বিধবাবিবাহ: বিদ্যাসাগরের বিপক্ষে ও পক্ষে
দ্বিশত জন্মবার্ষিকীর শ্রদ্ধা
শুরুটা ছিল ভয়াবহ। এক ইংরেজ ইন্সপেক্টর সাহেবকে হাত করে তিরিশ না পয়ত্রিশটা গার্লস স্কুল খুলিয়েছেন, বড় সাহেব আটকে না দিলে এ দেশে তো আর পুরুষ খুঁজে পাওয়া যেত না। ভারতবর্ষই হয়ে উঠত বিধবা আশ্রম। কারণ মেয়ে মানুষের বৈধত্যের আসল কারণই তো পড়াশোনা। স্বামী মরলে তবেই না বিধবা। 'হিন্দু অবলাকুলের বিদ্যাভ্যাস ও তাহার সম্মন্নতি'- এই গ্রন্থে কৈলাসবাসিনী দেবী লিখেছেন '...পণ্ডিতগণ কহিতেন যে সংস্কৃত শাস্ত্রে অবলা জাতির অধিকার নাই... এবং উহারা যে কোন শাস্ত্র অধ্যয়ন করুক না কেন তাহাতেই উহাদিগের বিষমানিষ্টের সম্ভাবনা, আরও কহিতেন যে স্ত্রীগণ বিদ্যাধ্যায়ন করিলে অনাশে বৈধব্যদশা প্রাপ্ত হয়।'
অথচ দরিদ্র ব্রাহ্মণের হতচ্ছাড়া পুত্র ঈশ্বরচন্দ্র কোথায় পৈতে লাগিয়ে স্বর্গে যাবার অলিগলি খুঁজে বের করবেন, তা না করে নিজে তো ম্লেচ্ছ সংসর্গে নরকবাসী হয়েছেনই, অবলা নারীকুলকে লেখাপড়া শিখিয়ে, বিধবার শান্তি হরণ করে তার অনুগমন করতে বাধ্য করবেন।
সেই বিদ্যাসাগরের দ্বিশততম জন্মবার্ষিকী গেল গত ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২০। রাগটা বোধহয় এখনও যায়নি, এর মধ্যে বিদ্যাসাগরের মূর্তিও ভাঙ্গচুর করল, জ্যান্ত পায়নি, তাই।
সিন্দুর-বিন্দু বিধবা-ললাটে
অত্যন্ত কাব্যিক এই শব্দগুলোর সরল অর্থ হচ্ছে বিধবার কপালে সিন্দুরের ফোঁটা। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বিদ্যাকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা 'সিন্দুর-বিন্দু বিধবা-ললাটে' শিরোনামের একটি ধারাবাহিক রচনা, লেখকের নামের সৌজন্য সম্ভাষণের কেবল 'শ্রী'- টুকুই লেখার শেষে মুদ্রিত হয়েছে, বাকিটুকু গবেষকের শ্রম বাড়াতে সম্পাদক অমুদ্রিতই রেখে দিয়েছেন। ১৩১৪ বাংলা সনের (এখন, কিন্তু ১৪২৭) মাসিক পত্রিকা আরতি-র কয়েকটি সংখ্যা বছর দশেক আগে ফটো কপি করিয়ে রেখেছিলাম। বিদ্যাসাগরের দ্বিতীয় জন্মশতবর্ষে পাতা উল্টাতে উল্টাতে ধারাবাহিক লেখাটি পেয়ে মনে হয়েছে, ভুল করিনি।
'সিন্দুর-বিন্দু বিধবা ললাটে' এ কথাটা কেবল কবিদিগের কাব্যেই ছিল, বিধবার ললাটে সিন্দুর থাকিতে পারে, বিধবার পুনর্ব্বার বিবাহ হইতে পারে, এ কথা হিন্দুসন্তানদিগের মধ্যে পূর্বে কেহ জানিতেন না, হিন্দুদিগের মধ্যে ইহা একটি অবিশ্বাস্য ও অশ্রুতপূর্ব কথা ছিল। বিদ্যাসাগর মহাশয় এই তত্ত্বের প্রথম উদ্ভাবক। লেখক 'স্ত্রী' কুল বলেননি-- বিদ্যাসাগর মহাশয় বুঝতে পেরেছেন হিন্দু সন্তান 'ধর্মশাস্ত্রের আজ্ঞাবাহী কিঙ্কর', তারা তাদের ধর্মরক্ষার জন্য স্ত্রী পুত্র ধন-মান এবং এমনকি প্রাণও বিসর্জন দিতে পারে, তবুও ঘরের বিধবা কোন বিধবা কন্যাকে এমন কি রাজপুত্র পাত্র হয়ে এলেও তার কাছে বিয়ে দিবেন না। বিদ্যাসাগর বিধবা নারীকে পুনরায় যৌনানন্দ দেবার কুমতলবে এ হেন ধর্মবিরুদ্ধ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছেন। এই পাপিষ্ঠের জন্য সর্বনিকৃষ্ট নরক অবধারিত।
'বিদ্যাসগর মহাশয়কে শাস্ত্র মন্থন করিতে গিয়া, অসত্যকে সত্য বলিয়া প্রতিপাদন করিতে গিয়া অনেক প্রকাশ পাইতে, অনেক কলাকৌশল খাটাইতে হইয়াছে।' বিধবাবিবাহের পক্ষে বিদ্যাসাগর পুস্তিকা রচনা করেন, মুদ্রণ করেন এবং বিতরণ করেন। ধর্মপ্রাণ বিদ্বজন তার প্রতিবাদ করলে তিনি প্রতিবাদে জবাব দিতে দ্বিতীয় পুস্তক রচনা করেন এবং সেখানে তিনি তার অপকর্মের স্বাক্ষর রাখতে একের পর এক 'শাস্ত্রের অসদ্ব্যাখ্যা' প্রদান করেন। একটা সময় ছিল যখন মূল সংহিতা কেউই দেখতেন না, কিন্তু 'গবর্নমেন্টের লাইব্রেরি বিদ্যাসাগর মহাশয়ের হাতে থাকায় 'তা দেখতে এবং 'কলাকৌশল খাটাইতে' যারপরনাই সুবিধে হয়েছিল। কিন্ত যারা কিঞ্চিৎমাত্র সংস্কৃত জানেন তারাও এখন বুঝতে পারছেন বিদ্যাসাগর মহাশয় বিধবাবিবাহ প্রচলনের জন্য শাস্ত্রের কতদূর অবমাননা ও অস্বাভাবিক অর্থ করিয়া গিয়াছেন। আশার কথা প্রকৃত হিন্দু তাকে বিশ্বাস করেন না বরং তার উপস্থাপিত শাস্ত্রের বিরোধিতা করেন। 'স্ত্রী' তে সব সংস্কৃত 'শ্লোক উদ্ধৃত করেছেন এবং তার অর্থ নির্দেশ করেছেন সেখান থেকে কয়েকটির অর্থ কেবল উপস্থাপন করছি:
১. কন্যা অন্যকে দান করিয়া পুনর্বার অন্যকে দান করলে তা পুনর্ভু হয়। পুনর্ভুর অন্ন কখনো ভোজন করবে না।
২. তাদের গর্ভজাত পুত্র কুপুত্র হয়ে থাকে। এসব পুত্র এমনকি ব্রহ্মচারী হলেও তারা বর্জনীয়।
৩. কুষ্ঠ রোগগ্রস্ত, মল, সুদখোর পুনর্ভুপুত্র পিতৃস্ত্রাদ্ধে বর্জিত। তাদের নিমন্ত্রণ দান নিষিদ্ধ।
৪. ধর্ম বিরুদ্ধ পদক্ষেপ গ্রহণ করে বিদ্যাসাগর আততায়ী হয়েছেন। আততায়ী বধে কোনো দোষ নেই। রাজা যদি আততায়ী বধ না করেন তা হলে তিনদিনও তার রাজ্য থাকে না।
৫. বিধবাবিবাহ ধর্মদ্রোহী অপরাধকর্ম তবে 'অদুষ্টা অথচ পতিকর্তৃক পরিত্যক্তা, নপুংসকের স্ত্রী এবং ক্ষয়রোগের স্ত্রী ইহাদের ইচ্ছাক্রমে যদি কোনো পুরুষ তাহাদের সহিত সহবাস করে সেই পুরুষের দোষ হইবে না।'
৬. এক রজ্জু দুইযুগে বেস্টন করা যায় না, সেইরূপ এক স্ত্রী দুই বিয়ে করতে পারে না।
৭. বিধবা যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন কেশমুন্ডন করে ব্রহ্মকর্ম ও তপস্যার মাধ্যমে শরীর শোধন করবে।
৮. বিদ্যাসাগর মহাশয়ের দ্বিতীয় স্বামী আসলে উপপতি- সাধ্বী স্ত্রীদিগের উপপতি থাকতে পারে না।
৯. স্বামীর জীবদ্দশায় অথবা মৃতবস্থায় যে নারী অন্য পুরুষ গ্রহণ করে না সে অক্ষয়কীর্তির অধিকারিনী হয় এবং অন্তে বৈকুণ্ঠে লক্ষ্মীর সাথে বাস করে।
১০. কন্যা দান একবারই মাত্র হতে পারে। হিন্দু নারীর বিয়ে ম্লেচ্ছ-যবনদের মতো চুক্তির বিয়ে নয়, তা সম্প্রদান। যা পিতা একবার দান করে দিলেন তা পুনরায় দান করার কোনো সুযোগ নেই।
১১. স্বামীর মৃত্যু হলে, স্বামী তাহাকে ত্যাগ করলে কিংবা বিক্রয় করে দিলেও ভার্যার নিকট হতে বিযুক্ত হন না।
১২. বিধবা কোনো গর্হিত কাজ করে পাপিষ্ঠা হলে তার মৃত পতিকেও ফল ভোগ করতে হয়- শাস্ত্রে এর ভুরি ভুরি প্রমাণ রয়েছে। দেহ নাশে আত্মার বিনাশ ঘটে না, সেক্ষেত্রে বিদ্যাসাগর মহাশয়ে বিধবাকে পাপিষ্ঠা বানিয়ে তার প্রয়াত স্বামীকেও অশেষ পাপযন্ত্রণা দেবার আয়োজন করেছেন।
১৩. স্বামীর ধনে স্ত্রীর অধিকার কি প্রমাণ করে না যে স্ত্রী আমৃত্যু স্ত্রীই রয়ে যায় - বিদ্যাসাগর মহাশয় ভীষণ দুরন্ধর, চিত্তভোগের বেলায় তা পূর্ণতা চান কিন্তু ধর্মরক্ষার বেলায় তা চূর্ণ করে দেন -- এসব 'স্বেচ্ছাচারের কথা শুনলে হাসিও পায় কান্নাও পায়।
বিদ্যাসাগর মহাশয়ের মতো 'দেশ বিখ্যাত লোকের বালক ভুলানো কথাবার্তা শুনলে হাস্য সংবরণ করা কঠিন হয়ে পড়ে' - দায়কৃত সম্পত্তি পুনঃদানের আয়োজন করে তিনি মহাপাতক হয়েছেন।
হিন্দু বালিকার বিয়ে 'ধূলাখেলা নহে, কোনরূপ চুক্তি বন্দোবস্তও নহে, হিন্দু কন্যাকে দেবতা, নক্ষত্র, অগ্নি প্রভৃতি সাক্ষী করিয়া আমি যাবজ্জীবন পতিকূলে রহিলাম-- ভগবানের নিকট এইরূপ প্রতিশ্রুত হইয়া পানিগ্রহণ করিতে হয়।' এরপর কন্যার মুক্তি লাভ ও পুনঃবিবাহের সুযোগ কোথায়?
বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বিধবার কপালের সিঁদুর দেবার বাসনাকে নবরসের সবগুলোই রয়েছে: সর্বাগ্রে আদিরস, নতুবা বিধবা বিয়ের প্রবৃত্তি জাগে কেমন করে? বিধবাবান্ধব মহাশয় কন্যা হরণ করে তার মানব অন্তরে করুণ রস তো সঞ্চার করবেনই তিনি বিলক্ষণ বীররসের অভিনয় করেই চলেছেন। ধার্মিকগণ পদে পদে বীবৎস রসের দেখা পাচ্ছে। প্রথম বিয়ের মতো একই কথা উচ্চারণ করে বিধবা নিজেই হাস্যরস সৃষ্টি করবে। অদ্ভূত সব কর্মকান্ডের মাধ্যমে অদ্ভূত রসও কম সৃষ্টি হচ্ছে না। চার বছরের বালক যা জানে, চন্ডাল যা জানে, বিদ্যার তরীও নয়, জাহাজও নয় স্বয়ং বিদ্যার সমুদ্র ঈশ্বরচন্দ্র মহাশয় তা জানেন না -- আফসোস হয়।
প্রমোদকান্ত বসু তাকে অভিসম্মাত দিয়েছেন কারণ তিনি দেবী চিনতে ভুল করেছেন -- হিন্দু বিধবা মানবী বেশে দেবী। কিন্তু বিধবা না থাকলে গৃহে পরিপূর্ণতা আসে না। মহাজাগতিক ঈশ্বরচন্দ্র সেই দেবী হরণের ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছেন।
মহাসাগরের পক্ষে অজ্ঞাত এক কবি লিখেছেন :
দেশে দেশে জেলায় জেলায় বেরোবে হুকুম
বিধবা রমণীর বিয়ের লেগে যাবে ধূম
সধবাধদের সঙ্গে যাবো বরণডালা লয়ে।
আর কেন ভাবিস লো সই ঈশ্বর দিয়েছেন সই
এবারে বুঝি ঈশ্বরেচ্ছায় পতিপ্রাপ্ত হই।
বিদ্যাসাগরের বিপরীতে ময়মনসিংহের বিদ্যাভূষণ
শ্রীযোগেন্দ্র চন্দ্র বিদ্যাভূষণ, ধীতপুর, শিদুলজানি জেলা ময়মনসিংহ বিদ্যাসাগরের শাস্ত্রজ্ঞানের সীমাবদ্ধতা দেখিয়ে এই বলে উপসংহার টেনেছেন যে বিধবা বিবাহ প্রথা হিন্দু সমাজে চালু করা হলে ইষ্টের চেয়ে বেশি অনিষ্ট হবে, এ নিয়ে তার মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। 'যাহাতে হিন্দু বিধবাগণের সতীত্বধর্ম্মের প্রতি অনুরাগ বৃদ্ধি হইতে পারে এবং তাহার ধর্মচারিণী হইয়া চিরকাল পরোপকার সাধন করিতে পারেন, তজ্জন্য প্রত্যেক নরনারীর যত্নবান হওয়া উচিত, যিনি একটি বিধবার জীবনও সৎপথে রাখিতে পারিবেন তিনি হিন্দুসমাজের শত শত ধন্যবাদের পাত্র।' আর মহাপাতক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর শত সহস্র বিধবাকে ক্ষমাহীন পাপের পথে ঠেলে দিয়েছেন। তিনি বিয়ের মন্ত্র ভুলে গেছেন, যে মন্ত্রে বলা হয়েছে : প্রথমে চন্দ্র তোমাকে বিয়ে করেছে, তারাপর গন্ধর্ব তোমাকে বিয়ে করেছে, তারপর অগ্নি তোমাকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেছে, কার্যত চতুর্থজন তোমার স্বামী, যদি এই স্বামী মৃত্যুবরণ করে অগ্নি আর কারো কাছে তোমাকে সমর্পণ করতে পারবেন না।
তবে শাস্ত্র কিছুটা করুণাও করেছে। 'অদুষ্টা অথচ পতিকর্তৃক পরিত্যক্ত স্ত্রী, নপুংশকের স্ত্রী এবং ক্ষয়রোগীর স্ত্রী, ইহাদের ইচ্ছাক্রমে যদি কোন পুরুষ তাহাদের সহিত সহবাস করে তবে সেই পুরুষের দন্ডাই দোষে হইবে না।' ক্ষয়রোগীর স্ত্রীর সাথে সহবাসে রাজদন্ড না হলে পরস্ত্রীগমনের কারণে ঈশ্বর নির্ধারিত পাপ হতে রেহাই পাওয়ার সুযোগ নেই, সেই সাথে সামাজিক গ্লানি তো থাকবেই।
বিদ্যাসগর মহাশয় যা লিখেছেন সবই তার কল্পিত, শাস্ত্রের সমর্থন তিনি কশ্নিনকালেও পাবেন না।
বিধবার গর্ভসঞ্চার
হিন্দু বিধবা বিবাহ আইন পাশ হয় ২৬ জুলাই ১৮৫৬। এর ১০ বছর পর ভাওয়ালের জমিদার কালীনারায়ন রায় চৌধুরীর বক্তব্য ১৫ এপ্রিল ১৮৬৬ ঢাকা প্রকাশ এ মুদ্রিত হয়। তিনি বিধবা রমণীর গর্ভজাত ভ্রুণ হত্যার তীব্র বিরোধিতা করেন। যুবকদিগকে কামাসাক্ত হয়ে বিধবাগমণ করা থেকে নিরস্ত্র থাকার আহ্বান জানান, তারপরও যদি বিধবা সন্তান সম্ভবা হয়ে উঠেন ভ্রুণহত্যার মতো মহাপাপ থেকে বিরত থাকতে তিনি কাতর মিনতি জানান। তার সহিচ্ছার কোনো ঘাটতি ছিল না তিনি পরবর্তীকালে বাল্যবিধবাদের আশ্রমও নির্মাণ করেন। কিন্তু বিধবার সাথে সহবাসকারী পুরুষকে বিধবা বিবাহের নির্দেশ দেননি।
তার বক্তব্যের কিছু অংশ উদ্ধৃত করা হচ্ছে:
'ইহা কামপ্রবৃত্তির অন্তর্গত একটি সুমহৎ দুষ্কর্ম্ম বিশেষ। কি স্ত্রী, কি পুরুষ সকলেই কাম রিপুর প্রলোভনে জ্ঞানশূণ্য হওত অগ্রপশ্চাতে বিবেচনা না করিয়া আশু-সুখের নিমিত্ত কামপ্রবৃত্তির চরিতার্থতা সাধন করিয়া থাকে। তদ্বারা কোন বিধবা রমনীর গর্ভ সঞ্চার হইলে অপমান ও কলঙ্ক ভয়ে সেই গর্ভের সন্তান প্রসূত হইলেই নিজ্জর্ন স্থানে বিনষ্ট করিয়া অথবা নানাবিধ সুতীব্র ঔষধ প্রয়োগ দ্বারা গর্ভ নষ্ট করিয়া আপনাদের মান সম্ভ্রম রক্ষা এবং কলঙ্ক ও লজ্জার নিবারণ করে।
অকিঞ্চিৎকর লজ্জার বশীভূত হইয়া একটি মহাপ্রাণী হত্যা করা কি মানুষ্যের উচিত কর্ম? না পরমেশ্বরেরই অভিপ্রেত কার্য্য?
...হে তাওয়ালবাসিগণ। তোমরা কামবৃত্তির অযথা নিয়মে পরিচালনা হইতে ক্ষান্ত থাক, কোনোক্রমেই এ প্রদেশে ভ্রুণ হত্যারূপ মহাপাপ প্রবেশ করিতে পারিবে না। যদি দৈবাৎ দুর্ঘটনাক্রমে কোন বিধবা রমণীর গর্ভসঞ্চার হয়, তাহা হইলে যথাসাধ্য গর্ভস্ত সন্তানটির রক্ষা করিতে যত্নবান হও অবোধ শিশুর প্রাণসংহার করিতে প্রাণান্তেও তৎপর হইও না।'
কালী নারায়ন রায় চৌধুরীর কল্যাণকর্ম সুবিদিত। বিশ্ববিদ্যালয়র মেধাবী শিক্ষার্থীরাও তার নামে প্রদেয় বৃত্তির প্রত্যাশা করে থেকেছেন। সম্ভবত: বিধবা সংক্রান্ত প্রচলিত ধর্মীয় অনুশাসনের বিরুদ্ধে তিনি যেতে চাননি। বিদ্যাসাগর কতোবড় ঝুঁকি নিয়ে এ কাজে নেমেছেন, এতে তা আরো স্পষ্ট হয়ে উঠে।
বিদ্যাসাগরের বিধবা বিবাহর সাধ জেগেছে!
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বয়স তখন ছেষট্টি পেরিয়েছে। এ সময় কোনো এক বিধবাকে বিয়ে করা তার অভিপ্রায় কিনা সে প্রশ্নই উঠিয়েছে, নাম আড়ালে রাখা একজন সত্যচারী ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি কতৃর্ক। ৭ নভেম্বর ১৮৮৬ তারিখে ঢাকা প্রকাশে বিদ্যাসাগরের বিধবা বিবাহ পুস্তক নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়েছে:
'বৃহস্পতির নাস্তিক ধর্ম্ম প্রবর্ত্তনার ন্যায় বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বিধবা বিবাহের অভিপ্রায় কিনা বলিতে পারি না, কিন্তু তাহার এই গ্রন্থ দেশের শিক্ষিত সমাজে যেরূপ প্রতিপত্তি লাভ করিয়াছে, তাহার গ্রন্থ অবলম্বন করিয়া দেশের উদ্ধত যুবকগণ যুবতীগণের যে রূপ মাথা খাওয়া ধরিতেছে, তাহাতে দেশের অধঃপাতের আর একটি সোপান প্রস্তুত হইয়াছে। এই সোপানে দেশের অধিকাংশ শিক্ষিত লোক আজ প্রবহমান, এই প্রবাহে পড়িয়া অনিচ্ছাসত্বেও অনেকে অধঃপতিত হইয়া থাকেন।'
বিদ্যাসাগরকে ধোলাই করার আগে এই রচনাটিতে ভারতবর্ষে অধর্ম আমদানির দায় কিছুটা অর্পণ করা হলো গৌতমবুদ্ধের উপর- বুদ্ধদেব অপ্রাসঙ্গিক জিজ্ঞাসার সৃষ্টি করে ধর্ম সম্পর্কে সন্দেহ জাগালেন আর ঘোর বৈরাগ্যের দর্শন ছড়িয়ে ধর্মপ্রাণ ভারতবাসীর ধর্মাচারে কুঠারাঘাত করে শত সহস্র জনতাকে অধঃপতনের দিকে ঠেলে দিলেন। অতঃপর কালাপানি ডিঙ্গিয়ে ম্লেচ্ছধর্মের আগমন ঘটল। দেশের কুপুত্রগণ ম্লেচ্ছের শিক্ষা প্রভাবে বিমুগ্ধ হইয়া সেই ম্লেচ্ছধর্মকে স্বনামে বিনামে গ্রহণ করিলেন, ইহারাই এত কালের মানবজীবনের অবলম্বন ধর্ম্মকে ক্ষীণমূল করিয়া ফেলিলেন।' পাপের পেয়ালা ষোলো আনা পূর্ণ করতে শ্রীযুক্ত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয় বিধবা বিবাহের পুস্তক প্রণয়ন করলেন। নিজের নামের সাথে ঈশ্বরযুক্ত রাখলেও তিনি ঈশ্বরিক বিধান অস্বীকার করে বসলেন। ধর্মের আধফোটা বিদ্যাও নেই অথচ বাহারী নাম বিদ্যাসাগর, তার ম্লেচ্ছগিরি চটকদারি ফাঁস করে দিয়েছেন বিদ্যার প্রকৃত মহাসাগর প্রসন্ন কুমার শম্মা, 'বিধবা বিবাহ শাস্ত্র বিরুদ্ধ' নামক গ্রন্থে তাকে নিঃশেষ করে দিয়েছেন। ঈশ্বরচন্দ্রের পুঁজি নারদের ব্যবহার শাস্ত্র। 'বস্তুত বিধবা বিবাহ না শাস্ত্রমূলক না ব্যবহারমূলক না যুক্তিমূলক, তা বিশেষরূপে দর্শাইবার জন্য এই বৃহৎ গ্রন্থের রয়েল আটপেজি সাইজের ৩২৮ পৃষ্ঠা ব্যয়িত হয়েছে।... কোন বিষয়ে সকল দিক না দেখিয়া অন্ধ দ্বারা হস্তীস্বরূপ ব্যাখ্যার ন্যায় একটা নিষ্পত্তি করা কোন কাজের কথা নহে, তাহাতে অনেক বিষয়ে পাপ ভাগীও হইতে হয়, নিন্দা ত আছেই। এরূপ গ্রন্থকে যাহারা অবহেলা করিয়া বিধবা বিবাহের পক্ষ সমর্থন করিবেন তাহারা নিশ্চয়ই সতীত্ব হরণের প্রশ্রয় দাতার নিমগ্ন হইয়া ইহ পরকালে সন্তাপিত হইবেন।'
এ ভাবেই ভয়ঙ্কর অভিশাপ নিয়ে রচনাটির সমাপ্তি টানা হয়েছে।
বিধবাবিবাহ : বিদ্যাসাগরের পক্ষে
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বিপক্ষেই ছিলেন, কাগজে কলমে বিরোধিতা করেছেন, মুখেও বলেছেন, তার বিষবৃক্ষের চরিত্রকে দিয়ে প্রকারান্তরে ঈশ্বরচন্দ্রকে মূর্খও বলিয়েছেন। তিনি থেমে থাকেননি, তিনি জানতেন তার গন্তব্য কোথায়। রবীন্দ্রনাথের আমলে এসে তার কাছেই ধিক্কার ধ্বনি আমাদের শুনতে হলো:
'আমাদের এই অপমানিত দেশে ঈশ্বরচন্দ্রের মতো এমন অখণ্ড পৌরুষের আদর্শ কেমন করিয়া জন্মগ্রহণ করিল আমরা বলিতে পারি না...
বিশ্বকর্ম সেখানে চার কোটি বাঙ্গালি নির্মাণ করিতেছিলেন সেখানে হঠাৎ দুই-একজন মানুষ গড়িয়া বসেন কেন তাহা বলা কঠিন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর যথার্থই ছিলেন অখন্ড পৌরুষের গৌরবে গৌরবান্বিত এমন এক মানুষ যার অজেয় পৌরুষ ও অমর মনুষ্যত্বের স্মৃতি বাঙ্গালির জীবন থেকে কখনো মুছে যাওয়ার নয়।'
বিদ্যাসাগরের সুকৃতির শেষ নেই। আজ যে গদ্যভাষার পক্ষে-বিপক্ষের যে নিবন্ধ লিখছি, বিদ্যাসাগর যদি আধুনিক গদ্য ভাষার পথ নির্দেশ না করতেন, তা লেখা হয়ে উঠত না।
বিধবা বিবাহের যুক্তি আছে
তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা ১৮৫৫ সালে বিদ্যাসাগরের বিধবা বিবাহ বিষয়ক পুস্তিকা প্রকাশিত হলে পত্রিকা তার প্রস্তাবের সমর্থনে সম্পাদকীয় প্রবন্ধ প্রকাশ করে। তাতে বিধবার বিয়ের পক্ষে নয়টি যুক্তি উপস্থাপন করা হয়:
১. স্ত্রী পুরুষের কামনা বাসনা বুদ্ধি, ধর্ম, অনুভূতির কোন প্রভেদ নেই। বিপত্বীক পুনর্বিবাহ করিতে পারেন তবে বিধবা পারবেন না কেন?
২. স্বামীর মৃত্যু হলে স্ত্রী অসহায় হয়ে পড়েন। তার সামাজিক নিরাপত্তার জন্য পুনর্বিবাহ প্রয়োজন।
৩. বিধবার বিবাহ হলে তার পিতামাতাও দুশ্চিন্তার হাত থেকে মুক্তি পাবেন।
৪. মেয়েদের রিপু পুরুষের চেয়ে অন্তত আটগুণ প্রবল (১৬৪ বছর আগের এই মতামতের কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি থাকার কথা নয়)। বাল্যবিধবাদের বিবাহের সম্ভাবনা না থাকায় তারা গোপনে ইন্দ্রিয় বৃত্তি চরিতার্থ করতে পারেন। সমাজের পক্ষে তার পরিণাম বিষবহ।
৫. উপরোক্ত কারণের ফলে বিধবা স্ত্রী ব্যভিচারিনী হয়। ভ্রুণ হত্যার প্রাবল্য ঘটে।
৬. বাল্যবিবাহের প্রচলন থাকায় স্বামী স্ত্রীর বয়সের যথেষ্ট পার্থক্য হয়। বালিকা স্ত্রী বৃদ্ধ স্বামীকে ভালবাসতে পারে না, বৃদ্ধ স্বামীর মৃত্যুর পর কোন সুখস্মৃতি পত্নীর সামনে থাকে না। পত্নীর ব্যভিচারিণী হবার পথে কোন মানবিক বাধা খাকে না।
৭. বহু বিবাহ প্রচলিত থাকায় এক পতির মৃত্যু হলে বহু পত্নী বিধবা হন। বিধবাদের মধ্যে সামাজিক নিরাপত্তার অভাব, পাপাচারের প্রবণতা -- ইত্যাদি কারণে অনেক বিধবা বেশ্যাবৃত্তি গ্রহণে বাধ্য হয়। কৌলিন্য প্রথাই এই সব ঘটনার জন্য দায়ী।
৮. বিধবা বিবাহের যৌক্তিকতা অনেকেই স্বীকার করেছেন।
৯. বিধবা বিবাহ প্রচলিত হলে স্বামীর পত্নী পছন্দ না হলে তাকে হত্যা করে দ্বিতীয় বিবাহে লিপ্ত হবে। এ আশঙ্কা অমূলক। এই প্রথা যে পত্নী হত্যার হেতু নয় তার প্রমাণ ইংল্যান্ডে এই প্রথা প্রচলিত থাকা সত্ত্বেও সেখানে পত্নী হত্যার ঘটনা ঘটে না।
(পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের 'বাংলা সংবাদপত্র ও বাঙালির নবজাগরণ' থেকে উদ্ধৃত)।
ঢাকাবাসী শিক্ষিতজন নির্বাক কেন?
বিধবা বিবাহ আইন পাশ হবার ২৮ বছর পরও ঢাকাবাসীর সাড়া সন্তোষজনক নয়। অথচ মানিকগঞ্জে এই আইন বাস্তবায়নের পক্ষে দুই সহস্রারাধিক লোক সমবেত হয়েছে।
২৩ নভেম্বর ১৮৮৪ ঢাকা প্রকাশ একটি হৃদয়বিদারক চিত্র উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছে যেখানে অন্তরপুরে অতি নিভৃতকক্ষে বার বছর বয়সী বিধবা বালিকার 'অবিরল অশ্রুধারা গন্ডদেশ প্লাবিত করিয়া মলিন বসনখানি ভিজাইয়া ফেলিয়াছে। ঘোর মনস্তাপ সন্তপ্ত ঘন দীর্ঘ নিঃশ্বাস সাহারা মরুর উত্তপ্ত বায়ুর ন্যায় অন্তঃপুরব্যাপী বায়ুরাশিকে দগ্ধীভূত করিতেছে। বালিকা মুহূর্মুহঃ 'হা জগদীশ! হা জগদীশ!" বলিয়া চৈতন্যশূণ্য হইয়া ভূমিতলে লুণ্ঠিত হইতেছে।
ঢাকাবাসী যে সব পুরুষের শিক্ষা ও সভ্যতার গরিমায় মাটিতে পা পড়ে না এই বালিকা কি তার কেউ নয়? আমাদের কন্যা ও ভগিনীর উপর এমন অধর্ম ও অনাচার তারা কেমন করে মেনে নিচ্ছেন? এতে নিজেকে সভ্য ও সুশিক্ষিত দাবি করার সামান্য সুযোগও নেই। ঢাকাবাসীর এ কলঙ্ক বঙ্গ সমাজের বৃহৎ কলঙ্ক। বাল্যবিধবার বিবাহ প্রশ্নে নির্বাক ও নিশ্চেষ্ট থাকা ঢাকাবাসীর জন্য অশেষ লজ্জা ও অপমানের বিষয়! এই রচনার এ আহ্বান উদ্ধৃত করা হচ্ছে :
'বঙ্গের দুঃখিনী নিরপরাধিনী বাল্যবিধবাগণের দুঃসহ যাতনা বিমোচন করিবার নিমিত্ত একবার বদ্ধপরিকর হইয়া তুমুল আন্দোলন উত্থাপন করুন। সে আন্দোলনের স্ত্রোতে বঙ্গদেশ প্লাবিত হইয়া যাউক। উনবিংশ শতাব্দীর শিক্ষা ও সভ্যতাভিমানী বঙ্গীয় যুবকগণ যদি একান্তই অসহায় রমনীগণের প্রতি অত্যাচার করিতে বিরত না হন-- অন্তঃপুরবাসিনী অবলাভিন্ন শৌর্যবীর্য্য প্রকাশের স্থল আর খুঁজিয়া না পান-- তবে বঙ্গোপসাগরের উত্তাল তরঙ্গমালা যেন ভীমবেগে সঞ্চালিত হইয়া ছার বঙ্গদেশকে অতল জলে নিমগ্ন করে, এই আমাদের প্রার্থনা। এরূপ স্বার্থপর পুরুষজাতির বাসভূমি ভূ-মন্ডল হইতে অন্তর্হিত হইলেই জগতের মঙ্গল।
বিধবা বিয়েতে ব্রাহ্মের গরহাজিরা
বিধবা বিবাহ আইন পাশ হবার ১০ বছর পর ১২ জুলাই ১৮৬৬ 'ঢাকা প্রকাশ জানাচ্ছে বরিশালে কিছু বিধবা বিয়ের খবর সৃষ্টি হলেও অনেকদিন ধরে এ সম্পর্কে কোনো আনুষ্ঠানিক বার্তা না পাওয়ায় বিধবাদের দরজা আবার বন্ধ হয়ে গেল কিনা এ নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু ঢাকা প্রকাশ মন করে বরিশালের উদ্যোগী ব্রাহ্মদের উৎসাহ সহজে নিবে যাবার নয়। তাদের অনুমান মিথ্যে নয়।
বরিশালের সাব অ্যাসিস্ট্যান্ট সার্জন শ্রীযুক্ত অনুদাচরন খাস্তগিরি ও ব্রাহ্মসমাজের উপাচার্য শ্রীযুক্ত বানু গিরিশচন্দ্র মজুমদারসহ ক'জন উৎসাহী ব্রাহ্মের আয়োজনে ২৬ জৈষ্ঠ্য (১২৭৩) সোমবার দুপুরে রজকজাতির মধ্যে একটি বিধবা বিবাহ সম্পন্ন হয়েছে। বর শ্রী কিশোরচন্দ্র ধুপী বরিশালের আওয়াবুনিয়া গ্রামের রামদুর্লভ ধুপীর পুত্র। তার বয়স আনুমানিক ২৫/২৬ বছর (পাত্রী শ্রীমতি অনুপূর্ণার বয়স আনুমানিক কুড়ি বছর, তার পিতা পঞ্চানন ধুপীও একই গ্রামের। যে পত্রপ্রেরক ঢাকা প্রকাশকে সংবাদটি দিয়েছেন, অনেক ব্রাহ্ম জানা সত্ত্বেও বিয়ের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন না বলে আক্ষেপ করেছেন। অনুপস্থিতির কারণ নিশ্চিত নয়, তবে তিনি দুটি কারণ অনুমাণ করছেন। প্রথমত বর ও কনের চরিতত্র দোষ সম্পর্কে তাদের পূর্বাগবতি এবং দ্বিতীয়ত উভয়ে হীন জাতিভুক্ত।
ঢাকা প্রকাশ মন্তব্য হয়েছে যদি প্রথম কারণটি সত্য হয় তাহলে তারা বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ না দিয়ে বুদ্ধিমানের কাজ করেছেন কারণ শুরুতেই যদি 'বিশুদ্ধরূপে সম্পাদিত না হয়, ভবিষ্যতে নিতান্তই অনিষ্টের হইয়া উঠিবে সন্দেহ নাই। ফলতঃ সাধারণ উপপতি উপপতীরা নামমাত্র বিবাহসূত্রে সম্পন্ন হইয়া প্রকাশ্যরূপে ইন্দ্রিয় চরিতার্থ করিতে পারিবে। বিধবা বিবাহের প্রণালী প্রচলনের এরূপ উদ্দেশ্য নহে।.... বর পাত্রীর চরিত্র বিষয়ে সংশয় থাকিলেও তদুদ্বাহে যোগ দেওয়া বিধেয় নহে।' তবে যদি দ্বিতীয় কারণে অনুপস্থিতি ঘটে থাকে তাতে দুশ্চিন্তার কারণ রয়েছে '... রজক অতি হীন জাতি বলিয়া যদি কোন কোন ব্রাহ্ম উপরিউক্ত বিবাহে অসংলিপ্ত থাকিয়া পরিসমর্থ হন নাই। উদার ব্রাহ্ম ধর্ম কোনো জাতিকে নিকৃষ্ট বলিয়া অবহেলা করিতে উপদেশ দেন না। অতএব যাহারা জাতিভেদ প্রথার বশবর্তী হইয়া কাহার প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করেন, তাহারা প্রকৃত ব্রাহ্ম পদবাচ্য হইতে পারেন না। যাহা হউক আমরা উপস্থিত বিষয়ে নিতান্ত সংশয় কূল রহিলাম।
বঙ্কিম না থাকুন প্যারিচাঁদ তো আছেন
'আলালের ঘরের দুলাল' খ্যাত প্যারীচাঁদ মিত্র ঈশ্বরচন্দ্রের ছয় বছর আগে ১৮১৪ জন্মগ্রহণ করেন, মারা যান তার মৃত্যুর আট বছর আগে (১৮৮৬), ভারতীয় নারীর ভাগ্যেন্নয়নের প্রশ্নে তিনি বিদ্যাসাগরের পাশে দাঁড়িয়েছেন। রামামঞ্জিকা (১৮৬০), যৎকিঞ্চিত (১৮৬৫), অভেদী (১৮৭১), এতদ্দেশীয় স্ত্রীলোকদিগের পূর্বাবস্থা (১৮৭৯), আধ্যাত্মিকা (১৮৮০) গ্রন্থ ছাড়াও বেশকিছু বাংলা ও ইংরেজি প্রবন্ধ রচনা করেছেন। ঈশ্বরচন্দ্র যখন 'বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত' এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব প্রথম ও দ্বিতীয় পুস্তক যথাক্রমে ১৮৫৫-র জানুয়ারি ও অক্টোবরে প্রকাশিত হয়। অক্টোবরেই ক্যালকাটা রিভিউ প্রকাশ করে প্যারীচাঁদের ইংরেজি প্রবন্ধ 'ম্যারেজ অব হিন্দু উইডোজ'।
বিদ্যাসাগরকে সমর্থন দিতে তিনি উচ্চকণ্ঠে বলেছেন ঋগ্বেদের সময় সহমরণ ছিল না। 'যিনি বিধবা হইতেন, তিনি স্বামীর মৃতদেহের সহিত কিয়ৎকালের জন্য স্থাপিত হইয়া উঠিয়া আসিতেন। পরে তিনি অন্য পুরুষকে বিবাহ করিতে পারিতেন। ঋষিরা বিধবা বিবাহ করিতেন।
কিন্তু তারপর কেমন করে পরিস্থিতি বদলে গেল? প্যারিচাঁদ ক্ষোভ থেকেই ঠাট্টা করে লিখছেন: অনন্তর বিধবার পুনর্বিবাহ পতিপরায়না নারীদিগের বিষতুল্য জ্ঞান হইতে লাগিল। তাহারা বলিতে লাগিলেন বৈবাহিক বন্ধন কেবল ঐহিক বন্ধন নহে-- ইহা ঐহিক ও পারলৌকিক বন্ধন। পতি সাকার হউক বা নিরাকার হউক, সেই জাতির সহিত মিলিত হইয়া, লোকান্তরে দুইজনে উন্নতি সাধন করিতে হইবে। অতএব এই বিশুদ্ধভাব পরিত্যাগ করিয়া পশুবৎ ভাবগ্রহণ পূর্বক, পশুবৎ হইয়া আধোগতি প্রাপ্তির কি আবশ্যক? বৈবাহিক বন্ধন স্ত্রী ও স্বামী পরস্পরের অর্ধেক নারীর অর্ধেক জীবন, অধেক হৃদয় এইরূপ চিন্তা সতীর হৃদয়ে মন্থিত হইলে সহমরণের প্রথা চালু হইল।
তারপর কন্যা অতিশয় 'স্নেহের পাত্রী' বলে ধনী বিধবাদের ইন্দ্রিয় শাসনের জন্য ব্রহ্মাচর্যের উত্তম বিধান নিলেন। 'রাসারঞ্জিকা'য় পদ্মাবতী শুনে এসেছেন, মেয়ে মানুষ লেখাপড়া শিখলে বিধবা হয়।
'মাগো মা, সে কথাটা শুনে অবধি মনটা ধুমপুক করছে কাম নাই বাবু আর লেখাপড়ায় কাম নাই। মেয়ে আমার অমনি থাকুক। যে কয়েকদিন পাঠাশালায় গিয়াছিল তার দোষ কাটাবার জন্য ঠাকুরের কাছে তুলসী দেওয়াব।'