ট রিসাইক্লিং নিয়ে একটি সম্মেলনে ভাষণ দিচ্ছিলেন হিলারি ক্লিনটন। এ সময় তার কাছাকাছি এসে পড়ে নিক্ষিপ্ত কালো এবং গোলাপি রঙ এর স্পোর্টস শু।
৩৬ বছর বয়স্ক অপর এক নারী এলিনা মিসেল আর্নস্ট এর পায়ে দেখা গেল এই নিক্ষিপ্ত জুতোর একটি অপর পা খালি। আদালত তাকে এক বছরের প্রবেশনে রাখার রায় দেয়।
কিন্তু এলিসন এই ঝুঁকির কাজটা কেন করতে গেলেন? সহজ উত্তর, অনুষ্ঠানে উপস্থিত সবার এবং বিশেষ করে হিলারির দৃষ্টি আকর্ষণ করতে এ কাজ করেছেন।
তাতে লাভ? এলিসনের মতো মানসিক রোগগ্রস্তদের দিকে সরকার আরো বেশি মনোযোগ দেবে। এলিসন সত্যিই মানসিক হাসপাতালে ছিলেন। মঞ্চে হিলারি ভালোভাবে সামলে নিলেন, বললেন, ওটা কি কেউ আমাকে নিক্ষেপ করলেন নাকি? সলিড ওয়েস্ট ব্যবস্থাপনা যে এতোটা বিতর্কিত আমি জানতাম না।
পাদুকা প্রতিরোধক জাল
প্রেসিডেন্টকে জুতো নিক্ষেপ করা তাইওয়ানিজদের একটি রুটিন দায়িত্ব হয়ে উঠেছিল। তারা ২০১৩ সালের ৮ সেপ্টেম্বর ২৬ সেপ্টেম্বর ২৯ সেপ্টেম্বর ১০ অক্টোবর, ১৯ অক্টোবর প্রেসিডেন্ট মা ইং জিয়োর দিকে জুতো ছুড়ে মেরেছেন। শেষের দিকে অনেকেই একাধিকবার জুতো ছুঁড়তে থাকেন। ১০ নভেম্বর দেখা গেল জুতোগুলো আর প্রেসিডেন্টের কাছে পৌঁছাচ্ছে না। একটি জালে আটকে পড়ে যাচ্ছে। পরে দেখা গেল মঞ্চের সামনে দুপাশে দুটি খুঁটির সাথে জাল বাধা। এই জালের দাম ১০,৫০০ পাউন্ড।
জুতা ঠেকাবার জাল প্রেসিডেন্টকে জনগণের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে কিনা এ প্রশ্নের জবাবে প্রেসিডেন্টের মুখপাত্র বলেন, এই জালটা প্রেসিডেন্ট নিজে পছন্দ করেন না, তবে নিরাপত্তা রক্ষীদের কাজের প্রতি তিনি শ্রদ্ধাশীল বলে তাদের আনা হাতিয়ার তিনি প্রত্যাখ্যান করবেন না। শেষ দিকে বেশি সংখ্যক জুতো নিক্ষিপ্ত হতে থাকায় রাষ্ট্রীয় খরচে এই পাদুকা প্রতিরোধ কিনতে হয়েছে। তাতে থেমে যায়নি জুতো নিক্ষেপকারীরা। প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য জাতীয় জুতো সঞ্চয় ব্যুরো স্থাপন করা হয়। এতে প্রেসিডেন্টকে মারার জন্য জুতো গ্রহণ করা হয়।
২০১৩ সালে ইরানের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমদিনেজাদ মিশর সফরে এলে ৬ ও ৭ ফেব্রুয়ারি পরপর দুদিন জুতো নিক্ষেপকারীর কবলে পড়েন। দ্বিতীয় দিন ইসলামিক সম্মেলনে বক্তৃতারত অবস্থায় ছিলেন। তিনি তার বক্তৃতা অব্যহত রাখেন।
২০১২ সালে মাহমুদ আহমদিনেজার নিজ দেশেই জুতো নিক্ষেপকারীর কবলে পড়েন। ৪৫ বছর বয়স্ক রশিদ নামের সাবেক টেক্সটাইল কর্মচারি তার প্রাপ্য বেকার ভাতা না পেয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে প্রেসিডেন্টকে জুতো ছুঁড়েন। তার আগের প্রেসিডেন্ট খাতামি এই রশিদের হামলার শিকার হন তবে তিনি জুতো পাননি। রশিদ তার উপর ডিম ও টমোটো নিক্ষেপ করেছে।
২০১০ সালের অক্টোবরে এবিসি টেলিভিশনের দর্শক উপস্থিতিতে লাইভ প্রোগ্রামে সাবেক প্রধানমন্ত্রী জন হাওয়ার্ড যখন ইরানে অস্ট্রেলিয় সৈন্যবাহিনী প্রেরণ যুক্তিসম্মত ছিল বলে দাবি করছিলেন অস্ট্রেলিয় পরিবেশবাদী ও অ্যাক্টিভিস্ট পিটার রবার্ট গ্রে তার দুটো জুতোই জন হাওয়ার্ডের উপর নিক্ষেপ করেন কিন্তু একটিও তার গায়ে লাগেনি; তারপর গ্রে চিৎকার করে বলেন জন হাওয়ার্ডের হাতে রক্ত। পিটার গ্রে ক্যান্সারাক্রান্ত ছিলেন, কয়েক মাস পরই মারা যান।
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার তার স্মৃতিকথা অ্যা জার্নি-র জন্য প্রকাশকের কাছ থেকে আগাম ৭ মিলিয়ন ডলার নিয়েছিলেন। ৪ সেপ্টেম্বর ২০১০ ডাবলিনে বইয়ের দোকানে বসে বইতে অটোগ্রাফ দিচ্ছিলেন। এর মধ্যে প্রথমে জুতো (একটি লেডিস স্যান্ডেল) এসে পড়ে, তারপর ডিম। ততক্ষণে দোকানের বাইরে জমে গেছে দু'শ প্রতিবাদকারী, তারা টনিকে ইরাকের খুনি বলে সম্বোধন করলেন এবং চিৎকার করে জানালেন টনির হাতে রক্ত। এই বইতেও তিনি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ইরাকযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করার জন্য তিনি মোটেও দুঃখিত নন।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জারদারি থাকা অবস্থায় বার্মিংহাম সফরের সময় তার স্বদেশি সর্দার শামিম খান তার দিকে দুটো জুতো ছুঁড়ে মারেন: শামিম পাকিস্তানি কুর্তা ও সালওয়ার পরিহিত অবস্থায় ছিলেন। কেন এ কাজটি করলেন তার স্পষ্ট জবাব দিয়েছেন: পাকিস্তানের ইতিহাসে আশি বছরের সবচেয়ে বড় বন্যার সময় আসিফ আলী দেশবাসীর পাশে না দাঁড়িয়ে সবচেয়ে বড় ধরনের মৌজ করতে ব্রিটেন চলে এসেছেন। জুতো, জুতোই তার প্রাপ্য। সর্দার শামিম জেলে গেলেও জারদারি বিরোধীদের কাছে তিনি বীর হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছেন।
২০০৯ সালের ২৬ এপ্রিল নির্বাচনী প্রচারণার সময় তখনকার ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং পাদুকা খেতে খেতে বেঁচে যান। ২৮ বছর বয়সী এক তরুণ ঝুঁকি নিয়ে এই কাজটি করে। পুলিশ তাকে সাথে সাথে ধরে ফেললেন মনমোহন সিং তাকে ক্ষমা করে ছেড়ে দেন।
২০০৯ এর ২ ফেব্রুয়ারি চীনের প্রধানমন্ত্রী ওয়েন জিয়াবাও এলেন ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে 'উন্নয়নের নিরিখে চীনকে দেখুন' শীর্ষক একটি বক্তৃতা দেবার জন্য। প্রধানমন্ত্রী মঞ্চে এসে বক্তৃতা শুরু করতেই দর্শক শ্রোতার মধ্য থেকে মার্টিন জাঙ্কে নামের ২৭ বছর বয়সী একজন জার্মান তরুণ চেঁচিয়ে বললেন, ক্যামব্রিজ এ কী বেশ্যাবৃত্তি শুরু করেছে? এতো স্বৈরাচারী শাসক। এই লোক মিথ্যে কথা শোনাচ্ছে।
তারপরই তরুণ তার দিকে জুতো নিক্ষেপ করে। কাছাকাছি এসে জুতোটা পড়ে। ক্যামব্রিজের ভাইস চ্যান্সেলর অ্যালিসন রিচার্ড মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেন এবং বলেন একজন ছাত্রের আচরণ দিয়ে ক্যামব্রিজকে বিচার করা ঠিক হবে না। গ্রেফতারকৃত মার্টিনের বিরুদ্ধে মামলা চলাকালে মার্টিনের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি আরোপের জন্য চীন হস্তক্ষেপ করে বলে মার্টিন দাবি জানায়।
ক্ষমতাবানদের জুতো মারার ঐতিহ্যটি বেশ পুরোনো। জুতোতে সবার প্রতিক্রিয়া একই রকম হয় না। কেউ এটাকে টার্গেট শুটিং-এর মতো খেলা হিসেবে নেন। বুদ্ধিমান রাজনীতিবিদরা তাই করেন। প্রথমদিকে জুতো নিক্ষেপের শিকার হয়েছেন রোমান সম্রাট দ্বিতীয় কনস্ট্যান্টিয়ান। এটি ৩৫৯ সালের ঘটনা। জুতোভাগ্য আরো অনেকের হলেও রাজা, প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী প্রমুখের পাদুকাঘাতই ইতিহাসে ঠাঁই পায়।
একটি কেবল চপেটাঘাত
আর্নেস্ট হেমিংওয়ে বলেছেন, তিনি বই দিয়ে ম্যাক্স ইস্টম্যানের গালে চড় বসিয়ে দিয়েছিলেন। আর ম্যাক্স বলেছেন, আর্নেস্টকে ডেস্ক থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে তার মাথার উপর দাঁড়িয়েছিলেন। ম্যাক্স যা করেছেন তা এ লেখাটিতে বিবেচ্য নয়, এমনকি আর্নেস্ট হেমিংওয়ে যা করেছেন ইংরেজিতে তা 'স্ল্যাপ উইথ অ্যা বুক' হলেও এটাকে বাংলা আক্ষরিক অর্থে চপেটাঘাত বলতে আমরা রাজি নই। হাতের পাঁচটি আঙ্গুলই যদি না বসল তো কিসের চপেটাঘাত?
সর্বশেষ চড় কিংবা চপেটাঘাত খেয়েছেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখো, এ ঘটনা এখনও তরতাজা। ৮ জুন ফ্রান্সের দক্ষি-পূর্বাঞ্চলের একটি শহরে সফর করার সময় প্রেসিডেন্ট বেস্টনির বাইরে দাঁড়ানো সমর্থক ও উৎসাহী দর্শকদের সাথে হাত মেলাতে থাকেন। এমন সময় সবুজাভ টি শার্ট, সান গ্লাস ও মাস্ক পরিহিত এক যুবক প্রেসিডেন্টের সাথে হাত মেলানোর সময় বা হাতে তাকে আঁকড়ে ধরে ডান হাতে চড় বসিয়ে দিয়ে চেঁচিয়ে উঠেন, মাখোবাদ নিপাত যাক।
প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা রক্ষীরা ঘটনার পরপরই তাকে ধরে নিচে ফেলে দেয়; প্রেসিডেন্টও কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে নিজেকে সামলে নেন। ১০ জুন আদালত তাকে চার মাসের কারাদন্ড প্রদান করে। এই চপেটাঘাত প্রদানকারীর নাম ড্যামিয়েন ট্যারেন। তার কোনো পূর্ব অপরাধের রেকর্ড নেই। গণ কর্মচারিকে আঘাত করার শাস্তি ১৮ মাসের কারাদণ্ড। প্রেসিডেন্ট একজন গণকর্মচারি। তিন সদস্যের আদালত তাকে ১৮ মাসের কারাদন্ড দিয়ে ১৪ মাসের দণ্ড সাসপেন্ডেড রাখেন। তাকে ৪ মাস কারাবাস করতেই হবে, তবে এর মধ্যে নতুন কোনো অপরাধে জড়িয়ে পড়লে স্থগিত ১৪ মাসের দণ্ডও তাকে ভোগ করতে হবে।
ড্যামিয়েন এমন একটা বড় কাজ করলেও মুনজাতার আল-সাইদির মতো সেলেব্রিটি হয়ে উঠতে পারেনি কারণ বেসরকারি সরকারি নির্বিশেষে সকল দলই তার হঠকারিতার নিন্দা করেছে। চপেটাঘাত শুনলেই আমার নজরুলের লিচু চোরকে মনে পড়ে।
....
আমিও বাগিয়ে থাপড়
দে হাওয়া চাপিয়ে কাপড়
লাফিয়ে ডিঙনু দেয়াল,
দেখি এক ভিটরে শেয়াল! …
সেকি ভাই যায় রে ভুলা-
মালীর ঐ পিটুনিগুলা!
কি বলিস ফের হপ্তা!
তৌবা-নাক খপ্তা…!
চপেটাঘাতের মতো গুরুত্বপূর্ণ অপরাধ নিয়ে অভিসন্দর্ভ লেখা লেখা যায়। আপাতত এটুকুই থাক।