বাগেরহাট কলেজে জীবনানন্দ: কেউ কি মনে রেখেছে?
পড়ালেখা শেষ করে ১৯২২ সালে কলকাতার সিটি কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিলেও ছয় বছরের মাথায় ১৯২৮ সালে একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে চাকরি হারান জীবনানন্দ দাশ। বছর দেড়েক বেকার থাকার পর ১৯২৯ সালের কোনো এক সময়ে (সঠিক তারিখ জানা যায় না) যোগ দেন বাগেরহাট কলেজে। ভূমেন্দ্র গুহর (জীবনানন্দের ডায়েরি, বিষয়মুখ, জানুয়ারি-জুন ২০০১, পৃষ্ঠা ৮৮) হিসাবে, জীবনানন্দ যেহেতু ১৯২৯ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৩০ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত দিল্লির রামযশ কলেজে ছিলেন এবং বাগেরহাটে ছিলেন রামযশ কলেজের আগে, সে হিসাবে ১৯২৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসের আগে কোনো এক সময় বাগেরহাট কলেজে তিনি পড়িয়েছেন। ক্লিন্টন বি সিলি (অনন্য জীবনানন্দ, পৃষ্ঠা ৮৯) জানাচ্ছেন, সিটি কলেজের চাকরি যাওয়ার পর ১৯২৯-এর শেষভাগের আগ পর্যন্ত তিনি আর কোনো চাকরি পাননি। তবে ক্লিন্টনের এই হিসাব পরিস্কার নয়। কারণ ১৯২৯ সালের সেপ্টেম্বরে (মতান্তরে ডিসেম্বর) যদি তিনি দিল্লি রামযশ কলেজে যোগ দেন, তাহলে বাগেরহাটে ২ মাস ২০ দিন কাজ করতে হলে জুন-জুলাইতে তার এখানে যোগ দেয়ার কথা।
গোপালচন্দ্র রায়ের (জীবনানন্দ, পৃষ্ঠা ২৭) হিসাবে, সিটি কলেজের চাকরি চলে যাওয়ার পরে বছরখানেক বেকার ছিলেন জীবনানন্দ। সিটি কলেজে স্বরস্বতী পূজা নিয়ে সমস্যা তৈরি হয় ১৯২৮ সালের ২৭ জানুয়ারি এবং গ্রীষ্মের আগাম ছুটি দিয়ে কলেজ বন্ধ ঘোষণা করা হয়। ওই সময় চাকরি হারান জীবনানন্দ। অর্থাৎ ১৯২৮ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে পুরো বছর তিনি বেকার ছিলেন। পরের বছর ১৯২৯ সালের সেপ্টেম্বরে দিল্লির রামযশ কলেজে চাকরি পান। প্রভাতকুমার দাস (জীবনানন্দ দাশ, পৃষ্ঠা ৩৬) জানাচ্ছেন, সিটি কলেজের চাকরি হারানোর পরে বছর দেড়েক বেকার ছিলেন জীবনানন্দ। আর কল্যাণকুমার বসুর (রবীন্দ্রনাথ অতুলপ্রসাদ জীবনানন্দ এবং একজন প্রবাসী বাঙালী, পৃষ্ঠা ৯৯) মতে, বাগেরহাটের চাকরি ছাড়ার কিছুদিন পর দিল্লির রামযশ কলেজে যোগ দেন জীবনানন্দ। এসব হিসাব মিলিয়ে দেখলে ধারণা করা যায়, ১৯২৯ সালের মাঝামাঝি কোনো একসময় জীবনানন্দ বাগেরহাট কলেজে পড়িয়েছিলেন।
১৯১৮ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে ১৯৩৩ সাল পর্যন্ত কলেজের নাম ছিল বাগেরহাট কলেজ। এরপর কলেজের পরিচালনা পর্যদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নাম পরিবর্তন করে প্রফুল্লচন্দ্র কলেজ বা পি.সি কলেজ নামকরণ করা হয়। অর্থাৎ জীবনানন্দ যখন এই কলেজে পড়াতে আসেন, তখন এটি বাগেরহাট কলেজ। এই কলেজটি প্রতিষ্ঠায় হাভেলি পরগণা সোশ্যাল রি-ইউনিয়ন নামে একটি সংঘের কর্তা ব্যক্তিরা বড় ভূমিকা পালন করেছিলেন। প্রতিষ্ঠানটির পৃষ্ঠপোষক ছিলেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। তাই পরবর্তীকালে কলেজটির নামকরণ করা হয় তারই নামে (প্রভাতকুমার, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৩৭)।
জীবনানন্দের প্রথম জীবনীকার গোপালচন্দ্র রায় (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ২৭) জানাচ্ছেন, ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দের একসময় জীবনানন্দ বাগেরহাট কলেজে ইংরেজির অধ্যাপক হিসেবে একটা কাজ পেলেন। খুব সম্ভব বিজ্ঞাপন দেখে দরখাস্ত করেই তিনি এই কাজটা জোগাড় করেছিলেন। কাজটা টেম্পরারি ছিল কি না, জানি না। তবে জীবনানন্দ এই চাকরি মাত্র মাস তিনেক করেছিলেন।
জীবনানন্দের পূর্ণাঙ্গ জীবনীকার প্রভাতকুমার দাসের (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৩৬) ভাষ্যমতে, ওই কলেজের অধ্যাপক মনোরঞ্জন কর ছুটি নিয়ে কলকাতার বঙ্গবাসী কলেজে যোগ দিলে তার স্থলে লিভ ভ্যাকান্সিতে অস্থায়ীভিত্তিতে যোগ দেন জীবনানন্দ দাশ।
হরিশংকর জলদাসও (জীবনানন্দ ও তাঁর কাল, পৃষ্ঠা ৮৭) লিখেছেন, মনোরঞ্জন কর নামে একজন শিক্ষক ছুটি নিয়ে কলকাতায় চলে গেলে পিসি কলেজে তার পদে অস্থায়ীভিত্তিতে জীবনানন্দ যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু ক্লিন্টন জানাচ্ছেন, জীবনানন্দের পরে তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন মনোরঞ্জন কর। মি. কর এবং প্রভাষচন্দ্র ঘোষ নামে আরেকজনের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিকে ক্লিন্টন বি সিলি (অনন্য জীবনানন্দ, পৃষ্ঠা ৯৮) জানাচ্ছেন, ১৯২৯ সালের শেষদিকে জীবনানন্দ কলকাতা আর বরিশালের মাঝামাঝি বাংলাদেশের খুব ছোট একটা শহর বাগেরহাটে সদ্য স্থাপিত (আসলে কলেজটি স্থাপিত হয় ১৯১৮ সালে, ফলে জীবনানন্দ যখন যোগ দেন তখন কলেজের বয়স ১১ বছর) প্রফুল্লচন্দ্র কলেজে। সেখানে তিনি ছিলেন মাত্র কয়েক মাস। মূলত ২ মাস ২০ দিন তিনি এই কলেজে ছিলেন (জলদাস, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৮৭।
প্রভাতকুমার (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৩৭) জানাচ্ছেন, এই কলেজের কাজে জীবনানন্দ খুব একটা খুশি হননি। প্রাকৃতিক পরিবেশ মনোমুগ্ধকর হলেও কলেজের সাথে যুক্ত মানুষজনের আচার-ব্যবহার তাঁর ভালো লাগেনি। বিরক্ত হয়ে তিনি শেষ পর্যন্ত মানিয়ে নিতে না পেরে চাকরি ছেড়ে জন্মস্থান বরিশালে চলে যান। চমৎকার প্রকৃতি, পরিবেশ থাকা সত্ত্বেও জীবনানন্দের চাকরি ছাড়ার পেছনে গবেষক সিরাজ সালেকীনও (জীবনানন্দ দাশ, পৃষ্ঠা ৪৯) কলেজের সঙ্গে যুক্ত কর্তাব্যক্তি ও শিক্ষকদের বিরূপ আচরণের কথা উল্লেখ করেছেন। জীবনানন্দের ছোট ভাই অশোকানন্দও (গোপালচন্দ্র, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ২৭) জানান, বাগেরহাট কলেজে ভালো না লাগায় দাদা ওই চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন।
এই কলেজে একসময় শিক্ষকতা করেছেন কবি আবুবকর সিদ্দিক (জন্ম ১৯৩৪)। তিনি ১৯৬৭ সালের এক স্মৃতিকথায় (বাগেরহাটের চিত্রপটে জীবনানন্দ দাশ, উত্তরাধিকার, বাংলা একাডেমি, জীবনানন্দ জন্মশতর্বষ সংখ্যা, পৃষ্ঠা ৪৩০-৪৩২) জানাচ্ছেন, ওই বছর জীবনানন্দের খোঁজে বাগেরহাটে যান মার্কিন গবেষক ক্লিন্টন বুথ সিলি। অধ্যাপক সিদ্দিকের ভাষায়, এর আগ পর্যন্ত তাঁর জানা ছিল না যে, জীবনানন্দ দাশের উপরে কেউ ডক্টরেট লেভেলে কাজ করছেন। তাও বাঙালি নন, বরং একজন বিদেশি। এই ঘটনা আবু বকর সিদ্দিককে বিস্ময়ে অভিভূত করে। ক্লিন্টনের কাছেই এ তথ্য প্রথমে জানা যায় যে, জীবনানন্দ দাশ এই কলেজে পড়িয়েছেন।
আবু বকর সিদ্দিক লিখছেন, তখন হেড ক্লার্ক ইয়াকুব আলী। তাকে নিয়ে প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান শুরু হয়। অর্থাৎ জীবনানন্দের সময়কালের কোনো রেকর্ডপত্র আছে কি না, তা খুঁজে দেখা। অবশেষে সন্ধান মিললো ১৯২৯ সালের রেকর্ড খাতা। অধ্যাপক সিদ্দিকের ভাষায়, সে এক রোমাঞ্চকর অনুভূতি। রেকর্ড অনুযায়ী, অধ্যাপক এম. কর ওরফে মনোরঞ্জন কর বাগেরহাট পি.সি কলেজ থেকে ছুটি নিয়ে কলকাতার বঙ্গবাসী কলেজে যোগ দেন। তাঁর লিভ ভ্যাকান্সিতে অস্থায়ী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন জীবনানন্দ দাশ। বেতনের বইটিও উদ্ধার করা সম্ভব হয়। তাতে সাক্ষ্য মেলে, জীবনানন্দ এই কলেজ থেকে মাত্র দুই মাস ২০ দিনের মাইনে তুলেছেন। তবে জীবনানন্দ দাশ ভালো না লাগায় বা কর্মপরিবেশে সন্তুষ্ট হতে না পারার কারণে বাগেরহাট কলেজের চাকরি ছেড়েছিলেন বলে তার ভাই ও বোন যে দাবি করেছেন, তাকে 'আগবাড়ানো এবং আন্দাজি বিশ্লেষণ' বলে মনে করেন আবুবকর সিদ্দিক।
জীবনানন্দের খোঁজে
২০১৯ সালের ২৫ ডিসেম্বর কনকনে শীতের সকালে হাজির হই বাগেরহাট পি.সি কলেজে। মূল গেট দিয়ে ঢুকলেই চোখে পড়ে দেয়ালঘেরা বড় মাঠ। মাঠসংলগ্ন রাস্তাটি ঢুকে গেছে উত্তর দিকে। হাতের ডানে দেয়ালঘেরা আরেকটি ছোট ক্যাম্পাস। এখানেই কলেজের প্রতিষ্ঠাতা আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্রর একটি ভাস্কর্য। উঁচু বেদির উপরে কংক্রিটের মূর্তি। ধুতি পাঞ্জাবি আর গায়ে চাদর জড়ানো। হাতে বাঁকা লাঠি হাতে দাঁড়ানো প্রফুল্ল চন্দ্র। মাথার উপরে ছাতা। গ্রিল দিয়ে ঘেরাও করা ভাস্কর্যের পেছনেই কলেজের পুরনো ভবন। এই কম্পাউন্ডে পুরনো দুটি ভবন। দখিনের একতলা ভবনটি হলুদ রঙের। লোহার গ্রিল দেয়া। নাম কামাখ্যাচরণ ভবন। কামাখ্যাচরণ নাগ ছিলেন এই কলেজের প্রথম অধ্যক্ষ। এটি পূর্বপশ্চিম এবং উত্তর-দক্ষিণে সম্প্রসারিত। এই ভবনের গায়ে খোদাই করে লেখা 'সরকারি পিসি কলেজ বাগেরহাট প্রতিষ্ঠা ১৯১৮।' এই ভবনে আরও আছে যুব রেড ক্রিসেন্ট এবং ছাত্রী মিলনায়তন। আর উত্তর দিকের দোতলা ভবনটি বাগেরহাটের একসময়কার এসডিও বিষ্ণুপদ ভট্টাচার্যের নামে। এটিই মূলত পুরোনো ভবন। এখানে অধ্যক্ষের কার্যালয়, প্রশাসনিক ভবন ও দর্শন বিভাগ।
এই কম্পাউন্ড থেকে বেরিয়ে হাতের ডানে, পশ্চিম দিকে বঙ্গবন্ধুর সুন্দর ম্যুরাল। বড় বেদির উপরে নির্মিত। এর পেছনে বিজ্ঞান ভবন। মাঠের দক্ষিণ-পশ্চিমে শহীদ মিনার। উত্তর দিকে তিন তলা ভবনে রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ইসলামের ইতিহাস ও অর্থনীতি বিভাগ। আড়াই তলা ব্যবসায় শিক্ষা ভবনে ইতিহাস ও ব্যবস্থাপনা এবং ছাত্র সংসদ কার্যালয়। সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যখন ছাত্র সংসদের কার্যক্রম নেই বললেই চলে, সেখানে জীবনানন্দের স্মৃতিবিজড়িত এই কলেজে ছাত্র সংসদের জন্য আলাদা কার্যালয় এবং বড় সাইনবোর্ড সত্যিই অন্যরকম। মাঠের পশ্চিম পাশে মাঝারি আকারের একটি পুকুর। দুপাশে শানবাঁধানো ঘাট। পশ্চিমে ছাত্রাবাস। পুকুর ও মাঠ সংলগ্ন একটি ছোট পার্ক, যেটির নামকরণ করা হয়েছে মঘিয়ার জমিদার রামনারায়ণ রায় চৌধুরীর নামে, রাম নারায়ণ পার্ক। এখন ইংরেজি বিভাগ অধ্যক্ষের বাসভবনের মুখোমুখি। নতুন পাঁচতলা ভবনের তৃতীয় তলায়। জীবনানন্দের সময় ইংরেজি বিভাগ ছিল পুরোনো ভবনে।
কেউ কি মনে রেখেছে?
ক্যাম্পাসে হাঁটতে হাঁটতে দেখা হয় কয়েকজন ছাত্রীর সঙ্গে। সৃষ্টি পারমিতা, তার বোন দৃষ্টি পারমিতা, নওসিন সুলতানা, হাফসা দিলরুবা, তার বোন ফারিয়া দিলরুবা এবং নাঈমা আক্তার। ছয়জন ছাত্রীর মধ্যে চারজনই পরস্পর বোন। জীবনানন্দকে খুঁজতে এসে এটিও এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। তারা পড়েন কলেজের বিভিন্ন বিভাগে। জানালেন, তারা জীবনানন্দের কবিতা শুধু পড়েছেন তাই নয়, তিনি যে এই কলেজে শিক্ষকতা করেছেন, সে কথাও শুনেছেন শিক্ষকদের কাছে। কিন্তু ঠিক কোন সময়টায় তিনি এখানে পড়িয়েছেন, তা জানেন না। জীবনানন্দ যে ইংরেজির শিক্ষক ছিলেন, বরিশালে তার জন্ম, বাবার নাম সত্যানন্দ দাশ, মা কুসুম কুমারিও যে কবি ছিলেন—এসব তথ্যও এই শিক্ষার্থীরা মুখস্ত বলে দিলেন।
যদিও এখানে জীবনানন্দের স্মৃতি বলতে কিছু নেই। এমনকি ইংরেজি বিভাগে তার একটি ছবিও নেই। এমনকি শিক্ষকদের অনেকে এই কলেজে জীবনানন্দের শিক্ষকতা করার কথা শুনলেও বইপত্রে যেহেতু এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু নেই, তাই এ বিষয়ে তারাও সবিশেষ অবগত নন। ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক আখনজি কামরুজ্জামানও সে কথাই বললেন।