বাঙালি বীর ও এক রাজকন্যার অমর প্রেমগাথা
১৬ শতকে বাংলার পূর্বাঞ্চলের বারো ভূঁইয়াদের অন্যতম নেতা এবং মুসলিম বাঙালি বীরের প্রতীক ছিলেন ঈশা খাঁ। বাংলার ইতিহাসে "বারো ভূঁইয়া" আমল একটি গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। কারণ, এই বারো ভূঁইয়ারা ছিলেন স্বাধীনচেতা বীরযোদ্ধা। তারা দিল্লীর সম্রাটদেরকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে প্রায় স্বাধীনভাবেই রাজত্ব করতেন।
১৩ শতকের শুরুতে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজীর বঙ্গ জয়ের মধ্য দিয়ে বাংলায় ইসলামী শাসনের সূচনা হয় যা ১৭৫৭ সাল পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। এই সময়কালে প্রথমে দিল্লীর সুলতানরা ও পরে মুঘল বাদশাহরা বাংলাকে দিল্লীর শাসনাধীনে রাখার জন্য অব্যাহত চেষ্টা করে গেছেন। ফলে বাংলা কখনো দিল্লীর অধীন ছিল, আবার কখনো কখনো স্বাধীন ছিল। স্বাধীন সুলতানী আমলের মতো বারো ভূঁইয়াদের আমলও বাংলার ইতিহাসে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাজত্বকাল হিসেবে বিবেচিত হয়।
এই বারো ভূঁইয়ারা হলেন- ১. ঈশা খাঁ- খিজিরপুর বা কর্ত্তাভূ ২. প্রতাপাদিত্য- যশোর ৩. চাঁদ রায় ও কেদার রায়- শ্রীপুর বা বিক্রমপুর ৪. কন্দর্প রায় ও রামচন্দ্র- বাকলা বা চন্দ্রদ্বীপ ৫. লক্ষ্মণমাণিক্য- ভূলুয়া; ৬. মুকুন্দ রায়- ভূষণা বা ফতেহাবাদ ৭. ফজল গাজী ও চাঁদ গাজী- ভাওয়াল ও চাঁদপ্রতাপ; ৮. হামীর মল্ল বা বীর হাম্বীর- বিষ্ণুপুর; ৯. কংসনারায়ণ- তাহিরপুর; ১০. রামকৃষ্ণ- সাতৈল; ১১. পীতাম্বর ও নীলাম্বর- পুটিয়া; ১২. ঈশা খাঁ লোহানী ও ওসমান খাঁ- উড়িষ্যা ও হিজলী।
বাংলার বারো ভূঁইয়াদের মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী ছিলেন ঈশা খাঁ। যিনি স্বাধীন সম্রাটের মতো "মসনদ-ই-আলা" উপাধি নিয়েছিলেন। ঈশা খাঁ'র সময় আরো যারা শৌর্যে-বীর্যে বলীয়ান ছিলেন তারা হলেন- যশোরের রাজা প্রতাপাদিত্য, চন্দ্রদ্বীপের কন্দর্পনারায়ণ, বিক্রমপুরের চাঁদ রায় ও কেদার রায় এবং ভাওয়ালের ফজল গাজী ও চাঁদ গাজী।
এই ঈশা খাঁ এবং বিক্রমপুরের রাজা চাঁদ রায়ের বাল্যবিধবা রুপসী কন্যা স্বর্ণময়ীকে ঘিরে লোকমূখে একটি গল্প প্রচলিত ছিলো। গল্পটি হলো-
"বিক্রমপুরের রাজা চাঁদ রায়ের রূপসী কন্যা স্বর্ণময়ী একবার লাঙ্গলবন্দে পুণ্যস্নান করতে এসে সখীদের নিয়ে শীতলক্ষ্যা নদীতে ভ্রমণে বের হন। নদীর স্বচ্ছ জল দেখে তারা গোসল করতে নেমে গেলেন!
সে সময়ে একদল জলদস্যু ওখান দিয়েই যাচ্ছিলো। জমিদার কন্যা স্বর্ণময়ীকে তুলে নিয়ে গেলো জলদস্যুরা।
গুপ্তচর মারফত দেওয়ান ঈশা খাঁ খবর পেলেন তার এলাকা থেকে প্রতিবেশী জমিদার কন্যা অপহৃত হয়েছে! এটা মেনে নেওয়া যায় না।
তিনি তখন শীতলক্ষ্যার পাড়ের একটি দূর্গে অবস্থান করছিলেন (বর্তমান সোনাকান্দা)। সেখান থেকে তিনি ঘোড়া ছুটিয়ে তাড়া করে ধরে ফেললেন জলদস্যুদের জাহাজ। উদ্ধার করলেন রাজকন্যা স্বর্ণময়ীকে।
হিন্দু রাজকন্যাকে নিয়ে এলেন নিজ দূর্গে। চাঁদ রায়কে খবর দেওয়া হলো, পরের দিন সকাল বেলা চাঁদ রায়ের পরিবার রাজকন্যাকে নিতে এলো। কিন্তু বাঁধ সাধলেন চাঁদ রায়ের রাজ পুরোহিত!
মুসলমানের ঘরে রাত কাটানো রাজকন্যাকে ঘরে ফেরত আনলে কুলনাশ হয়ে যাবে! অনর্থ হবে, জাত-পাত আর রইবে না!
পুরোহিতের কথা শুনে কেঁদে ফেললেন রাজকন্যা স্বর্ণময়ী! ঈশা খাঁ নিজেও পড়লেন মুসিবতে! এই রাজকন্যা নিয়ে তিনি এখন কি করবেন? রূপসী সুন্দরী রাজকন্যা, তাকে রাস্তায় ফেলে দিতে পারেন না! আর তাছাড়া মুসলমানরা তো জাত-পাতের ভেদ করে না। ইসলামে সবার সামাজিক মর্যাদা সমান।
সমাধান দিলেন ঈশা খাঁর বেগম ফাতেমা খান! তিনি জানালেন, রাজকন্যা স্বর্ণময়ীকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে হবে। আর তাকে ২য় স্ত্রী হিসেবে বিয়ে করবেন ঈশা খাঁ।
স্বর্ণময়ীর নতুন নাম হলো সোনাবিবি। তাকে নিয়ে আসা হলো রাজধানী সুবর্ণ গাঁও-এ, (বর্তমান সোনারগাঁও)। কিন্তু স্বর্ণময়ী গভীর এক দুঃখের সাগরে নিমজ্জিত হলেন। তার পরিবার থেকে যে আঘাত তিনি পেলেন, তা তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না।
ঈশা খাঁ তার নববধুর প্রতি ভালোবাসা স্বরূপ তার রাজধানী সুবর্ণগাঁও এর নাম বদলে সোনা বিবির গাঁও বা সোনারগাঁও নামকরণ করলেন, শুধু তাই নয়, রাজকন্যাকে উদ্ধারের পরে শীতলক্ষ্যার পাড়ে যে দূর্গে রাজকন্যাকে রেখেছিলেন সেটা নাম বদলে রাখলেন সোনা কান্দা (সোনা বিবির কান্না)।
কারণ এ দূর্গে থাকা অবস্থায় চাঁদ রায়ের মেয়ে রাজকন্যা স্বর্ণময়ী ওরফে সোনাবিবি বেশিরভাগ সময় মন খারাপ করে থেকেছেন, কান্নাকাটি করেছেন। তবে সময় গড়াতে স্বর্ণময়ী ধীরে ধীরে বুঝতে শুরু করলেন ঈসা খাঁ তার প্রতি খুবই যত্নবান তাকে প্রকৃত স্ত্রীর মতোই সম্মান করছেন, মর্যাদা দিয়েছেন। তার মনের কষ্ট কমতে শুরু করল। নিজের ভাগ্যকে মেনে নিলেন তিনি।
তবে এই গল্পের সত্যতা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। অনেকের মতে, বিক্রমপুরের জমিদার চাঁদ রায় ও কেদার রায়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব ছিলো ঈশা খাঁর। সেই সুবাদে ঈশা খাঁ প্রায়ই যাতায়াত করতেন তাদের প্রাসাদে। রাজা চাঁদ রায়ের বাল্যবিধবা এক সুন্দরী কন্যা ছিল, যার নাম ছিল সোনামণি। তিনি ঈশা খাঁর চারিত্রিক মাধুর্য, দৈহিক গঠন ও বীরত্বে দারুণভাবে মুগ্ধ হয়েছিলেন, যা এক সময় প্রেমে রূপ নেয়। ফলে এক সময় ধর্ম ও জাত-পাতের সব বাধা ছিন্ন করে তিনি পালিয়ে চলে আসেন ঈশা খাঁর প্রাসাদে। বিয়ে করেন ঈশা খাঁকে। প্রথমে বিয়েতে রাজি হচ্ছিলেন না ঈশা খাঁ। কেননা, রাজকন্যা সোনামণির বাবা ও চাচা ছিলেন ঈশা খাঁ'র ঘনিষ্ঠ বন্ধু। দ্বিধা কাটিয়ে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার পর ঈসা খাঁ সোনামণির নতুন মুসলমানি নাম রাখেন সোনাবিবি।
আবার কারো কারো মতে, ঈশা খাঁ আসলে স্বর্ণময়ীকে জোর করে বিয়ে করেন। স্বর্ণময়ীর রূপ দেখে মোহিত হয়ে পড়েছিলেন ঈসা খাঁ। বিয়ে করতে চান বন্ধু কেদার রায়ের ভাই চাঁদ রায়ের বিধবা কন্যা স্বর্ণময়ীকে। কিন্তু স্বর্ণময়ীর পিতা চাঁদ রায় আর চাচা কেদার রায় দুজনেই এই প্রস্তাব শুনে ভয়ঙ্কর ক্ষেপে উঠেন। এই ঘটনায় কেদার রায় আর ঈসা খাঁর বন্ধুত্বও শেষ হয়ে যায়। কিন্তু ঈসা খাঁ তাতে দমে যাননি। একদিন সুযোগ বুঝে যাত্রা পথে আক্রমণ করে স্বর্ণময়ীকে তুলে আনেন। এই ঘটনায় চাঁদ রায় ও কেদার রায়ের সাথে ঈশা খাঁর যুদ্ধও বাধে।
তবে ঘটনা যেভাবেই ঘটুক না কেন, ঈশা খাঁর স্ত্রী হিসেবে স্বর্ণময়ী সম্মানিত হয়েছেন। মৃত্যু পর্যন্ত তিনি ঈসা খাঁর পাশেই ছিলেন। প্রকৃত প্রস্তাবে স্বর্ণময়ী নিজের জীবন দিয়ে ঈশা খাঁর প্রতি তার ভালোবাসা ও আনুগত্যের প্রমাণ দিয়েছিলেন।
ঐতিহাসিকদের মতে, ঈশা খাঁ নিজেও হিন্দু থেকে মুসলমান হওয়া পিতার সন্তান ছিলেন। অযোধ্যার বাইশওয়ার পরগনায় এক ক্ষত্রিয় রাজার বংশধর তিনি। এই রাজার নাম ছিল ভগীরথ। ভগীরথের সাথে দিল্লীর বাদশাহ ফিরোজ শাহ তুঘলকের অন্তরঙ্গ সম্পর্ক ছিল। রাজা ভগীরথ একবার তীর্থ দর্শনে বাংলায় আসেন। তখন বাংলার শাসক ছিলেন সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ। এসময় গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক তৈরি হওয়ায় তিনি বাংলাতেই থেকে যান।
জনশ্রুতি রয়েছে, এই রাজা ভগীরথের বংশেই জন্মগ্রহণ করেন একজন পণ্ডিত। তাঁর নাম ছিল কালিদাস। পণ্ডিত কালিদাস নিজ হাতে নানা জিনিস তৈরি করতে পারতেন, তার মধ্যে একটি ছিল স্বর্ণহাতি। তিনি প্রায়ই সোনার হাতি গড়তেন। এ জন্যেই নাকি কালিদাসের ভক্তরা তাকে উপাধি দিয়েছিল গজদানি। সেই থেকে কালিদাস গজদানি নামে পরিচিত হন।
এই কালিদাস গজদানি দেখতে অপরূপ সুন্দর ছিলেন। তাঁর পৌরুষদীপ্ত রাজকীয় চেহারা দেখে মুগ্ধ হন বাংলার সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহের পুত্র গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহের কন্যা। মাহমুদ শাহের কন্যা কালীদাস গজদানীকে পতি হিসেবে পেতে মরিয়া হয়ে ওঠেন। কালিদাসকে স্বামী হিসেবে পাওয়ার জন্য তিনি যে চিঠি দিয়েছিলেন, তার উত্তরে কালিদাস প্রচুর সদবাক্য ও বহু সদুপদেশ দান করেন এবং বিনয়ের সাথে রাজকন্যার প্রেমকে প্রত্যাখ্যান করেন। কিন্তু রাজকন্যা দমবার পাত্রী ছিলেন না। তিনি নানা ভাবে চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকেন এবং শেষ পর্যন্ত কালিদাসের সম্মতি আদায় করতে সক্ষম হন, তিনি রাজকন্যাকে বিয়ে করতে সম্মত হন।
কথিত আছে, কালিদাস গজদানী উদার প্রকৃতির মানুষ ছিলেন, ধর্মের প্রতি ছিল তার গভীর অনুরাগ। বিভিন্ন ধর্মের সার কথা জানার জন্য তিনি ধর্মীয় বিতর্কের ব্যবস্থা করতেন। নিজেও তর্কে অংশগ্রহণ করতেন। এভাবে আলোচনা করতে গিয়েই জনৈক মুসলিম মনীষীর কথা শুনে তিনি এতটাই অনুপ্রাণিত হন যে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেন। ধর্মান্তরিত হওয়ার পর কালিদাসের নতুন নাম হয় সুলাইমান খাঁ। এই সুলাইমান খাঁরই পুত্র ছিলেন ঈশা খাঁ।
বাংলার স্বাধীন সুলতানি আমলের শেষ শাসক সুলতান গিয়াসউদ্দিন মাহমুদের মৃত্যুর পর তার জামাতা সুলাইমান খাঁ নিজেকে সালতানাতের উত্তরাধিকারী দাবি করে পুর্ব বাংলায় রাজত্ব করতে শুরু করেন। দিল্লিতে নব প্রতিষ্ঠিত আফগান শাসনের বিরুদ্ধেও বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। তিনি প্রায় স্বাধীনভাবেই ভাটি অঞ্চলের শাসনকার্য পরিচালনা করেছিলেন এবং তাঁর রাজ্য শাসনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল সরাইল। বাংলার উত্তর-পশ্চিমাংশ তখন আফগান সম্রাটদের দখলে।
১৫৪৫ খ্রিস্টাব্দে আফগান সম্রাট শেরশাহের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র ইসলাম শাহ দিল্লীর সিংহাসনে আরোহন করে বাংলাকে একটি একক প্রশাসনিক শৃঙ্খলার মধ্যে আনার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। কিন্তু সুলাইমান খাঁ ইসলাম শাহের ব্যবস্থা মেনে নিতে অস্বীকার করলে ইসলাম শাহ তাজ খান ও দরিয়া খান নামে দু'জন সেনাপতিকে তার বিরুদ্ধে পাঠান। সুলায়মান খান তাদের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি পরাজিত ও নিহত হন এবং তার দুই পুত্র ঈসা ও ইসমাইলকে বন্দি করে ইরানী বণিকদের কাছে দাস হিসেবে বিক্রি করে দেওয়া হয়।
১৫৬৩ সালে তাজ খান কররানী বাংলা ও বিহারের শাসন ক্ষমতা গ্রহণ করলে, ঈসা খাঁর চাচা কুতুব খাঁ তার অনুগ্রভাজন হন এবং দরবারি কাজে নিযুক্তি লাভ করেন। এ সময়ে তিনি তাঁর দুই ভাতিজা ঈসা ও ইসমাইলের খোঁজ পেয়ে অর্থের বিনিময়ে ইরানী বণিকের কাছ থেকে তাদের মুক্ত করে আনেন।
ঈসা খাঁ দেশে ফিরে এসে চাচা কুতুব খানের চেষ্টায় আফগানদের কাছ থেকে তার পিতার সরাইলস্থ জমিদারি উদ্ধার করেন। ১৫৬৫ সালে তাজ খান কররানীর মৃত্যুর পর ঈসা খাঁ আফগান শাসকদেরকে মোঘল আক্রমণ মোকাবিলায় সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন।
১৫৭৬ সালে রাজমহলের কাছে আগমহলের যুদ্ধে মোঘলদের কাছে দাউদ খান কররানী পরাজিত ও নিহত হলে কার্যত বাংলায় আফগান শাসনের অবসান ঘটে। ঈসা খাঁ এ সময়ে প্রায় স্বাধীনভাবেই তাঁর রাজ্য পরিচালনা করছিলেন। কিন্তু তিনি যথার্থভাবেই বুঝতে পারেন যে, তিনি নিজের সীমিত শক্তি দিয়ে একা মোঘলদের মোকাবিলা করতে পারবেন না। তাই তিনি বাংলার পূর্বাঞ্চলের সব জমিদার ও আফগান দলপতিদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন এবং তাদের সঙ্গে মোঘলবিরোধী রাজনৈতিক ও সামরিক জোট গঠন করেন। প্রতিবেশী ত্রিপুরা ও কামরূপের রাজা যথাক্রমে অমরমাণিক্য ও রঘুদেবের সঙ্গেও বন্ধুত্ব স্থাপন করেন। এ ছাড়াও ঈসা খান একটি শক্তিশালী নৌবাহিনী গড়ে তোলেন। শৌর্য-বীর্যে অল্প দিনের মধ্যেই তিনি মশহুর হয়ে উঠেন পুরো বাংলায়। বৃহত্তর ঢাকা ও কুমিল্লা জেলার প্রায় অর্ধেক, প্রায় সমগ্র বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলা এবং সম্ভবত বৃহত্তর রংপুর, বগুড়া ও পাবনা জেলার কিছু অংশ সহ বিশাল রাজত্ব ছিলো ঈশা খাঁর।
ক্রমে ঈশা খাঁ বাংলায় এতোটাই শক্তিশালী হয়ে ওঠেন যে, স্বাধীন সম্রাটের মতোই তিনি জীবন-যাপন করতেন ও রাজ্য শাসন করতেন। ঈশা খাঁর বীরত্ব ও শৌর্য-বীর্যের সংবাদ চলে যায় দিল্লীর মুঘল সম্রাটের কাছে। দিল্লীর সম্রাট শঙ্কিত হয়ে পড়েন। বাংলার সুবাদার করে পাঠান শাহবাজ খাঁকে। মুঘল সুবাদার শাহবাজ খাঁকে জঙ্গলবাড়ির যুদ্ধে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেন বীর ঈশা খাঁ। এরপর ১৫৯৭ সালে সেনাপতি মানসিংহ বিশাল মোঘল বাহিনী নিয়ে ধেয়ে আসেন বাংলার বীর ঈশা খাঁকে দমন করতে।
মোঘল সেনাপতি মানসিংহের আগমনে বঙ্গবীর ঈশা খাঁ মোটেই ভীত হলেন না। মোকাবিলার প্রস্তুতি নিয়ে তিনি আস্তানা গাড়েন এগারোসিন্ধুর দুর্গে। রাজা মানসিংহ নদীর তীর বেয়ে হাজির হন এগারোসিন্ধুর দুর্গের কাছে। যুদ্ধ চলল তুমুল গতিতে। রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে রাজা মানসিংহের জামাতা দুর্জয় সিংহ নিহত হলো। প্রতিশোধের নেশায় মরিয়া হয়ে উঠলেন রাজা মানসিংহ। সরাসরি দ্বন্দ্ব-যুদ্ধের আহ্বান জানালেন ঈশা খাঁকে। দ্বন্দ্ব-যুদ্ধে ঈশা খাঁর তরবারীর আঘাতে রাজা মানসিংহের তরবারি দ্বিখন্ডিত হলো। নিরস্ত্র হয়ে হতবাক হয়ে গেলেন রাজা মানসিংহ। দুর্ধর্ষ বীর ঈশা খাঁ এক আঘাতেই পারতেন রাজপুত বীর মানসিংহের মস্তক দ্বিখণ্ডিত করে দিতে। কিন্তু তিনি তা করলেন না। তরবারি নামিয়ে শত্রুর কাছে গিয়ে বললেন, নিরস্ত্রকে হত্যা করা ইসলাম ধর্মের রীতি নয়। এই নিন তরবারি। শক্তি পরীক্ষা করুন শেষ পর্যন্ত। যুদ্ধের মাধ্যমে নিষ্পত্তি হবে জয় পরাজয়। বেকায়দায় পেয়ে কাউকে হত্যা কিংবা পরাজয়ে বাধ্য করা বীরধর্ম নয়। ঈশা খাঁর কথা শুনে মানসিংহ অবাক। সারা জীবন যুদ্ধের মধ্যে কাটিয়েছেন। এমন কথা শুনেননি কখনো। এমন হৃদয়বান বীর জীবনে দেখেননি। 'এমন বীরের সাথে আর যুদ্ধ নয়। আমি আপনার শৌর্য-বীর্যে মুগ্ধ, অভিভূত। আমি পরাজয় স্বীকার করলাম। সত্যিই আপনি অদ্বিতীয় বীর।' এরকম মন্তব্য ছিল মানসিংহের। এরপর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বাংলায় মাথা উঁচু করেই রাজ্য শাসন করেন ঈশা খাঁ।
ঈশা খাঁর স্ত্রী সোনাবিবিও বীরাঙ্গনা খ্যাতি পেয়েছিলেন। কথিত আছে ঈশা খাঁর মৃত্যুর পর কেদার রায় অপমানের প্রতিশোধ নেয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন। ত্রিপুরা রাজের সঙ্গে মিলিত হয়ে আক্রমণ করেন সোনাকান্দা দুর্গ। সোনাবিবি সেখানেই অবস্থান করছিলেন। বীর বিক্রমে সোনাবিবি নিজেই পুরুষের বেশে সৈন্য পরিচালনা করেন। সপ্তাহের পর সপ্তাহ অবরোধ করেও কিছুতেই দূর্গের পতন ঘটাতে পারলেন না চাচা কেদার রায়। বীরাঙ্গনা সোনাবিবি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন জীবন দেব তবুও বন্দী হবো না। যুদ্ধ ক্ষেত্রেই সোনাবিবির মৃত্যু হলো। সোনাকান্দা দুর্গের পতন হলো। জীবন দিয়ে বীর ও প্রেমিক স্বামীর প্রতি আনুগত্য ধরে রাখলেন স্ত্রী সোনাবিবি।
ঈশা খাঁর মৃত্যুর পর তার ছেলে মূসা খাঁ খুব বেশিদিন স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব ধরে রাখতে পারেননি। মাত্র ১০ বছরেই তিনি আর যুদ্ধে টিকতে না পেরে দিল্লীর মোঘলদের কাছে ১৬১১ সালে হার মানেন।
প্রসঙ্গত, ১২০৩ খ্রিস্টাব্দে বখতিয়ার খিলজির বাংলা জয়ের পর আনুমানিক ১২৮১ খ্রিস্টাব্দে সোনারগাঁয়ে মুসলিম আধিপত্যের সূচনা হয়। ১৩৩৮ খ্রিস্টাব্দে ফখরুদ্দিন মোবারক শাহ সোনারগাঁকে কেন্দ্র করে বাংলার পূর্বাঞ্চলকে দিল্লি থেকে স্বাধীন বলে ঘোষণা করেন এবং এটি পূর্ব বাংলার স্বতন্ত্র রাজধানী হিসেবে প্রথম মর্যাদা লাভ করে। আর এর আগে বারো ভূ্ইঁয়াদের প্রধান নেতা 'মসনদ-ই-আলা' ঈশা খাঁর আমলে সোনারগাঁও বাংলার রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে খ্যাতির শীর্ষে আরোহণ করেছিল।
সোনারগাঁয়ের প্রাচীন নাম ছিল সুবর্ণবীথি বা সুবর্ণগ্রাম। প্রবাদ আছে, 'মহারাজ জয়ধ্বজের সময় এ অঞ্চলে স্বর্ণ বৃষ্টি হয়েছিল বলে এ স্থানটি সুবর্ণগ্রাম নামে পরিচিতি লাভ করে।
এই সোনারগাঁয়ের মধ্য দিয়েই নির্মিত হয় ষোঁড়শ শতকের দিল্লীর আফগান সম্রাট শেরশাহ সূরীর ঐতিহাসিক গ্র্যান্ড ট্রাংক রোড, যা সিন্ধু থেকে সোনারগাঁয়ে এসে শেষ হয়।
পূর্ব বাংলার রাজধানী সোনারগাঁকে বাংলার যে সমস্ত মুসলিম শাসকরা সমৃদ্ধ করেছেন, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন ফখরুদ্দিন মোবারক শাহ, যার উপাধি ছিল 'ফখর-ই-বাংগাল', (১৩৩৭-১৩৪৯ খৃ.)। শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ (১৩৩৮-১৩৫৮), যাকে 'সুলতান-ই-বাংগাল' বলা হতো, যিনি সমগ্র বাংলার প্রথম স্বাধীন সুলতান। তিনিই সর্বপ্রথম 'বাংলা ভাষা'কে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দান করেন। এরই ধারাবাহিকতায় সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহের আমলে (১৪৯৩-১৫১৯) মধ্যযুগের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য সর্বোচ্চ বিকাশ লাভ করে। ইতিহাসে ন্যায় বিচার ও উদারতার জন্য কিংবদন্তিতুল্য সুলতান গিয়াসউদ্দিন আযম শাহ, আলাউদ্দিন হোসেন শাহ সহ আরো অনেক শাসকও সোনারগাঁকে সবদিক থেকে সমৃদ্ধ করেছেন। ন্যায় বিচারক, প্রজাবৎসল এবং বাংলা ভাষা ও সাহিত্যানুরাগী শাসক হিসেবে ইতিহাসে তাঁরা কিংবদন্তি হয়ে আছেন।
বাংলার স্বাধীন সুলতানি আমলের সব শাসকই ছিলেন জ্ঞানী-গুণি ও প্রজাবৎসল। তাই তারা জ্ঞানী-গুণি ও পণ্ডিত ব্যক্তিদেরও খুবই কদর করতেন। তাদের নিয়ে জ্ঞানচর্চা ও কাব্য-সাহিত্যের দরবার বসাতেন। ফলে, দিল্লী, আজমীর, আরব বিশ্ব থেকে আসতে থাকেন জ্ঞানী-গুণি, পীর-ওলী ও সুফী সাধকগণ।
দিল্লী-আগ্রা থেকে আসা বড় বড় ব্যবসায়ী শিল্পপতি, আরব বিশ্ব থেকে আসা সওদাগরদের কাফেলাগুলো বাংলার রাজধানী লখনৌতির পাশাপাশি সোনারগাঁয়ে এসেও ভিড় জমাতে শুরু করে। এখানকার মসলিন কাপড় হয়ে ওঠে বিশ্ববিখ্যাত। এছাড়া জামদানি শাড়ি, মলমল বস্ত্র, সোনা-রূপার নানা ডিজাইনের অলংকার- এ সমস্ত পণ্য সামগ্রী নিতে হাজার হাজার নৌকা ভিড় জমাতো সোনারগাঁয়ের ঘাটে। যার ফলে লোকেরা বলাবলি করতো, সোনার গাঁ'র নদী স্রোতে অবিরাম ঝিকমিক করে ভেসে যায় সোনারেণু। সোনারগাঁ হয়ে ওঠে জ্ঞান-বিজ্ঞান, সাধু-দরবেশ ও ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র। সোনারগাঁয়ের অধিবাসীদের জীবনে তখন ছিল স্বর্ণযুগ। কোনক্ষেত্রেই সমৃদ্ধির কমতি ছিল না তাদের। আর সোনারগাঁয়ের সঙ্গে তাই আজও জড়ানো ঈসা খাঁ ও তার স্ত্রী সোনাবিবির নাম।